03 Oct

মায়া দর্পণ

লিখেছেন:নির্মল ভর্মা


ব্যালকনিতে রূপালী বালির মিহি স্তর জমেছে। হাওয়া বইলে রোদ ঝিকমিক করে,

নাচতে থাকে অলস ধুলো। যুদ্ধের সময়ের ব্যারাকগুলো তুলে ফেলা হচ্ছে। বালি এবং আবর্জনার স্তূপ এমনভাবে জমেছে যেন ফোঁড়া হয়েছে কাঁচা রাস্তাটার মাথায়।

জানলা দিয়ে সমস্তই দেখা যায়। সকাল থেকে সন্ধে অবধি নানা রঙের ছায়া টিলায় ফিচলাতে থাকে।

দূর থেকে নিরন্তর কানে আসে পাথর ভাঙার মেশিনের শব্দ, দৈত্যের গর্জনের মতো … ঢেউয়ের … ঘড়ঘড় …. ঘড়ঘড় …. ঘড়ঘড় …. ঘড়ঘড় … ঢেউয়ের মতো শব্দটা আছড়ে পড়ে দুপুরের কাঁচা ঘুমে। চমকে ওঠে তরণ। মাথায় হাত দিয়ে বোঝে ঘামে চুলটা লেপটে গেছে। টিপের কুমকুম ছড়িয়ে পড়েছে দুই ভুরুর মাঝে। মনে হয় যেন এতক্ষণ জেগে ছিল। সত্যি সত্যি ঘুম ভাঙার পর বুঝতে পেরেছে, ঘুমের মধ্যেও এ সমস্তই ভাবছিল। দুপুরের ঘুম তো অর্ধকে চোখে, অর্ধকে বাইরে।

টিপটা মুছে নিয়ে পাম্পের জল ছিটিয়ে দিল চোখে-মুখে। বাথরুমের খোলা জানলা দিয়ে মাঠের সেই জায়গাটা চোখে পড়ে, যেখানে ব্যারাক ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ভাঙা কঙ্কালের মতো দালানখানি দাঁড়িয়ে। শুকনো বালি খাঁ খাঁ রোদে ঝিকমিক করছে মুক্তোর মতো। তরণের মনে হয়, দাঁতে যেন বালি কিচকিচ করছে।

দেখ্‌ তো তরণ, বাবা উঠেছে কিনা, তাহলে ওঁর ঘরে গড়গড়াটা রেখে আয়। রান্নাঘরের লাগোয়া ঘরটি থেকে পিসি বলে। এই বয়সেও পিসির সব মনে থাকে। যেন উঠতে-বসতে শয়নে-স্বপনে তার চেতনার সূত্র বাবার দিনচর্যার সঙ্গে বাঁধা। বসে বসে ঝিমোয়, আশপাশের প্রতি কেমন যেন নির্লিপ্ত। অথচ কীভাবে যে বাবার যাবতীয় প্রয়োজনের আভাস পেয়ে যায়, ভেবে তরণের বড়ই বিস্ময় জাগে।

সন্ধ্যা নামতেই দেওয়ান সাহেব বন্ধুদের প্রতীক্ষা.অধীর হয়ে ওঠেন। স্টেশনে খানিকক্ষণ হেঁটেই ফিরে আসেন, কেউ এসে যেন ফিরে না যায়। এসেই পিসিকে জিজ্ঞেস করেন, কেউ আসেনি তো? সে হ্যাঁ­-না ছাড়া উত্তর দিতে পারে না। এখনো দাদাকে ভীষণ ভয় করে। যখন ছোট ছিল, তখনো মাথা নিচু করে থাকত। বিধবা হলে দাদা কিছু টাকা মাসোহারা বেঁধে দেন। এই বয়সে, অন্য মেয়েমানুষের অভাবে এসে রয়েছে – তা-ও এত বড় বাড়িতে কার্যত সে একা থাকে। তরণ না থাকলে, মুহূর্তের জন্যেও তার পক্ষে এখানে একা থাকা দুষ্কর।

রোদটা সরে গেলেই ভিড় জমে বারান্দায়। সরকারি সুপারভাইজার মি. দাস থেকে শুরু করে বড় ঠিকাদার মেহেরচাঁদ পর্যন্ত সবাই কাজের শেষে বারান্দায় বিশ্রাম করতে বসেন। নির্জন প্রান্তরটায় আছেই বা কী, যেখানে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করা যায়? গোয়ালাদের ঝুপড়ি, দুটো একটা পান বিড়ির দোকান, ধাবা আর টিলার ওপরে কাল-ভৈরবীর মন্দির। শুধু দেওয়ানসাহেবের বাড়িতেই যা প্রবাসী ভদ্রলোকরা খানিকক্ষণ গল্প-স্বল্ব করে মন হালকা করে যান।

তরণ, দাসবাবুর জন্য গড়গড়াটা সেজে আন্‌ তো দেখি। দরজার দিকে মুখ করে বাবা বলেন। ওঁর চোখ-মুখ থেকে ক্লান্তির স্পর্শ মিলিয়ে যাচ্ছে। দাসবাবু যখন এসেছেন, অন্যরাও এসে পড়বেন।

– আজ বড্ড দেরি করে ফেললেন যে? সাইরেন তো অনেক আগেই বেজেছে।

দাসবাবু নাদুসনুদুস শরীরটা নিয়ে চেয়ারে বসে পড়েন। কথা বললে তাঁর বাঁধানো দাঁত ক়িমিড় করে ওঠে ­– খালপাড়ে জমি দেখতে গিয়ে আটকে পড়ি নতুন পেট্রোল পাম্পে। এখানে আর পেট্রোলের অভাব থাকবে না, দেওয়ানসাহেব।

