22 Oct

পুণ্যপাত্র

লিখেছেন:উত্তম বিশ্বাস


গোয়ালা বাড়ির গোবরগুলো গাদাদরে কিনে নেয় সরলার মা। বর্ষা বিদায় নিলে ওগুলোর সাথে তুষকুঁড়ো মিশিয়ে মুঠো পাকিয়ে চণ্ডীমণ্ডপের পেছনের দেওয়ালে ঘুঁটে দেয়। এরপর শুকিয়ে বস্তা ভরে বাজারের ছোটছোট চায়ের দোকানগুলোতে বিক্রি করে। জগৎ ঘোষের বড় মেয়ে ঐশী। ঐশী উচ্চ শিক্ষিত। বড় মানুষের মন বলতে যা বোঝায়, তার থেকে অনেকটা আলাদা ঐশী। আজ অনেকগুলো সরা পড়েছে উঠোনে। প্রতিবছর পুজোর আগে এভাবেই ঐশীদের উঠোনে সরা জমে। সরা উল্টিয়ে ওর ওপর অন্নপূর্ণা দুর্গা আঁকতে হবে। একসরার অন্নপূর্ণা এ অঞ্চলে খুবই বিখ্যাত। কয়েকবছর আগেও এ গাঁয়ের মানুষ এগুলো বাজার থেকে কিনে আনত। এখন এগুলো ঐশীই এঁকে দেয়। কলকাতার এক আর্ট কলেজে কিছুদিন পড়াশুনা করেছে ঐশী। এই আঁকাআঁকির কাজটা একপ্রকার অহংকারের সাথে নিয়েছিল সে। আর এখন এটা ওর পরিবারের কাছে একচেটিয়া অধিকারের পর্যায়ে পৌঁছেছে। সে সবার হয়ে দুর্গা অন্নপূর্ণা এঁকে দেয়। ওর হাতের সরা গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দরজায় লক্ষ্মীর আসনে গোলার দোরে গোয়ালঘরে সারাবছর ঝোলানো থাকে। এটা কি কম গর্বের কথা! এর বিনিময়ে মানুষের আশীর্বাদ আর ভালোবাসা আঁচলভরে কুড়িয়ে নেয় ঐশী। আজ ওর হঠাৎ নজরে এল খুড়িমার সাথে কে যেন গোবরের মুঠো চালছে। ওড়নায় বালি ঘষতে ঘষতে উঠে এল ঐশী,“ও খুড়ি, ওটা কে গো?”
-“আমার বোনপো।”
-“হঠাৎ বোন কোথায় পেলে? বেশ ভালো তো! গুলঘুঁটের কারখানা খুলে এতো শ্রমিক নিয়োগ করলে, কোই আমাদের কিছু খাওয়ালে না?” ছেলেটি মুঠো চালতে চালতে একটিবার তাকাল ঐশীর দিকে। শুষ্ক মুখমণ্ডল। সরু গোঁফ। চাপা চিবুক। বয়েস ত্রিশের অধিক নয়। কিন্তু চোখের কোণে যুদ্ধের বারুদ! ঐশী অন্যমনস্ক হবার ভান করে বলল,“এহ কী কেন্ন! একটু কেরোসিন মিশিয়েও তো নিতে পার নাকি! তোমাদেরও সময় আর হয়না! পুজোকালের দিন ঘরেবাড়িতে কেন্নো কেঁচোয় এবেবারে হাট বসাবে।”
ঐশী চলে গেল।

কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই ঐশীর মা মোহিনী এল।
-“আর কতক্ষণ লাগবে গো সরলার মা?”
-“আর মাত্র ঝুড়ি দশেক হলেই…।”
ছেলেটিকে আগাপাশতলা নিরিখ করে মোহিনী বলল, “যাবার আগে একবার দীঘির ঘাটে আসতে পারবে?”
-“কেন গো?”
