আপনাকে তো এর আগেও বলেছি এভাবে নিউজ এডিটরের সঙ্গে দেখা করা যায় না।
আমি এই নিয়ে আট দিন আসছি। আপনি এভাবে বারবার আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারেন না।
এছাড়া আমার কিছু করার নেই। আমার উপর নির্দেশ আছে, যে কাউকে নিউজ এডিটরের কাছে পাঠানো যাবে না। উনি খুব ব্যস্ত মানুষ। রাগীও। আমার চাকরি থাকবে না।
দেখুন, আপনার চাকরি,এডিটরের ব্যস্ততার চেয়েও অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ন বিষয় নিয়ে আমি কথা বলতে চাই। এর আগে গোটা বিষয়টা জানিয়ে আপনার কাছে চারটে চিঠি দিয়ে গেছি।
দেখুন আমার কাছে আমার চাকরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। আপনার গুরুত্বপূর্ন বিষয় নিয়ে আমার কিছু আসে যায় না। এছাড়া আমি আপনার চিঠি গুলো এডিটরের কাছে পৌঁছে দিলেও উনি কিছুই বলেন নি।
বাংলাভাষায় প্রকাশিত সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদপত্রের রিশেপসনে দাড়িয়ে যে সুপুরুষ তরুণটি চেঁচামেচি করছেন তার নাম শঙ্খশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্যদিকে ঠিক তার উল্টোদিকে রিশেপসনে যে সুন্দরী বসে আছে তার বয়স কোনভাবেই পঁচিশের বেশী নয়। সুন্দর করে পরা শাড়িতে ক্লিপ দিয়ে নেম প্লেট লাগানো। নাম দিতিপ্রিয়া সরকার। কেউ ই হার মানতে রাজি নয়। রিশেপসনে উপস্থিত অন্যান্য কর্মী বা ভিজিটররা ব্যাপারটাকে উপভোগ করছে বলেই মনে হল। কথা কাটাকাটি আরও কিছুক্ষন চলল।
তরুণ ছেলেটি বলল – আপনি সম্পাদকের ফোন নম্বর দিন। আমি কথা বলব।
এভাবে অচেনা কাউকে ফোন নম্বর দেওয়া যায় না। সব কিছুর একটা সিস্টেম আছে। আরও রেগে গিয়ে দিতিপ্রিয়া বলল – ডোন্ট ডিস্টার্ব মি। আদাওয়াইজ, আই উইল কল আওয়ার সিকিউরিটি।
ইউ হ্যাভ এভরি রাইট টু ডু দিস, বাট আই এম অলসো ফাইটিং ফর এ রাইট। যাকে বলে বেঁচে থাকার অধিকার – শঙ্খশুভ্র উত্তর দিল।
এ আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেল – সুদর্শন, ইন্টালিজেন্ট, স্মার্ট এই যুবক প্রথম দর্শনেই নজরকাড়া হলেও স্বগতোক্তির মতো একথা বলতে বাধ্য হল দিতিপ্রিয়া।
তাহলে আপনি গুরুত্বপুর্ন এই ব্যাপারে কোনও সহযোগিতা করবেন না। ‘পাগল’ সম্বোধন শুনে ক্ষোভ প্রকাশ করল শঙ্খশুভ্র।
দেখুন বিষয়টা আপনার কাছে যতই গুরুত্বপূর্ন হোক আমার কিছু করার নেই। এক্তিয়ারের বাইরে আমার কিছু করা সম্ভব নয়। আপনি আসতে পারেন–ভারী বুকের উপর থেকে সরে যাওয়া শাড়ির পাড় ঠিক করতে করতে উত্তর দিল দিতিপ্রিয়া।
আগুন জ্বালো… আগুন জ্বালো…
খবরের কাগজ অফিস থেকে কিছুটা হতাশ হয়েই বেরিয়ে পড়ল শঙ্খশুভ্র। আর কদিন পরেই ফাঁসি হতে চলেছে ইয়াকুব মেমনের। ১৯৯৩ সালে মুম্বাই বিস্ফোরণ কান্ডে জড়িত থাকার অপরাধে টাডা আদালতে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামি সে। ৩০ জুলাই ফাসির দিনও ঠিক হয়ে গেছে।
