22 Oct

যমালয়ের দরবারে

লিখেছেন:সায়ন্বিতা সরকার শেঠ


— চিত্রগুপ্ত, কখন থেকে ডাকছি তোকে। আসতে এত সময় লাগে কেন? যমরাজ হুঙ্কার ছাড়েন।

— আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ এই তো এসে গেছি। আসলে আজ খুব কাজের চাপ, অনেকগুলো বডি এসেছে কি না। সব দেখে শুনে পাঠাতে হচ্ছে। তার ওপর মর্ত্যে এখন করোনায় কত কত লোক প্রাণ হারাচ্ছে। সেইসব মৃত দেহ আনতে অনেক ঝামেলা। পি পি ই পরে প্রপার প্রটেকশন নিয়ে যেতে হচ্চে। এসে আবার সব স্যানিটাইজ করা, অনেক সময় লেগে যাচ্ছে মহারাজ।

— হুম্, বুঝলাম। তা ওদের আলাদা কক্ষে কোয়ারেনটাইনে রাখছিস তো?

— হ্যাঁ হ্যাঁ, সে আর বলতে।

— তবে মহারাজ, আজ করোনা রুগী ছাড়াও অনেক এমনি বডি এসেছে, তাদের মোটামুটি লিস্ট বানানো হয়ে গেছে। যাকে যাকে স্বর্গে আর যাকে যাকে নরকে পাঠানোর সব ব্যবস্থা করে পাঠিয়ে দিয়েছি, তবে একটা বুড়িকে নিয়ে পড়েছি ভীষণ ঝামেলায়।

— সে কি কথা, এই যে বুড়িটা এইমাত্র এলো? কেসটা কি শুনি একটু।

— আর বলবেন না মহিলার যাবার কথা নরকে, কিন্তু বুড়ি কিছুতেই সেখানে যাবে না। চেঁচিয়ে মাত করছে, এদিকে বাকিরা তার এই হল্লায় রেগে যাচ্ছে।

— যাবে না কেন, পুরো ডিটেইলসটা একটু দেখা দেখি কম্পিউটারটা খুলে ডেটাবেসে। আমারো বয়স হচ্ছে, এখন কখন কাকে কি জন্য আনছি এত এত হিস্ট্রি আর মনে রাখতে পারিনা।

— ওকে দাঁড়ান, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার স্যারকে ডেকে আনছি।

অতঃপর ইঞ্জিনিয়ার এসে কম্পিউটার অন করে ‘যমের দুয়ার’ সফটওয়্যারে ঢুকে বললেন, কি দেখতে চান বলুন?

— ওই বুড়ি, চিত্রগুপ্ত কি নাম বললে যেন করুণা দেবী, পুরো নাম করুণা দে, ওর ডিটেইলস চাই।

একটু সময় নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার পুরোটা সার্চ করে নিয়ে বলল, স্যার ভদ্রমহিলার নাম করুণা দে হলেও উনি কাউকেও কোনো দয়া, মায়া, করুণা করতেন না। ওনার বয়স পঁচাত্তর। মহিলা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরই আঠারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেছিল, ওনার শাশুড়ি ওনাকে খুব খাটাতেন, কথায় কথায় খোঁটা দিতেন, মুখ করতেন, সব কাজে ভুল ধরতেন। বছর কুড়ি ওনার জীবন দুর্বিষহ কেটেছে। তারপর অবশ্য ওনার শাশুড়ি মারা যাবার পর উনি বাড়ির কর্ত্রী হয়ে ওঠেন।

— একটা কথা বলতে পারি? চিত্রগুপ্ত কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে বলে ওঠে।

