‘না, না . . . আমায় ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন কাকাবাবু . . . আপনার পায়ে পড়ছি আমায় ছেড়ে দিন . . . ছেড়ে দিন ’
হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল পলাশের। ধড়মড় করে উঠে বসল বিছানার উপর। গা ঘামে ভেজা, গলা শুকিয়ে কাঠ। জল খেতে হবে।
বিছানা থেকে নেমে স্যুইচ টিপে আলো জ্বালল। ঘড়িতে রাত প্রায় আড়াইটে।
জল খেয়ে খানিক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল পলাশ। মাথাটা গরম হয়ে আছে। বাথরুম থেকে ঘাড়ে–মাথায় ভালো করে জল দিয়ে বেরিয়ে এসে সিগারেট ধরালো সে।
সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে ! এ ক’দিনে কাকাবাবুর মৃত্যু আর সুজনের গ্রেফতারি — দু’টি ঘটনার কোনওটা নিয়েই তো সে তেমন চিন্তিত ছিল না। কিছুই চিন্তা ভাবনা করেনি সেভাবে। তাহলে ঘুমোলেই এমন স্বপ্ন দেখছে কেন এই এক সপ্তাহ ধরে ! কেন সারা দিন বিভিন্ন সময়ে বাড়ির আনাচে কানাচে, এমনকি বাড়ির বাইরেও বারবার মনে হচ্ছে কাকাবাবু যেন সঙ্গেই আছেন, নানা ভাবে নিজের অস্তিত্ত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
একটু ধাতস্থ হয়েছে সে এতক্ষণে। নিজের উপর তার করুণা হল। হাসি পেল এমন চিন্তা মনে আসার জন্য। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে সে মনকে বোঝাল —- কাকাবাবু আজ এক সপ্তাহ হল মারা গেছেন —- তিনি বেঁচে নেই। ডাক্তার সরকার তার সামনেই নাড়ি পরীক্ষা করে বলেছেন রাত প্রায় আড়াইটে নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়েছে। মুখের উপর বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে তাঁকে। তাঁর শেষকৃত্যেও আগাগোড়া উপস্থিত ছিল পলাশ। কাকাবাবুর কাটাছেঁড়া দেহটা নিঃশেষে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সে এক পাও নড়েনি। মনের সমস্ত সন্দেহ ঘুচিয়ে তবেই বাড়ি ফিরেছিল। মরা মানুষ ফিরে আসতে পারে না, কক্ষনো না . . .
দ্বিতীয় বার ঘুম ভাঙলো চাকরের ডাকে —- ‘বাবু, উঠুন বাবু . . . আইটটা বাজে। আইজকে আপনের সাক্ষীর দিন, কোটে যাবেন নি ! উকিলবাবু সকাল থিকে দু’বার ফুন করিছেন যে ’
উকিল পরাশর সামন্ত পলাশকে দেখেই বললেন — ‘কি ব্যাপার পলাশবাবু,এত দেরি কেন ? সাড়ে দশটা বাজে। আর আধ-ঘন্টার মধ্যেই এজলাসের কাজ শুরু হয়ে যাবে। আপনার সাক্ষ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বুঝতে পারছেন ? সুজনবাবু কোনও ভাবে যদি নির্দোষ প্রমাণ হয়ে যান ফাঁসির দড়িটা কিন্তু আপনার গলাতেই উঠবে, মনে রাখবেন। সন্দেহের তালিকায় আপনারা দু’জন ছাড়া আর কিন্তু কেউ নেই।’
পরাশরবাবুর কাছ থেকে সব বুঝে শুনে নিয়ে পলাশ আদালতকক্ষের আসন গ্রহণ করার মিনিট দশেকের মধ্যেই আসামীকে কাঠগড়ায় তোলা হল। রুক্ষ শুষ্ক মুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফে ঢাকা। মাথার চুল বিদ্রোহী। চোখে অনিদ্রার পীড়ন। চেহারা এই পাঁচ দিনেই ভেঙে অর্ধেক হয়ে গেছে। পরনের পোষাক একবারও পালটানো হয়েছে বলে মনে হয় না।
সাক্ষ্যগ্রহণ চলার মধ্যেই একবার সুজন আর পলাশের চোখাচুখি হল। কেতাদুরস্ত সাজপোশাকে পরিপাটি পলাশকে দেখে সুজনের চোখে মুখে একটা তীব্র ঘেন্না স্পষ্ট ছাপ ফেলল। পলাশের চোখও তা এড়ালো না।
এক সময় পলাশের ডাক পড়ল কাঠগড়ায়। শপথ নেওয়ার পর সরকারি উকিল এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন — ‘পলাশবাবু, সুজনবাবু সম্পর্কে আপনার কে হন ?’
