22 Oct

লাল চিনার পাতা

লিখেছেন:সুরজিৎ কুন্ডু


এপ্রিল মাসের সন্ধ্যা। সদ্য কালবৈশাখী হয়ে যাওয়াতে সারাদিনের গরমের জ্বলুনির উপর একটা সামরিক শীতলতার আস্তরণ পড়েছে ।আর ভালো জল পরলে আমাদের সাধের শহর কলকাতার সেই ভেনিসীয় রুপ খানি ধরা পড়ে । নাহ্ !  যদিও নৌকো চলবার মত অবস্থা হয়নি কিন্তু গাড়ি চলাচলেরও বিশেষ অবস্থানেই তা নিশ্চিত করে বলা যায় । তা সে যাই হোক ,একে ঝড়-বাদল আর রাত তার ওপর আবার লোডশেডিং । তায় আবার লেখাপড়ার চাপটাও কম। আমরা কজন জমায়েত হলাম কলকাতার গলির বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের ক্লাব ঘরে। যদিও দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে আর ওপরের করিবর্গা ওয়ালা ছাতের অবস্থা যে খুব ভালো তাও বলা চলে না। তবুও এই উত্তর কলকাতার ছক্কু খানসামা লেনের এহেন কেলাব্ ঘরটি আমাদের বেশ প্রিয়। হবে নাইবা কেন ? বাপ ঠাকুরদার তোলার ক্লাব বলে কথা । যাইহোক আমি, ছানা ,পটকা, পচা ও আরও জনা তিনেক কেরোসিনের লম্ফ তোলা আলোয় গোল হয়ে বসে ফালতু ছ্যাবলাম মারছি। আর ওদিকে , মানে উত্তরের জানালার কাছে বসে এর পাড়ার ভোম্বলদের বাড়িতে আসা ওর ছোট্টদাদু  বয়স্ক ভদ্রলোক । মুখে কাঁচা পাকা দাড়ি ,গায়ের ফতুয়া আর লুঙ্গি। একমনে খোলা ছোট্ট টিনের জানলা দিয়ে বাইরের জল পড়া দেখছে। আর মাঝে মাঝেই মুখের থেকে বিড়ির ধোঁয়ার রিং ছাড়ছে যা জোলো বাতাসে ভর করে পাড়ি দিচ্ছে গলির বাঁকে।
বাইরে থেকে আসা স্ট্রীট লাইটের আলোর ফালি জানলার গরাদে জাফরি কেটেছে। বাইরে থেকেই মাঝে মাঝে জল ভেঙে চলা মানুষের শব্দ বা হাতে টানা রিকশার টুন্ টুন্ শব্দ ভেসে আসছে। আর ঠান্ডা বাতাস মেখে দূরের বড় রাস্তার কোলাহলহীন থেকে ক্ষীণতর হয়ে ভেসে আসছে। খানিকক্ষণ ছ্যাবলাম মরার পর সবাই চুপচাপ। কোন কথা বলার নেই,  আবার যে কেরাম পিটাবো সে অবস্থাও নেই। হঠাৎ পটকা বলে ওঠে–” ভূতের গপ্প জানিস তোরা ?”পচা তার উত্তরে বলে ওঠে –“আরে ছোড় ছোড় !  ওসব ভূত টুত  কিছু নাই । ফালতু বাচ্চাদের ভয় খাওয়ানোর জন্য সব বলা হয়।” কথার টানে মালভূমির স্পষ্ট ছাপ কথাগুলোকে আরো যেন জোরালো করল । এইসব তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে ঘরের উত্তর দিকটা থেকে একটা জ্বলদ্ গম্ভীর স্বরে কথা কথা ভেসে এলো ।—-“তা, ভূত বলতে তোরা কি বুঝিস ? “—–আমি বললাম —“ভূত—-ভূত! কি আবার বুঝবো ব্রহ্মদত্যী, পেত্নী ,শাকচুন্নী এইসব।”শেষ হয়ে আসা নিভু নিভু বিড়িটাকে  বাইরে ফেলে ছোট দাদু বলল–” ভূতের আরেকটা মানেও আছে, জানিস না! ভূত- ভবিষ্যৎ!” পচা বলল–পাস্ট আর ফিউচার” । উত্তর এলো হ্যাঁ সেই ভূতের কথাই আজ তোদের বলবো তবে সে ভূতে যে সে ভূত এক্কেবারেই নেই সে কথা বলছি না । যাইহোক শুনবি নাকি তোরা ? ” চশমার উপর দিয়ে চেয়ে বলল। আমরা সব একসাথে শিয়ালের দলের মতো হ্যাঁ হ্যাঁ করে সমর্থন জানালাম । যদিও ছানা ,একটু ভীতু প্রকৃতির ছেলেটা, খানিক সরে এসে পচার গা ঘেঁসে বসলো। আর তাতেই সবাই খানিক খ্যাঁক্ খ্যাঁক্ করে হেসে উঠলাম। কিন্তু ছোট দাদু গল্প বলা আরম্ভ করতেই সব চুপ। এখানেই বলে রাখা ভাল দাদুর এক অদ্ভুত স্বভাবের কথা। এই গরমেও ওর হাতে দস্তানা গ্লাভস । শুনেছি একবার কি কারনে জানি হাত পুড়ে যাওয়ায় পর থেকে হাত দুখানি দস্তানায় মুড়ে রাখে। ছোট দাদু বলতে আরম্ভ করলো।
তোরা নিশ্চয়ই বাষট্টি সালের সেই ভারত-চীন যুদ্ধের কথা শুনেছিস। সে এক ভয়ানক পরিস্থিতি, কখন যে কোথায় বোম পরবে তার ঠিক নেই । শহরের সবাই ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতো । যখন যুদ্ধ থামলো আমরা সবাই ভাব ছেড়ে বাঁচলাম , চারদিক আবার ধীরে ধীরে যুদ্ধ ভয় ছেড়ে সুন্দর শান্ত দিনে ফিরছে। এখন যে ঘটনা বলব, তা ওই যুদ্ধের বছর পাঁচেক পরের ঘটনা , সময়টা—শীতের শেষ বসন্তের শুরু। তবুও শীতের আমেজ এখনো বেশ ভালোই হয়েছে শহরজুড়ে । কিন্তু তখনই হঠাৎ করেই শহর আবার উত্তাল হয়ে ওঠে একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বলা নেই কওয়া নেই প্রতি সপ্তাহে একটা –আধটা করে খুন হচ্ছে।  কিন্তু কোনো চুরি নেই ডাকাতি নেই । তবে খুন কেন?  কিজন্য ? তার উত্তর পুলিশের কাছে ও নেই। এতটাই রুদ্ধশ্বাস অবস্থা যে সন্ধ্যের পর মানুষের দেখা মেলা ভার হয়ে গেল শহরজুড়ে । এমনকি রাতে ফুটপাতবাসী ও চোখে পড়ে না বললেই চলে। যদি কারোর কোন হঠাৎ দরকার পড়তো দলবেঁধে যাতায়াত করতো। আর বেরোবেই বা কোথায়!  