29 Sep

নিছক গল্পকথা

লিখেছেন:সিদ্ধার্থ সান্যাল


‘ মধু, এতো তাড়া করছো কেন, বোসো ? আজ রবিবার, এই তো এলে ! এসো, একত্রে চা পান করতে করতে প্যারাডাইজ লস্ট পড়া যাক !’

গৌরদাস আলমারী হইতে একটি চামড়ার বাঁধাই ক্ষুদ্র বহি বাহির করিতে করিতে কহিলেন !

যাহাকে বলা হইলো, তিনি শ্যামবর্ণ, অতি উজ্জ্বল চক্ষুবিশিষ্ট, ইউরোপিয়ান পোশাকে সুসজ্জিত এক বয়োত্তীর্ণ  কিশোর, গুচ্ছ গুচ্ছ ঘনকেশ তাহার মস্তকের উপর হইতে স্কন্ধদেশ পর্যন্ত নামিয়া  আসিয়াছে !

খিদিরপুর নিবাসী কলিকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার রাজনারায়ণ দত্তের এই অতি মেধাবী পুত্র মধুসূদন এই মুহূর্তে প্রিয় বন্ধু  গৌরদাস বসাকের বৈঠকখানা কক্ষে অস্থির ভাবে পায়চারী করিতেছেন !

মধু কোটের ঘড়ি-পকেট হইতে সুদৃশ্য সোনার ঘড়ি বাহির করিয়া সময় দেখিলেন, তারপর বলিলেন,

-‘গৌর, তুমি বুঝছো না ! রবিবারের ‘মাস’ শেষ হবে বেলা এগারোটায়  !  এখন বেরিয়ে পড়তে না পারলে এগারোটার আগে  সার্কুলার রোডের জোড়া গির্জার সামনে পৌঁছতে পারবো না ! তুমি তো জানো, সপ্তাহে একবার অন্তত কমলমণি-র দর্শন না পেলে আমার চিত্ত শান্ত থাকে না ! আমি পুরো সপ্তাহে এক ছত্রও লিখতে পারি না !’

-‘মধু, তুমি যা ভেবে রেখেছো তা হবার নয় ! এই বিধর্মের বিবাহ হিন্দু সমাজ মানবে না কিছুতেই ! তোমার বাবা, মা জাহ্নবী দেবী মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত  হয়ে পড়বেন !’

-‘ গৌর, তোমাকে এখন পুরোটা জানানোর সময় এসেছে ! কারণ তুমিই  আমার বিবাহপ্রস্তাব নিয়ে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনবাবুর গৃহে যাবে ! আমি বিবাহব্যবস্থার সমস্ত রীতি ভাঙতে চাই ! আর ভালো করে শোনো, কমলমণিকে বিবাহের উদ্দেশ্যে আমি ক্রীশ্চান হবো স্থির করেছি ! কৃষ্ণমোহনবাবু সম্মত আছেন, ধর্মান্তরিত হলেই বিবাহ হবে !’ মধু ঘরের বাহিরে যাইতে উদ্যত হইলেন  !

গৌরদাস প্রিয়বন্ধুর মানসিক দৃঢ়তা সম্পর্কে সম্যক অবহিত, তাই তিনি  স্তব্ধ হইয়া বসিয়া থাকিলেন  !

রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের বৈঠকখানা কক্ষ  !

গুরুতর আলোচনা চলিবার হেতু রেভারেন্ড-পত্নী বিন্ধ্যবাসিনী দেবী-ও কক্ষে উপস্থিত !

গত পরশ্ব কৃষ্ণমোহনের ব্যবস্থাপনায় মধুসূদন খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হইয়াছেন !

এখন কলিকাতার বিশিষ্ট হিন্দুসমাজ যৎপরোনাস্তি বিচলিত হইয়া এই দুর্ঘটনার অন্তর্নিহিত গূঢ় কারণ খুঁজিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিতেছেন !

এই মুহূর্তে গৌরদাস প্রায় নতমস্তকে বন্দ্যোপাধ্যায় দম্পতির সামনে দন্ডায়মান !