-“অত বিচি ভেঙে বলতে পারবনা! ভুলে যেওনা কিন্তু।”

ঘোষবাড়ির নিচেই ঘাট। ঘাটজুড়ে আজ তুমুল হৈহল্লা। হয়ত সরলা খুড়ির কথাই হচ্ছে। হাতেমুখে গোবর নিয়ে ঘাটের সিঁড়িতে একপা দিতেই মেয়েগুলো রে রে করে উঠল। মোহিনী ধমক দিয়ে ঐশী ও তার বন্ধুদের থামিয়ে দিল, “এই, আমিই উনাকে আসতে বলেছি! নাও তো সরলার মা, ওগুলো তুলে নাও।”
ঘাটের এক্কেবারে ওপরের সিঁড়িতে শালকাঠের খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। ওকে উৎসাহিত করে মোহিনী বলল, “তোমার নাম কী, সেটা তো বললে না?”
-“পরেশ, পরেশ পাল।”
-“এগুলো একটু খালি করে দেবে?” পরেশ দেখল মাটির সরাভর্তি চাল ডাল কাঁচাটাকা পান সুপারি কোনটাতে বা নতুন গামছা গাছের ডাব ইত্যাদি সব থরে থরে সাজানো। কারখানায় যাওয়া আসার সময় গঙ্গার ধারে অজ্ঞাত অপরিচিত মানুষজনদের পিণ্ডদানের সময় এগুলো এমনভাবে সাজাতে দেখেছে পরেশ। সে চুপকরে দাঁড়িয়ে রইল।
-“কী দেখছিস? মাঅন্নপূর্ণার জিনিস তো! এতে দোষ নেই। কত কপাল আমার বল দিকিনি এই শেষ বয়েসে এসে আজ অন্নকূট পেলাম! এট্টু হাত লাগা দিকিনি বাপ!” পরেশ আর বাক্যব্যয় করলনা। সরা কাঁচিয়ে চাল পয়সা একত্র করে গামছায় গিঁট দিতে দিতে বলল,“আমি তবে এগুলো নিয়ে বাড়ি যাই মাসি?”
-“যা উঠোনে থুয়ে কল চেপে চান করে নে। গোয়াল ঘরের মাচায় গা ধোয়া সাবান আছে দেখিস।” পরেশ চলে গেল। হঠাৎ ওদের মধ্যে থেকে একটি মেয়ে পেতলের কলসি উপুড় করে বুক বাধিয়ে বলল, “মাসি, আমাদের সুখীর জন্যে একটা ছেলে দেখে দাওনা গো!”
আরেকজন জলে ঘাই দিয়ে বলল, “উঁহু মোটেও না। সুখীকে এক্ষুনি বিয়ে দিলে আমাদের ঘরদোর মুছে দেবে কে শুনি? তুই তাহলে সুখীর হয়ে এঁটো বাসনগুলোও মেজে দিস!”
কাঁধের কাপড় জলের ওপর বাড়ি দিয়ে সরলার মা বলে উঠল, “তোরা কী রে! কী করে বলিস এসব কথা? ওর হাতের একদলা মাটির দাম কত জানিস? একখান ঠাকুর পাওয়ার জন্যে বিদেশের বাবুরা সারাবছর হাঁ করে বসে থাকে! প্লেনে করে লোক আসে নিতে। কালনাগিনী করোনায় সব শেষ করে দেলে না! এবছর একখানাও বায়নাপত্তর হয়নিকো। টুলিপাড়ায় ঠিকের আণ্ডারে নতুন নতুন মাটি ছেনতে যারা যায় তাদের যে কী দুর্গতি বুঝবি কী করে! ছুড়াডা দুদিন অন্তর গলায় দড়ি দিতে যায়। খবর পেয়ে আমি বললাম আয়, দুদিন ঘুরে যা মন শান্ত হোক সব ফিরে পাবি। অথচ সত্যি কথা বলতে কী ও আমার পেটের কাঁটাগুলোর চেয়েও…!” বলতে বলতে স্বর আটকে আসে সরলার মায়ের। ঘাটের জলে আরও দুফোটা অশ্রু মিশে যায় অজান্তে।
পরেশ আবার এল। হয়ত কলের জলে গোবরের গন্ধ যাবেনা, কিম্বা সাঁতরাবে বলে। মেয়েগুলো একডুব কম দিয়েই উঠে গেল। ঐশী মাটির সরাগুলো ঘষেঘষে ধুয়ে সিঁড়িতে মেলে দিয়ে সাঁতরে অন্যঘাটে গিয়ে উঠল।
বিকালবেলা ঘুরতে ঘুরতে সরলাদের উঠোনে আবার এসে হাজির হল ঐশী, “তুমি কিছু মনে করনি তো খুড়ি?”