দোকানপাট তো সব সন্ধ্যার পরপরই বন্ধ হয়ে যায় আর তখন তো এখনকার মতো এতো আলো ছিলনা। কলকাতার প্রায় ছোট-বড় সব অলিগলি আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে । প্রতি বাঁকে যেন ওই ঝুপ্ করা গাঢ়ো অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আছে সেই অচেনা, অজানা।  সাক্ষাতে যম দাঁড়িয়ে কিনা কে বলতে পারে! কোন আধারের ঘেরা বাঁক দূর থেকে দেখলেই যেন পাঁজরের ভেতরে হঠাৎ করেই জমাটবাঁধা শীতল রক্তে শ্বাস আটকে যায় । নানা ভয়ের খবর ভেসে উড়ে বেড়াচ্ছে শহরের কানা গলির হাওয়ার  ভাঁজে ভাঁজে।  কোনটা সত্য আর কোনটা যে মিথ্যা তাই বলা দায়। কিন্তু একথা ঠিক যে সব খবরেই কেমন যেন ভয়টা আরো বেশী করে বুকের উপর  চেপে বসছে। তখন আমারই এক বান্ধবী বা বলতে পারিস্ চেনা,  খবরের কাগজে কাজ করে । সে তার আপিস থেকে দায়িত্ব পেলে ওদের কাগচের হয়ে ওই খবরটা কে কভার করতে। এখনো মনে আছে , ওর নাম তৃষা। তৃষা আর ওর স্বামী থাকতো মানিকতলার ইস্ট ক্যানাল রোডের কাছটায় । ওই ব্যাপারে নানা খবর জোগাড় করে আর ওই কাগচে বেরোয়। যত সে ওই ব্যাপারে আরো গভীরে প্রবেশ করে সে ততই যেন সব অদ্ভুত নানা বিষয়ে জানতে পারে। এদিকে পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু যা জানতে পারে তৃষা তার পুরোটাই সে কাগজে ছাপতে পারে না ।কারণ এমন অনেক তথ্য উঠে আসে ওর হাতে যা একদিকে যেমন খুবই ভয়ানক তেমনি দেশের সরকারের উচ্চস্তরের গোপন কথা । যত দিন যাচ্ছে আর একটু একটু করে জানছে ততই সে যেন এই রহস্যের গভীর অন্তরালে হারিয়ে যাচ্ছে । এমন কথা ও না জানায় হয়তো ভালো ছিল । তখন কি আর জানতো ! বেশ ভালই বুঝতে পারছি ওসব কথাই একদিন তার কাছে তার জীবনকে এক বিভীষিকার সামনে এনে দাড় করাবে। এদিকে যে ওই কাজ ছেড়ে দেবে তারও উপায় নেই। কারণ ইতিমধ্যেই ওর বর যে সওদাগরী অফিসে কাজ করতো তা লোকসান খেয়ে উঠে যাওয়ার জোগাড় আর তাতেই তৃষার বর মানে অবিনাশের চাকরিটাও চলে যায়। খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে ওরা। যাই হোক এরকম করেই কদিন যাবার পর সব ব্যাপারটা একটু থিতিয়ে আসে। এর কিছুদিন বাদেই তৃষ্ণার বড় একটা নতুন কাজ পায়  যদিও একটাই অসুবিধে, প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে বেরিয়ে যায় আবার পরদিন বেলার দিকে ফিরে আসে । তৃষার এতে একটু আপত্তিই ছিল প্রথমটায় ।কিন্তু কিছু করার তো নেই, অবস্থার দোটানায় শেষটায় তাই মেনে নিতে বাধ্য হলো একরকম। যাইহোক এরকমভাবে দিনকতক চলার পর আবার এক খুন অবস্থাকে আরো জটিল করে তোলে। কিন্তু এবার কোন এক উচ্চবিত্ত পরিবারের লোক। আর খুন হয়েছে ঠিক ভোর রাতের দিকে।  আর ঠিক এখানটাতেই তৃষার কপালে চিন্তার ভাঁজ আসে । সে চিন্তা করে অবিনাশের জন্য ; কারণ ওই সময়ে সে অফিস থেকে বেরোয় কাজ শেষে। এরমধ্যে একদিন তৃষার সাথে ওর বরের খুবই ঝামেলা বাদ বাঁধে । কারণ সে চায় অবিনাশ ওরম চাকরি ছেড়ে দিক যাতে কিনা প্রাণ সংশয় আছে। কিন্তু এদিকে আবার অবিনাশ সে কথা মানতে নারাজ। খুব তর্কাতর্কি কান্নাকাটির পর শেষটায় অবিনাশ তৃষার কাছে কিছু সময় চাইল নতুন কোন কাজ পেলে সে ওকাজ ছেড়ে দেবে। কিন্তু এরপর পরই এমন এক ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় ওদের যা ওদের দুজনকে এক জটিলতার পাকদণ্ডী মধ্যে এনে ফেলে। সারারাত বৃষ্টি পরে ভোর বেলায় আকাশ থমথমে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে। শীতের শেষবেলায় বসন্তের শুরুতে এরকম আষাঢ় ধারা এক অদ্ভুত নিস্তব্ধ আবহ রচনা করেছে। মনের ব্যাকুলতা শঙ্কা যেন জমাটবাঁধা কুয়াশার মতো তার চোখে-মুখে ছেয়ে রয়েছে । সে চুপচাপ একদৃষ্টে জানালা দিয়ে থমথমে আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে। আকাশও যেন কোন অনাগত বীভৎসতার অপেক্ষায় রয়েছে । ঠিক সেই সময় কলিংবেলটা বেজে ওঠে , আর তৃষার তন্ময় ভাবটা কাটে। কিন্তু এত সকালে কে ?  দিনকাল এর গতিক কোন সাধারণ ঘটনাকেও কালের গভীর ষড়যন্ত্রের চক্রব্যূহে নিয়ে ফেলে। যা তৃষার মনেও এক অজানা আতঙ্কের হিমেল স্রোতের রক্তধারা বইয়ে দিল । এসব ভাবতে ভাবতেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো —“কে ?কাকে চাই?” সকাল হলেও তখনো ভোর রাতের ঘুমের রেশ শহরের গা থেকে যায়নি। যাই হোক তৃষা উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার জিজ্ঞেস করলো –“কে আপনি?” এবারের প্রশ্ন করার সময় গলা শুকিয়ে কথার ভাজে কাঁপা ভাবটা গুঁজে গেল । হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে ভারী বুটের আওয়াজ আর তার পরপরই কোন মেটাল যন্ত্র বন্ধ করার শব্দ । যা তৃষাকে আরো কুহেলির গভীর অন্ধকারে নিক্ষেপ করল।  