—- পলাশ শান্ত গলায় জবাব দিল — ‘আমার খুড়তুতো ভাই।’
—- ‘আপনার কাকাকে কি সুজনবাবুই খুন করেছেন ?’
—- ‘এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিৎ নই; খুনের রাতে বাড়িতে ছিলাম না। ব্যবসার কাজে কাকাবাবু আমায় বাইরে পাঠিয়েছিলেন। আমি পরদিন সকালে ফিরে সব জানতে পারি।’
—- ‘আপনার ভাই যে আপনার কাকা অর্থাৎ তাঁর বাবাকে খুনের হুমকি দিয়েছিলেন এ কথা আপনি জানতেন ?’
—- ‘এ কথা সর্বসমক্ষেই সে বলেছিল। শুধু আমি কেন, বাড়ির চাকর-বাকর, রাধুনি সবাই জানে।’
—- ‘উনি হঠাৎ সর্বসমক্ষে এমন হুমকি কেন দিলেন ?’
—- ‘ছোটবেলায় একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় আমার বাবা-মা দু’জনেই মারা যান। তারপর থেকে কাকাবাবুই আমায় মানুষ করেন। সুজনের জন্মের বছরকয়েকের মধ্যে কাকিমাও চলে গেলেন। সুজন কুসঙ্গে পড়ে বখে গিয়েছিল। ফলে কাকাবাবুর কাছে ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। তিনি আমাকেই ব্যবসার সমস্ত দায়ীত্ব দেন। সুজনের উপর তিনি কোনও দিনই ভরসা করেননি। সুজন মনে মনে আমার প্রতি হিংসায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। তারপরে বেশ কিছু দিন কোথায় ছিল আমি জানি না। হঠাৎ দিন দশেক আগে ফিরে আসে। টাকা-পয়সার ভাগ নিয়ে কাকাবাবুর সাথে ঝগড়া শুরু হয়। কথা কাটাকাটিও হয়। তখনই ও চিৎকার করে খুনের হুমকি দেয়। বাড়িতে তখন যারা ছিল সকলেই শুনেছে।’
সুজন উসখুস করতে লাগল। যেন সে কিছু বলতে চায়, পলাশের কথার প্রতিবাদ করতে চায় সে। বিচারক হাতুড়ি ঠুকে সুজনকে থামিয়ে দিয়ে বললেন —- ‘সুজনবাবু, আপনাকে যথা সময়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হবে। এখন আপনি কথা বলবেন না, চুপচাপ শুনে যান।’
পলাশ বড় রাস্তায় ওঠার আগেই পরাশর সামন্ত পিছন থেকে হন্তদন্ত হয়ে এসে ধরে ফেলল — ‘আরে মশাই আপনার হয়েছে কি বলুন তো ! সারা সকাল ধরে এত করে বোঝানোর পরেও আপনি বললেন আপনার ভাই খুন করেছে কিনা সে ব্যাপারে আপনি নিশ্চিৎ নন !’