-“হঠাৎ?”
-“মা’টাও না একেবারে যা তা! উনি বলল আর তুমি নিয়ে নিলে?”
সরলার মায়ের মুখখানা সঙ্কোচে চুপসে আসে, “কী রে ওই চাল পয়সার কথা বলছিস? কেন আর কারও দিতিস?”
-“আরে না, আমি বলি অন্য কথা। তুমি রাগটাগ করলে কিনা তাই একটু জিজ্ঞেস করছিলাম।”
-“রাগ করব কেন? আজ বড় হেঁয়ালি করে কথা বলছিস যে!”
-“হেঁয়ালির কিচ্ছু হয়নি তো! এবার ধান উঠলে দু’বস্তা ধান নিয়ে এসো। সারাবছর দুটো পেট হামেশাই চলে যাবে।”
বারান্দার বেড়ার ফাঁক দিয়ে দুবার উঁকিঝুঁকি মারল ঐশী, কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলনা।
চলে যেতে যেতে কাউকে যেন দেখল ঐশী। এবার সে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে গেল,“ঢেঁকিতে নেবুর পাতা লঙ্কা থেঁতো করে ছোটবেলায় যেমন টাঙানো চিঁড়ে খাওয়াতে, ঠিক অমন চিঁড়ে আবার কিন্তু খাওয়ানো চাই বলে দিলাম!” বলতে বলতে অদৃশ্য হয়ে গেল ঐশী। সরলার মা কিছুই বুঝল না। কিন্তু অন্তরাল থেকে আরেকজন বোধহয় কিছুটা হলেও বুঝতে পারল।

সরলার মা ঘুঁটে নিয়ে বাজারে গেলে পরেশ ভোলার টুঙিতে গিয়ে বসে। সারাবেলা ধরে ভোলার সাথে আড্ডা দেয়। ভোলা পরেশের থেকে বেশ কয়েক বছরের বড়। কিন্তু কী যেন এক অদৃশ্য আঠা আছে ভোলার মধ্যে। সে সহজে সবাইকে আপন করে নেয়। ভোলা ঘোষ বাবুর দীঘিতে লিজে পদ্ম চাষ করে। দিনরাত চব্বিশঘণ্টা জলের ওপরেই ভেসে থাকে ভোলা। জলের ওপরে এমন একখান খোলামেলা ঘর পেয়ে পরেশও দারুণ ফুরফুরে মেজাজে আছে। জলের ওপর দিয়ে বয়ে আসা শীতল হাওয়ায় এখন ঘনঘন ঘুমিয়ে পড়ে পরেশ। ভোলা কথার ফাঁকে গাছের পরিচর্যা করে, অনুখাদ্য দেয়। খানিক খানিক রসালো গল্প করেও পরেশকে উত্তেজিত করে ভোলা। দুপুরে ভাত এলে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে পরেশ।
-“এই যাও কোই? একসাথে খাই এসো।”
-“না মাসী বকবে। ঘরে যাই।”
-“মাসী বকলে সন্ধ্যায় আমরা খেয়ে শোধ করে দেব। হাত ধুয়ে এসো দিকিনি!”
ঘোমটা উড়িয়ে চন্দ্রা ডাকে, “দুজনের ভাতই তো আনলাম! বুঝে দেখো বাড়াভাত…! আমাকে কিন্তু এভাবে কেউ ডাকেনি। সে কপাল করেও আসিনি!” পরেশের সব অভিযোগ ফুরিয়ে যায়। জলের ওপরে পা ঝুলিয়ে দুজনে ভাত খায়। চন্দ্রা বসে বসে দেখে। দীঘিভরা কুঁড়ি। একদিনে গুনে শেষ করা যায়না। একসাথে ফুটলে অনেকটাকার মাল! ভাত খেয়ে টিনের নৌকায় ভেসে যায় ভোলা। চন্দ্রার তখন অল্প অল্প গল্প করতে ইচ্ছে করে, “সরলার মা তোমার কেমন মাসী হয় গো?”