এমন সময় ওপার থেকে উত্তর ভেসে এলো–“আরে  আমি দরজা খোলো !”গলাটা চেনা অচেনার পাঁকে হারিয়ে গেল। কে বাইরের পুরুষালী গলার লোকটা ! আর–কাকেই বা চায় ? —আবার কথা ভেসে এলো ওপার থেকে –“আরে ;খোল খোল !!” –“পুরো ভিজে গেছি” গলাটা শুনে মনে হল অবিনাশের কিন্তু এখন তো ওর আসার কথা নয় ,তবে কি অন্য কেউ অবিনাশের গলা করে !!!!!এসব ভাবনা যেন তাকে আরো আরষ্ঠ করলো । এবার তৃষা  মনের সমস্ত জোর এক করে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল –“কে ?” উত্তর —“আরে আমি! আমি অবিনাশ”  চেনা লোক চেনা স্বর,  কিন্তু তবু যেন মনে হলো পাতালের কোন গভীর রহস্যের তল থেকে উঠে আসছে । কিন্তু এর পরিস্থিতি তৃষাকে এনে ফেলেছে এক অদ্ভুত টানাপোড়েনের সপ্তপদীর বাঁকে। একদিকে সেই অজানা ছায়াময় শত্রু, অন্যদিকে প্রিয়জনের  ডাক । তার সমস্ত শক্তি একত্র করে এক ঝটকায় দরজাটা খুলে ফেললো । আর খুলে ফেলতেই দ্যেখে , একটা লোক মাথায় কচি বাঁশের তেকোনা টুপি পরা,  মাথা নীচু করে কি যেন একটা করছে । ধড়াম্ করে,  একরকম তৃষাকে ঠেলেই লোকটা ঘরে ঢুকে পড়ল । এত গতিতে ঘটনাপ্রবাহ প্রবাহিত হতে লাগল যে , তৃষা যে তার প্রতুত্তর দেবে সেটাই ভুলে গিয়ে হতবুদ্ধির মত বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রয়েছে। ওদিকে লোকটা হাতে থাকা ছাতাটা ধড়াম করে ওদিকে  রাখা বালতিতে ছুড়ে ফেলে তার দিকেই এগিয়ে আসছে । এবার তৃষা নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে চিৎকার করলো —“কে আপনি ? কি চাই ? ” লোকটা আরো এগিয়ে আসছে । ঘরের সিলিং থেকে ঝোলা মেটাল বাল্বটা যেনো ওই লোকটার তিনকোনা টুপির আর গায়ের জলে খেলা করে একটা লোক বৃত্তের রচনা করেছে তার চারদিকে। এদিকে লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখে এক অদ্ভুত শিহরন খেলে যাচ্ছে তৃষার সর্বাঙ্গে। চোখের নিষ্পলক চাহনি চেয়ে সে আবার প্রশ্ন করল —“কে ! কি চাও?” এবার উত্তর এলো –“তোমাকে !” ভয়ে চোখ বন্ধ করতেই লোকটার সামনে এগিয়ে এসে এক ঝটকায় কোলে তুলে নেয় তৃষাকে। সে ছাড়া পাবার জন্য ঝাপটা ঝাপটি  করতে থাকে । আর প্রায় কিছুক্ষণের মধ্যেই খুলে যায় লোকটার মাথার টুপি। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায় ওর মুখ সে মুঠো করা হাত দিয়ে আঘাত করতে থাকে লোকটাকে। কিন্তু সে আঘাত আদরের , ভালোবাসার সে এতক্ষণে চিনতে পেরেছি লোকটিকে সত্যিই তার স্বামী অবিনাশ। পুরো কাকভেজা হয়ে এসেছে । ত‌ষার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে হো হো করে হেসে উঠলো অবিনাশ—” একটুতেই ভয় পেয়ে গেলে এমন যে নিজের বর কেউ চিনতে পারছ না !!!” তৃষা ক্ষেপে গিয়ে ওর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রাগান্বিত হয়ে বলল—” আমার ওরম  একদম ভালো লাগেনা ! বোঝনা চিন্তা হয় , ভয় করে ।” অবিনাশ –“কিসের ভয় ?”
–“জানো না কিসের ভয়?” অবিনাশ কান ধরে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে–” আচ্ছা বাবা ভুল হয়ে গেছে; এত এত ভিজে এসেছি এক কাপ গরম চা খাওয়ায় তো।
চায়ের জল চাপিয়ে অবিনাশের ছাড়া জামাকাপড় নিয়ে ধুতে চলল সে । অবিনাশ চুপচাপ বসে ওদের বেড রুমের খাটে, কি যেন এক গভীর চিন্তায় মগ্ন। এদিকে তৃষা জামা ধুতে গিয়ে এক অদ্ভুত কাণ্ড দেখে থমকে দাঁড়ায় । খানিকক্ষণ চিন্তা করে সোজা জামাটা হাতে তুলে সটান গিয়ে দাঁড়ায় অবিনাশের সামনে । —“এটা কি ?”অবিনাশ চিন্তার ঘোরটা কাটিয়ে ওর দিকে ফিরে চেয়ে বলে –“কি!” তৃষা জামাটা ওর মুখের সামনে তুলে আবার প্রশ্ন করে —“বলছি এটা কি ?” খানিক শুকনো হাসি দিয়ে সে বলে –“জামা” তৃষা—” সেতো বুঝলাম জামা, কিন্তু জামাই এটা ? কি কোথায় গিয়েছিলে ?”         অবিনাশ —“কোথায় আবার যাব !” কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে শুকনো হাসি জিইয়ে রেখে বলে সে। তৃষা এবার জোরালোভাবে প্রশ্নটা করে—” বলছি জামায় এটা কিসের দাগ ?” জামায় লাগা কালচে লাল দাগটা তার চোখের সামনে নিয়ে যায় সে ।আবার খানিক হেসে উত্তর দেয় সে —“কিসের আবার! কই দেখি ?” ওর হাত থেকে জামাটা নিয়ে ভালো করে দেখে বলে—” ও কিছু না, কী জানি কোথাথেকে লেগেছে!” তৃষা —“কিন্তু যত ধুচ্ছি যাচ্ছে না !’ উত্তর আসলো—” তাহলে হয়তো কোন রং হবে” —-“কিন্তু চ্যাট চ্যাট করছিল প্রথমে”  এবার অবিনাশের সপ্রতিভ  উত্তর দিল —‘ও বুঝেছি, সসের দাগ হবে। ওই মম খেয়েছিলাম” তৃষা –“কিন্তু তুমিতো সস্ খাও না!” অবিনাশ খানিক নাক সিঁটকে বলে ওঠে —“উহ্! কী যেনো পুড়ছে ! ” তৃষা–“কি !”