পলাশ হাঁটতে হাঁটতেই নির্লিপ্তভাবে বলল —- ‘আমি নিরুপায়’
তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে একটু ইতস্তত করে এদিক ওদিক তাকিয়ে পরাশরবাবুর একেবারে কাছে সরে এসে ধীরে ধীরে বলল —- ‘পরাশরবাবু, আমি খুব সমস্যায় আছি। এমনই সমস্যা কাউকে বলতেও পারছি না। লোকে আমায় পাগল বলবে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে সত্যিই আমি পাগল হয়ে জাচ্ছি না তো !’
পরাশর সামন্ত খানিক্ষণ হাঁ করে তার মক্কেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কি মনে করে বললেন —- ‘চলুন আমার অফিসে চলুন, শুনি কি ব্যাপার।’
বাইরে অন্ধকার হয়ে আসছে। রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। জ্বলে উঠেছে বিজ্ঞাপনের বড় বড় হোর্ডিং। জ্বলে উঠেছে রাস্তায় নিরন্তর ছুটে চলা ছোট বড় সমস্ত গাড়ির চোখ।
পরাশর সামন্ত অনেক্ষণ গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে ছিলেন। ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে আলোটা জ্বালিয়ে দিলেন। তারপর আবার এসে নিজের আসনে বসলেন। চিন্তিত গলায় থেমে থেমে বললেন — ‘তাহলে আপনি বলতে চান আপনার কাকাবাবু এখনও আপনার সঙ্গেই আছেন ! তাঁর আত্মা শান্তি পায়নি !’
–‘ কি করে বলি বলুন তো ! হিন্দু শাস্ত্রমতে সম্পূর্ণ নিয়ম নিষ্ঠা মেনেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। তারপরেও প্রতি রাতে এই স্বপ্ন। আর আজ তো কোর্টের মধ্যেই ‘
—- ‘স্বপ্নে কী দেখেন ?’
—- ‘কাকাবাবুর চিতা জ্বলছে। সবাই চিতা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। এক সময় সকলে একে একে চলে গেল। আমিই একমাত্র দাঁড়িয়ে রইলাম। চিতা জ্বলছে। হঠাৎ কাকাবাবুর জ্বলন্ত দেহটা চিতা থেকে নেমে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আর বলতে লাগল — তোকে আমি ছাড়ব না, তোকে আমি ছাড়ব না। তারপরেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। সে যে কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য আর কি বিভৎস সে গলার স্বর . . . উফ্।’
পরদিন সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আবার ডাক পড়ল পলাশের। সবেমাত্র সে জেরার জবাব দিতে শুরু করেছে, হঠাৎই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সমস্ত মুখটা অসম্ভব ভয়ে যেন কালো হয়ে গেল তার। মনে হল সে অল্প কাঁপছে। ধীরে ধীরে পাশের চেয়ারের সারির দিকে তাকালো পলাশ। শেষ সারিতে বসা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের দিকে অনেক্ষণ চেয়ে রইল। তারপরেই শরীর খারাপ লাগছে বলে বুক চেপে ধরে কাঠগড়া থেকে নেমে গেল হুড়মুড় করে।
রাতে পরাশরবাবু এলেন।
—- ‘সমস্যাটা কি বলুন তো আপনার ! কালও বলছিলেন কোর্টরুমের ভিতর আপনি কিছু দেখেছেন। কি দেখে এত ভয় পেলেন ?’
—- ‘আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, যখন সাক্ষ্য দিচ্ছিলাম আমার ডান দিকের আসনগুলির একেবারে শেষ সারিতে আবছাভাবে দেখতে পেলাম সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী পরা একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন। এক দৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে আছেন তিনি। তখনই সরাসরি তাঁর দিকে তাকাতে সাহস হল না আমার। আবছা হলেও বুঝতে অসুবিধে হল না তিনি কাকাবাবুই। কিন্তু পরে যখন ভয়ে ভয়ে সে দিকে তাকালাম, দেখলাম ঐ আসনে ঐ একই পোশাক পরে বসে আছেন অন্য এক ভদ্রলোক। আশ্চর্যের ব্যাপার, তাঁর সাথে কাকাবাবুর চেহারার কোনও মিলই নেই।’
পরাশরবাবু এবার প্রশ্ন করলেন — ‘আচ্ছা, আপনি ছাড়া তাঁর উপস্থিতি আর কেউ অনুভব করতে পারে ?’