-“মাসী। মাসী। যেমন হয়!”
-“শুনি ঠাকুর বানাতে! কী ঠাকুর বানাও গো ঠাকুরপো? তোমার গল্প কিন্তু এখন মুখে মুখে…!”
-“কে বলল এতো গল্প? ভোলাদা?”
-“ফুলের নেশায় যে বউ বাচ্চার কথা ভাববার সময় পায়না! সে শোনাবে গল্প? এত সময় আছে ওর?”
কিছু একটা চিন্তা করে অদূরে অর্ধনিমজ্জিত একটা মূর্তির কাঠামো দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা ওদেশে এসব চলে না?”
-“কীসের মাচা? এগুলো এখানে কেন?”
-“মাচা না, মা মনসার পিঁড়ি! ওই মিলনীর খাল হয়ে ভেসে আসে। দেখছ না সাপের ফনাগুলো এখনো কেমন সত্যিপানা দেখাচ্ছে!…ভোরে পদ্ম ভাঙতে হয়ত, তোমার দাদার খুব ভয়! একবার তো ধুম জ্বর! সে আর কিছুতেই সারেনা। একবার এথানে একবার ওথানে ঝাড়ান কাড়ান করে অবশেষে…!” বলতে বলতে খানিকটা দম টেনে নেয় চন্দ্রা। একটানা কথা বলতে ওর কষ্ট হয়। অথচ এসব দুঃখ দৈন্যে একটুখানি উসকানি পেলে সেও ফুল্লরা হয়ে ওঠে, “কাঠামোগুলো দরকারে বেদকারে অনেক কাজেও লেগে যায়। এই ঝেমন মনে করো পাতা যেমাসে বেশি ভাঙা পড়ে ওর ওপরে বাণ্ডিলগুলো রাখা হয়। গতমাসে তো ওর থেকে দুয়েকখানা বাখারি বার করে এনে বৈঠা বানিয়ে দিয়েছি। এই টোঙের ঠ্যাকনাও…।”
-“বাঃ খালটা বেশ কাজের তো! অনেক দামি দামি জিনিস ভাসিয়ে আনে!”
-“উঁহু তোমাকে কে বলেছে! মরাধরা সব আসে! কাকাকে কতবার বলেছি খালের মুখটা বন্ধ করে দেন। দিলনা। বলেন কী শুনবে? দুদিনেই নাকি দীঘি শুকিয়ে যাবে! তুমিই বলো দীঘিই ঝেদি হবে তাহলে খালের মুখপানে চেয়ে থাকবে কেন?” চন্দ্রার এমন দার্শনিক অভিজ্ঞতা পরেশের খুব ভালো লাগে। চন্দ্রার চোখের দিকে সে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। ওর ওই চোখদুটো কত স্বচ্ছ কত সহজ! অথচ ওখানে কী যেন এক গভীরতা…!
বেলা গড়িয়ে গেলে ভোলা টুঙিতে আসে। এসে দেখে আঁচল এলিয়ে গুমিয়ে পড়েছে চন্দ্রা।
-“কীরে, ঘরে যাসনি?”