—–“কিসের একটা পোড়া গন্ধ?” তৃষা —“ওই যাহ্! চা চাপিয়ে  এসেছিলাম তো!” অবিনাশ— যাও , যাও! মনে হয় পুড়েই গেল ” তৃষা ছুটে  রান্নাঘরে চলে গেল। আর  অবিনাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বাইরের দিকে চাইল।
কাপ হাতে বসে দুজনে মুখোমুখি, এটা ওটা নিয়ে টুকটাক কথা হচ্ছে।  রোজকার ঘর-গেরস্থালির কথা। হঠাৎ তৃষা বলল—-” টুপিটা পেলে কোথায় ?” অবিনাশ —“ওটা তো আমারই টুপি”  তৃষা —“তোমার টুপি ! কবে কিনলে?”অবিনাশ —“না মানে অফিসের” তৃষা খানিক আদুরে গলায় বলল —-“তুমি কিন্তু এখনো বললে না ঠিক  কোথায় কাজ করো!” অবিনাশ—” সে কি বললাম যে তপসিয়ার ওদিকে একটা ইমপোর্ট এক্সপোর্ট কোম্পানিতে।”
তৃষা—” তাই বলে রোজ নাইট ডিউটি!”
—” কেন রাতে কাটেনা বুঝি !” একটা দুষ্টু চোখের ইশারায় প্রশ্ন করল অবিনাশ —“বাহ্ ! আমি বুঝি তাই বলেছি ? তবে রোজ রাত জাগলে শরীর খারাপ হবে তো।” অবিনাশ ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল —“আজ বেরোবে না ?” তৃষা হ্যাঁ, তাইতো —-দশটায় বেরোতে হবে।”  ওদিকে ঘড়িতে তখন সোয়া ন’টা ।  তাড়াতাড়ি নাওয়া-খাওয়া সেরে বেরিয়ে গেল সে।
প্রথম বসন্তে শ্রাবণের থমথমে সন্ধ্যা নেমেছে শহর জুড়ে । বাড়ি ফিরে এসে ক্লান্ত তৃষা বরের তৈরি চায়ে চুমুক দিচ্ছে । এমন সময় অবিনাশ বলল–” ওই খুনের ব্যাপারে কত দূর এগোল?” তৃষা —-“হ্যাঁ ভালো কথা ! জানো একজন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া গেছে।”  খানিক অবাক হওয়ার ভাবটা ঢাকা দিয়ে সে জিজ্ঞেস করল —“মানে ! দেখেছে নাকি তাকে কেউ ? ”
—“না মানে দেখেনি সরাসরি , কিন্তু খানিকটা একটা ছায়ামূর্তি , একটু স্পষ্ট খানিকটা আবছা এক মূর্তি!” অবিনাশ —“মানে ?”
—“বলছে যে তেকোনা টুপি আর অদ্ভূত পোশাক পরা লোক ! —–এক ফুটপাতবাসী ভিখিড়ি দেখেছে।”তৃষা বলে যেতে থাকল —” পুলিশ তাকে নিয়ে গিয়ে এমন জেরা আরম্ভ করছে , আর তাতেই বেচারার প্রাণ ওষ্ঠাগত !” খানিক চিন্তিত হয়ে নিজের মনে বলতে লাগল অবিনাশ —“তবে কি এবার”
—” কি তবে?” জিগ্যেস করল  তৃষা।
—” না মানে , মনে হয় এবার ধরা পড়তে পারে” কথার রেশ টেনে তৃষাও বলল—” ধরা পড়লেই বাচি বাবা!  এমন সব কান্ড-কারখানা আর এমন সব ব্যাপার এর সাথে জড়িত —”
—“কে জড়িত ?”
—“আরে ওই যারা খুন হচ্ছে,  মানে যারা—- খুন হচ্ছে তারা প্রত্যেকেই নয় ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট এর সাথে জড়িত নয় তো ওই যুদ্ধের সময় লড়েছিল !”
অবিনাশ —“বিশেষ কেউ তো এখনও মরে নি ”
তৃষা কথাটা কেটে বলে উঠল —“কিন্তু গোয়েন্দা দপ্তর ভাবছে যদি কোন বিশেষ লোক ভিকটিম হয় , তবে আর চাপের শেষ থাকবে না ! ” সবটা শুনে অবিনাশ খানিক যেন চুপচাপ হয়ে গেল। তৃষার সাংবাদিকের চোখ তা এড়ায়নি । সে প্রশ্ন করলো —“কি হলো এরম থমথমে মুখ কেন ? ” কৌতুহলী সন্দিগগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ও আবার বলল –‘ তুমি তো আবার এসব—!”
( সামান্য হেসে ) —-“বলা তো যায়না!”
অবিনাশ খানিক গলা চড়িয়ে বলে –“কি বলা যায় না, হ্যাঁ!”
—নাহ্ ! বলছিলাম তুমি আবার সিআইডিতে যোগ দিলে না তো,যে ওরম গভীরভাবে চিন্তা করছো!” অবিনাশ —“চলো খেতে দেবে, বেরুতে হবে তো ”
তৃষা আড়মোড়া ভেঙে উঠতে থাকে ,এমন সময় অবিনাশ বলে —“জানো তো আজ একটা জিনিস এনেছি তোমার জন্যে ।”—–“তোমার আবার খুব ঘর সাজানোর সখ্ না !” তৃষা —“কি?”