তরণ গড়গড়াটা নিয়ে এলে দাসবাবু যেন গুটিয়ে গেলেন। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে অথচ কোনো মেয়ের মুখোমুখি হলে এখনো খাবড়ে যান।

তরণ ফিরে গেলে কিছুটা স্বাভাবিক হন। গলাটা পরিষ্কার করা সত্ত্বেও কথা বলতে গিয়ে ঘড়ঘড় করে ওঠে – দেওয়ানসাহেব, ক’দিন হরিদ্বার হৃষিকেশ ঘুরে এলেই তো পারেন? মেয়েটার হয়তো ভালো লাগবে। একা থেকে থেকে নিশ্চয় একঘেয়ে লাগে। দাসবাবু তরণের নাম নিতে পারেন না। সে আর একটু ছোট হলে, নামটা উচ্চারণ করা সহজ হয়ে যেত।

বাবা চুপ করে তাকেন। বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করেন ঠিকই, তবু তাদের নিজের চেয়ে ছোট মনে করেন। এত ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও কোথাও একটা গন্ডি টেনে রেখেছেন, যা পেরোবার দুঃসাহস আজও কেউ করতে পারেনি।

তরণ দাসবাবুর কথাটা শুনে সহসা থমকে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে সচল হল। পুরনো কাপড় সেলাই করছে পিসি। তার চোখ বাঁচিয়ে ঘরে ফিরে আসে। দরজা ভেজিয়ে অনেকক্ষণ হেলান দিয়ে শুনতে থাকে সেই সুচিভেদ্য মৌনকে যা ছড়িয়ে রয়েছে বাড়ি জুড়ে।

জানলা থেকে বারান্দাটা পরিষ্কার দেখা যায়। যেদিন সন্ধ্যায় বন্ধুরা আসেন না উনি একা একা চোখ বুজে বসে থাকেন। গভীর বিষন্নতা চারদিক থেকে ছেঁকে ধরে। তরণ অনেকবার ভেবেছে, এ রকম সময়ে বাবার কাছে বসে দুটো কথা বলবে। শেষ পর্যন্ত তারা দু’জনেই তো রয়েছে, যারা পরস্পর স্মৃতি-রোমন্থন করতে পারে। তবু কখনো পা ওঠে না, শুধু জানলা দিয়ে ওঁকে চুপচাপ দেখে যায়।

সাঁই সাঁই হাওয়া বইছে দুপুর-সন্ধ্যা…। টিলার মাটি, গরম বালি বারবার দরজায় ধাক্কা দেয়, পথ না পেয়ে ছড়িয়ে পড়ে উঠোনে।

মাঝে-মধ্যে বারুদ দিয়ে পাথরের চাঙড় ভাঙা হয় রাস্তাটা সমতল করার জন্য। বিস্ফোরণ হলেই পিলে-চমকানো শব্দ হয়, ভূমিকম্পের মতো … দূর দূর পর্যন্ত হায়োয়ওড়ে বিপদের লাল পতাকা।

ঝিমোতে ঝিমোতে তরণ আচমকা ডেরে ওঠে, যেন কেউ ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিয়েছে। মাঠময় নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়েছে সন্ধ্যার ম্লা-হলদেটে ভাব।

পিসি ঘরে ফিরে আসে। জানলার ধারে তাকে ঝিমোতে দেখে বিরক্ত হয় খুব – তোকে না কতবার বলেছি, সন্ধ্যাবেলা অন্ধকার ঘরে বসতে নেই। শম্ভুর সঙ্গে একটু ঘুরে এলেই পারিস।

ঠিক তখুনি সিঁড়িতে কার যেন পদশব্দ শোনা যায়। তরণের চোখ দুটি অমনি চলে যায় জানলাটার দিকে। ইঞ্জিনীয়ারবাবু এসেছেন।

ভদ্রলোক অদ্ভূত! এমন ভারিক্কি চালে চলাফেরা করেন যে সারা বাড়ি কেঁপে ওঠে।

মাস চার-পাঁচ আগে সরকারী আর্কিটেক্ট হয়ে এসেছেন, তবে সবাই ওঁকে “ইঞ্জিনীয়ার বাবু’ বলেই সম্বোধন রে। হাঁটাচলা, কথাবার্তায় এমন একটা ভাব যেন অনেক বছরের যাতায়াত। অবশ্য উনি বাবার নিয়মিত আসা বন্ধুদের মধ্যে পড়েন না। বন্ধু বলাও মুশকিল। কারণ বয়সে বাবার অর্ধকে। বাবাও ওঁর সঙ্গে কিছুতেই খোলামেলাভাবে মিশতে পারেন না।

তরণ ঘাবড়ে গি‍য়ে চুলটা গুছিয়ে নেয়, কোথাও ফাঁপিয়ে দেয় হালকা করে। পাউডার বোলাতেই চোখ কটকট করে ওঠে। কপালে টিপ দিতে গিয়ে ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে হাতখানি। ভাবে, একি ভ্রম? না, নিজেকে নিয়ে মনে কোনো ভ্রম নেই। মুখের আকর্ষণ, যার যা-ই থাক, সে জানে তার নেই। সেজন্য দুঃখও নেই মনে। এককালে পথে যেতে যেতে কেউ তাকিয়ে দেখলে দেহমনে শিহরণ খেলে যেত। ছুটে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকত আয়নার সামনে। লোকে তার মধ্যে কী দেখে? বিচিত্র প্রশ্নটার উত্তরের আশায় কতক্ষণ যে বুক কাঁপত!

এখন কেউ চেয়ে দেখলে ভারি বিস্ময় জাগে। মনে হয় লোকটার সঙ্গে একাত্ম হয়ে তারই কৌতুলপূর্ণ দৃষ্টিতে নিজেকে দেখছে …

– আপনি এখনো বসে যে?

