গল্পের সময় – কিন্নরদা আপনি পুরো সময়ের লেখক, অর্থাৎ লিখেই জীবনধারণ করেন। বাংলাভাষায় লেখালিখি করে জীবনধারণ – এটা কতটা সহজ কতটা কঠিন?
কিন্নর রায় – পুরো সময়ের লেখক নিশ্চয়ই – কিন্তু আমার স্ত্রী একটি চাকরি করতেন – সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। ফলে অর্থের ব্যাপারটা যদি পুরোটা আমাকে জোগাড় করতে হত তাহলে খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তাম। আমি মূলত লিটল ম্যাগাজিনের লেখক – অনেকেই খুব কষ্ট করে কাগজ করেন – সেখানে আমি লিখি। তারা সবাই তো সন্মান মূল্য দিতে পারেন না। তাই আমার স্ত্রী রোজগার করেন বলেই এটা আমার পক্ষে করা সম্ভব হয়েছে। শুধুমাত্র লিখে রোজগার করে সংসার চালানো খুব কঠিন। আমি সমরেশ বসুকে দেখেছি, যদিও তার পেছনে আনন্দবাজারের মত প্রতিষ্ঠান ছিল। মহাশ্বেতা দিকেও দেখেছি। তিনি একটা সময় পর্যন্ত অধ্যাপনা করতেন। সমরেশ বসু ও মহাশ্বেতা দেবী দুজনেই প্রথমে নানা পেশার মধ্যে দিয়ে গেছেন। তবে আমি কোথাও চাকরির অফার পাইনি এমনটাও কিন্তু নয়। আমি তো যুগান্তরে চাকরি করতাম, তার আগে পাক্ষিক প্রতিক্ষণ, মহানগরে চাকরি করেছি। মহানগরের ‘সবজান্তা মজারু’ বলে ছোটদের কাগজ ছিল। তার আগে দৈনিক বসুমতীতে সাউথ সুবার্বান করসপন্ডেন্ট ছিলাম। এক কলম খবর লিখলে পাচঁ টাকা পেতাম। এটা ৭৭-৭৮ বা ৭৯ সালের কথা বলছি। তা যখন যুগান্তর বন্ধ হল তারপরেও আমার কাছে চাকরির অফার এসছিল। একমাত্র আনন্দবাজার পত্রিকা ছাড়া সেইসময় বাংলা ভাষায় আর যতগুলি পত্রিকা ছিল তাদের সকলের কাছ থেকেই খানিকটা খানিকটা চাকরির অফার আমার কাছে এসেছিল। কিন্তু আমি আর চাকরি করিনি। কারন আমি যে ধরনের লেখা লিখতে চাই বা জীবনধারণ করতে চাই তা চাকরি করতে গেলে হয়তো সম্ভব হত না। এটা আমার কথা। অনেকেই চাকরি করেও লেখালিখি করেছেন। এ ব্যাপারে আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি। তিনি বলেন, আমি তো চাকরি করি, আমাদের কোনও অসুবিধে হবে না, কুলিয়ে যাবে। তো সেই থেকেই, প্রায় ২৭-২৮ বছর হয়ে গেল আমি চাকরি না করে লেখালিখি করে চালিয়ে যাচ্ছি।
গল্পের সময় – পেশাদার লেখকদের লড়াইটা কেমন?