—-” চলোইনা দেখবে !” বলে অবিনাশ ঠেলতে ঠেলতে ওকে নিয়ে ওদের পড়ার ঘরে গেল। সাধারণত ওরা পড়ালেখা ছাড়া সেখানে যায় না। ওটা একতলায় বেডরুমের ঠিক নীচেই । দরজা খুলে দুজনে প্রবেশ করে , দরজার পাশে হাত বাড়িয়ে লাইটটা জ্বালালো অবিনাশ । তৃষাকে চোখ বন্ধ করতে বলে কাঁধে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে নিয়ে একটা টেবিলের সামনে দাঁড় করায় । তৃষা চোখ খুলতে যাচ্ছিল, তখনই সে বলে উঠল —“না!  একদম না!”  তৃষা—” আরে খুলিই না!”  অবিনাশ ততক্ষনে টেবিলের উপর একটা কাঠের বাক্স রেখেছে তৃষা চোখ খুলে , উপর থেকে পড়া হলদে আলোয় টেবিলের উপর রাখা এক অপূর্ব কাজ করা বাক্স দেখে আর খানিকক্ষণ অবাক হয়ে থেকেই ও জিজ্ঞেস করে—” এটাকি?  কোথায় পেলে?” অবিনাশ জানায় আজ দুপুরের পর একটু বেরিয়েছিল ও।  আর তখনই ওই পার্ক স্ট্রিটের দিকের একটা অকশন হাউস থেকে কিনেছে অবিনাশ —“দেখে চোখ এমন ভাবে আটকে গেল না নিয়ে পারলাম না!  তোমার মুখটা যে ভেসে উঠল হয়ে শোকেসের কাচে !!” তৃষা—-ঢং ,রাখো তো—কই দেখি কি জিনিস ” বলে বাক্সটাকে হাতে তুলে নিল । অদ্ভুত মোহময় সে বস্তুটি। যতই দেখে ততই যেন কোন মায়া বলে আরো চেয়ে থাকে বা থাকতে বাধ্য হয়। কালচে হয়ে যাওয়া বার্মাটিক এর বাক্সটির ওপর-নিচে সারা গায়ে অপূর্ব সূক্ষ্ম সব কাজ করা। সারা গায়ের কাঠ খোদাইকে আরো নিবিড় ভাবে দেখতে থাকলো সে মোহিতের মতো । আরো এগিয়ে এনে চোখ দিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে । নাম না জানা কোন উঁচুদরের শিল্পীর কাজ । প্রতিটি খোদাইয়ে এঁকে দিয়েছে জীবনের গল্পকে ওই বাক্সের গায়ে। ফলার প্রতিটি আঁচর জীবন্ত করে তুলেছে কোন এক নাম না-জানা ভয়ংকর সুন্দরী বৌদ্ধ দেবীর  নৃত্য ভঙ্গিমাকে । চোখের সেই ভয়াল চাহনির সাথে মিশে গেছে ঠোঁটে মাখা রহস্যে ভেজা হাসি , যাকে দেখলে শুধু দেখতেই হয়।  অবিনাশের ডাকে তৃষার হুঁশ ফিরল—-” কি!  কেমন হয়েছে? বললে না তো?” ভালো হয়েছে? “তৃষা—“হ্যাঁ !—-হ্যাঁ ,খুব সুন্দর ,এত অপূর্ব !” বাক্স টা রাখতে গিয়ে হঠাৎ করেই চোখে পড়ল যেটা এতক্ষণ সে খেয়ালই করেনি। ওটার উল্টোপিঠে এক ছবি আঁকা ওটাও কম জীবন্ত নয়, কিন্তু শুধু ফটোগ্রাফ বললে ওই চিত্রের শিল্পকে খাটো করা হবে বরঞ্চ বাস্তবের সাথে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে শিল্প ,দুয়ে মিলে এক হয়েছে । এক প্রাচীন চীনা বা তিব্বতী সামুরাইয়ের ছবি। পরনে জমকালো জামা ,হালকা রঙের পাজামা ,কোমরে বেল্ট তা থেকে ঝুলছে সমুরাই তরোয়ালের । বাহাত কোমরে আর ডান হাতে থেকে ঝুলছে সামুরাই শোড। পায়ে কাঠের চিনা চটি। আর হ্যাঁ ,কালো জামায় সোনালী ড্রাগনের ছবি । মাথায় তেকোনা টুপি । টুপিটায়য় এসেই চোখ আটকে গেল ওর । কোথায় যেন দেখেছি , কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না। তবে এটা নিশ্চিত কোথাও না কোথাও তো নিশ্চয়ই  দেখেইছে । কথাটা অবিনাশ তো জিজ্ঞেস করতেই সে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বলল—“ছাড়োতো!  কোন পুজো প্যান্ডেলে বা ছবিতে দেখে থাকবে!”
—” তাই হবে হয়তো “। খানিকটা নিষ্প্রভ ভাবে বলে বাক্সটার টেবিলের উপর রাখতে যাবে, তখনই অবিনাশ বলে উঠলো —“আর রাখছো কি? আসল চমকটা তো দেখলেই না!” তৃষা —“মানে?”
—” আরে ঢাকনাটা খোলো, তবে তো দেখবে ।” তৃষা খানিক মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে অবিনাশের দিকে আস্তে করে তাকিয়ে বাক্সটার ঢাকনা খোলে আর খুলতেই যা চোখে পড়ে তা তার সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন শিহরন খেলিয়ে দেয়। কী অদ্ভুত ! কী সুন্দর ! আশ্চর্য !দেখে বাক্সর পেছনে ঠিক যেমনটি চিনা সামুরাইয়ের  ছবি আঁকা ছিল, অবিকল তেমন একটা ফুট খানেকের ছোট্ট পুতুল। ঠিক সেইরকম পোশাক, কোমরে বেল্ট, মাথায় টুপি, এমনকি জামার উপর সুতার কাজ করা ড্রাগন দুটোও  ঠোঁটের কোনে সূক্ষ্ম হাসির রেশ টেনে বিস্ময়ভরা চাহনি নিয়ে আলগোছে পুতুলটাকে হাতে তোলে। কিন্তু হাত ছোয়ানোর আগে সে কি আর জানতো তার জন্য কি অপেক্ষা করছে!  হাতে তুলতেই যেন তার বিস্ময় দশগুণ বেড়ে গেল । একী!এযেন একটি মানুষের ক্ষুদ্র সংস্করণ , দেহের প্রতিটি ভাঁজে , আঙুলের প্রতিটি নোখে, এমনকি হাতের পাতার রেখা পর্যন্ত । কিন্তু এও কি সম্ভব , এসব ভাবতে ভাবতে সে যখন পুতুলটার মুখে আঙ্গুল দিয়েছে, আর দেওয়া মাত্রই তার বিস্ময় ভাবটা কেটে গিয়ে কোথায় যেন এক হিমেল স্রোত শিঁড়দাড়া দিয়ে বয়ে গেল আঙুলটা ছেকা খাওয়ার মতো চট করে সরিয়ে নিল সে আতঙ্কে । অবিনাশ জিজ্ঞেস করল —“কী হলো!” তৃষা খানিক আমতা-আমতা করে উত্তর দিল–” হ্যাঁ ? না মানে !” কথাটা শেষ না করেই কৌতূহলবশত আবার ছুঁল ওটা । বিস্ময়ভরে সে দেখল একী , এ যেন জীবন্ত মানুষ ছোঁয়ার অনুভূতি।ওটার গা আর মানুষের গায়ে এত টুকু যেন পার্থক্য নেই।—” কিন্তু কি করে সম্ভব ?” আর কথাটা বলে অবিনাশের মুখের দিকে চাইতেই দেখে সেও খানিক নেশা  লাগা চোখে চেয়ে। হাত বাড়িয়ে পুতুলটাকে নিয়ে নিজেকে খানিক সামলে বলে —“তবে কেমন পছন্দ বল একবার!” তৃষার  কি উত্তর দেবে তাই খুঁজে পাচ্ছেনা । অবিনাশ পুতুলটা তৃষার হাতে ফেরত দিতে দিতে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে প্রায় সাড়ে আটটা বাজতে যায়। সে তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে
” দাও, দাও খেতে দাও! বরোব তো।” তৃষা  পুতুলটা বাক্সে রেখে ঢাকনা বন্ধ করতে যাবে, ঠিক তখনই একটা দৃশ্যটাকে মিনিট খানেকের জন্য যেন পাথরের মূর্তি করে তুলল। প্রাণহীন ,স্পন্দনহীন । বাক্সের ভিতরের আধো অন্ধকারের মধ্যে থেকে  যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুতুলটা তাকে দেখছে। যার প্রতিটি পড়তে  হিংস্রতা বীভৎসতার মিশেল। কিন্তু যার সাথে ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হালকা সরল হাসি এই পুরো মুখটাতে এক রহস্যের আবডালে মুড়ে ফেলেছে। খানিকক্ষণ মনের অতলে হারিয়ে সে চেয়ে থাকলো ওটার দিকে। আবার অবিনাশের ডাকে ওর হুঁশ ফেরে। তাড়াতাড়ি বাক্স বন্ধ করে টেবিলে রেখে চলে যায়।
তখন রাত কত হবে তৃষার  জানা নেই হঠাৎ একটা অস্বস্তিতে ঘুমটা ভাঙে। বাইরে তখন নিশুতি রাত, বৃষ্টি না পড়লেও হালকা মেঘলা কুয়াশা জমাট বেঁধে রয়েছে ,অন্ধকার উত্তর কলকাতার অলিগলির ভাঁজে ভাঁজে । এতটাই নিস্তব্ধ যে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাওয়া যায় কান পাতলে। ঠিক তখনই একটা স্পষ্ট শব্দের হাত ধরে সেই অসস্তি ভাবটা আরো চেপে বসল তৃষার মনের উপর । একটা খট্ করে শব্দ। ঠিক যেন কোন দেরজা খোলার মত । আবার সব চুপচাপ । ওর মনে হলো হয়তোবা পাশের বাড়ি বা হয়তো অন্য কিছুর । তাই মনকে শক্ত করে আবার চোখ বন্ধ করলো সে । কিন্তু বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেলেও ঘুম আসছে না । সেভাবে কতটা সময় কেটেছে তার মনে নেই । কিন্তু তারপর যা ঘটলো তাতে ঘুমতো অনেক দূরের কথা , খাট থেকে নেমে যে লাইট জ্বালিয়ে নীচে নামবে সে সাহসটুকুও সঞ্চয় করা তার পক্ষে ঝড়ের রাতে উত্তাল সমুদ্র সাঁতরানোর থেকে দুঃসহ মনে হল। এদিকে অবিনাশও বাড়ি নেই। হঠাৎই সে বেশ জোরে একটা শব্দে চমক লাগে ,চাদর ফেলে খাটের উপর তরাক করে উঠে বসলো সে। মনে হয় কে যেন বেশ জোরেই কোন কাঠের পাল্লা খুললো। আর সেটা এল যেন ওর বেডরুমে নীচের ঘর থেকেই। কিন্তু কিসের শব্দ হতে পারি? নিচে তো কেউ নেই ! তবে কেইবা ……তবে কি কোন চোর, এসব সাত-পাঁচ চিন্তায় ডুব দিয়েছে ওর মন আর ঠিক সেই সময়ই রাস্তার এক কুকুর এমনভাবে কেঁদে উঠল যে তৃষার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। নাহ্! এবার তাকে নামতেই হবে নিচে, এছাড়া অন্য কোন পথ নেই । সত্যিই যদি চোর হয়! কুকুরের আওয়াজ টা দুম করে থামতেই সমস্ত পৃথিবীটা যেন কোন মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতায় অতলে ডুব দিল । কিন্তু সে নিস্তব্ধতা ভাঙলে এক জোরালো শব্দে, এবার সে নিশ্চিত শব্দটা ওর নীচের ঘর থেকেই আসছে, ঠিক যেন কেউ খড়ম বা শক্ত সোলের জুতো পড়ে হাটছে । তাহলে কি সত্যিই কেউ ঢুকেছে সে ঘরে? ঘরে এপাশ থেকে ওপাশ চলছে সেই শব্দটা। তৃষার সমস্ত তরল রক্ত যেন চাপ হয়ে বসেছে পাঁজরের মধ্যে ; দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। বাতাসটা যেন কোন মায়া জাদু বলে ঘন হয়ে এসেছে ঘরের মধ্যে । সমগ্র জগত থেকে সে আজ বিছিন্ন। অনুভূতি বলছে কোন কালশীত ভর করে ওর হাত পা বরফ-শীতল করে তুলেছে । হাতের উপর হঠাৎ কি যেন এক পড়ল উপর থেকে, আর তাতেই চমকে ওঠে তৃষা। এতক্ষণ অন্ধকারে থাকায় ওর চোখ হয়ে গিয়েছে। আস্তে আস্তে মাথা তুলে উপরে চাইতেই দেখে, একটা চাক্ বাধা মৌমাছির ঝাঁক ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে । আর সেখান থেকে টপ্ করে আরেক ফোঁটা রস হাতের উপর এসে পড়ল। কিন্তু এগুলো এলো কোত্থেকে! কেনইবা এল ? এসব কি হচ্ছে !আর ঠিক তখনই আরেক ঘটনা তার মনকে সেই দিকে টেনে নিয়ে যায় । যা ওর মনে এক ঘটনার রেখা ছবি অঙ্কন করে দেয় ।মনে হয় ওই ভারি জুতো পরা লোকটি, যে এতক্ষণ চলাচল করে বেড়াচ্ছিল নীচের ঘরে ;সেই বুঝি ঘরের পিছনের বাগানের দিকের জানলাটা খুলল । স্পষ্ট শুনতে পেল জানলার ছিটকিনি পড়ার শব্দ। আর তার পরপরই ঝুপ্ করে শুকনো ঝরা পাতায় নেমে এগিয়ে চলার । চলে গেল সেই অদৃশ্য মানুষটি। সবকিছু বুঝতে পারছে! শুনতে পারছে ! কিন্তু ঘটনার ঘনঘটার এক নীরব দর্শকের মত তৃষা ঠায় বসে রয়েছে বিছনায়। একফোঁটা নড়ার শক্তিও সে হারিয়েছে। হঠাৎ আবার যেন আরেক ফোটা পড়ল হাতের পাতার উপর । আর তাতেই যেন সে সম্বিত ফিরে পায় হাতের পাতার দিকে ভাল করে চেয়ে দেখে এক ফোটা লাল বিন্দু ,রক্ত ! ভয় আরো চেপে বসে তার সমস্ত মাংসপেশিকে এক মরণ সংকোচনে করায়ত্ত করেছে । একটা সূক্ষ্ম