—- ‘আজ্ঞে না। বাড়ির অন্য কারও মুখে তো এ ব্যাপারে কোনও কথা আমি শুনিনি। সবাই স্বাভাবিকভাবেই বেঁচে আছে। শুধু আমিই খাওয়া-ঘুম-সুখ-শান্তি সব কছু থেকে বঞ্চিত। আমায় বাঁচান পরাশরবাবু, আমায় বাঁচান।’
রাতে নিজের ঘরে বসে পলাশ পরাশরবাবুর শেষ কথাগুলো ভাবছিল —- ‘পলাশবাবু আমি সব ব্যাপারটাই তো জানি, আমি সৎ ভাবেই পরামর্শ দিচ্ছি আপনি কোনও ভালো মনোবিদকে দেখান। আমার মনে হয় আপনার স্নায়ু দূর্বল হয়ে পড়েছে।’
পরাশরবাবুর সাথে তাদের এতদিনকার পারবারিক ঘনিষ্ঠতা, কাকাবাবুর আমল থেকেই তিনি পলাশদের ব্যবসা ও জমিজমা সংক্রান্ত সমস্ত মামলা-মোকদ্দমা দেখভাল করেন। এত কাছের লোক হয়ে তিনিই যদি পলাশের কথা বিশ্বাস না করেন তাহলে সে আর কার কাছে যাবে।
হঠাৎ কি একটা শব্দে পলাশের হুঁশ ফিরল। ডায়েরির পাতা ওল্টানোর শব্দ। চমক ভেঙে সে দেখল সামনের টেবিলের উপর তার হিসাবপত্রের ডায়েরিটা খোলা অবস্থায় আছে। ঘরে সে ছাড়া আর কোনও লোক নেই।
ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে সে এগিয়ে গেল ডায়েরিটার দিকে। কেমন একটা অজানা ভয় তার শরীরকে যেন তিন গুন ভারী করে দিয়েছে।
অতি কষ্টে শরীরের ভার টেনে সে ডায়েরিটা পর্যন্ত পৌঁছালো। খোলা পাতাটা দেখেই আঁতকে উঠল পলাশ। আলতা বা ঐ জাতীয় কিছু দিয়ে কাঁপা হাতে বড় বড় করে লেখা—-দোষ স্বীকার কর। নাহলে বাঁচবি না। উকিল মরেছে, তুইও মরবি।
এ হাতের লেখা পলাশ খুব ভালো করে চেনে। দীর্ঘ দিনের পরিচয় তার এ লেখার সাথে। বাহাত্তর-তিয়াত্তর বছর বয়সেও কাকাবাবুর হাতের লেখা ছিল ছবির মত। তবে বয়সের কারনেই শেষ দিকে হাতটা একটু কাঁপত।
সে উন্মাদের মত চিৎকার করে তার চাকরকে ডাকতে লাগল – ‘দুখে, এই দুখে . . .’