একবিংশ শতাব্দীতে দাড়িয়ে একটা দেশ কেন যে একটা মানুষকে ফাঁসিতে লটকাবে তা মাথায় ঢোকে না ওর। ও নিজে একজন মানবাধিকার কর্মী। মানবাধিকারের অ আ ক খ যে পড়েছে সে কোনও মানুষের মৃত্যুদন্ডের কথা শুনলে দুবার ভাববে। অথচ ভারতের মত পৃথিবীর বৃহত্তম গনতন্ত্রের দেশ একটা লোককে ফাঁসি কাঠে ঝোলাবার জন্য কী বিশাল আয়োজন করেছে দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়। শঙ্খশুভ্র মনে করে এর যথোপযুক্ত প্রতিবাদ হওয়া দরকার। দেশের যত সংবাদমাধ্যম আছে সোচ্চার হয়ে উঠুক মানবতা বিরোধী এই ফাঁসির বিরুদ্ধে। তেড়েফুড়ে উঠুক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–ছাত্রীরা। আওয়াজ তুলুক বুদ্ধিজীবী সমাজ। গানে-গল্পে-নাটকে তুলে ধরা হোক কাউকে খুন করতে রাস্ট্রের এই ন্যাক্কারজনক বন্দোবস্তের চেহারাটা। তবে এসব কথা যে শঙ্খশুভ্র এই প্রথম ভাবছে তা নয়। এর আগেও একশোবার ভেবেছে হাজারবার ভেবেছে। বারবার ছুটে যাচ্ছে সমাজের বিভিন্ন হত্তা–কত্তার কাছে। কিন্তু কোনও লাভই হচ্ছে না। গত আট দিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে জনপ্রিয় একটি কাগজের সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে। যাতে এই ফাঁসির বিরুদ্ধে জনমত গড়তে বিখ্যাত লোকেদের মতামত তুলে ধরা যায়। কিন্তু কোথায় কী? চিঠি দিয়ে, তাতে ফোন নাম্বার দিয়ে, ই – মেল অ্যাড্রেস দিয়েও কোনও উত্তর পাওয়া যায় নি। যোগাযোগ করার প্রয়োজনই বোধ করেন নি সম্পাদক মশাই। সম্পাদক যে দেখা করবেন না তা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল রিশেপসনের মেয়েটি। বলেছিল এরকম অনেকেই আসে। তারপর সম্পাদকের সঙ্গে দেখা হলে হয় নিজের, না হয় নিজের শালা, না হয় বউয়ের মাসতুতো ভাইয়ের চাকরির জন্য হাতে পায়ে ধরে।
এই মুহুর্তে ইয়াকুব মেমনকে বাঁচানো ছাড়া তার যে আর কোনও আবেদন নেই তা রিসেপসনিস্ট দিতিপ্রিয়াকে বোঝাতে পারেনি শঙ্খশুভ্র। দিতিপ্রিয়া ইয়াকুব মেমনকে চেনে না। চোখ বড় বড় করে দিতিপ্রিয়া বলে – ইয়াকুব মেমন না কার কথা বলছেন সে কী আপনার আত্মীয়?
শঙ্খশুভ্র বুদ্ধিমান ছেলে। শিক্ষিতও। সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজি ভাষায় মাস্টার ডিগ্রি করেছে। ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে হিউম্যানিজম নিয়ে পড়াশুনো করেছে। তারপরই বন্ধুদের বক্তব্য অনুযায়ী পাগলা কুকুরে কামড়ানোয় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে খুলে ফেলেছে একটা মানবাধিকার বিষয়ক তথ্যকেন্দ্র । নিজের বাড়িতেই পুব দিকের কোনের ঘরে অফিসের পাশাপাশি আছে ওয়েবসাইট। পুলিশের অত্যাচার, রাষ্ট্রের টরচার, মানুষের অধিকার এসব নিয়ে মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে চায় সে। গুটিকয়েক টিউশানির পাশাপাশি চলে এই মানবাধিকার চর্চার কাজ। দিতিপ্রিয়ার এমন চরম বোকাবোকা,বে-আক্কেলে প্রশ্ন শুনেও উত্তেজিত হয় না শঙ্খশুভ্র। হওয়ার কথাও নয়। বলে, দেখুন, ইয়াকুব মেমন আমার আত্মীয় নয়। সে জঙ্গীদের একজন সঙ্গী। মুম্বাই বিস্ফোরণ কান্ডে তার ফাঁসি হবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা সে একজন মানুষ। একটা রাষ্ট্র কখনও একজন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে না। এই নিয়েই নিউজ এডিটরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তবে এত শব্দ খরচ করেও ব্যর্থ হতে হয়েছে শঙ্খশুভ্রকে। দেখাই করা যায়নি সম্পাদকের সঙ্গে। পত্রিকা দপ্তরে কাজ না হওয়ায় সে অন্য উদ্যোগ নিল। উত্তর কলকাতার একটা বাসস্টপে নেমে সন্ধ্যের সময় পৌঁছে গেল একটি বিখ্যাত মানবাধিকার সংগঠনের দফতরে। বাংলার বুকে দীর্ঘ দশক ধরে কাজ করছে এই সংগঠন। অনেক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। বাংলা থেকে বাংলাদেশ, ইরাক থেকে ইজরায়েল বিভিন্ন জায়গায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য তুলে ধরে প্রকাশ করেছে হরেক রকমের পুস্তিকা। শঙ্খশুভ্রর কথা শুনে ঠোঙায় করে বেগুনি আর মুড়ি খেতে খেতে সংগঠনের প্রেসিডেন্ট বললেন, ভারতের মত বৃহৎ গনতান্ত্রিক দেশে এ এক পরিতাপের বিষয়। মৃত্যুদন্ড তুলে দেওয়া সংক্রান্ত রাষ্ট্রসংঘের সনদে ভারত স্বেচ্ছায় সই করেছিল ১৯৭৯ সালে। অথচ ভারত এখনও মৃত্যুদন্ড তুলে দিয়ে নতুন আইন পাশ করাতে পারল না। এই মুহুর্তে বিশ্বের ১৪০ টি দেশ মৃত্যুদন্ড তুলে দিয়েছে। পক্ষে ৬০ এরও কম। গত ২৫ বছরে মৃত্যুদন্ড তুলে দিয়েছে ৭৫ টি দেশ। অথচ ভারত সেই তিমিরেই। বিভিন্ন স্ট্রিট কর্নারে আমরা তো এর প্রতিবাদ করেছি। তবে ধনঞ্জয়ের ফাঁসির সময়ের মত এবারও আমরা ফাঁসির রাতে প্রতিবাদী মানুষদের নিয়ে মোমবাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করব।
নামডাকওয়ালা মানবাধিকার সংগঠনের মোমবাতি প্রতিবাদের পরিকল্পনা শুনেই মাথা গরম হয়ে গেল শঙ্খশুভ্রর। সে চাইছে ফাঁসি ইস্যুতে গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ুক আন্দোলন। দিল্লিতে যেমন নির্ভয়ার সময় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল, সিঙ্গুর – নন্দীগ্রাম- কামদুনী কান্ডে যেমন উত্তাল হয়েছিল কলকাতা। পৃথক তেলেঙ্গানার দাবিতে যেমন সরব হয়েছিল দক্ষিন ভারত – তেমনই মানুষ গর্জে উঠুক ফাঁসির বিরুদ্ধেও। ফাঁসির বিরুদ্ধে জ্বলে উঠুক মশাল। এ বিষয়ে ছাত্র সমাজকে একত্রিত করা দরকার বলে মনে করল সে।
আঁধার রাতে একলা পাগল…
দাদা আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে – ঠোটের কোনে একটা ব্যাঙ্গার্থক ভঙ্গি ধরে রেখে হাসতে হাসতে বললেন ধর্মদাস ধর। বললেন ছাত্র সমাজের কাছে ফাঁসি–টাসির কোনও গুরুত্ব নেই। আমি দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র ইউনিয়ন করছি। এই সময়ের স্টুডেন্টদের পালস্ আমি বুঝি।
আপনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজ্য সম্পাদক। স্টুডেন্টসদের মোটিভেট করতে আপনারও তো একটা দায়িত্ব আছে – শঙ্খশুভ্র বোঝানোর চেষ্টা করল।
নিশ্চয়ই আছে। তা বলে একটি জঙ্গির সাজার বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন করতে বলব?