তরণ চমকে ওঠে। দরজায় ইঞ্জিনীয়ারবাবু দাঁড়িয়ে।

– এইমাত্র ভাবছিলাম বারান্দায় যাব। চা খাওয়া হয়েছে?

– পরে একদিন চা খেতে আসব. যেদিন আপনি বারান্দায় যাবার সময় পাবেন। আজ একটু তাড়া আছে।

তরণ সামনে জলচৌকিটা পেতে দেয়। – বসুন, কিছু খেয়ে যান। কবে তো এলেন।

তরণ যেতে যেতে উদ্যত হলে ইঞ্জিনীয়ারবাবু থামিয়ে দিলেন – দেখুন, থাক ওসব। সবে শহর থেকে ফিরেছি। রাস্তায় যা ধুলো খেয়েছি, তাতেই পেট ভরে গেছে।

উনি হাসলে তরণের মনে হয় সবাই সম্ভ্রম করে যতই “ইঞ্জিনীয়ারবাবু’ বলে ডাকুক, বয়সে তার চেয়ে ছোটই হবেন। ওঁকে বাবার বন্ধুদের মধ্যে দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিল। বয়স্কদের মধ্যে কলেজ ছাত্রের মতো দেখতে ইঞ্জিনীয়ারবাবুটি ঠিক মানানসই ছিলেন না।

– ওদিকে বুঝি আর যান না? মন্টুরোজ আপনার খোঁজ নেয়।

মন্টু ইঞ্জিনীয়ারবাবুর চাকর, তরণ লাইনের ওপারে ঘুরতে গেলে দেখা হয়ে যায়।

– যাব। থাকবেন তো।

– ও সপ্তাহে আসুন। চার-পাঁচটা দিন একটু ব্যস্ত থাকব।

ইঞ্জিনীয়ারবাবু যাবার আগে রুমাল দিয়ে চশমার কাচটা পরিষ্কার করলেন।

তরণের চোখ সেই জায়গাটায় স্থির, কিছুক্ষণ আগে যেখানে উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন।

ভদ্রলোক কেমন যেন … খট্‌খট্‌ করে সিঁড়ি ভাঙলে সারাটা বাড়ি কেঁপে ওঠে।

জানলার ওপাশে রেল লাইনের ওপর অস্তগামী সূর্যের রক্তরেখা। এবড়োখেবড়ো পাথরের মাঝে শ্রমিকদের কটেজ, সন্ধ্যার হলদে রোদে ছোট ছোট বাক্সের মতো দেখায়। কালী-মন্দিরের আশপাশের হালকা গোলাপী মেঘটা ক্রমে জমাট হয়ে উঠছে।

তরণ পালঙ্কের কাছে সরে এল। অসমাপ্ত চিঠিটা এখনো বালিশের নিচে চাপা। সকাল থেকে দাদাকে লিখতে বসলেও পাঁচ-ছ লাইনের বেশি লিখে উঠতে পারেনি। লিখতে বসলেই সময়ের আবছা আবরণ ভেদ করে দাদার চেহারাটা চোখে ভেসে ওঠে। সেই চেহারা না, যা বাবার সঙ্গে ঝগড়়া করে যাবার সময়ে সঙ্গে নিয় গিয়েছিল। সেই ভয়াবহ মুখভঙ্গি এত বছর পর আজও মনে পড়লে … বুকটা কেঁপে ওঠে। না, সেই চেহারা না। আর একটা … খুব সরল আর উদাস … তখন মা মারা গেছেন। গোড়া থেকেই বাবাকে এমন ভয় করে যে মন ভরে কাঁদতেও সঙ্কোচ হোত। তখন দাদা এসেছিল। “দেখছিস না তরণ, বাবা কেমন একা হয়ে গেছে’, কাঁপা-কাঁপা ঠোঁটে ও বলেছিল, “আমাদের ওঁর সঙ্গে থাকতে হবে। … ক’দিনেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে’।

আজ তরণ ভাবে, কোথায় তা হতে পারল? তখন সে ছোট। দাদা কেন চলে গেল, বাবা তাকে আটকাতে পারেনি কেন – কিছুই বুঝতে পারেনি। আজ মনে হয়, তাদের মাঝে মা একটা যোগসূত্র ছিল। মা চলে যাওয়ায় একত্রে থেকেও তারা পরস্পরের অচেনা হয়ে গেছে।

পিসি খেতে ডাকতে এসে, তরণের হাতে কাগজ দেখে শুধাল – কি রে, চিঠি এসেছে?

– দাদাকে লিখছিলাম। কালই ওর চিঠি পেয়েছি।

– যেতে বলেছে?

– লিখছে, ক’দিনের জন্য ওর কাছে যেতে – পিসি, ওখানে যাওয়া যায় না?

পিসি বিস্ফারিত চোখে তরণকে দেখে। অতদূর একা একা যাবে, কল্পনা করাও যে পাগলামা।

– বোনের প্রতি দগদ থাকলে কি.ক’বছরে একবারও দেখতে আসত না?বাপের সঙ্গে ঝগড়া, তাই কি সবার সঙ্গেই সম্পর্ক চুকে গেছে?

কাশির দমকে পিসি বেশি কথা বলতে পারে না। অনেক কথাই দীর্ঘশ্বাসে ডুবে যায়। পিসির চোখে জল দেখে তরণ স্থির করতে পারে নি এটা কি দাদার জন্য, নাকি কাশরি চোটে এমনি বেরিয়ে এসেছে!