এত রাতে মনিবের এ হেন তলবে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দুখে ছুটে এসে আতঙ্কিত মুখে দরজার সামনে দাঁড়ালো। পলাশ পিছন ফিরে তাকে বলতে গেল —- এটা এখানে কে লিখেছে ? কিন্তু বলতে গিয়ে সে হতবাক্। মুখের কথা মুখেই থেকে গেল। কোথায় কি লেখা ! ডায়েরি ডায়েরির জায়গাতেই বন্ধ অবস্থায় আছে। সমস্ত পাতা উল্টেও কোন হুমকির হদিস পাওয়া গেল না। দুখে কেমন এক সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে ফিরে গেল।
সে রাতে খেতে বসে কয়েক গাল খাওয়ার পরই পেটের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল পলাশের। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে, গা গোলাচ্ছে। সে ছুটে গেল বাথরুমে। হড় হড় করে বমি করে ফেলল। কান মাথা দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে তার। নিজের নিশ্বাসে নিজেই পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে পলাশ।
কোন রকমে টলতে টলতে এসে রাধুনিকে ডাকল —- ‘মোহান্তি . . .’
ওড়িয়া রাধুনি মোহান্তি ছুটে এল সঙ্গে সঙ্গে।
‘আমার ভাতে বিষ মিশিয়েছে কে ? জবাব দে . . .’ —- চিৎকার করে উঠল সে।
চাকর-বাকররা তো অবাক ! মোহান্তি কাঁদো কাঁদো গলায় হাতজোড় করে বলল —- ‘কত্তা, আমি আজ বিশ বছর হল এ বাড়ি রান্না কচ্চি। এমন কাজ আমি কেন করব কত্তা ?’
পলাশ কিছু বলার আগেই দুখে হাতজোড় করে মিনমিনে গলায় বলল —- ‘আমরা সবাই এ বাড়ির পুরোন চাকর। বড় কত্তাবাবুর আমল তিকে এ বাড়ি কাজ কত্তিচি। আমরা কেউ এমন করার কতা ভাবতিও পারিনে বাবু . . .’
কিন্তু তাতেও পলাশের সন্দেহ গেল না। সে হাঁফাতে হাঁফাতে জড়ানো গলায় বলল —- ‘যদি তোরা কেউ ভাতে বিষ না মিশিয়ে থাকিস তাহলে যে কেউ একজন বাকী ভাতটা খা আমার সামনে। নাহলে পুলিশে দেব সব ক’টাকে।’
খানিক্ষণ এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। তারপর অবশেষে মোহান্তিই ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এসে বাকী ভাতটা খেয়ে ফেলল। পলাশের সামনেই।
কিন্তু কি আশ্চর্য, তার কিছুই হল না। বহাল তবিয়তে হাত-মুখ ধুয়ে এসে সে পলাশের সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়ালো। তারপর এক সময় দৈনন্দিন কাজকর্ম সেরে শুতেও চলে গেল।
পলাশ কিন্তু সারা রাত ঘুমোতে পারল না। অসহ্য পেটের ব্যথায় এপাশ ওপাশ করতে থাকল। রাত্রে বেশ কয়েকবার বমিও হল। তার সাথে রক্তও উঠল খানিকটা।
মাঝরাতে আধচেতন অবস্থায় পলাশ —- তার বিছানার থেকে খানিক তফাতে তারই চেয়ারটায় আবছা অন্ধকারে ধুতি-পাঞ্জাবী পরা এক বয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন। ঘোলাটে দৃষ্টিতেও তাঁকে চিনতে পলাশের বিশেষ অসুবিধা হল না। ভদ্রলোকের চোখ দুটো যেন জ্বলছে। সেই জ্বলন্ত দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। ঠোঁটের কোনে নিষ্ঠুর কুটিলতা। ভয় পাওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে পলাশ। মড়ার মত পড়ে রইল বিছানায়।
সকালে কোনও রকমে উঠে দুর্বল শরীর নিয়ে অতি কষ্টে আদালতে হাজির হল। আজ সুজনকে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেবে আদালত। জবানবন্দী নেওয়া হবে। আজ পলাশ এবং তার উকিলকে আদালতে হাজির থাকতেই হবে।
কিন্তু আদালত চত্তরের পরিবেশ যেন আজ অন্য রকম। কোন একটা বিষয় নিয়ে চাপা গুঞ্জন চলছে। কিছু যে একটা ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই।
পলাশ ধীরে ধীরে এক তরুণ উকিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করল –‘কি হয়েছে দাদা ?’