শাস্তির বিরোধিতা তো করতে বলিনি, বলেছি রাষ্ট্রসংঘের সনদ মেনে ফাঁসির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে।
দেখুন এত সহজে আন্দোলন হয় না। আগে দেখতে হয় এটা লংটার্ম না শর্টটার্ম ইস্যু। তারপর দেখতে হয় পলিটিক্যাল ইনফ্লুয়েন্স কতটা আছে? আমরা যে দলের ইউনিয়ন করি সে দল কী ভাবছে। এই ইস্যুতে ন্যাশনাল লেভেল পলিটিক্যাল সিনারিওটা কী? স্টেট লেভেল কোনও ক্রাইসিস আছে কী-না?
এতসব ভাবতে ভাবতে তো ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি হয়েই যাবে… উদ্বেগ নিয়ে বলল শঙ্খশুভ্র।
আরে আপনি দাদা ইতিহাস পড়েন নি দেখছি। একটা আন্দোলন কী হাওয়া থেকে জন্ম নেয়? পড়েন নি, ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান …। মঙ্গল পান্ডে থেকে ক্ষুদিরাম বসু… সেই ট্রাডিশান সমানে চলছে। হয়ত দেখবেন আপনার প্রিয় ইয়াকুব মেমনের ফাঁসিই একটা মাইলস্টোন পুতে দিল। দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু হল। কিন্তু তার জন্য দেশলাই কাঠি জ্বালার কাজটা তো আপনাকেই করতে হবে মশাই। এমন কিছু করুন যাতে ফাঁসি নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠে যায় দেশের মানুষের মনে। মানে সামথিং নিউ।
ছাত্রনেতার এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই হা হা – হি হি করে হেসে উঠল তার সাঙ্গপাঙ্গরা। ইয়াকুবের ফাঁসি নিয়ে তার এই উদ্বেগ ঘিরে যে মুচমুচে মজা তৈরি হচ্ছে তা বিলক্ষণ বুঝতে পারল শঙ্খশুভ্র। তবুও বলল, দেখুন আমি কিন্তু জঙ্গির সঙ্গী ইয়াকুবের পক্ষে নই। আমি মানুষ ইয়াকুবকে ফাঁসির দেওয়ার বিপক্ষে। রাষ্ট্র কখনও প্রতিহিংসা পরায়ন হতে পারে না। কেউ খুন করলে রাষ্ট্রও কী তাকে খুন করবে? সভ্যদেশেও কী জীবিত থাকবে মৃত্যুদন্ডের কালাকানুন?
আপনাকে তো মহাত্মা গান্ধীর বংশধর মনে হচ্ছে দাদা। শরীর জুড়ে ক্ষমার ঢল। ইউনিয়ন নেতার এক সাগরেদ টোন কাটল।
আপনাকে রাষ্ট্রসংঘে খুব প্রয়োজন। শান্তির দূত হয়ে কাজ করবেন। দেশে দেশে ছড়িয়ে দেবেন ক্ষমার বানী – বলল আর এক সাগরেদ।
দলের মধ্যমনি ইউনিয়ন নেতা ধর্মদাস ধর ফের কিছু বলার আগেই সেখান থেকে কেটে পড়ল শঙ্খশুভ্র। এদের ভাবটা এমন যেন বাবা মায়ের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেপুলে, হররা পাবলিক বনে যাওয়া স্টুডেন্টস, মাথায় ঠকঠকালেও এককুচি বুদ্ধি না বেরোনো ছাত্র–ছাত্রীদের ক্ষেপিয়ে আন্দোলনের জন্ম দেওয়া নেতারা এমন বেখাপ্পা মানুষ আগে দেখে নি। আরে ভাই এটা স্বাধীন দেশ, এখানে আইন আছে। পুলিশ আছে। মানবাধিকার কমিশন আছে। সুপ্রিম কোর্ট আছে। রাষ্ট্রপতি আছেন। আইন–আদালত, ন্যায়- অন্যায়, সত্যি– মিথ্যে নিয়ে বেমক্কা প্রশ্ন তোলার তুমি কে হে ? তুমি গোটা দেশে কেঁচোর মত কিলবিল করা একটা মানুষ। ভাল–মন্দ খাও, আলুভাজা খেতে খেতে টিভিতে ক্রিকেট দেখ, সিরিয়াল দেখ। ক্ষমতায় কুলোলে অফিসের রসেপশনিস্ট বউদিকে ফুসলিয়ে দুদিনের মন্দারমনি ট্রিপ দিয়ে এসো। ধর্মতলার মোড়, হাওড়া স্টেশনে বা পাড়ায় বেমক্কা কোনও চোর ধরা পড়লে সত্যবান পাবলিক হয়ে তেড়ে ঠ্যাঙাও। এতসব হুল্লোড় আর মজা ছেড়ে হঠাৎ করে মানবাধিকার নিয়ে আদিখ্যেতা কেন বাবা ?