কিন্নর রায় – কষ্ট খুব। বাংলাভাষায় একজন পেশাদার লেখকের পক্ষে লেখালিখি করে সংসার চালানো খুব কঠিন ব্যাপার। প্রথমত লেখককে খুব কম টাকা দেওয়া হয়। একটিমাত্র মনোপলি হাউজ বাংলাভাষায় – যারা অনেক টাকা দেয়। উপন্যাস, গল্প, কবিতা, ফিচার সবেতেই টাকা দেয়। কিন্তু যেখানে এন্ট্রি পাওয়া বা তাদের মনোমতো হয়ে কাজ করাটা খুব কঠিন। যারা পারেন তার পারেন। বাকী যে কাগজগুলি আছে, যাদের কেউ কেউ টাকা দেয়, তাদের প্রবণতা হল সেই মনোপলি (নাম করেই বলি – আনন্দবাজার পত্রিকা) ফেরত বা বাতিল লেখককে বেশি কদর করা। আগে যেমন বিলেত ফেরত লেখা হত সেই রকমই আনন্দবাজার ফেরত লেখা হয়। তাই সবাই প্রায় নতজানু হয়ে আনন্দবাজারে লেখার চেষ্টা করেন। তবে এসব শুনে পাঠক হয়ত ভাববেন যে আমি কথামালার সেই লেজকাটা শিয়ালের গল্প বলতে বসেছি। ব্যাপারটা তা নয়। আনন্দবাজার আমাকে যখন লেখার অফার দেয় তখন আমার ৪৫ বছর বয়েস। এখন আমি ৬৩ প্লাস। সেই সময় আমায় ফোন করে ওদের চারের পাতায় পোস্ট এডিটোরিয়াল, বুক রিভিউ লেখার কথা বলা হয়। তখন অধীর বিশ্বাস ছিলেন। ছিলেন অনির্বান চট্যোপাধ্যায় – যিনি এখন কাগজটির সম্পাদক, তিনি পক্ষান্তরে প্রস্তাবটি দেন। তখন আমি বলি যে দেখুন আপনাদেরও আমাকে বাদ দিয়ে এতদিন চলে গেছে, আমারও আপনাদের বাদ দিয়ে এতদিন চলে গেছে – ফলে আমার আর লেখাটা বোধ হয় উচিত হবে না। এতদসত্ত্বেও তারা অধীরের মাধ্যমে বাড়িতে বসেই বই রিভিউ করার প্রস্তাব দেন। আমি তাও সবিনয়ে প্রত্যাখান করি। এরপর তারা যাদবপুরের কলোনি অঞ্চলে কীভাবে বামপন্থীদের প্রভাব কমছে ও হিন্দুত্ববাদী শক্তি ক্রমশ মাথাচাড়া (তখন সবে রাজনৈতিক দিক থেকে ভারতীয় জনতা পার্টির উত্থান হচ্ছে) দিচ্ছে তার উপর একটি বড় কাজ করতে বলেন। আমি তাতেও অস্বীকার করি। সেইসময় আনন্দমেলায় সাধারন সংখ্যায় কবি রতনতনু ঘাঁটি আমায় লিখতে বললেন – জানান যে এটা তো আনন্দবাজার নয়, আনন্দমেলা আপনি লিখতেই পারেন। এরপর পুজো সংখ্যা আনন্দমেলাতেও লিখতে বলেন – আমি তাও লিখি নি। এইভাবেই আমি নিজের মতো অটল থেকেছি – এর ফলে আমি যে বিরাট কোনও দুর্গ জয় করে ফেলেছি তা নয়। আমি দেখেছি, বহু লোক আগে যারা বলেছিলেন আনন্দবাজারে লিখব না তারা ঘাড় নীচু করে লিখেছেন। এর মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। আনন্দবাজার একটি বড়ো প্রতিষ্ঠান। তারা লেখককে টাকা দেয়, বিজ্ঞাপিত করে। কিন্তু আমার কোথাও মনে হয়েছিল যে আনন্দবাজারের যে এডিটোরিয়াল পলিসি, যে রাজনৈতিক দীক্ষা থেকে আনন্দবাজার চলে – গ্লোবালাইজেশনের পক্ষে, উদার অর্থনীতির পক্ষে, মার্কেটিং ক্যাপিটাল এর পক্ষে, তা মেনে নেওয়া সম্ভব হয় নি। কেন না আমি এখনও একটা রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাস করি। সে বিশ্বাস যে আমার খুব টাল খেয়েছে, এমনটা নয়। আমার এই সিদ্ধান্তের ভালমন্দ কী হয়েছে তা জানি না – হয়ত পরে বিচার হবে।
অন্যদিকে অন্যান্য কাগজগুলোও যে আমাকে খুব কাজে লাগিয়েছে এমনটাও নয়। কারণ আমার পাবলিক রিলেশন খুব খারাপ। আমি সকালে উঠেই একে-ওকে-তাকে ফোন করতে পারি না। কলকাতার লেখক কূলের (আমাদের সময়ের যারা লেখক) মাথা ঠোকার কতগুলি জায়গা আছে। কোনও কোনও বড় কবি বা বড় লেখকের বাড়ি রোববার সকালে গিয়ে আড্ডা দেওয়া – এসব আমার কখনও করা হয়নি। এমনিতে আমি যাদের শ্রদ্ধা করেছি, সন্মান করেছি তাদের বাড়ি গেছি, যেমন মহাশ্বেতা দেবী। তবে ২০০৬-০৭ সময়কালে রাজনৈতিক কারনে ওনার সঙ্গে আমার দূরত্ব বেড়েছে। তাঁর সঙ্গে আমার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। এইভাবে কোথাও মাথা না ঠোকার কারনে কিছু দাম হয়ত আমায় দিতে হয়ছে। কিন্তু তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমার মনে হয় লেখক যদি লিখতে পারেন তা হলে কোনও সমস্যা নেই।
গল্পের সময় – কিন্তু এত সব সত্ত্বেও আপনি সুনামের সঙ্গে লিখেছেন, প্রচুর লিখেছেন। প্রচুর বই প্রকাশ হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব হল?