-“যাই কীকরে! বউদি এখনো সেই ছেলেমানুষি…!” ভোলা দেখে পরেশের হাতে মাটির মণ্ড। মণ্ড ঠিক নয় চাঁদের মতো আবছা মুখের আদল! যে মুখখানি ভোলা বহুবার স্বপ্নে দেখেছে, কল্পনা করেছে ঠিক তেমন একখানি মুখের চেরাগ চাকতির মতো ঘোরাতে থাকে পরেশ। ভোলা আবেগতাড়িত হয়ে পরেশের হাতখানি ধরে বলে, “আর ফিরে যেয়ে কাজ নেই ভায়া! ঠিকে কাজের গুষ্ঠি কিলাই! এরচেয়ে বাড়ি বসে মনসার ঘট বানালেও দিব্যি দুটো পেট হেসেখেলে চলে যাবে তোমার।”
কথার গন্ধ পেয়ে চন্দ্রাও ঠেলে উঠল। সেও খানিকটা চিন্তা করে বলল, “দাঁড়াও লকডাউনটা উঠুক, মেয়ে দেখে দেব ক্ষন!” পরেশ জবাব দেয়না। কেবল জলের নিচে নিজের ছায়ার দিকে এক নিরিখে চেয়ে থাকে।

দেখতে দেখতে গোয়ালাদের পাড়াটা ঝকঝকে হয়ে উঠেছে। কারও রান্নাঘরের পাশে কারও বা কলপাঁড়ে কারোও বা সারগর্তে সারাবছরের গোবর ডাঁই করা থাকে। আশ্বিনমাস আসতে না আসতেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। পরেশ পালা করে আসে আর সেগুলো সারাবেলা ধরে কোদাল দিয়ে ছেঁচে ছেঁচে তুলতে থাকে। সেদিকে কেউই উৎসাহ দেখায়না। কেবলমাত্র কিছু চীনা মুরগি গুবরে পোকার প্রত্যাশায় ওর পেছনে সারাক্ষণ কককক করে ঘুরঘুর করে। আর কিছু ছেলেছোকড়া আছে যারা কিনা সদ্যসদ্য স্মার্টফোনের স্বাদ পেতে শুরু করেছে অথবা পড়াশুনা লাটে তুলে দিয়ে ভাবছে অফুরন্ত সময়টাকে তারা কীভাবে উপভোগ করবে, ওরা মাঝেমধ্যে এসে কাক কাঠবেরালি ক্যামেরাবন্দি করার পাশাপাশি পরেশের সাথে একটুআধটু ভাব জমাবার চেষ্টা করে। চাঁদমালার মতো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘুঁটে দেয় পরেশ। দুর্গাপদর দালানের নোনালাগা দেওয়াল, জগৎ ঘোষের খাটাল ঘরের পাঁচিল, চণ্ডীমণ্ডপ সব জায়গায় ঠেসে গোবর শুকাচ্ছে পরেশ। উঠোনে ধান আসার এখনও অনেকটাদিন বাকি, তবু এমন একজন যুবকের দৃষ্টি কাড়তে অনেকেই ঘনঘন গোবরমাটিতে উঠোনকাঠান নিকোতে শুরু করে দেয়। কেউ মাদুর পেতে ঝাল হলুদ শুকোয়। কেউ কেউ ট্রাংক খুলে কাপড় মেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই শাড়ি বুকের ওপর বিছিয়ে নিয়ে উঠোন ঝাঁটায়। পরেশ দেখেও না দেখার ভান করে। পটল মাচার তারে ওড়ে এমনকিছু ছেঁড়া শাড়ি রোদে পুড়েপুড়ে জলে ভিজেভিজে এক্কেবারে তেনা উঠে যাবার উপক্রম হয়, সেগুলো কেউ তুলতেও আসেনা। আকাশে শরত মেঘের ভেলা ভাসে। বেলা পড়ে এলে হালকাপাতলা মেঘগুলোর মতো মাথা ভর্তি পাকা চুল নিয়ে উঠোনে কাপড় তুলতে আসে গোপীর মা। পরেশকে শিখণ্ডী রেখে বাড়ির বউ মেয়েদের উদ্দেশ্যে শাপশাপান্ত করে বলে, “দুদিন গেলেই চিতায় উঠব, কত পুজো এল আর কত পুজো গেল, দিসনে তো একখান শাড়ি। হাতে বাধিয়ে এট্টু তুলবি তাতেও তোদের এতো ঘেন্না!” একমাত্র সরলার মা ছাড়া গোপীর মায়ের কথা কেউ শুনতে আসেনা। পরেশ ঘুঁটে গোছায় আর এসব কষ্টের কথা সেও কান পেতে শোনে।

আজ জগৎ ঘোষের বাড়ি সারাবেলা ধরে আদাড় কাঁচানোর কাজ করবে সরলার মা। বছরকালে এইটুখানি একবার দুবার করে দিতেই হয়। তা নাহলে গোবরমাটিগুলো এতো সস্তায় পাবে কেন সরলার মা! আজ ঐশীর মা নিজপায়ে এসে পরেশও নেমন্তন্ন করে গেল, “কী গো বাবু, মেয়ের কাছে জানলাম তোমার গায়ে নাকি জলডুমো উঠেছে! ডাক্তার দেখিয়েছ? ওসব হাতুড়ের কাজ নয়। ভালো একজন ডাক্তার দেখিয়ে নিও। আর হ্যাঁ, মাসী কিন্তু দুপুরে বাড়িতে আসবেনা রান্নাবান্নাও করবেনা। মনেকরে দুপুরবেলা আমার ওখানে দুটো খেয়ে এসো। যেও কিন্তু। তা নাহলে তোমার কাকুও খুব দুঃখ পাবে!”