ক্ষণকাল পূর্বে তিনি প্রিয় বন্ধু মধুসূদনের সঙ্গে কৃষ্ণমোহন-তনয়া কমলমণির বিবাহপ্রস্তাব উভয়ের সামনে রাখিয়াছেন !

কৃষ্ণমোহন এবিষয়ে প্রথমেই পত্নীর মতামত জানিতে চাহিলেন !

কক্ষে ক্ষণকালের জন্য সম্পূর্ণ নীরবতা !

নীরবতা ভাঙিয়া বিন্ধ্যবাসিনী কহিলেন, ‘মধু খুব ভালো ছেলে, আমি তাকে পছন্দ করি, তোমার কাছে শুনেছি সে অত্যন্ত মেধাবীও বটে ! ধর্মের বাধা-ও এখন আর নেই  ! কিন্তু..’  বিন্ধ্যবাসিনী থামিয়া গেলেন !

গৌরদাস মাথা তুলিয়া রেভারেন্ড-পত্নীর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন, সে দৃষ্টি অতীব উদগ্রীব !

কৃষ্ণমোহন কহিলেন, ‘ কিন্তু…?’

বিন্ধ্যবাসিনী থামিয়া থামিয়া কহিলেন, ‘ কিন্তু, হাজার হোক, মধু তো কায়েতের ব্যাটা, তাই….তাই এ বিয়েতে আমার মত নেই ! তুমি বাছা একথাটা  তাকে জানিয়ে দিও !’

এই অভাবিত যুক্তিতে সম্পূর্ণ বিমূঢ় হইয়া গৌরদাস কৃষ্ণমোহনের প্রতি আকুলনয়নে চাহিলেন !

জবাবে কৃষ্ণমোহন মস্তক সঞ্চালন ও দৃষ্টি দ্বারা যে শতাব্দীপ্রাচীন ইঙ্গিত করিলেন, তাহার মর্ম হইতেছে  পত্নীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাইবার কোনো অভিপ্রায় বা  ক্ষমতা তাঁহার নাই !

গৌরদাসের বৈঠকখানা কক্ষে মধুসূদন অধীরভাবে প্রতীক্ষা করিতেছেন, সুসংবাদ লইয়া যে কোনো মুহূর্তে গৌর  আসিয়া পড়িতে পারে !

এমনসময় বিষাদাচ্ছন্ন মুখ লইয়া গৌরদাস প্রবেশ করিলেন !

মধুসূদন অত্যন্ত উদগ্রীবভাবে প্রশ্ন করিতে গিয়া বন্ধুর ভাবগতিক দেখিয়া থামিয়া গেলেন !

ক্ষণপরে গৌর ক্লীষ্টস্বরে কহিলেন, ‘এ বিবাহে কৃষ্ণমোহন-জায়ার সম্মতি নেই !’

মধুসূদন শুনিয়া চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া মৌন রহিলেন, তাঁহার ললাটে ঘর্ম দেখা দিলো !

গৌর আবার বলিতে গেলেন , ‘অমতের কারণ হিসাবে তিনি….’ মধুসূদন হাত তুলিয়া তাঁহাকে থামিতে বললেন !

বিশাল গ্রান্ডফাদার ঘড়ির টিকটিক শব্দ ভিন্ন কক্ষে অস্বস্তিকর নীরবতা বিরাজ করিতেছে !

গৌর বলিল, ‘ মধু, আমি কি ঈশ্বরচন্দ্র মশায়ের সঙ্গে বিধান নিয়ে কথা বলবো, তোমার পুনর্ধর্মান্তরের ব্যাপারে…’

গৌরদাসের কথা শেষ হইলো না, মধুসূদন উঠিয়া দাঁড়াইলেন,

-‘না গৌর ! অনেক হয়েছে ! এই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করলাম ভবিষ্যতে যদি কখনও বিবাহ করি, বাঙালী তথা ভারতীয় রমণীকে বিবাহ করব না !

মধুসূদন দ্রুতপদে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন !

ঘোড়ার গাড়ীর শব্দ ধীরে ধীরে দূরে মিলাইয়া গেলো !

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