সে খানিক্ষণ পলাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল —- ‘আপনি পলাশবাবু তো ? আজ তো আপনার কেসের ডেট ছিল ?’
তারপর মাথা নেড়ে দুঃখিতভাবে বলল —- ‘আপনার কপালটা খারাপ মশাই। আপনার উকিল পরাশর সামন্ত কাল রাতে হৃদ্রোগে মারা গেছেন। অনেকদিন ধরেই বুকে মাঝে মাঝে একটা ব্যথা অনুভব করছিলেন। এখন যত দিন না আপনি নতুন উকিল পাচ্ছেন, আপনার কেসটা মুলতুবি থাকবে।’
খবরটা শুনেই রাতে ডায়েরির আলতা-লেখা লাইনগুলোর একটা মনে পড়ে গেল পলাশের —- ‘উকিল মরেছে, তুইও মরবি।’ তাহলে কাকাবাবুই কি . . .
পলাশ আর দাঁড়াতে পারল না। কোন মতে বাড়ি ফিরেই বিছানা নিল।
বেলা যত বাড়তে লাগল ততই অবস্থা খারাপ হতে লাগল পলাশের। মাঝে মাঝেই বমি হতে লাগল। বিষের ভয়ে সে জল পর্যন্তও মুখে তুলল না। এক সময়ে প্রলাপ বকতে আরম্ভ করল —- ‘আমি পাপ করেছি কাকাবাবু, আমি পাপ করেছি। সব দোষ স্বীকার করে নেব —- এবারকার মত ক্ষমা করে দিন। আপনি চলে যান, দয়া করে আপনি চলে যান।’
অনেক চেষ্টা করেও কাউকেই সে চিনতে পারল না। দুপুরের দিকে পারিবারিক ডাক্তার অবিনাশ সরকার যখন এলেন তখন পলাশের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ডাক্তারকে সে চিনতে পারল। ক্ষীণ স্বরে কিছু বলতে চাইল। ডাক্তার কান নিয়ে গেলেন পলাশের মুখের কাছে। সে মিন্ মিন্ করে বলল —- ‘ডাক্তারবাবু, পুলিশকে তাড়াতাড়ি একটা খবর দিন। আমি জবানবন্দী দিতে চাই। আমার হাতে সময় খুব কম। কাকাবাবু আমায় ক্ষমা করবেন না . . .’
সুজনের মামলার তদন্তকারী অফিসার গুরুদাস দত্ত এলেন বিকেলবেলা। পলাশের অবস্থা এখন একটু ভালো। সে চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে কাউকে যেন খোঁজার চেষ্টা করল। উঠে বসতে গেল, পারল না। মিহি স্বরে অতি কষ্টে বলল —- ‘বসুন . . .’
দত্ত বিছানার পাশের চেয়ারটায় বসে কোমল গলায় বললেন —- ‘বলুন আপনার কি বলার আছে।’ কন্সটেবলটি পিছনে দাঁড়িয়ে রইল।
পলাশ ক্লান্তভাবে টেনে টেনে বলতে শুরু করল —- ‘আজ আমি যা বলব তা আমার ব্যক্তিগত জবানবন্দী। আমি সম্পূর্ণ সজ্ঞানে কথাগুলো বলছি। এর একটি কথাও মিথ্যে নয়।’
দত্ত অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন পলাশের দিকে। তাঁর যেন কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।
—- ‘সুজন নির্দোষ। আমি তার বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা সাজিয়েছি, মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়েছি। ও খুন করেনি স্যার, ও খুন করেনি।’
দত্তর বিস্ময় আরও বেড়ে গেল —- ‘মানে . . .’
