খবরের কাগজে প্রতিদিন কত কি খবর থাকে। সবগুলো ঠিক ঠিক খুঁটিয়ে পড়া হয় না। কোনও কোনও দিন বড় বড় হেডিং এ চোখ বুলিয়ে যেতে হয়। সেটা ২০১২ সাল হবে। একটি প্রভাতী সংবাদপত্রে চোখ রাখতে গিয়ে ভিতরের পাতায় হঠাৎ করে দৃষ্টি আকর্ষন করল ছোট্ট একটি খবরে। একজন স্বল্প বয়সী বিবাহিতার মর্মান্তিক পরিণতি। কতিপয় দুষ্কৃতির অ্যাসিড বাল্ব নিক্ষেপে মুখ থেকে দেহের বেশিরভাগ পুড়ে গিয়ে এক গৃহবধুর মৃত্যু। হাসপাতালে তড়িঘড়ি ভর্তি করেও তাঁকে বাঁচানো যায় নি। তার ছোট্ট পাঁচ বছরের ছেলেকে রেখে মহিলাটি মারা যায়। পরে পাড়া প্রতিবেশী ও সরকারি হস্তক্ষেপে বাচ্চা ছেলেটার একটি অনাথ আশ্রমে ঠাঁই হয়। খবরটা পড়ে মনে পড়ে যায় কয়েকমাস আগের একটি ঘটনার কথা। পেশাগত প্রয়োজনে আসানসোলের একটি হাসপাতালের বহির্বিভাগে বসে রোগী দেখার কাজ করছিলাম। সেই সময়ে একজন মহিলা আসে দেখানোর জন্যে। বয়স তার ৩০ এর মধ্যে। প্রতিমাসেই মহিলাটি বহির্বিভাগে আসে। দেখানোর পরে ওষুধ নিয়ে চলে যায়। হঠাৎ একদিন ওষুধ নেওয়ার পরে এক অদ্ভুত অনুরোধ জানায়। ‘ডাক্তারবাবু, আমার ছেলে খুব অসুস্থ। শয্যাশায়ী। ওকে আনা সম্ভব হচ্ছে না। যদি আপনার ডিউটির পরে একটিবার আমাদের বাড়িতে আসেন তো খুবই উপকার হয়।’ হাসপাতালে ডিউটির বাইরে এমনকি বাইরেও রোগী দেখার চল নেই। সেরকম অনুরোধ কেউ কোনদিন করেও নি। মহিলাটির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলাম। বড়ই করুণ মুখ। চোখের কোণে জল। বুকের ভেতরটায় কেমন যেন কষ্ট বোধ করলাম। তাই সেদিন ওই মহিলার করুণ আর্তিতে সাড়া না দিয়ে পারলাম না। মানবিকতার খাতিরে হাসপাতালের ডিউটির পরে ওনার বাড়িতে গেলাম অসুস্থ ছেলেকে দেখবার জন্যে। ভদ্রমহিলার আস্তানাটি ছিল শহর থেকে বেশ দূরে। একটা ঘিঞ্জি বস্তি অঞ্চলে। পরিবেশ এতটাই নোংরা ও পড়শীদের কথাবার্তা যে রকম অমার্জিত ভাবতে অবাক লাগছিল। স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও নূন্যতম চাহিদাগুলো যেমন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও সুস্বাস্থ্যের পরিকাঠামোগুলো মোটেই মজবুত নয়। বেশ নড়বড়ে হয়েই রেয়েছে।
আসানসোল শিল্পাঞ্চল হওয়ার জন্যে বহু ভাষাভাষী ও বহুজাতের লোকজন এখানে থাকে। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে বহু মানুষ,বহু পরিবার। ডাক্তারি মাপকাঠি অনুসারে সু-স্বাস্থ্যের প্রকৃতি বেশ দুর্বল, সেই সঙ্গে পরিবেশও বেশ কলুষিত। যাই হোক ডাক্তারি পাঠক্রমের শেষে প্রত্যেকটি চিকিৎসককে যে ‘হিপোক্রেটিস শপথ’ নিতে হয় তারই বাধ্যবাধকতায় প্রতিটি চিকিৎসককে প্রতিকুল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে তার কর্তব্য ধর্ম পালন করে যেতে হয়। ওই ঘিঞ্জি নোংরা পরিবেশের মধ্যে