স্রোত তার কপাল থেকে নাক হয়ে নিচে নেমে আসছে । নাকের ডগায় ওই তরলটা আসতেই তার দৃশ্যমান রক্তিম রঙ যেন তাকে আরও জড়ত্ব দান করেছে । সে চিৎকার করতে চাইছে! চিৎকার করে অবিনাশ থাকতে চাইছে, কিন্তু পারছেনা। মাথার সব সাধারন চিন্তাভাবনা  যেন দলা পাকিয়ে মাথার মধ্যে বন বন করে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে তা মিশে যাচ্ছে চোখে দেখা দৃশ্যের সাথে। মাথাটা সত্যিই যেন ঘুরছে ,চেতনা যেন ওর ধীরে ধীরে হারাচ্ছে, ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ, চোখের সামনের আসবাব ,দেওয়াল সবকিছু হঠাৎ করেই তার চোখের সামনে থাকা আয়নায় । নিজের মূর্তি দেখে নিজেই ভয়ে আতঙ্কে উথলে উঠল । এখনও কপাল থেকে নেমে আসা লম্বা দাগটা চক্ চক্  করছে। তার শরীর অবসন্ন হয়ে সে যেন বসে থাকার শক্তিটুকুও হারাচ্ছে ।ধপ্ করে সে সটান শুয়ে পড়ল বিছানায় নিজের অজান্তেই । কিছুক্ষণ পর যখন হুঁশ ফিরল সোজা চোখ গেল  সিলিঙের দিকে। কিন্তু কোথায় সেই মৌচাক! ওতো জাফরিকাটা নাইট ল্যাম্প এর থেকে আসা আলো-আঁধারের কাটাকুটি।  ব্যাপারটা বুঝে খানিক বল ফিরে পেয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসল। এবার তার চোখ আবার গেল আয়নায়, দ্যাখে ঐ শীতের মধ্যেও ঘেমেনেয়ে স্নান করে উঠেছে সে। মুখের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখে ,সে এতই ঘেমেছে যে সিঁথির সিঁদুর ঘামে গলে কপাল থেকে নাক বরাবর নেমে এসেছে । তবে কি সে এতই ভুল দেখল! এতটাই ভুল……… চুপচাপ শুয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে তা তার মনে নেই।

কলিং বেলের শব্দে ঘুমটা ভাঙে তৃষার। দরজা খুলতেই অবিনাশকে দেখে যেন ওর মনের সমস্ত আগল ভেঙে গেল।  তাকে আঁকড়ে ধরে একনিঃশ্বাসে বলে গেল কাল রাতের সব ঘটনা । কিন্তু এ কী করে সম্ভব ! তৃষার মত শিক্ষিত সাংবাদিকের কথা মনের ভুল বলে উড়িয়ে দেয়া অসম্ভব। প্রথমটায় যদিও খানিকটা ইয়ার্কি মেরে ব্যাপারটাকে হালকা করার চেষ্টা করেছিল অবিনাশ ,কিন্তু পরক্ষণেই তৃষার বর্ণনার ডিটেলিং তাকে ঘটনার গভীরতার অতলান্তে নিক্ষেপ করে । কপালে চিন্তার ভাঁজ যেন এঁকেবেঁকে চলতে থাকা কাল রাতের ঘটে যাওয়া এক মায়াবী দুর্ধর্ষ ঘটনা,যাকে যুক্তিতর্কের কষ্টিপাথরে যাচাই করার কোন উপায় নেই । যাইহোক ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুকে দেখতেই হোক বা তৃষার ভয় কাটানোর জন্যই হোক ,তৃষাকে নিয়ে চলল অবিনাশ ওই ঘরে। কিন্তু কোথায় কি ! বন্ধ জানলার খিড়কি দিয়ে হালকা আলো জাফরি কেটেছে দেওয়ালে , মেঝেতে আর ঘরের ঠিক মাঝখানে গোল টেবিলটার উপর রয়েছে সেই বার্মাটীকের বাক্সটি । তৃষার চোখ  চারদিকে ঘুরছে উপরের সিলিং থেকে জানলার গোবরাট ।কাচের শার্সি থেকে মেঝের আনাচ-কানাচ , খুঁজে চলেছে কাল রাতে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার এতোটুকু অস্তিত্বকে।  কিন্তু যতই দেখছে ততই ঘরের প্রতিটি আবডাল প্রতিটি ভাজ  যেন সবকিছু থেকে আড়াল করছে । হঠাৎই মনে হতে লাগল কাল রাতের সেই লোকটি যেন এখনও উপস্থিত, তার উপস্থিতি সে টের পাচ্ছে । আর এটাও বেশ বুঝতে পারছে, সেই অদৃশ্য মানুষটি কাল রাতের ঘটনার এতোটুকু নিদর্শনকেও লুকিয়ে দিচ্ছে প্রতিটি ভাজে। সমস্ত জগৎ যেন তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চাইছে। সে কি করে বোঝাবে অবিনাশকে? তার চোখেও অবিশ্বাসের ছায়া হালকা হালকা করে খেলতে শুরু করেছে । যাই হোক তখনকার মতো তারা সেখান থেকে চলে গেল।
তখন বেলা বেশি গড়িয়েছে মাত্র, ওই পড়ার ঘরে একটা আরাম চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে স্বামীর করা চা’য়ে আদরের চুমুক দিচ্ছে তৃষা। ওদিকে কালকেও শহরে খুন হয়েছে, কিন্তু এবারের খুনটা বেশ চাঞ্চল্যের স্রোত বইছে পুলিশ মহলে। দিল্লি থেকে সিবিআই এসেছে তদন্ত করতে, কারণ এবারে আক্রান্ত কোন আর পাঁচটা সাধারণ শহুরে নয় । মারা গেছে তপন রায়চৌধুরী ! যিনি কিনা ডিফেন্স মিনিস্ট্রিতে একটা উচ্চপর্যায়ের অফিসার। চীন যুদ্ধের সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল সে।সে খবরই কাগচে চোখ বুলাচ্ছে অবিনাশ । একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কাপটাকে টেবিলের একপাশে রেখে, ওই বার্মাটিক এর বাক্সটি হাতে তুলে নেয় সে। এপাশ-ওপাশ নেড়েচেড়ে বলতে থাকে—” ভারি উঁচুদরের কাজ!” বাক্স টা উল্টো ছবিটাতে চোখ পড়তেই কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হয়। খানিকক্ষণ ভালো করে নজর করে তৃষার হাতে দিয়ে বলে– “দ্যাখো ! কি যেন একটা পরিবর্তন হয়েছে না? কোথায় যেন একটা……, তুমি দেখো তো” তৃষা বাক্সটা নিয়ে উপরটা দেখে বলতে থাকে–” কই আমার তো কিছু……, কিন্তু বাক্সটা উল্টে ওই হাতে আঁকা সামুরাইয়ের ছবিটা চোখে পড়তেই এক ঝটকায় ওর সাংবাদিকের চোখ সূক্ষ্ম পরিবর্তন টাকে দেখে ফেলে। কিন্তু খানিকটা সন্দিহান হয়ে আরো ভালো করে নিরীক্ষণ করতে থাকে , আর যত নিবিরভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকে, ততই যেন ওর শিরা ধমনী গুলো আবার দৃঢ় হতে শুরু করে কোন অজানার আশঙ্কায়। কিন্তু এটা কি ওর মনের ভুল সেটা যাচাই করতেই অবিনাশের উদ্দেশ্যেই ছবিটা এগিয়ে নিয়ে বলে –“দেখো, একটা লাল দাগ তরোয়ালটার আগায়, তাই না ! কিন্তু কাল কি ছিল ?