—- ‘স্যার, খুন করেছি আমি। দোষ স্বীকার না করলে কাকাবাবু আমায় ছাড়বেন না। তিনি এখনও আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। আপনারা দেখতে পাবেন না, আমি পাই। এখনও পাচ্ছি।’
দত্ত অবাক বিস্ময়ে তাঁর টেপ রেকর্ডারটা চালিয়ে দিয়ে বললেন —- ‘খুলে বলুন; কিচ্ছু বাদ দেবেন না।’
পলাশ বলতে শুরু করল। তার সব কথা ধরা থাকল টেপ রেকর্ডারে —- ‘গত বেশ কয়েক বছর কাকাবাবুর ব্যবসা আমিই দেখাশোনা করি। ওষুধের আড়ালে তৈরি হয় মাদক। আমি সবই জানি। বিভিন্ন হাত ঘুরে তবে এগুলো বাইরের বাজারে আসে। জীবনে বহু ছেলেকে শেষ হয়ে যেতে দেখেছি। কোন দিন প্রতিবাদ করিনি।সেদিন রাতে অফিস থেকে যখন বাড়ি ফিরছি, আমার চোখের সামনে একটা গাড়ি একজন বৃদ্ধাকে পিষে দিয়ে পাশের পোস্টটাতে ধাক্কা মারল। বৃদ্ধা রাস্তার ধারে ঐ জায়গাটাতেই ভিক্ষা করতেন —- তৎক্ষণাৎ মারা গেলেন। পুলিশ গাড়ির চালককে গ্রেফতার করল। গাড়ি থেকে তাকে যখন বার করা হল তখন দেখলাম মাদকের নেশায় তার প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থা।
পুলিশ চলে যাওয়ার পরও আমি সেখানে প্রায় এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখের সামনে বছর কুড়ি আগের একটা ঘটনা ঘটে চলল। একটা গাড়ি দু’জন স্বামী-স্ত্রীকে পিষে দিচ্ছে। এ রকমই এক রাতে। এই রাস্তাতেই। গাড়ির চালকের আসনে কে জানেন মিঃ দত্ত —- কাকাবাবু; আর যাদের পিষে দেওয়া হল তারা কে জানেন —- আমার বাবা-মা . . .’
দত্ত অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন —- ‘আপনার বাবা-মা . . . !’
—- ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। কাকাবাবুর কর্মচারী ছিলেন, অনেক গোপন কথা জেনে ফেলেছিলেন।’
—- ‘তারপর ?’
—- ‘চারপাশের দুনিয়ার সঙ্গে যেন সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল আমার। চারদিক থেকে কেমন একটা অন্ধকার ঘিরে ধরল। কখন বাড়ি পৌঁছেছি খেয়ালই করলাম না। অন্য দিন বাড়ি ফিরে সোজা নিজের ঘরে চলে যাই। কিন্তু সেদিন কি হল জানি না, ঘরে ঢুকে খেয়াল হল আমি নিজের ঘরে নয় কাকাবাবুর ঘরে ঢুকে পড়েছি।
বিছানার উপর কাকাবাবু ঘুমোচ্ছেন। তিনি বরাবর দরজা খুলেই ঘুমোন; দরজা বন্ধ করলে শ্বাসকষ্ট হয়। একবার ভাবলাম ভুল করে ঢুকে পড়েছি, বেরিয়ে যাই। কিন্তু পা সরল না। বাইরের রাস্তায় একদল কুকুর তারস্বরে চিৎকার করে প্রচন্ড আক্রোশে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়া কামড়ি করছে। তাদের মরণপন লড়াইয়ের খুনে-মেজাজ . . . আর এক মুহুর্তও চিন্তা না করে কাকাবাবুর মাথার বালিশটাই চেপে ধরলাম তাঁর মুখের উপর। নিজেকে মনে হল গাড়ি আর বালিশটা চাকা। প্রাণপনে পিষে দিতে লাগলাম কাকাবাবুকে। তাঁর শিথিল দেহটা হঠাৎ প্রাণশক্তিতে সজীব হয়ে প্রবল আন্দোলনে প্রায় ছিটকে যেতে চাইল বিছানা থেকে। ঝটপটানি চলল বেশ খানিক্ষণ। তারপর সব শান্ত, সব স্থির।‘