পিসি তুমি যাও, আমি আসছি।

ঘরে অসহ্য স্তব্ধতা। বারান্দায় পায়চারি করতে থাকা বাবার ক্লান্ত, উদ্দেশ্যহীন পদশব্দ কানে আসে। ওধারে মাঠের অন্ধকারে মাটির লম্বা-লম্বা ঢিপির হালকা ছায়া জ্যোৎস্নায় প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে।

একটা ছায়া-আঁকা ছবি ভেসে ওঠে। ঢালু উপত্যকায় দূর-দূরান্ত অবধি চা বাগান গাছপালার আড়ালে কোথাও দাদা থাকে। সেখানে নাকি স্টিমারে করে যেতে হয়। স্টিমার চড়তে কেমন লাগে কে জানে!

তরণ সিগন্যালের আলো দেখছে। ধাবমান ট্রেনের চাকার শব্দ বাড়ির দেওয়াল, দূর-দূরান্তের টিলাগুলোকে ঝাঁঝরা করে দিয়ে যায়। পাথর ভাঙার মেশিনের শব্দটা খানিকক্ষণ চাপা পড়ে চাকার নিচে। হেডলাইটের আলোয় ঝোপঝাড় ঝিকমিক করে ওঠে … গভীর নৈঃশব্দ পুনরায় চারপাশটাকে গ্রাস করে।

রাতে পিসি তরণের ঘরে অনেকক্ষণ বসে থাকে। মাঝে মাঝে তরণের দিকে তাকায় আর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুপুরি কাটে।

– ঘুমিয়ে পড়লি, তরণ? শঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করে।

– না, ঘুমোইনি।

তরণ বুঝতে পারে, পিসি কথা শুরু করার উপযুক্ত শব্দ খুঁজছে। সে চোখ বুজে প্রতীক্ষা করে।

– আজ তোর মা’র ঘরে গিয়েছিলাম, খানিকটা থেমে পিসি বলে, অবাক হয়ে গেছি তরণ, কে জানে কতকাল ধরে ও এসব জিনিস অল্প অল্প করে জোগাড় করেছে! বিয়ের শাড়িটা পর্যন্ত বাক্সে তুলে রেখে গেছে।

তরণের মনে সামান্য কৌতুহল জাগে। একদিন মা’রও বিয়ে হয়েছিল, সহজে বিশ্বাস হতে চায় না।

– তোর বাবা তখন সবে দেওয়ান হয়েছে। বিয়ে হয়েছিল খুব ধুমধাম করে। শিখ দরবারে ও-ই একমাত্র হিন্দু দেওয়ান, অনুমতি ছাড়াই যে রাজার সঙ্গে দেখা করতে পারত।

পিসির চোখে একটা খুব পুরনো, অন্তহীন স্বপ্ন ভেসে ওঠে, হাতের জাঁতিটা চলতে চলতে থেমে যায় – একদিন এস্টেটের ইংরেজ রেসিডেন্ট ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। পাড়ার সবাই সবিস্ময়ে বাড়ির সামনে জড়ো হয়েছিল। তবে তোর বাবা নিয়মধর্মরে প্রতি এতটাই নিষ্ঠাবান যে লোকটা চলে গেলে রীতিমতো স্নান করেছিল। মাজতে হয়েছিল সব বাসনপত্তর।

তরণ পালঙ্কে গিয়ে বসে। পিসির মুখে বহুবার এসব শুনলেও প্রতিবারই মনে নতুন করে ঔত্সুক্য জাগে। মনে হয় চুপি চুপি এক মায়াবী জগতে চলে এসেছে …

– তুমি তো সেকালে বাবাকে দেখেছ। তখনো কি আজকের মতোই ভয় করতে?

– আরে ওকে কে না ভয় পেত? পিসির চোখে ম্লান হাসি, সেই ভয়টাই তো আঈজ পর্যন্ত চলে এসেছে। তোর মা আমার চেয়েও বেশি ভয় করত। ও দরবারে গেলে আমরা ঝরোকায় দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। চকচকে চুড়িদার পাজামা, সাদা রেশমী আচকান আর মাথায় গোলাপী রঙের রাজসিক পাগড়ি … আমাদের চোখ সরত না।

পিসির হাতে জাঁতি, চোখ দুটি শূন্যে কোথাও স্থির।

– ভাবি, আজ তোর বাবা যে উঁচু জাতি, বনেদী পরিবারের কথা বলে, তা কি ঠিক? কিছুই তো আগের মতো নেই। আজ আমাদের কোন্ সম্মানটা আছে যে বনেদী পরবিারের ছেলে পাব! তবে ওকে বোঝাবে কে?

পিসির চোখে বিস্ময়। যেন বুঝতে পারছে না, যা নেই, তা আজও কীভাবেজোঁকের মতো সেঁটে আছে। মান-মর্যাদা আর নেই, জমি জায়গা কবেই বিকিয়ে গেছে, বাপ-ঠাকুর্দার চিহ্ন বলতে আছে কেবল বাড়িখানা আর সময়ের ধুলোয় মলিন হয়ে যাওয়া দেওয়ান খেতাব। কিন্তু যা নেই, লোকে তা মানবে কেন?

পিসির গলাটা ভারি হয়ে ওঠে, চোখের পাতা চিকটিক করে। অছট ছোঁটের হালকা হাসির রেশটা যেন মুছতে ভুলে গেছে।

এসব কথা তরণের মোটই ভালো লাগে না। ভালো লাগত যখন মা ঠাট্টার ছলে গয়না দেখাত, যা তার বিয়েতে দেবে। তখন চনমনে উত্তেজনা হোত। বিয়ের জন্য না, গয়নার জন্যও না। বরং সেই অদ্ভূত, এচেনা সুখের জন্য যা তার নিজের। যেখান সে একা।

তরণ ফের শুয়ে পড়ে। জানলা দি‍য়ে নিকষ অন্ধকারে সিকন্যালের লাল আলোটা দেখা যায়। খালপাড়ের ব্যারাকে নিঃশব্দ রাত্রি নেমে এসেছে। সেখানে অন্ধকার ঘুপচি ঘরে ইঞ্জিনীয়ারবাবু থাকেন, কথাটা ভেবেই সে চোখ বোজে।