— যমরাজ বিরক্ত হয়ে বলে, বল কি বলবি।

— এইখানেই মহারাজ যত ঝামেলার সৃষ্টি। ওনার শাশুড়ি গিরিবালা দেবীও বৌমার সাথে চিরকাল দুর্ব্যবহারের জন্য নরকে ঠাঁই পেয়েছিলেন, তবে উনি ভীষণ খুঁতখুঁতে ও বাতিকগ্রস্ত। নরকে এসেও সব মেয়েদের ভুল ত্রুটি ধরে বেড়ান, গালমন্দ করেন, তাই ওনার এখনো পাপের ঘড়া পুণ্য হয়নি, অতএব পুনর্জন্মও হয়নি।

এখন মুশকিল হয়েছে যে করুণা দেবী নরকে ঢুকে ওনার শাশুড়িকে দেখতে পেয়েই চলে এসে ঝামেলা করছেন। বলছেন, “কিছুতেই নরকে থাকবেন না।”

আরো বলেছেন, “বেঁচে থাকতে ওই বুড়ি আমার হাড় মাস ভাজা ভাজা করে দিয়েছিলেন, এখন মরে গিয়ে শান্তি নেই, আবার ওই বুড়ি আমাকে জ্বালাবে, না আমি কিছুতেই ওনার সাথে নরকে থাকবো না, তার থেকে আমাকে যদি করনায় মৃতদের সাথেও এক ঘরে থাকতে হয় আমার তাতে আপত্তি নেই। ওই বুড়ির সাথে থাকার চেয়ে ঢের ভালো।”

এত ঝামেলা করছে বলে আমি ওকে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে এসেছি।

— হুম্, বুঝলাম। যমরাজ চিন্তিত হয়ে পায়চারি করতে করতে বলেন, আচ্ছা ফ্ল্যাশব্যাকে একটু ওনার লাইফটা আরেকবার দেখাও। উনি কি কি পাপ করেছেন যার জন্য নরকে যেতে হবে।

ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ওকে একটু দাঁড়ান চালাচ্ছি।

ফ্ল্যাশব্যাকে ভেসে ওঠে করুণা দে’র সংসার…

— কি হলো কি, এত আসতে আসতে হাত চালালে আমার ছেলে খেয়ে বেরোবে কি করে?

করুণা চেঁচিয়ে ওঠেন তাঁর বৌমা রিনির ওপর।

রিনি কাঁচুমাচু মুখে বলে, — এইতো সব হয়ে গেছে, শুধু ভাজাটা বাকি, আপনি চিন্তা করবেন না, আপনার ছেলে ঠিক করেই খেয়ে বেরোবে।

— চিন্তা না করে থাকি কি করে বলো দেখি, কাজকম্মতো কিছুই শিখে আসোনি তুমি। নেহাত আমি আছি তাই রক্ষে। নাহলে আমার ছেলে নাতি নাতনি সব না খেতে পেয়ে মরতো।

— এরকমভাবে বলছেন কেন মা। আমি হয়তো আপনার মত খুব ভালো করে গুছিয়ে নিখুঁত পরিপাটি সবকিছু করতে পারি না। কিন্তু তার জন্য কেউ না খেতে পেয়ে মরবে না।

— থাক থাক। অত কথায় দরকার নেই। কাজে মন আছে না কি তোমার? সারাদিন নিজের অফিসের কাজের চিন্তা, নয়তো মোবাইলে হয় বন্ধুদের সাথে নয়তো তোমার মায়ের সাথে শলা পরামর্শ করতে ব্যস্ত। ছেলে মেয়েদুটোকে মানুষ করার কোনো খেয়াল আছে। আমার কথা না হয় বাদই দিলাম, নিজের বরটাকেও তো একটু যত্ন করতে পারো।

এবার চোয়াল শক্ত করে খুব শান্ত গলায় উত্তর দেয় রিনি, — মা আপনি যেমন সারাদিন আপনার ছেলে নিজের কাছে থাকা সত্ত্বেও চিন্তা করেন, আমার মা অনেকটা দূর থেকে ফোনে খোঁজ নেন কেমন আছি, সেটাকে শলা পরামর্শ বলবেন না দয়া করে। তাছাড়া আমার ছেলে মেয়েকে আমি ঠিক মানুষ করবো, সংসারও ঠিকই সামলে নেব যেরকমটা আমি পারি সেরকম করে।

