08 Mar

মেটামরফোসিস

লিখেছেন:ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


ফুটফুটে মেয়ের নাম মঞ্জু । যে পড়শী পরিবারে সে মানুষ হল তাদের পদবীই বসেছে তার নামের শেষে। সে মেয়ে এখন মঞ্জু তামাং। তবে মঞ্জু তা মানতে নারাজ। সে বলে আমি মঞ্জু চুডৈল। নেপালী ভাষায় চুডৈল এর অর্থ ডাইনি। কালে কালে বাড়তে থাকল সে। সেই মেয়ে যখন বছর পাঁচেকের পাহাড়ি ঝোরার সামনে দাঁড়িয়ে কলকল করে সে হাসে। কথা বলে চলে অনর্গল। আর যখনই সে প্রচন্ড কাঁদে তখনই সেই গ্রামে একটা অঘটন ঘটে। হয় কেউ মারা যায় নয় প্রবল ভূমিকম্প হয় অথবা প্রবল ধস নামে পাহাড়ে। তার ঠিক পরেই মেয়ের প্রচন্ড জ্বর আসে। চোখদুটো লাল হয় তার। আর সব অঘটন থেমে গেলে মঞ্জুটাও আগের মত সুস্থ হয়ে যায়। মেয়ে কিশোরী থেকে যৌবনবতী হয় ঋতুনির্ঘন্ট মেনেই। ওপর দিকে টানাটানা চোখ, কোঁকড়ানো একমাথা চুল। পাড়ার লোকে তার সব চিহ্ন দেখে তাকে চুডৈল বা ডাইনি বলতে শুরু করে। তারা বলে এর মধ্যে প্রকৃত ডাইনির সব লক্ষণগুলো বিদ্যমান। গুণীন আনে তারা। আর মঞ্জুও অবলীলায় বড় হতে হতে ব্ল্যাক মাজিকের গল্প শোনায়। তাক লেগে যায় গ্রামে। সে নাকি স্বপ্নে প্রতিদিন তার মৃত মায়ের কাছ থেকে জাদুবিদ্যা শেখে।

একদিন বাগানের ওয়েইং শেডের পাশেই দাঁড়িয়েছিল মঞ্জু। কাঁচা চা পাতার ঝুড়ি নিয়ে নামিয়ে রাখছিল তারই সব গ্রামের মেয়ে, মাসীরা। পাতা ওজন হবে আর সেই বুঝে সব পয়সা নেবে। পাহাড়ের চড়াই পথ থেকে তরতর করে নেমে এসে পুরুষমানুষদের কেউ কেউ টিফিনের ঝোলাগুলো নিয়ে আসছিল তাদের দিকেই। হঠাৎ মঞ্জু তুমুল কান্না জুড়ে দিল। সকলে বলল, কি,কেন … ওরে আমার সোনা রে! কি চাই তোর ? লজেন্স নিবি ? রঙ্গীন ফিতে ? মোবাইলে গেম দেখবি ? গান শুনবি ? সে মেয়ে কিছুতেই আর থামেনা। কেউ বলল, ধিঙ্গি মেয়ের আবার শুরু হল ডাইনিপনা । দেখ আবার কি বিপদ আসে আমাদের! তারপরেই শোরগোল, হৈচৈ। পাহাড় থেকে নামছিল এক ট্রাক। বীভত্স এক অ্যাকসিডেন্টে চা বাগানের প্রচুর মানুষ নাকি মারা গেছে শোনা গেল। মঞ্জুর কি হাসি সেই শুনে। সে মাথা ঝাঁকাতেই থাকে আর বলে চলে মঞ্জু চুডৈল বলেছে না? তা হবেই হবে। সকলে বলল, চুপ যা মঞ্জু! কেউ অমন হাসে? কিন্তু মঞ্জুর হাসি আর থামায় কে?

তামসাং চা বাগানের পাশেই চা প্রোডাকশান ইউনিট। সেখানে প্রসেসিং থেকে প্যাকেজিং পুরোটাই হয়। আশপাশের গ্রামের গোর্খা মহিলারা সব এই বাগানের কর্মী। চা পাতা তোলা থেকে শুরু করে সবধরণের কাজে তারাই ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দেয়। এমনি এক আদিবাসী মেয়ে গোর্খাদের দঙ্গলে বেমানান হয়ে আচমকা উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল কিছু বছর আগে । প্রোডাকশান ইউনিটে কত পুরুষমানুষ! মুন্সীবাবুর পর হেড চাপরাশি। তারপর কামদারী, হেড চৌকিদার, জুনিয়ার সুপারভাইজার। তারপরে প্লাকার্স মেয়েগুলো চা পাতা তুলে নিয়ে আসে। বাগানের ওয়েইং শেডে চা পাতা এনে জড়ো করে সকলে চলে যাবার পর সেই আদিবাসী মেয়েটা আলো আঁধারিতে একজন পুরুষকর্মীর কামপিপাসার শিকার হল চরমভাবে । তারপর সে মেয়ে কিছুদিনের মধ্যেই অন্তঃসত্ত্বা হল। এবার আর কি? পাহাড়ি মেয়েরা খুব লড়াকু তায় আবার আদিবাসী। সে ছিল চুপচাপ। কাঁচা চা-পাতা জমা করতে এসে রোজ দেখা হত লোকটার সঙ্গে । আভাসে ইঙ্গিতে কিছুই বলত না সে। লোকটাও ঘাঁটাত না মেয়েটাকে। এগিয়ে এল তার প্রসবের দিন। তার আগেই সে ছুটি নিল। কিন্তু সে তখন আক্রান্ত প্রি-এক্লেমপ্‌সিয়ায়। হাত-পা সব ফুলতে লাগল। সর্বক্ষণ যেন একটা হ্যালুসিনেশান হয় তার। তার সাথে শুরু হল ভুল বকা, খিঁচুনি। ঘর থেকে বেরিয়ে একদিন পাহাড়ের পিছনে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে সে কেমন জানি হয়ে গেল। তখন গ্রামের লোকে তাকে নিয়ে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করে দিল। তারপর স্যালাইন থেকে শুরু করে যন্ত্রণা ওঠার ওষুধপত্র দিয়েও সুখপ্রসব হলনা। বাচ্চা মেয়েটা বেঁচে গেল আর তার মা টা মারা গেল। চা বাগানের যে লোকটা ঐ শিশুর বাপ সে তখনো মুখে কুলুপ আঁটা। সেই শিশুটি বড় হতে লাগল এক গোর্খা পড়শীর কাছে। এই হল মঞ্জু।

মঞ্জু দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছিল । তামসাং এর প্রকৃতি, জনপদ, চা বাগানের সবুজ তার বড্ড প্রিয়। সে চীৎকার করে বলছিল সেদিন… বুঝলি মা? এইবার ট্রাক অ্যাক্সিডেন্টে সেই লোকটাকে চিরকালের মত শেষ করে দিয়েছি আমি। প্রাণে মারিনি। শুধু খোঁড়া নয় রে, এক্কেবারে খোজা করে দিয়েছি। আমাকে এবার তুই মঞ্জু ডাইনি থেকে কেবল মঞ্জু করে দে!

 

Tags: ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