ঐশীর মা এত করে বলে গেলেন, অথচ আজ পরশের মোটেও খিদে পাচ্ছেনা! কী যেন এক সুরভী ওর সমগ্র দেহমন ভরিয়ে রেখেছে। আজ শুধু শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে, আকাশ পাতাল ভাবতে ইচ্ছে করছে। গলা ফেড়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কিছুই পারছেনা সে। একছুট্টে ভোলার টোঙে গেল। কিন্তু এ কী! ভোলাদার মন ভালো নেই। পরেশ বুঝতে পারে ফুলগুলো নিয়ে চাপে আছে সে। আজ একখানি ধারালো হাঁসুয়া নিয়ে জলে নেমেছে ভোলা।
পরেশ শিউরে ওঠে,“এহ! এতো সুন্দর ফুল এভাবে কেউ কুচিয়ে দেয়? প্লিজ কিছু অন্তত রাখো!”
-“কী করবি ফুল?…পাছায় গুঁজে দিয়ে ঘুমাবি?”
-“আর কিছু দিন থাক না, কেউ না কেউ…!”
ভোলার চোখে দীর্ঘ হতাশা,“আলাদীন আগলে রেখে আর কোনও লাভ নেই ভায়া! দিন চলে গেছে। ব্যাপারী আর আসবে না! অর্ডার নেই। বলতে বলতে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে ভোলা। মুখের মধ্যে জল ঢুকে যায়। জল গিলতে গিলতে আবারো বলে ওঠে,“শালার সাপেও খায়না! আমি আর বাঁচতে চাইনে পরেশ!” বলতে বলতে ডুব দিল ভোলা। হাতে অস্ত্র নিয়ে এতক্ষণ জলের নিচে থাকছে দেখে ভয় পেল পরেশ। এবার সেও ঝপকরে জলে ঝাঁপ দিল!

পরেশ খেতে এলনা কেন বিষয়টা এখন অনেক টাকার প্রশ্ন! সরলার মা বিকেলেও একা ঘুঁটে ওল্টাতে এল। পরেশ তবে কোথায় গেল? ঐশী পায়ে পায়ে ভোলাদের উঠোনে এসে হাজির হল। দেখল উঠোনে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে পরেশ। চন্দ্রা চামচে করে বোরোলিন গরম করে ঊরুতে কোমরে পিঠে ঘষে ঘষে মালিশ করে দিছে। ঐশীকে দেখে একটি পিঁড়ি চেলে দিল। পরেশকে এইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে ওর কেমন যেন ঠেকল। ঐশী সরে যাচ্ছিল দেখে চন্দ্রা আবার ডাকল,“ও ঠাকুরঝি, চলে যাচ্ছ যে বড়! কিছু কি বলবা?”
-“ভোলাদা কোথায় গো?”
চন্দ্রা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে উঠল, “কী জানি কোন যমের দুয়োরে গেচে! বলতে পারিনেকো!”
-“কিছু সাদা পদ্মের দরকার ছিল…!”
-“এমা! কালই তো দীঘির আদ্দেক চকা করে ফেলেছে শুনলাম।”
-“এ রাম! পদ্মবাগান পরিষ্কার করে দিয়েছে? কেন?”
-“পানিফল না কী ছাই লাগাবে!…বলছিল তাই শুনছিলাম!” কথার ফাঁকে কখন যেন ঐশীর চোখ আটকে গেল পরেশের শরীরের ওপর। দেখন সারা অঙ্গ জুড়ে চাকা চাকা দাগ। কোথাও কোথাও চামড়া ফেটে রক্ত ঝরছে। ঐশী অস্ফুটে বলে উঠল, “ও মাগো! কীকরে হল গো? ডাক্তারের কাছে না নিয়ে তুমি এসব কেন করছ?”