— এত তর্ক ভালো লাগে না।

কম্পিউটার স্ক্রিনে এরকম অনেক টুকরো টুকরো ভিডিও দেখার পর যমরাজ বলেন, করুণার পটল তোলার আগের কিছু মুহূর্ত দেখাও হে।

আবার ফ্ল্যাশব্যাক।

এবার করুণা অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে গোঙাচ্ছে, — ও বৌমা, কই গেলে, একটু জল দিয়ে যাও না। পায়ের ব্যথাটাও বড্ড বেড়েছে, একটু তেল মালিশ করে দেবে।

রিনি এসে জল দিয়ে তেল লাগাতে লাগাতে কড়া গলায় বলে, আমি না হয় আমার ছেলে মানুষ করতে পারবো না বলে চেঁচাতেন, তা আপনার ছেলেকেতো আপনি খুব ভালো মানুষ করেছেন, তা আমার বদলে সেতো এখন অফিস ছুটি নিয়ে আপনার একটু সেবা যত্ন করতে পারতো না কি!

— আরে তুমি তাই বলে আমার ওপর এখন রাগ দেখাবে।

— মা আজ আপনাকে নিজের মায়ের চাইতেও বেশি যত্ন করতেই পারতাম যদি আপনিও আমাকে আগে একটু ভালোবাসা দিতেন। তাও তো আমি করছি , অন্য কেউ হলে ফেলে রেখে দিত।

— “এই যে এই যে এই মুখপুড়ি মেয়েটা মরলে ওর নরকে  ঠাঁই পাওয়ার কথা। ও যদি ঠিক করে দেখতো তাহলে আর আমাকে মরতে হত না।”

করুণা দেবী ওয়েটিং রুম থেকে বেরিয়ে সোজা যমরাজের দরবারে ঢুকে পড়ে বলে ওঠে কথাগুলো।

যমরাজ রেগে গিয়ে বলে, — মোটেই না, আপনাকে যতই ভালো করে দেখুক আপনার এই ডেটেই এখানে আসার জন্য নাম এনরোল করা ছিল। বেকার বৌমার ওপর দোষ দিচ্ছেন কেন! তাছাড়া আপনি ওকে কম জ্বালিয়েছেন, সেই জন্যই তো আপনার নাম নরকে রাখা হয়েছে। আপনার বরের সাথেও আপনার দেখা করাতে পারছি না এই মুহূর্তে। ওনার নবজন্ম হয়ে গেছে। এখন নরকে আপনাকে যেতেই হবে, আপনার কিছু শেষ ইচ্ছা থাকলে বলুন পূরণ করে দিচ্ছি।

— বেশ আমাকে একবার মাস কয়েক বাদে আমার ছেলের সংসারের বর্তমান অবস্থাটা দেখাতে হবে। আমার খুব শখ দেখার। আমি দেখবো কি করে চলছে। চলবে না, জানি আমি, নাতি নাতনি আমার ছেলে কেউ খেতে পাবে না…. তাও…তাও আমি দেখতে চাই….।

— তা এই মাস কয়েক আপনি কোথায় থাকবেন শুনি? বেশ আপাতত নরকেই গিয়ে উঠুন। কয়েক মাস পর যদি আপনি মনে করেন নিজে মুখে আপনার দোষ স্বীকার করবেন তাহলে আপনার শাস্তি লঘু করার ব্যবস্থা করবো। আপনার শাশুড়িওকেও একই শর্ত দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি নিজের দোষ স্বীকার করতে রাজি নন। তাই এখনো নরকেই পচে মরছেন।

মাস কয়েক পর…….