কিন্নর রায় – আসলে এর পেছনে আমার মূল প্রকাশক দে’জ পাবলিশিং এর সুধাংশু শেখর দে ও তার পারিবারিক অবদান অনেক। আমার কোনও বই তারা ছাপার ব্যাপারে না করেনি। আমায় যখন কেউ চিনত না তখন তারা আমার বই প্রকাশ করেছে। এ-ছাড়াও মিত্র ঘোষ এর ভানুবাবু (সবিতেন্দ্রনাথ রায়), মনীশ চক্রবর্তী এরাও আমাকে খুব সহায়তা করেছেন। আমি ‘কথাসাহিত্য’ পত্রিকায় শ্রীচৈতন্য নিয়ে একটা ধারাবাহিক লিখছি। একদিন ভানুবাবুই আমাকে ফোন করে বললেন – তুমি কী মনে কর চৈতন্যদেব বিপ্লবী ছিলেন? আমি বললাম তা মনে করি। তখন তিনি বললেন ধারাবাহিক লেখার কথা। আমি বললাম – সে কী আমি তো কোনারক নিয়ে কাজ করছি, তা নিয়ে উপন্যাস লিখব বলে। যাই হোক সেই থেকে চৈতন্য নিয়ে ‘কথাসাহিত্য’ পত্রিকায় লেখা শুরু। এখনও চৈতন্য জন্মাননি কিন্তু ৩৫-৩৬ পর্ব বা শ তিনেক পাতা লেখা হয়ে গেছে। ভানুদা না বললে আমার হয়ত চৈতন্য নিয়ে লেখা হত না। যেমন এখনও ইচ্ছা আছে অতীশ দীপঙ্করকে কে নিয়ে লেখার। কিন্তু আয়ু সীমাবদ্ধ আর এসব লেখা লিখতে গেলে প্রচুর পড়তে হয়। অসংখ্য পাতা পড়ে হয়ত চার পাতার মতো লেখা বেড়িয়ে আসে। অন্যদিকে প্রতিক্ষণের প্রিয়ব্রত দেব, স্বপ্না দেব আমার অনেক বই ছেপেছেন। অনেকে অনেক সেমিনারে ডেকেছেন,কথা শুনতে চেয়েছেন,সম্মান দিয়েছেন- যেমন চন্দননগরের গল্পমেলা পুরস্কার, এটা আমার কাছে দারুন সম্মানের। এরকম অনেক ভালো মানুষ আমাকে অক্সিজেন জুগিয়েছেন। তার ফলে বাংলা সাহিত্যে বেঁচে আছি। মানে আমাকে ফেলে দেওয়া খুব কঠিন। এটা অহংকারের কথা হল হয়তো। কিন্তু তথাকথিত বড় প্রতিষ্ঠানে না লিখে একজন লেখকের ১০০টা মত বই প্রকাশ হয়েছে – তাকে একেবারে অস্বীকার করা হয়ত সম্ভব নয়।
গল্পের সময় – যদিও কথা প্রসঙ্গে কিছুটা উল্লেখ করেছেন, তবুও বলি, শুধুই লিখবেন, আর চাকরি নয়- এই সিদ্ধান্তটা কবে নিলেন?