কথাটায় চন্দ্রার কোথায় যেন একটুখানি লাগল, সে ঐশীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল, “তোমার বাবাই তো বারবার তাগাদা দিচ্ছেন। ফুল নিতে কেউ এলনা। দীঘির লিজের টাকা পাই কোথায় বল দিকিনি? পাঁচটা জনমজুর দিয়ে যে পদ্মগুলো কেটেছেঁটে সাফসুতরো করব সে পয়সাও নেই। তোমার ভোলাদা একা যেটুক পারছিল করছিল। উনি মাঝে থেকে বললেন ভোলাদা, সময় কাটেনা মোটে আমিও তোমার সাথে কাজ করি। সবার দিয়ে সব কাজ ঝেদি হত! কী বিড়াম্বনা বল দিকিনি! আমাদের ওই মদনাটারও বলিহারি! শ্যাওলা সরানোর আর মানুষ পেলনা! ছিনেজোঁকে একেবারে ছিঁড়ে খেয়েছে!”
-“যাক, তাও তো এতদিনে একটা মানুষ পেয়েছ! এটাও বা কী বলো? এবার ভোলাদা টুঙি থেকে না নেমে আর পারবে না!”
পরেশ পাশমোড়া দিয়ে সরে শুল। চন্দ্রা কথা ঘুরিয়ে বলল,“তা হঠাৎ সাদা পদ্ম? কী হবে গো? কাকিমা তো পান সুপুরি দিয়েই আড়ি পাতেন দেখি…!”
ঐশী মজা করে বলল,“মালা গাঁথব। যোগিনী হয়ে সংসার ছেড়ে পালিয়ে যাব আমারও ইচ্ছে…!” ভোলা বাড়ি নেই শুনে ঐশী চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ অন্ধকারে চন্দ্রা পথ আগলে দাঁড়াল,“ঠাকুরঝি, এলেই ঝ্যাকন দেখলে না কী একখান জিনিস বানিয়েছি!”
ঐশী ভয় পেয়ে গেল। তবু ওটুকু চেপে রেখে বলল, “কী গো? গয়না গড়ালে নাকি?”
চন্দ্রা আঁচলের মধ্যে থেকে বের করল একটি কাঁচামাটির মণ্ড। ঠিক যেন ঐশীর মতো।
-“আমি একখান সরা বানানোর আবদার করলুম। দিল এইখান বানিয়ে। আমি তো আকাশ থে পড়ি!”
ঐশীর কথা ফুরিয়ে এল। কেবলমাত্র কৌতূহলেই কণ্ঠ বেজে উঠল,“কে বানাল পরেশ?”
-“এইবার বুঝলে এই হাতখানি দিয়ে ওই অঙ্গে কেন বোরোলিন লাগাতে সাধ হল?” ঐশী কিছুক্ষণের জন্যে চন্দ্রার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে ধরে রাখল। তারপর ছেড়ে দিল। ঐশী চলে গেল দেখে চন্দ্রা হাঁক দিয়ে বলল, “সাদা পদ্ম তো? কটা লাগবে জানিও। তোমার ভোলাদা শহরে পানিফলের বীজ আনতে গেছে। আসুক, দীঘিতে না থাকলেও যেকরেই হোক এনে দিতে বলবক্ষন!”
চন্দ্রা ফিরে এসে দেখল পরেশ উঠে বসেছে। এবার চন্দ্রা অভিমান করে বলল, “তোমরা পুরুষরাও ছলনায় কম কিছু যাওনা! বাপুরে বাপু! তাই বলি আমি ভাবলাম ঘুমিয়েই পড়েছ! কোই দেখি আর কোথায় কোথায় ফুলেছে?” পরেশ খপকরে চন্দ্রার হাতখানি ধরে ফেলে।
-“এখনো খানিকটা বোরোলিন রয়েছে। ছাড়ো ন্যাকামো করোনা!”
পরেশ পাজামার দড়ি দুহাতে শক্তকরে গিঁট দিয়ে বলল,“ব্যস এই অব্দি!… আর না!”