বেশ এই দেখুন করুণা দেবী, আপনার ছেলে, বৌমা, নাতি, নাতনি কেমন আছে নিজেই দেখুন। আপনাকে টাইম মেশিনে অশরীরী করে ওখানে পাঠালে ওরা ভয় পেয়ে যেতে পারে, তাই আপনি কম্পিউটার স্ক্রিন থেকেই দেখুন। যমরাজের ঘরে আবার জমায়েত হয়েছে সবাই।

করুণা দেবী দেখলেন, তাঁর বৌমা সকালে উঠে ছেলের সাথে চা খেয়ে স্নান করে পুজো সেরে রান্না করল বেশ অনেকপদ। তার ছেলে পরিতৃপ্তি করে খেয়ে টিফিন নিয়ে অফিস গেল, বাচ্চারাও মাকে টুকটাক কাজে হেল্প করে দিল। রিনিও পরিপাটি হয়ে অফিস যাবার পথে বাচ্চাদের স্কুলে নামিয়ে গেল।

সন্ধ্যেবেলা আবার করুণা দেবীকে ডেকে কম্পিউটার দেখানো হল। সবাই বাড়িতে ফিরে মনের আনন্দে চা ও ঝালমুড়ি খাচ্ছে। ওমা তার ছেলে একি করছে। রুটি মাখছে। বউকে হেল্প করছে। রেগে গেলেন করুণা দেবী।

যমরাজ বললেন, পজ।

আপনাকেও ছেলে বিয়ের আগে আটা মেখে দিত সে ফাইল আমাদের কাছে আছে। দেখবেন?

— মা কে সাহায্য করা ছেলে মেয়েদের কর্তব্য। বললেন করুণা।

— আর বউকে সাহায্য করলে পাপ বুঝি? যমরাজ হাসেন।

দেখুন আপনি ভেবেছিলেন আপনার সংসার চলবে না। চলছে কি না নিজেই দেখুন। ভালোই চলছে, বরং দৌড়াচ্ছে। কারুর জন্য কারুর আটকায় না বুঝলেন। এবার বুঝলেন কি নিজের ভুলটা? এর চাইতে যদি বেঁচে থাকতে বৌমাকে একটু ভালোবাসতেন, লোকের কাছে মেয়েটার নামে মিথ্যা বানিয়ে বানিয়ে নিন্দা না করতেন তাহলে আজ স্বর্গে যেতে পারতেন।

— বুঝেছি বুঝেছি। আমার একটু ভালোবাসা দেওয়া উচিত ছিল মেয়েটার ওপর।

— যাক বুঝেছেন তাহলে, আপনার শাশুড়ি আপনাকে ভালোবাসা দেয়নি বলে আপনিও তাই করবেন … না না এটা ভুল, যাক এখানে এসে যে অন্তত বুঝেছেন এই অনেক। আপনার নবজন্মের ফাইল রেডি করতে বলছি।

চিত্রগুপ্ত ব্যাপারটা চুপিসারে কোরো অবশ্য। করুণার শাশুড়ি জানলে এক্ষুণি ঝামেলা পাকাতে ছুটে আসবে। ওর এখনো নবজন্মের দু বছর বাকি।

— বেশ বেশ। আমি এখুনি কাজ শেষ করছি চুপি চুপি। বললেন বললেন চিত্রগুপ্ত।

— আর হ্যাঁ আজকের রাতটা আর মর্ত্যবাসীকে জ্বালাবো না। আজ আর কাউকে যমালয়ে আনবো না বুঝলি। যা হবে কাল সকালে দেখা যাবে। আজকে যাদের আসার কথা নামগুলো লিখে রাখ। কাল সকাল সকাল বেড়িয়ে তুলে নেব। আজ বড় ঘুম পেয়েছে। এই শাশুড়ি বৌমা ক্যাঁচাল শুনে শুনে মাথা ধরে গেছে।

যমালয়ের দরবার আজ এ পর্যন্তই বলে যমরাজ উঠে পড়েন সভা ছেড়ে। ওদিকে পৃথিবীতে রাত নামতে সবাই শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