কিন্নর রায় – আমি লেখক হব বলে কোনও দিন চেষ্টা করিনি। আমি নকশাল রাজনীতি করতাম। জেলেও গেছি। স্কুল বা কলেজ ম্যাগাজিনে আমি কখনও লিখিনি। ৭৭ সালে জরুরী অবস্থা যখন উঠে গেল, জেল থেকে বেরোনোর পর মনে হল সামনে প্রায় কিছুই নেই। যে সব মেয়েদের দেখতে ভালো লাগত তাদের সকলেরই প্রায় বিয়ে হয়ে গেছে, কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত। কারণ পার্টি তখন খন্ড বিখন্ড। নানা দল-উপদল। তখন আমার মনে হল, আমার মধ্যে যে কথাগুলো আছে তা আমাকেই বলতে হবে। আমি ছাড়া সে কথা আর কে বলবে? তখন আমি খবরের কাগজের অফিসে যাওয়া-আসা শুরু করি। পরবর্তীকালে কাগজের অফিসে ঝাঁট দেওয়া, চা-জল দেওয়া (কর্মীদের ছোট বা অসম্মান না করেই বলছি) ছাড়া সব কাজই করেছি। সব ধরনের সাংবাদিকতা করেছি। বামফ্রন্টের সময়েই একবার তিন বিঘায় গুলি চলল…. সুধীর রায় নামে ফরোয়ার্ড ব্লকের একজন সহিদ হন… তখন অশোক ঘোষ, কমল গুহ কলকাতা থেকে তিন বিঘা গেলেন… বসুমতীর সম্পাদকের কথায় আমিও এক রাতের নোটিশে ব্যাগে গামছা ভরে নিয়ে চলে গেলাম। ট্রেনে অশোক ঘোষই ব্যবস্থা করে নিয়ে গেলেন। যুগান্তরের ডেস্কের পাশাপাশি সাংবাদিকতা করেছি। কেরলে তখন CPM ভাঙছে। কলকাতাতেও ভিন্ন মত তৈরি হচ্ছে। এই সময় রিপোর্টারি করেছি। কিন্তু যুগান্তর যখন বন্ধ হয়ে গেল তখনই ঠিক করলাম আর চাকরি করব না।
গল্পের সময় – আপনি লিটল ম্যাগাজিনের লেখক, বিগ হাউসকে আপনি সে ভাবে কোনও দিনই পাত্তা দেন নি। এতে পাঠকের কাছে পৌঁছোতে কোনও অসুবিধে হয়েছে?
কিন্নর রায় – আমি লিটল ম্যাগাজিনের লেখক, এ কথাটা আমি গর্বের সঙ্গেই বলি। এরমধ্যে কোনও হীনমন্যতা নেই। আসলে আমি যে ধরনের লেখালিখি করি সে লেখা যে খুব পপুলার হবে এটা আমার মনে হয় না। আমার বই লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি এটা ভাবি না। পপুলিজমের সঙ্গে ক্লাসিক সাহিত্যের কোনও বিরোধ আছে না সাযুজ্য আছে না ভালবাসা আছে তা ঠিক জানি না তবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই খুব বিক্রি হয়। তিনি খুব সিরিয়াস লেখক। বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক তিনি। আমার তো মনে হয় ঠিক বিচার হলে তাঁর ইছামতি, অপরাজিত ও আরন্যকের জন্য তিনটি নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত। মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরে কপিরাইট উঠে যাওয়া বিভূতিভূষনের বইয়ের বিক্রি দারুন। আমি যে লেখালিখি করি তা কঠিন না হলেও গবগব করে পাঠক খাবে এমনটাও আমি বিশ্বাস করি না। সিলেকটেড পাঠক আমার বই পড়বেন বা পড়েন। আমার বইও তো কিছু বিক্রি হয়। বিশাল টাকা না হলেও আমিও কিছু রয়ালটি পাই। আমার খুব নামী প্রকাশক ব্যবসার জায়গা থেকেই আমার বই বিক্রি করেন। ফলে পাঠকের কাছে পৌঁছোতে অসুবিধা হয় না।
গল্পের সময় – সচেতন পাঠক আপনার বই খুঁজছেন এই অনুভবটা কেমন ? পাশাপাশি পাঠকের সচেতনতা নিয়ে আপনার মত কী ?