আজ ষষ্ঠী। ঐশীদের উঠোন থেকে শাঁখ উলুর আওয়াজ আসছে। সরায় খড়ি দেবে ঐশী। কিন্তু এ কী! জগতের সমস্ত কুণ্ঠা আজ ওর ওপর ভর করছে কেন? একটি পটও ঠিকঠাক আঁকতে পারছেনা ঐশী। ছোট্ট ছেলেমেয়েরা হিহি করে হেসে লুটিয়ে পড়ছে, “দুর্গার মুখটা দেখ, কেমন যেন অসুর অসুর লাগছে!
-“অসুর না রে, ওই যে কাকুটা বাস্কেট বলের মতো গোবর চালে, ওই কাকুটার মতো।” বাচ্চাকাচ্চাদের কথায় ঐশীর কষ্ট হয় খুব। কিন্তু কিছু বলতে পারেনা। ওর হাত এখন থরথরিয়ে কাঁপছে। কিছুতেই মনস্থির করতে পারছেনা সে। উঠোনে অপেক্ষারত মহিলারা অস্থির হয়ে উঠল। কী যেন এক উৎসবের আবহে মেতে উঠেছে সবাই। এদের চোখেমুখের এখনো সেই চিরচেনা আলো,…সেই দীপ্তি! মহামারীর এতটা পথ পার করে এসেও এদেরকে এতটুকু মলিন করতে পারেনি! কী যেন এক কুহকের বশবর্তী হয়ে আজ পরেশও পায়ে পায়ে এসে ঐশীদের উঠোনে দাঁড়াল। ও দাঁড়াতেই ভেতর থেকে ব্যগ্রস্বরে কে যেন হাঁক দিলেন,“এই মেয়ে, খাবিদাবি তো! নিজের দিকে একটুও তাকাস? জামাকাপড় ছাড়, চানখাওয়া কর!”
ঐশী হাত ধুয়ে ঘরে গেল। অনেকক্ষণ ধরে প্রসাধন করল। আলমারি খুলে মায়ের বেনারসিটা পরল। পায়ের পাতাদুখানি অনেকক্ষণ ধরে আলতায় রাঙাল। কপালে কুমকুম দিল। এরপর যখন বাইরে এল, সূর্য অস্ত যেতে বসেছে। উঠোন ফাঁকা। কোথায় গেল সব? খড়ি দেওয়া সরাগুলো সেইভাবে পড়ে আছে।
-“তবে কি….?” অনেক প্রশ্ন ঢেউ খেয়ে উঠল ঐশীর মনের মধ্যে। একটি মাটির সরায় রঙ ঢেলে নিয়ে সোজা সরলার মায়ের উঠোনে হাজির,“খুড়ি, পরেশদা কোথায় গো?”
-“বারান্দায় শোয়া ছিল তো। কী জানি কোথায় গেল? গা ধুতে গেছে মনে হয়!”
ঐশী আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না, চণ্ডীমণ্ডপের পেছনের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল। ঘাটের কাছে গিয়ে ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, “ভেলার ওপরে বেগমজানের মতো বসে আছে কে ও? হাতে পদ্ম, দাঁতে চাপা ঘোমটা।…চন্দ্রা না? হ্যাঁ চন্দ্রাই তো!” অস্তমিত আলোয় সবকিছু যেন আবছা আবছা দেখায়। ঐশী দেখল, ভেলা নয় একটি ওল্টানো মনসার মূর্তির ওপরে ভেসে আছে চন্দ্রা। এবং ওটাকে কোমরের সাথে দড়ি বেঁধে মহিষের মতো টেনে আনছে দুটি পুরুষ। একজন ভোলা, অপরজন…!
দূর থেকে ঐশীকে দেখে চন্দ্রা বিলচরা বকের মতো হাঁক দিয়ে উঠল,“কী গো ঠাকুরঝি, কলাবউ সেজে এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
-“তুমি এটার ওপরে উঠে আছ কেন গো?”
খলখল করে হেসে উঠল চন্দ্রা, “দেখছনা জলমই? শ্যাওলা সরাচ্ছি গো! কত্তা কাল পানিফলের বীজ ফেলবে!”
ওদিকে আর তাকাল না ঐশী। এখন ঘোলাজলে রঙের সরাটা ভেসে যাচ্ছে, যেদিকে মিলনী খাল ওইদিকে…

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