পলাশ যেন কাঁপছে। ভয়ের ছাপ তার মুখ জুড়ে —- ‘বালিশটা যখন মুখের উপর থেকে সরিয়ে নিলাম তখন রাত ঠিক আড়াইটে বাজে। কাকাবাবুর সাবেকি ঘড়িটাতে ঢং করে ঘন্টা পড়ল। ঘন্টার আওয়াজটা না হলে আরও কতক্ষণ বালিশটা ধরে রাখতাম জানি না।’
হঠাৎই মনে হল এ আমি কি করলাম ? এমন কেন করলাম আমি ? কাকাবাবুর দেহটাকে জোরে জোরে ঝাঁকাতে থাকলাম, যদি তিনি উঠে বসেন। কিন্তু না, তিনি উঠলেন না। তার দেহ তখন ঠান্ডা, নিথর। অনেক্ষণ সেখানেই বসে রইলাম। মাথার ভিতরটা একেবারে শূণ্য। ভাববার চেষ্টা করেও কিছুই ভাবতে পারলাম না। এক সময় একটা কেমন জানি ব্যথা বুকের ভিতর থেকে দলা পাকিয়ে উঠে এলো গলায়; তারপর আবেগ বাষ্প হয়ে বেরিয়ে এলো দুই চোখ দিয়ে।
পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে এলো। ভাবলাম বাঁচতে হবে। কারন ততক্ষণে ভয় আমায় পেয়ে বসেছে। মৃত্যুভয়, ফাঁসির ভয়।
পরদিন ভোরেই গেলাম পরাশরবাবুর কাছে। তাঁকে সব খুলে বললাম। কিন্তু আমার শরীর, আমার মন কিছুই যেন আমার অধীনে নেই। কি বলছি, কি করছি কিছুই বুঝতে পারছি না। কাকাবাবুর চোখ ওল্টানো – জিভ বের হওয়া – মুষ্ঠিবদ্ধ, বাঁকা, ছড়ানো হাত-পা সহ পুরো শরীরটা তখন সর্বক্ষণ আমার চোখের সামনে ভাসছে।
কিছু দিন আগে কাকাবাবুর সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত একটা ব্যাপার নিয়ে সুজনের কথা কাটাকাটি হয়। রাগের মাথায় সুজন সকলের সামনেই কাকাবাবুকে খুনের হুমকি দেয়। এই হুমকির উপর ভিত্তি করেই পুলিশ সুজনকে গ্রেফতার করে। শুরু হয় মামলা . . .’
অফিসার দত্ত এমনিতেই একটু গোমড়া গোছের। এমন জবানবন্দী শুনে তাঁর মুখে কোনও কথাই জোগালো না। তিনি শুধু চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইলেন পলাশের দিকে।
পলাশ আবার বিষন্নভাবে বলল —- ‘পৃথিবীর বুকে আর আমার কোন উদ্দেশ্যই পূরণ হওয়ার নেই। আপনারা আমার বিচারও করতে পারবেন না, সাজাও দিতে পারবেন না। আমি এখন এ সবের অনেক ঊর্দ্ধে। আমার শেষ বিচার হবে রাজাধিরাজের বিচারসভায়।’
পলাশ ধীরে ধীরে চোখ বুজল। দুই রগ বেয়ে দুটি জলের ধারা গড়িয়ে পড়ল বালিশের উপর।
পরদিন দুপুরে সুজন যখন বাড়ি ফিরল তখন শবযাত্রীরা শ্মশানের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছে …
Tags: শিবাজী সেন
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।