সেই মুহূর্তে কিছুই মনে তাকে না। পিসি কী বলেছে, তাও মনে নেই। অনকে বছর আগের ঝাপসা অনুভূতি জেগে ওঠেছে। মনে হয় সে যেন টাবের জলে নগ্ন দেহে শুয়ে। মাঝখানে আর কিছু নেই। ক্ষতি-বৃদ্ধি যা-ই ঘটে থার, সবই জলের ওপরে।

– ঘুমিয়ে পড়লি তরণ? পিসি জিজ্ঞেস করে।

তরণ নিজেই স্থির করতে পারে না – সে কি ঘুমের এপারে, নাকি ওপারে। জলে ছায়া ভাসে, অথচ নিচে যে কী গভীর মৌন …

মাঝে মাঝে দেওয়ান সাহেব সারাদিন ঘর ছেড়ে বেরোন না। খাঁ খাঁ করে বারান্দাটা। খালি চেয়ারে গরম বালি আর চুনের স্তর জমতে থাকে। পিসি বারবার ওঁর ঘর অবধি গিয়ে ফিরে আসে। খাবারটাও পাঠিয়ে দিতে বলেন। যেতে-আসতে চোখে পড়ে গেলেও দেখেন না। দেখলেও এমন ভাব করেন যেন চিনতে কষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করেন যাতে কাচে যেতে না হয়। আচমকা মুখোমুখি হয়ে গেলে চোখ সরিয়ে নেন, নইলে পথ ছেড়ে বেরিয়ে যান।

তরণ ভাবে, বাবা এমন সরে থাকেন কেন? বাড়িতে কেমন একটা অস্থিরতা। আগে ক্ষোভ হোত, এখন তাও হয় না। কেবল বিষম রিক্ততায় মনটা ভরে ওঠে। দায়মুক্ত হলেই পারেন। পিসি অনেকবার জোর করে বাবাকে দিয়ে চিঠি লিখিয়েছে, কথাবার্তাও এগিয়েছে। ফটো এবং ঠিকুজি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিবার মাঝপথেই সব থেমে যায়। কারণটা তরণ আজও বুঝে উঠতে পারেনি।

সেই রাতটার কথা মনে পড়লে তরণ আজও শিউরে ওঠে। অন্ধকারে পিসির পদশব্দ এগিয়ে আসছে। সে দমবন্ধ করে শুয়ে।

– পিসি তুমি?

পিসির গলাটা কাঁপছে – তুই কি কিছু শুনেছিস?

তরণ উঠে বসে। চোখ বিস্ফারিত করে অন্ধকারে একটা ছায়া দেখতে পায়।

– কী ব্যাপার পিসি?

– এখানে আর একটা মুহূর্তও থাকতে পারছি না!

– কী ব্যাপার বল না।

– বলার আর কী বাকি আছে! পিসির গলাটা ধরে আসে। তরণ স্তব্ধ চোখে অন্ধকারে চেয়ে থাকে, যেখানে সে দাঁড়িয়ে।

– বাবার সঙ্গে কোনো কথা হয়েছে? তরণ জিজ্ঞেস করে।

– আমার ঘরে ও নিজেই এসেছিল। যা বলার সোজাসুজি তোকে বললেই পারে! তুই তো আর খুকি না, অকারণ আমায় কেন মাঝখানে টেনে আনা!

– কী বলেছিলেন পিসি? তরণের গলায় অদ্ভূত শূন্যতা।

– ওর কথা কিছুই বুঝতে পারি না! বলছিল, তোর মা’র উপস্থিতিতে সব হয়ে গেলেই ভালো হোত। ওকে দীর্ঘক্ষণ পায়চারি করতে দেখে সুযোগ বুঝে বললাম, বনেদী পরবিারের অপেক্ষায় বসে থেকে কী লাভ? উপযুক্ত পাত্র পেলেই হয়। কথাটা শুনে ও আর বসল না। দ্রুতপায়ে গিয়ে দরজায় খিল এঁটে দিল। খানিক পর বেরিয়ে এলে ওকে চেনাই যায় না। চোখ দুটো টকটকে লাল। উসকোখুসকো চুল। তোর মা গত হবার পর ওকে কখনো ওভাবে দেখিনি। হাতের পুঁটুলিটা সামনে ছুঁড়ে দিল – এতে ওর মা’র গয়না আছে। এ নিয়ে যেখানে খুশি যাক। ছেলে চলে গেছে, আমি মরে যাইনি, ও গেলেও কিছু বয়ে যাবে না। অবাক হ‍য়ে গেলাম তরণ! কোনো বাবা কি মেয়ের সম্পর্কে ও কথা বলতে পারে!

পিসির প্রশ্নটা অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হয়। বুঝে উঠতে পারে না, বাবা ঠিক কী চান? নিজেকেই কেমন ভয় করতে লাগল। বাবার সন্দেহ, সেও হয়তো দাদার মতো একদিন ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে। আগে কখনো অমন ভাবেনি। কিন্তু বাবার সন্দেহ মনটাকে অস্থির করে তোলে। সে কি সত্যি সত্যি বাড়িতে থাকতে চায়। হয়তো বাবার সন্দেহটাই ঠিক। ফাঁকা ঘরগুলোকে ভয় পেলেও মনোভাবটা এতদিন গোপন করে এসেছে – সত্যি কি তা-ই?