কিন্নর রায় – এটা আমি খুব বুঝতে পারি জেলা বইমেলায় গেলে। সেখানে কোনও উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বা সেমিনারে একেবারে অজানা একজন আমার বইটি কিনে আমায় সই করে দিতে বলেন। প্রকাশকের কাউন্টারেও এটা হয়। যখন কেউ কোনও বই কিনল আমি জানতে চাই সে কোন বয়সের ? পুরুষ না মহিলা ?
গল্পের সময় – লেখালিখির সুত্রে আপনি বাংলাদেশেও গেছেন। সেখানে কতটা পাঠকের উন্মাদনা লক্ষ্য করেছেন ?
কিন্নর রায় – দারুন উন্মাদনা লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশে। ত্রিপুরাতেও তাই। আগরতলা বা ঢাকায় গেলে বুঝতে পারি সেখানকার মানুষজন খুব পড়েন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, সিলেট – এই যে ব্যাপক পড়াশুনোর জায়গা, সেখানে মানুষের কাছে খুব সম্মান পাই। ঢাকায় তো কলকাতার নামী–দামী লেখকদের বেস্ট সেলারের পাশে আমার বই রাখা থাকতে দেখেছি। ওখানকার পাঠক সমাবেশ, প্যাপিরাস বা ঘাসফুল নদীতে বই সাজান থাকে। সেখানকার ছেলেরা–মেয়েরা প্রচুর পড়েন। তারা আমাদের বই কেনেন। তর্ক করেন। এখানে উত্তরবঙ্গে গেলেও এটা দেখেছি। মফস্বলেও দেখেছি। এটা আমাকে এনার্জি দেয়। লিখতে উৎসাহী করে।
গল্পের সময় – আপনি ছোটদের জন্যও লিখেছেন। কাদের লেখা লিখতে ভাল লাগে – ছোটদের না বড়দের ?
কিন্নর রায় – আসলে ছোটদের – বড়দের লেখা কিছু হয় বলে আমার মনে হয় না। যেমন আমার বুড়ো আংলা, রাজকাহিনী, আবোল তাবোল, হলদে পাখির পালক, ভোঁদড় বাহাদুরের মত – লেখাকে ছোটদের বা বড়দের বলে ভাগ করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু কথা হল আমি নিশ্চয়ই ছোটদের লেখা লিখে খুব আনন্দ পাই। কিন্তু বাজার চালু অ্যাডভেঞ্চার, গুলি, পিস্তল এই সব নিয়ে ছোটদের লেখা লিখতে আমার মোটেই ইচ্ছে করে না। কিছুটা কল্পবিজ্ঞান, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক, মানুষের সঙ্গে জীবজন্তুর সম্পর্ক এই সব নিয়ে বেশি লিখতে হচ্ছে করে। ডিটেকটিভ গল্প নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে, কয়েকটা লিখেছিও। কিন্তু শেষটা ঠিক না হলে সে গল্প লেখা মুশকিল বলে আমার মনে হয়। ভূত থাকুক বা না থাকুক ভূতের গল্প লিখতে ইচ্ছে করে।
গল্পের সময় – আপনার কলমে লেখা আসে কী ভাবে?