চলো নিয়ম মতে …
১৩, জুলাই, ২০১৫। মৃত্যু থেকে এর ১৭ দিন দূরে ইয়াকুব মেমন। ৩০ এপ্রিল টাডা আদালত যে প্রাণদন্ডের ওয়ারেন্ট জারি করছিল তা কার্যকর হবে ৩০ জুলাই। খবরের কাগজ থেকে এমন তথ্যই পেল শঙ্খশুভ্র। কিন্তু ইয়াকুবু মেমনের ফাঁসি হবে তো ? জোর আলোচনা শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। খবরের কাগজ, টিভি, ইন্টারনেটে রোজ ব্রেকিং নিউজ আর এক্সক্লুসিভ খবরের ছড়াছড়ি। ইয়াকুবের প্রাণভিক্ষার আবেদন কী খারিজ করে দিলেন মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল ? মৃত্যুদন্ড থেকে রেহাই পেতে ফের কী সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করবেন ইয়াকুবের আইনজীবীরা, শেষ পর্যন্ত কী মেমনের আর্জি শুনবেন রাষ্ট্রপতি ? সংখ্যালঘু বলেই কী ইয়াকুবের ফাঁসি ঘিরে এমন টালবাহানা ? এমন আলোচনা চলছে ট্রেন – বাস সর্বত্র।
ইয়াকুবের ফাঁসি আটকাতে নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠল শঙ্খশুভ্রর। ফাঁসির এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞে ওর ক্ষুদ্র উদ্যোগ কী ভাবে কাজে আসবে তা ভেবে পেল না সে। অসহায় লাগতে শুরু করলেও হাল ছাড়তে নারাজ সে। একটা হত্যাকারীকে শাস্তি দিতে ঠান্ডা মাথায় এর একটা হত্যার উদ্যোগ নিচ্ছে রাষ্ট্র – এই বিষয়টাই মেনে নিতে পারছে না শঙ্খশুভ্র। গতকালই সে অন্য একটা অধিকার আন্দোলন সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছিল। তারা শঙ্খশুভ্রকে বাড়ি বাড়ি যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। প্রতিটা বাড়ির প্রতিটি বয়স্ক মানুষের কাছ থেকে সই সংগ্রহ করা হবে। কলকাতা ও শহরতলীর বিভিন্ন এলাকায় ওই অধিকার সংগঠনের সদস্যদের নামিয়ে দেওয়া হবে সই সংগ্রহের কাজে। ধর্মতলা, শ্যামবাজার, রাসবিহারী এভিনিউ, গড়িয়া সর্বত্র সই সংগ্রহের জন্য টেবিল পেতে বসা হবে। বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার-হাজার,লক্ষ- লক্ষ সই সংগ্রহ করে পাঠানো হবে রাষ্ট্রপতির কাছে। তোড়া তোড়া কাগজে মানুষের প্রতিবাদী সই দেখে হয়ত ফাঁসিও রদ করে দিতে পারেন রাষ্ট্রপতি।
কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিটা বোঝা গেল কাজে নামার পর। হাতে সময় কম থাকায় পাড়ার বিভিন্ন মানুষের কাছে যেতে শুরু করল শঙ্খশুভ্র নিজেই। হাতে এক তোড়া ছাপা কাগজ।
শঙ্খশুভ্রর কলিংবেলের ডাকে দরজা খুলে সমস্ত বিষয় শুনে শিবানন্দ বাবু বললেন তুমি লক্ষ্মীকান্তর ছেলে না ? শঙ্খশুভ্র ঘাড় নাড়তেই বললেন তোমার এত অধঃপতন হয়েছে ? রাষ্ট্রপতি, সুপ্রিম কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করছ ? এর শাস্তি কী হতে পারে জানো ?