নিতান্তই সাদামাটা প্রশ্ন। অথচ সেই হাজার হাজার প্রশ্নের একটা, যার কোনো উত্তর হয় না। তরণ তা জানত না বলেই সারারাত বালিশে মুখ গুঁজে থরথর করে কেঁপেছিল।

রাতেই স্থির করে, ক’দিন দাদার কাছে গিয়ে থাকবে।

পরদিন ইচ্ছে সত্ত্বেও বাবাকে যাবার কথা বলতে সাহস পেল না। ক’বার ওঁর ঘর অবধি গিয়েও ফিরে এল। ভয়টা থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারে না। পিসিকে বলেছিল, বাবাকে গিয়ে বলতে।

পিসি সবিস্ময়ে তার দিকে তাকায়। পরে ভেবে দেখে, তরণের যাওয়াই ভালো। সন্ধ্যায় বাবা ডেকে পাঠান। চৌকাঠে তরণের পা দুটো সহসা থমকে যায়, যেন দম আটকে আসে।

– এদিকে এসে বোসো। বাবার গলাটা গম্ভীর।

বালিশে হেলান দিয়ে বাবা বসে, নিথর-নিস্পন্দ। ইচ্ছে হল, ফিরে যায়। তবু পা দুটো নড়ে না।

– শুনলাম, তুমি নাকি ক’দিনের জন্য বাইরে যেতে চাও?

তরণ নিরুত্তর। মনে হয় বাবা তার সামনে দাদার নাম নিতে চান না। কখনো বাবার মুখে দাদার কথা শোনেনি। ওর চিঠি না পড়েই তার কাছে পাঠিয়ে দেন।

– এখানে মন লাগে না তরণ? বাবার কণ্ঠে নিরীহ জিজ্ঞাসা। যেন এই প্রথম এ বিষয়ে ভেবেছেন।

তরণ এক লহমার জন্য চোখ তোলে। হয়তো তাকে ছাড়া উনিও একা বোধ করেন। তার বুক কাঁপতে থাকে। বাবা থেকে যেতে বললে সে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলবে। তাহলে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।

কিন্তু বাবা চুপ করে থাকেন। তরণ চোখ নামিয়ে নেয়। পুণরায় জমাট হয়ে ওঠে স্তব্ধতা।

– বেশ যেতে চাও যখন যাও। আমার কথা ভেবো না। বাবার কন্ঠস্বর একেবারে ভাবলেশহীন।

বেরিয়ে আসার পথে তরণের পা থমকে যায়। বাবা হয়তো কিছু বলবেন। কিন্তু ঘরটায় নৈশঃব্দ ছাড়া কিছু নেই। হয়তো বলার কিছুই ছিল না।

দুপুরে তরণ শুয়েছিল। এতদিনে তার কোনো ক্ষমতা জন্মে থাকলে তা এই – যখন ইচ্ছে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। মনে হয় এতকাল জেগে চোখ খুলে দেখার যে সময়টা পেয়েছে, সবই অস্বাভাবিক। কিছুই পরিপূর্ণভাবে তাচে আসেনি। ঘুমের চৌহদ্দি থেকে ফিরে গেছে। সন্ধ্যায় বেরিয়ে এল। সারা দুপুর শুয়ে থাকায় শরীরটা বেশ ভার-ভার লাগছে। বাইরে সারাদিন বালি উড়েছে, আকাশে হলদেটে স্তরটা যেন জমে বসেছে। তরণ দেখে, বাবা এখনো বারান্দায় আসেননি। ঘরের দরজাটা বন্ধ।

পিসি ঘরে বসে কাশছে আর কী যেন বিড়বিড় করছে। দমকা হাওয়ার স্রোতে কড়কড় করে ওঠে কপাটগুলো।

তড়িঘড়ি পায়ে চটি গলিয়ে পিসিকে জানিয়ে এল, একটু বাইরে যাচ্ছি।

বালিময় প্রান্তরটা বহুদূর বিস্তযত। অস্ত যাবার আগে সূর্যরে হলদে আলো কাঁচা সোনার মতো বালিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। নতুন রাস্তাটার দু’পাশ জুড়ে পাথরের ঢিপি, ছোট ছোট পিরামিড যেন।

সমস্ত পেরিয়ে সে জলের ট্যাঙ্কটার কাছে গেল।

এ সমস্ত দূরের হলেও কত আপন, তরণ বাবে। কতকাল ধরে দেখছে। যুদ্ধের সময়ে যখন ব্যারাক বানানো হচ্ছিল, মিলিটারির ট্রাক ধুলো উড়িয়ে শহরে আসত, তখনো সে এখানে। আজ, নতুন রাস্তা হচ্ছে, ব্যারাক ভেঙে ফেলা হচ্ছে, সবই সকাল-সন্ধ্যা জানলা দিয়ে দেখে আসছে।

ভেবে ভালো লাগে, ক’দিন এ সমস্ত থেকে মুক্তি পাবে। মনের সমস্ত অবসাদ যেন ভেসে যাচ্ছে। দূর থেকে ইঞ্জিনীয়ারবাবুকে আসতে দেখে তাই না হেসে পারে না।

ইঞ্জিনিয়ারবাবু ট্যাঙ্কটার কাছে এসে দাঁড়ান। শোলার টুপিতে রোদের ঝিলিক। জামার হাতা গোটানো, নগ্ন বাহু ধুলো-মলিন। বোতাম খোলা গলার নিচে দু-চার ফোঁটা ঘাম। হাতে বড়সড় বোর্ড। চশমার পেছনে চোখ দুটো আগের মতোই অস্থির অথচ গম্ভীর দেখাচ্ছে।

– হঠাৎ এদিকে যে?

– এই একটু ঘুরতে বেরিয়েছি। ঘরে যা গুমোট, বসে থাকা যায় না। দূর থেকেই আপনাকে দেখেছি, যদিও শোলার টুপিতে চেনা মুশকিল।

ইঞ্জিনীয়ারবাবু হেসে ওঠেন। তরণরে মনে পড়ে, প্রথম প্রথম দরজার পেছনে দাঁড়ি‍য়ে ওঁর হাসি শুনে মনে হত বয়সে তার চেয়ে কিছু ছোই হবেন।

– এরমধ্যে শহরে যাননি?