কিন্নর রায় – আগে যেটা হত, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাটা খুব বেশি থাকত। যত বয়স গড়ায় তখন স্বপ্ন-বাস্তব-কল্পনা মিশতে থাকে আমার লেখায়। আমি হাতে লিখি। লাইনটানা ভালো কাগজে লেখা শুরু করি। এখন ডটপেনে লিখি। উপন্যাস হলে কালি পেনে লেখার চেষ্টা করি। আমার লেখার ক্ষেত্রে প্রথম লাইনটা আসাই জরুরী। কিছুতেই তা আমার পছন্দ হয় না। কাটাকুটি করি। বদলে ফেলি। তিনটে প্যারাগ্রাফ লিখে বাতিল করি। কিন্তু শুরু হলে লেখা তরতর করে এগোতে থাকে। আমি লেখা কপি করি না। বহুদিন থেকেই আমি একদানেই লিখি। লেখার শেষ নিয়ে আমি কখনও ভাবি না। শেষ ভেবে আমি কখনও লেখা শুরু করিনি। আবছা দিগন্ত রেখা হয়ত থাকে। তবে লিখতে গেলে আমি নোট তৈরি করি। কিছু দিন আগে বেনারস গিয়েছিলাম। এর আগেও বহুবার গেছি। ফের নোট তৈরি করছি আবার লিখব বলে। যেমন বেনারসেই এক বয়স্ক মহিলার কাছ থেকে জানলুম শিউলিকে ‘পর্যাটা’ বলে। এই ভাবেই প্রতিদিন খবরের কাগজ, টিভি ইত্যাদি থেকে নতুন নতুন জিনিষ জানার ও শেখার চেষ্টা করি।
গল্পের সময় – আপনি মোবাইল ব্যবহার করেন না কেন?
কিন্নর রায় – আসলে আমি মনে করি আমার একটা প্রাইভেসি আছে। আমি যেখানে খুশি থাকতে পারি। লোকে আমায় ধরতে পারবে কেন? আর তা ছাড়া আমাদের ল্যান্ড ফোন আছে। আমি তো চাকরি করি না। সকলের সঙ্গে বিভিন্ন প্রয়োজনের কাজ তো মিটেই যায়। তবে মোবাইল একেবারে ব্যবহার করি না একথা ভুল বলা হবে। আমি যখন বাইরে যাই তখন মেয়ে–বউ আমাকে মোবাইল ধরিয়ে দেয়, যোগাযোগ রাখার জন্য। আমার বাবাদের জীবনে তো পোস্টকার্ড- এর চিঠিপত্রেই কাজ মিটে গেছে। তখন এলাহাবাদে কলকাতা থেকে চার থেকে পাঁচদিনে চিঠি যেত। কলকাতার মধ্যে একদিনে চিঠি বিলি হত। দিনে তিন-চারটে ডাক আসত। এখন মোবাইলের যুগ,ফেসবুকের যুগ। আমার মনে হয় এর অনেকটাই অপচয় হচ্ছে। আসলে কাজের কাজে কিছু লাগছে না। এগুলো না থাকলেও জীবনে চলতে খুব একটা অসুবিধে হয় না।
গল্পের সময় – একজন লেখকের লেখালিখির মধ্যে কী কোনও সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে?
কিন্নর রায় – দেখুন সামাজিক দায়বদ্ধতা বিষয়টি আমার কাছে আগে এরকম ছিল, এখন আরেক রকম, আমাদের কৈশোরে বা প্রথম যৌবনে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা বলে একটা শব্দ ছিল, তখন অটটু সোভিয়েত। ম্যাক্সিম গোর্কির লেখা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা তখন আলোচিত। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের উত্তরকালের গল্প সংগ্রহ নিয়ে খুব আলোচনা হয় কিন্তু তার পুতুল নাচের ইতিকথা বা দিবারাত্রির কাব্য এগুলোকে ফ্রয়েডিয়ান বলে অনেক সময় চালনো হয়। আমার কেমন যেন মনে হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কখনই ফ্রয়েডিয়ান মানিক বা মার্কসিস্ট মানিক বলে আলাদা করা যায় না। ছোট বেলায় শুনেছি জীবনানন্দ দাশ হচ্ছেন নির্জনতার কবি। সতীনাথ ভাদুড়ি খুব বেশি পড়া হয়নি বা পড়ানো হয়নি, কারণ সতীনাথ স্যোসালিস্ট পার্টি করতেন, তারাশংকর কংগ্রেস রাজনীতি করতেন বলে তার সম্পর্কে কতকগুলো ব্যারিয়ার ছিল। বিভূতিভূষনকে খানিকটা ভুত-প্রেতের লেখক বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আমার যেটা মনে হয় একজন লেখকের কোনও পার্টির ঘাড়নীচু করা সদস্য হওয়াটা তার পক্ষে বিপজ্জনক। লেখক স্বপ্নদর্শী। কোনও