রাস্তার মোড়ের বাংলো বাড়ির মালিক ব্যাঙ্ক ম্যানেজার রামকিশোর বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন তুমিতো ভাই ব্রাক্ষ্মন সন্তান। তা একটা মুসলমানের জন্য এত বাবা বাছা কেন ? ওদের জন্যই তো দেশটার এই হাল।
নীলিমা আন্টি বললেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে লজ্জা করে না। আমার নাতিকে দেখে শেখো। হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ে দিব্যি দিল্লি-দুবাই করে বেড়াচ্ছে। মেমকে বিয়ে করেছে। ফ্ল্যাটের পর ফ্ল্যাট কিনছে … …
পাড়ার মোড়ে আড্ডা দিতে বসা ছেলেরা শঙ্খশুভ্রর থেকে ফর্মের বান্ডিলটা কেড়ে নিয়ে ফড়ফড় করে ছিঁড়ে দিল। বলল মালটার ফাঁসি হচ্ছে ঠিক হচ্ছে। এসব নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে গাঁঢ় ভেঙে দেব। গুটিকয় মানবাধিকার কর্মী, প্রতিদিন টেলিভিশনে বসা জনাকয়েক তার্কিক, খবরের কাগজে নিয়ম করে প্রবন্ধ লেখা কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ছাড়া সকলেই যে মেমনকে ফাঁসি কাঠে ঝোলাতে চায় তা দিব্যি বুঝতে পারল শঙ্খশুভ্র।
২৯ জুলাই, ফাঁসির বাকি একদিন
রাত পোহালেই ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি। অথচ মৃত্যু প্রক্রিয়া থামাতে কিছুই করতে পারছে না শঙ্খশুভ্র – এই অক্ষমতাটাই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে। একটা রাষ্ট্রের বিশাল আয়োজনের কাছে তার এই প্রতিরোধ কতটুকু ? পাহাড়ের সঙ্গে ইঁদুরের অসম লড়াই এর মত। এই বাস্তবটা না বোঝার মত অক্ষম ও নয়। তবু বুকের উপর চেপে বসা পাথরটা কিছুতেই সরাতে পারছে না সে। শঙ্খশুভ্র ইউনিভার্সিটি তে যাওয়ার পর থেকেই ওর বাবা – মা ছেলের নানারকম অদ্ভূত এবং আশ্চর্য কার্যকলাপের মাথামুন্ডু খুঁজে পায় না। কাজেই ইয়াকুবু মেমনের ফাঁসি হওয়া না হওয়া নিয়ে শঙ্খশুভ্রর বুকে ব্যাথা উঠলেও তাতে মাথাব্যথা নেই তাদের। এদেশ – বিদেশ মিলিয়ে ফেসবুকে ১৩১ জনের লাইক পেলেও পাড়ায় তার মেমন বাঁচাও প্রকল্পে আধখানা মানুষের সমর্থনও জোটাতে পারে নি শঙ্খশুভ্র। কিন্তু কিছু একটা করার জন্য ও ছটফট করতে লাগল। এখনই এসব আইন – আদালত – বিচার থামানো দরকার। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব তা ও বুঝতে পারল না। গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছে ওর ক্ষমতা একটা পিঁপড়ের সমান। রাষ্ট্রের একটা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ও বিদ্রোহ করছে। হিসেব মত সে রাষ্ট্রদ্রোহী। পিঁপড়ের ক্ষমতা অতি নগণ্য হলেও রাষ্ট্রব্যবস্থা কোনও বিদ্রোহই বরদাস্ত করে না।
কিন্তু ফাঁসির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে নিজের পরিণতির কথা চিন্তা করলে চলে না। তাই আকারে, প্রভাবে অতি ক্ষুদ্র, অতি নগণ্য হলেও জনসমক্ষে এর প্রতিবাদ করা জরুরী বলে মনে করল শঙ্খশুভ্র। এলাকার দাস ইলেক্ট্রিকের কাছ থেকে একটা মাইক ভাড়া নিয়ে গোলাবাড়ি এলাকায় ফাঁসির বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করল ও। দাঁতের মাজন নয়, পেট পরিষ্কারের পাউডার নয়, এমনকী যৌন শক্তিবর্দ্ধক তেলও নয়। একজন জঙ্গির ফাঁসির বিরুদ্ধে কাউকে এরকম মাইক ফুঁকতে কোনওদিন দেখেনি এলাকার মানুষ। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা সৌম্যদর্শন এক যুবকের বাজারে এত রকমের মজা লাভের উপকরণ ছেড়ে সমাজ সংশোধনের চেষ্টায় আমোদিত হল অনেকেই। দু – দশজন কৌতুহলভরে দাড়িয়ে গিয়ে শোনারও চেষ্টা করল কিছুটা। ভাবতে লাগল ভদ্র বাড়ির ছেলেরও এমন মাথার ব্যামো হল কেন ?