– কী করে যাব? ইঞ্জিনীয়ারবাবু নিজের সমস্যা এমনভাবে বলেন যে তরণের মনে হয়, ওঁর খুব আনন্দ হচ্ছে।

– কী করে যাব! তিন দিন হল একটাও লরি যায়নি। আমার বা মন্টুর পক্ষে অতদূর যাওয়া সম্ভব না।

– লরি যায়নি?তরণ সবিস্ময়ে ওঁকে দেখতে থাকে, তাহলে খাবার কে এনে দেয়? এখানে তো বালো হোটেল নেই।

– আপনি মন্টুকে চেনেন না, ইঞ্জিনীয়ারবাবু হো হো করে হেসে ওঠেন, শহরে যেতে আমাদের দু’জনারই সমান আলস্য। তাই ও এখানে একটা ভালো ধাবা খুঁজে বের করেছে। সেখান থেকেই দু’বেলার খাবার নিয়ে আসে।

তরণ ওঁর দিকে চেয়ে থাকে। অদ্ভূত লাগছে। ভদ্রলোক কেমন যেন! নিজের শহর, ঘরদোর ছেড়ে কতদূর চলে এসেছেন। চাকরটা ছাড়া এই বিদেশ-বিভুঁয়ে ওঁর কেউ নেই।

– চলুন, আপনি তো ঘুরতে বেরিয়েছেন।

এবড়োখেবড়ো কাঁচা রাস্তায় দু’জনে নীরবে হাঁটতে থাকে। চোখ বুজে আসে দমকা হায়োর স্রোত ভেসে এলে। মুখে বালি কিচকিচ করে। সাদা পর্দার মতো একটা কিছু চোখ ঢেকে দেয়। শ্রমিকদের কটেজ এবং ছাপরার ওপর কালী মন্দিরের আলো জ্বলে গেছে। যদিও পাথরের চাঙড়, মাটির ঢিপিতে মরা রোদটা এখনো এসে পড়ছে।

আচমকা ইঞ্জিনীয়ারবাবু দাঁড়িয়ে পড়েন।

– ওই যে টিলাগুলি দেখছেন, কটেজগুলরি পেছনে … ওঁর চোখ দূরে কোথাও স্থির।

তরণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকায়।

– রাস্তাটা তৈ‍রি হয়ে গেলে ওগুলি ভেঙে ফেলা হবে। রেল লাইনের সামনে যে পোড়ো জমিটা দেখছেন ওতে চাষ-আবাদ হবে। খালপাড়ে কারখানা বসবে। দেখতে দেখতে বদলে যাবে সব।

ইঞ্জিনীয়ারবাবুর গলায় উৎসাহের ছোঁয়া। সন্ধ্যার মরা রোদটা চশমার কাচে বারবার ঝিলিক দিচ্ছে।

উনি আরো অদ্ভূত অদ্ভূত কথা বলছেন। তরণ বিস্মিত হয়ে শুনে যায়। ভাবে, যতই কলেজ ছাত্রের মতো দেখাক, আসলে অনেক কিছুই জানেন। তার হাসি পাবার কারণ এটুকুই, ভদ্রলোক অমন উত্তেজিত হয়ে কথা বলছেন কেন. ‍সে তো বিরোধিতা করছে না!

ওরা রেল ফটকের কাছে এসে দাঁড়ায়। ইঞ্জিনীয়ারবাবু একরকম নীরব, স ন্ধ্যার নেমে আসা শূন্যতা যেন ওদেরও স্পর্শ করেছে। আকাশে কাস্তের মতো চাঁদ। টিলার উঁচু-উঁচু রেখা, দুপুরে পরষ্কিার দেখা যাচ্ছিল, সন্ধ্যার ফিকে আলোয় হালকা হয়ে আসছে। যেন নিজ নিজ দূরত্ব পেরিয়ে একত্রিত হয়েছে।

– আপনি কখনো অসমে গেছেন?

– অসম?না তো। কেন, কী ব্যাপার?

– না, এমনি মনে পড়ে গেল। সেখানে আমার দাদা থাকে, আপনাদেরই বয়সী।

– ও! ইঞ্জিনীয়ারবাবুর চোখ অন্যদিকে।

তরণকে ফিরতে হবে, তবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কমে ঐসে হাওয়া। ট্যাঙ্কের পাশে ছোট ছোট বাড়ির নীল ছাদ সন্ধ্যার পড়ন্ত রোদে চকচক করছে।

– এবার ফিরে যান, অন্ধকার হয়ে এল। বলেন তো মন্টুকে সঙ্গে পাঠিয়ে দিই?

– না, একাই যেতে পারব। কতই বা দূর!

ইঞ্জিনীয়ারবাবু লাইনটা পেরিয়ে মাঠের বাইরে চলে গেলেন।

তরণ অনেকক্ষণ ওঁর দিকে চেয়ে থাকে। অস্তগামী সূর্য‍ের শেষ আভাটুকুও মিলিয়ে যাচ্ছে।

ফিরে যেতে যেতে তরণ একবার থামে। যেন বহুকাল পর সে রহস্যময় সুখের অনুভূতি পেয়েছে। ঘনায়মান অন্ধকারের স্নিগ্ধতায় সমস্ত দুশ্চিন্তাই নিরর্থক মনে হয়। বুঝতে পারে না, এতদিন কিসের ভয় পাচ্ছিল? মানুষ একবারই বাঁচে নিজের মতো করে। ইঞ্জিনীয়ারবাবুর কথাই ধরা যাক, ঘরদোর ছেড়ে এতদূর এসেছেন। কিসের জন্য?ওঁর কেমন লাগে?