সংগঠনের কাছে, কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছে, কোনও বন্ধনের কাছে তিনি মাথা নত করবেন না। তার মতো করে তিনি স্বাধীন এবং সেই অর্থে সমস্তরকম সিস্টেম, সমস্তরকম রাজনৈতিক পরিবেশ তার মধ্যে লেখক একজন পরাধীন মানুষ। এই পরাধীনতার শৃঙ্খলকে ছেঁড়ার কাজটাই লেখকের। একসময় আমি প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেছি। লেখক পার্টি সদস্য হতে পারেন। কিন্তু ঘাড় নীচু করে পার্টির ফতোয়া মেনে নেওয়া তার চলে না। যেমন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময়ই আমরা দেখেছি যে অনেক কাজ ঠিক হচ্ছে না। সিঙ্গুরে যে ভাবে জমি দখল/অধিগ্রহন করা হয়েছে তা ঠিক নয়। নন্দীগ্রামে গুলি চালিয়ে চোদ্দ জনকে খুন করা হয়েছে, সে সব আমার পছন্দ হয় নি কখনও। যদিও আমি কোনও কালেই পার্টি সদস্য ছিলাম না কিন্তু তবুও আমার মনে হয়েছে বামপন্থীদের এসব করা ঠিক হয় নি। কিন্তু আমি পার্টি সদস্য হলে এসব কথা কী প্রকাশ্যে বলতে পারতাম। তখন দলে সংখ্যা গরিষ্ঠের মতই মেনে নিতে হত। এমন কী জ্যোতি বসুর মত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেও প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রশ্নে সংখ্যা গরিষ্ঠতার মত মেনে নিতে হয়েছে। একজন লেখক আসলে একটা সুন্দর সমাজের স্বপ্ন তৈরি করেন। তাতে সকলের সমান অধিকার থাকবে এমনটাই চায় সে।
গল্পের সময় – আপনার কী মনে হয় তরুণ প্রজন্মের গল্প–উপন্যাস পড়ার প্রবণতা কমছে? এর ফলে কী সমাজে কোনও খারাপ প্রভাব পড়তে পারে?
কিন্নর রায় – শুধুমাত্র গত ১০ বা ১৫ বছরের তরুণ প্রজন্মকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এই প্রবণতা তার আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এর জন্য লেখকরাও কিছুটা দায়ী। ঘরের কোণে এখন ১৫০-২০০ চ্যানেলের টেলিভিশন হাজির, সেখানে লেখকের প্যানপ্যানানি লেখা এই প্রজন্ম নেবে কেন? বিদেশে লেখকরা অনেক সময় নিয়ে, অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে লেখা তৈরি করেন – যদিও সেখানে একটা বিনিয়োগ থাকে। বাংলা বাজারে সেই সুবিধে না থাকলেও লেখকদের বস্তাপচা ত্রিকোণ প্রেমের গল্প – চলবে না। লেখকরা যদি স্পটে না গিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় না করে শধুমাত্র খবরের কাগজ আর ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে লেখালিখি করে তা হলে পাঠক তা নেবে কেন? আগে মহিলারা দুপুরে গল্প-উপন্যাস বুকে নিয়ে নিদ্রা যেতেন। এখন মেয়েদের সে সময় নেই। এক সময়ে বাংলা গল্প উপন্যাসের যে বিনোদন উপাদান থাকত এখন তার জায়গা নিয়ে নিয়েছে সিরিয়াল গুলো। ফলে লেখককে সেই লেখা লিখতে হবে যা দিয়ে সিরিয়াল করা যায় না। তবে এই সময়টা সব শিল্পের কাছেই খুব অ্যালার্মিং।প্রচুর খরচ করে তৈরি করা গান কপি হয়ে যাচ্ছে,সিনেমা ডাউনলোড হয়ে যাচ্ছে,হাতে আঁকা ছবি সেভাবে কেউ কেনে না।এই ব্যাপারগুলো থাকলেও আমি বিশ্বাস করি পরমাণু যুদ্ধে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে না গেলে শিল্প থাকবে, কবিতা থাকবে।মানুষ গল্প লিখবে,গল্প পড়বে। সৃষ্টি কখনও বন্ধ হবে না।
গল্পের সময় – গল্পের সময়ের পক্ষ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
কিন্নর রায় – ধন্যবাদ।
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।