হেঁটে গেলাম ভদ্রমহিলার পিছু পিছু। শেষে একটা ঝুপড়ি ঘরে এসে ঢুকলাম। না আছে পর্যাপ্ত আলো, আছে খোলা বাতাস। এরকম পরিবেশে যে কোনও সুস্থ লোকও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। দেখালাম বাচ্চা ছেলেটা শুয়ে আছে একটা দড়ির খাটিয়ার উপরে। গায়ে চাপা দেওয়া আছে একটা মলিন চাদর। কয়েকদিন জ্বরে ভুগে বেশ কাহিল। জ্বর কমার কোনও লক্ষণ নেই। ছেলেটির টাইফয়েড হয়েছে। যার ওষুধ কেনার ক্ষমতা নেই তো পরীক্ষা নিরীক্ষা করবে কি করে ? বললাম, “ওষুধগুলো লিখে দিলাম, হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে যোগাড় করে নিও। টাইফয়েড হয়েছে। জ্বর কমতে একটু সময় নেবে। তবে ওর একটু ভাল খাবার-দাবার আর সেইসঙ্গে সেবাযত্ন প্রয়োজন।”
এরমধ্যেই দেখলাম ২ – ৩ জন ষন্ডামার্কা লোক আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের চোখে মুখে একরাশ বিরক্তির চিহ্ন। পান খেয়ে দাঁত লাল। একজনের হাতে একটা খৈনির ডিবে। একজন তো আবার কর্কশ ভাষায় আমার শুনিয়ে একটা বাজে ইঙ্গিত করে বসলো মহিলাটিকে নিয়ে। যাইহোক সেদিন গায়ে না মেখে চলে এসেছিলাম ওই মহিলাটির বাড়ি থেকে। আসার সময় বলে এসেছিলাম, কেমন থাকে ছেলেটি একটা খবর দিতে। মহিলাটি মাথা নাড়তেই আশ্বস্ত হয়েছিলাম। মাঝে একবার মহিলাটি জানিয়ে গিয়েছিল ছেলেটির জ্বর ছেড়ে গেছে। ছেলের ভাল থাকার খবরের সঙ্গেই সে জানাল তার নিজের খারাপ থাকার কথাও। আমি ডাক্তার মানুষ,আমার সঙ্গে বহু মানুষের যোগাযোগ আছে এই ভেবেই হয়ত ভরসা করেছে। বিষয়টার গুরুত্ব বুঝে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলব এমনটাও আশ্বাস দিলাম। এরপর কাজের ব্যস্ততায় ওই মহিলাটির কথা ভুলেও গিয়েছিলাম। সংবাদপত্রে ওই খবরটা দেখে চমকে উঠলাম। ভাল করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে ও খোঁজখবর করে জানতে পারলাম দুষ্কৃতিদের হাতে আমার আগের চেনা মহিলাটিই মারা গেছে। শুধু তাই নয়, এই ঘটনার পেছনে রয়েছে নারী ও শিশু পাচারকারী এক চক্র। তারা মতলব করেছিল ওই মহিলাসহ বাচ্চা ছেলেটাকে দূরে কোথাও পাচার করে দেবে। ওদের সন্দেহ হয়েছিল মহিলাটি ছেলে সহ কোথাও পালিয়ে যেতে পারে। তাদের সন্দেহ আর দৃঢ় হয় সাদা পোষাকের পুলিশের আনাগোনায়। শিকার হাতছাড়া হওয়ার আশংকায় তারা শেষ অস্ত্র হিসেবে ওই নিষ্ঠুর কর্মটি করে ফেলে। খবর পড়তে পড়তে মনে হল একজন কর্তব্যপরায়ণ চিকিৎসক হিসাবে আমার কি আর কোনও দায়িত্ব ছিল না ? অনুশোচনায় জর্জরিত হলাম। বিবেকের দংশনে মনে হল মহিলাটির ব্যাপারে খবর করার আগেই মহিলাটি নিজেই খবরের পাতায় নাম করে নিল, এ আপসোস সারা জীবনে মুছবে না।
Tags: প্রদীপ কুমার দাস
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।