অন্ধকার মাঠে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, অতীতের সমস্ত ক্লান্তিই যেন ধুয়ে গেছে। শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে তৃপ্তির ঢেউ। না, বাড়িতে আর ফিরবে না। নিজের মতো করে বাঁচবে। কারো মোহ ধরে রাখতে পারবে না তাকে।

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে ওপরে তাকায়। বারান্দায় জমাট অন্ধকার। সারা বাড়িতে নৈশঃব্দ চেপে বসেছে। কেবল রান্নাঘরে আলো জ্বলছে, তার একটা ধূসর রেখা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করছে।

দরজার কপাট খেলা! তরণের হৃৎকম্পন বেড়ে যায় দ্রুত। বাবা কি একা একা বসে আছেন!

পা চেপে কাছে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কপাটে ঠেলা দেয়। অন্ধকারে প্রথমে কিছুই ঠাহর করতে পারে না। পরে এক কোণে স্থির হয়ে যায় চোখ দুটো।

একদৃষ্টে চেয়ে থাকে তরণ। ঘুমের ঘোরে হেঁটে চলা মানুষের মতো বাবা ঘরময় পায়চারি করছেন। কখনো দাঁড়িয়ে পড়ছেন, যেন ভুলে যাওয়া কোনো কথা হঠাৎ মনে পড়েছে। আচমকা পা দুটো ঘুরে গেল। তাকে তুলে রাখা বহুকালের পুরনো একটা ছবির সামনে এসে দাঁড়ালেন। নীল শিরায় ভর্তি কাঁপা-কাঁপা হাতে ফ্রেমের ধুলোটা পরিষ্কার করলেন। ঠিকমতো পরিষ্কার হয় না। কেবল আঙুলের ছাপ কাচে লেগে থাকে।

পঞ্াচম জর্জরে সিলভার জুবিলী অনুষ্ঠানে যে ফটোটা তোলা হয়েছিল, মন্তমুগ্ধের মতো সেটা দেখছেন। রাজ্যের ইংরেজ রেসিডেন্ট ও অন্যান্য রাজকর্মচারীর মাঝে যেখানে উনি বসে, সেই অংশে চোখ দুটি স্থির। যেন নিজেকেই খুঁজে পেতে চেষ্টা করছেন।

দপজার পাসে দেওয়াল ঘেঁষে তরণ দাঁড়িয়ে। চোখে দেখেও যেন বিশ্বাস হতে চায় না। াার্ধক্যকে এই প্রথম অনাবৃত অবস্থায় দেখে নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িে. থাকে।

বাবার রুক্ষ সাদা চুল, সরু হাতের নীল শিরা, মুখের অজস্র বলিরেখা – সবই কি তার চোখের সামনে হয়েছে?

– বাবা! আর্দ্র হয়ে ওঠে চোখ দুটো, সে সামনে এসে দাঁড়ায়। জীবনে প্রথম ওঁর এত কাছে আসার সাহস পেয়েছে।

বাবা ধীরে ধীরে মাথা তুলে তরণকে দেখলেন, দেখতে থাকলেন।

– তুমি এখানে কেন? ওঁর গলাটা কেঁপে ওঠে। চোখে কাতরতা।

বেরিয়ে এসে তরণ দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ি‍য়ে থাকে অন্ধকার বারান্দায়। মাথায় একটা দুর্ভাবনা পাক দিয়ে ওঠে। বাবা তাকে কোনোদিন ছাড়বেন না। সেও ওঁকে ছেড়ে যেতে পারবে না। একাই থাকবে, তবে বাবার সঙ্গে বাঁধা হয়ে। ওঁর একাকিত্ব আজীবন তার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে।

সন্ধ্যার সেইসব মুহূর্ত, রেল লাইনের ধারে, হয়তো ভুল। একটা সুখময় ভ্রম ছাড়া কিছু না। তেমন সময় জীবনে ফিরে আসবে না।

সারারাত কাশির শব্দ শোনা গেল পিসির ঘরে। মধ্যরাতে বাবার ঘরে গিয়ে তরণ দীর্ঘ সময় দরজায় হেলান দিয়ে রইল। মনে হল, মা যেন আজই মারা গেছে। যে অশ্রু কৈশোরে বেরিয়ে আসতে পারেনি, এতকাল অপেক্ষা করছিল রাতটার …।

তরণ জানলাটার পাশে এসে দাঁড়ায়। মাঠটা ধু ধু করছে ফিনফি‍নে জ্যোৎস্নায়। লাইনের ওপারে তিন-চারটে টিমটিমে আলো। ওদিকেই ইঞ্জিনীয়ারবাবু থাকেন। ওঁর কথাটা মনে পড়ে। ক’বছরেই বদলে যাবে সব। বিষণ্ণ হাসি ছড়ি‍য়ে পড়ে তার চোখে।

তরণ এসে পালঙ্কে শুয়ে পড়ে। ক্লান্তিতে চোখের পাতা ভারি হয়ে এলেও ঘুম আসে না সহজে। মাঝে সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হলে মনে হয় সামনে দাদা দাঁড়িয়ে … ঠিক সেই মুখ, উদাস চোখ … তরণ দাদার কথা ভাবে। কতকাল দেখেনি, নিশ্চয় অনেক বদলে গেছে…

চোখে একটা ছায়া-আঁকা ছবি ভেসে ওঠে। কোথাও অনেক দূরে, চা বাগানের আড়ালে দাদার বাংলো। সেখানে নাকি স্টিমারে করে যেতে হয়। স্টিমারে চড়তে কেমন লাগে কে জানে!

হিন্দি থেকে ভাষান্তর : অনিন্দ্য সৌরভ

Tags:

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