এদিকে শঙ্খশুভ্রর মতই ফাঁসি রুখতে শেষ চেষ্টা চালাচ্ছে ইয়াকুবের বাড়ির লোকজন ও তার আইনজীবীরা। ২৯ জুলাই দিনভর দিল্লিতে চলল ইয়াকুবকে প্রাণে বাচানোর লড়াই। ঘটনাগুলো ঘটল এইভাবে –
সকাল ১১ টা – ইয়াকুবের ফাঁসি রদের আবেদন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে তিন বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি শুরু। দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন জানালেন ইয়াকুবের আইনজীবীরা।
বিকেল ৩ টে – ইয়াকুবের ফাঁসি রদের আবেদন খারিজ হয়ে গেল সুপ্রিম কোর্টে।
বিকেল ৩ টে ১৫ – মেমনের প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ করলেন মাহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল।
বিকেল ৪ টে – প্রাণ ভিক্ষার আবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে পাঠালেন রাষ্ট্রপতি।
রাত ৮টা ৩০ – রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজের সুপারিশ করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
রাত ১০টা ৩০ – প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ করলেন রাষ্ট্রপতি।
রাত ১১ টা – সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা অনুসারে প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ ও ফাঁসির মধ্যে ১৪ দিনের ব্যবধান থাকা উচিত। ফাঁসির উপর ১৪ দিনের স্থগিতাদেশ চেয়ে প্রধান বিচারপতির দ্বারস্থ হলেন মেমনের আইনজীবীরা।দেশবাসীকে চমকে দিয়ে রাত দেড়টায় মধ্যরাতের শুনানিতে রাজি হলেন শীর্ষ আদালতের বিচারপতিরা। সিদ্ধান্ত হল ঐতিহাসিক শুনানি হবে সুপ্রিম কোর্টে। দন্ডিত আসামীর আবেদন শুনতে মধ্যরাতে এজলাস খুলে শুনানি, শীর্ষ আদালতের ইতিহাস হয়েছে বলে কেউ মনে করতে পারলেন না।
রাত ২টো ৩০ – সুপ্রিম কোর্টে হাজির তিন বিচারপতি। নজিরবিহীনভাবে গভীর রাতে দরজা খুলল শীর্ষ আদালতের চার নম্বর কোর্টের। মিডিয়ার উপস্থিতি ছাড়া নিদ্রামগ্ন গোটা দেশ।
রাত ৩ টে ২০ – চার নম্বর কোর্টে শুনানি শুরু। অন্যদিকে নাগপুর জেলে শুরু ফাঁসির প্রস্তুতি। ঘুম থেকে ওঠানো হল ইয়াকুব মেমনকে। আজ তার ৫৪ তম জন্মদিন।
রাত ৩ টে ৪৫ – গরম জলে স্নান করলেন মেমন। দেওয়া হল নতুন জামাকাপড়।
ভোর ৪ টে ৫০ – রাতভর দীর্ঘ সওয়াল জবাবের পর ইয়াকুবের অন্তিম আবেদনও খারিজ শীর্ষ আদালতে। নির্ধারিত সময়েই ফাঁসির সিদ্ধান্ত।
ভোর ৫ টার পর – নমাজ পড়লেন ইয়াকুব। করলেন কোরান পাঠ। দেওয়া হল পছন্দের ব্রেকফার্স্ট।
৩০ জুলাই ভোর ৬ টা ৩৫ – ফাঁসি হল ইয়াকুব মেমনের।
……………
৩১ জুলাই, ২০১৫। ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি খবরের কাগজের প্রথম পাতায় সবচেয়ে বড় খবর হিসেবে স্থান পেল ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি। কলকাতার কয়েকটি কাগজের একেবারে ভেতরের পাতায় কয়েক লাইনে ছাপা হল আর একটি খবর। গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা এক যুবকের। নাম শঙ্খশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিবেশীদের মতে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন তিনি।
Tags: ইয়াকুব মেমন, মানবাধিকার গল্প, সমীর ঘোষ
email:galpersamay@gmail.com
দিব্যেন্দু মিত্র on January 11, 2017
খুব ভালো হয়েছে আরো লেখা চাই
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।