মনে আছে?” অবিনাশ ও দিকে চেয়ে দেখে ও জানায়—” নাহ্ ! আমি যখন কিনি তখনও ভালো করে খুটিয়ে দেখি, এসব জিনিস সাধারণত ভাল করে দেখেই কেনা হয়ও” তৃষা—” তার মানে ছিল না!’ কথাটা বলেই হাত দিয়ে পাশে থাকা জলের বোতল থেকে জল নিয়ে ঘষতে থাকে কিন্তু সে দাগ আর ওঠে না। একসময় ও ধৈর্য হারিয়ে বাক্স টা রেখে দেয় আর রাখার কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা শব্দ, একটা ঘটনা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মিলিয়ে একাকার করে দেয়। কোনটা আসল আর কোনটা ইলিউশন তার সংজ্ঞাটাই যেন যুক্তি ও তর্কের আবডালে মিলেমিশে এক হয় । পৃথক করার শক্তি হারায় ওই গোলকধাঁধায়। বাক্সটা রাখার পর ওই খুনের ঘটনাটা মন দিয়ে পড়তে থাকে তৃষা, আর ঠিক তখনই একটা শব্দও ওর কানে আসে। একটা খট্ করে শব্দ আর শব্দটা যে ওই বাক্সের ভেতর থেকে আসছে তা বুঝতে ওদের দেরি হয়না। মনে হয় যেন ওই বাক্সের মধ্যে কোন জীবন্ত প্রাণ নড়েচড়ে  বেড়াচ্ছে, চাইছে ছাড়া ওই ঘেরাটোপ থেকে। তৎক্ষণাৎ বাক্সটা তুলে নেয় তৃষা , অবিনাশ হতভম্বের মত চেয়ে সেদিকে। আর বাক্স টা খুলতেই চোখে পড়ে অন্ধকারে দুটি উজ্জ্বল চোখ যেন তার দিকেই চেয়ে আছে। কি ক্ষুরধার হিংস্র দৃষ্টি! সে অসম্ভব ক্রুর চাহনিতে অসহ্য হয়ে বাক্সটা অবিনাশের হাতে ধরিয়ে হাঁপাতে থাকে সে,চোখ বন্ধ করে নেয় তৃষা। অবিনাশ ধীরে ধীরে ইতস্তত কাঁপা হাতে ওই পুতুলটাকে বাইরে বার করে , এদিকে তৃষার হাত ঘামতি শুরু করেছে এই ঠান্ডায়ও । কিন্তু কই পুতুলের তো পরিবর্তন নেই! শুধু শুধুমাত্র ওই তরোয়ালের খাপছাড়া। ওটা কেমন যেন একটু বেমানান ঠেকে অবিনাশের। কেমন যেন একটু বেঁকে গেছে কি মনে করে ওটায় হাত দিতেই, একটু ভেজা ভেজা লাগে। এর মধ্যে থাকা ছোট্ট শোডটাকে টেনে বার করতেই মা চোখে পড়ে , তাতেই ভয়টা চেপে বসে এবার অবিনাশের মুখেও । শোডের আগাও একটু লাল, ঠিক যেমনটা ছিল ওই বাক্সের ছবির সামুরাইয়ের হাতের শোডটায় । আর ওটা চোখে পড়তেই তৃষার মুখ থেকে একটা অস্ফুট আর্তনাদ বের হয়ে আসে নিজে থেকেই!  কিন্তু অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও সে রক্তিম দাগ আর উঠলো না । আর সহ্য করতে না পেরে দুজনেই সেখান থেকে চলে যায় দরজা বন্ধ করে । বন্ধ দরজার ওপারে , বন্ধ বাক্স নিশ্চল ভাবে পড়ে ওই টেবিলে। প্রাণহীন না জীবন্ত তা পরখ করার সাধ্য আর ওদের নেই । তৃষা সারাদিন অফিসের কাজ করলেও সর্বক্ষন ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে ওই চিন্তা। অবিনাশ ওকে এই বলে আশ্বস্ত করে যে সে খবর নেবে ঐ পুতুলটার ব্যাপারে।
সন্ধ্যেবেলা ।আজ যেন ঠাণ্ডাটা আরো জাঁকিয়ে বসেছে শহরজুড়ে নতুন করে । শেষ কবে এমন বাসন্তে এমন ঠান্ডা পড়েছে তা মনে পরেনা। বাড়ি ফেরার পর দু’জনের মধ্যে ওই একই আলোচনা আর সেই কথায় অবিনাশ এক ঘটনার কথা বলে। যাতে তৃষার  হৃদস্পন্দনকে গলা টিপে ধরে কোন অদৃশ্য শক্তি। গলা দিয়ে কথা তো দূরের ব্যাপার, আওয়াজ পর্যন্ত করার ক্ষমতা নেই ওর। এদিকে তৃষা, জানায় কালকের ঘটে যাওয়া খুনের ঘটনায় সিবিআই এক সূত্র খুঁজে পেয়েছে । ওই মৃতদেহের পাশেই নাকি পাওয়া গেছে এক লাল রঙের চিনার পাতা আর তাতে সাদা দিয়ে লেখা “ট্রুথ” আর ছ’টা নতুন তারা আঁকা হলদে রঙের। ওদের অনুমান হত্যাকারী ইচ্ছাকৃত ওই জিনিস ছেড়ে গেছে আর এই তপন রায়চৌধুরী যে গোপন টিমের সদস্য ছিলেন তার বাকি দুজনকে খুবই কড়া পাহারায় রাখা হয়েছে। এ খবর নিঃসন্দেহে চাঞ্চলকর ,কিন্তু এরচেয়েও ভয়াল অতি অলৌকিক কথা যে তৃষার জন্যেই অপেক্ষা করছে তা তখন ওর ধারণার বাইরে। এবার অবিনাশ অসম্ভব ঠান্ডা গলায় বলতে আরম্ভ করলো।—–” ওই অকশন হাউজের লেজার ঘেঁটে জানা গেছে যে ওই বাক্সটার একটা গোপন ইতিহাস আছে যে, ইতিহাস যেমন রোমাঞ্চকর তেমনি এক অতিপ্রাকৃতিক সত্তা কেও হয়তোবা ইঙ্গিত করে। তখন তিব্বতের ওখানে ভারত-চীন যুদ্ধের ভয়াবহতা অনেকটাই অস্তমিত । অনেক প্রাণহানি যেমন হয়েছে, তেমনি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রচুর । তার সে যাইহোক, সেই সময় সেখানে নিযুক্ত পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একমেজর নিজের জীবন তুচ্ছ করে প্রচন্ড লড়াই করেছিল আর বাঁচিয়ে ছিলো এক মঠ ও তার তান্ত্রিক সন্ন্যাসীদের । যখন ওই মেজর ওখানের সেনা হাসপাতলে ভর্তি তখনই এক বৃদ্ধ বৌদ্ধ ভিক্ষু এসে ওকে এই বাক্সটি দিয়ে যায়, আর বলে যায় এ এক মন্ত্রপূতঃ বাক্স যা কিনা প্রাচীন সামুরাই যোদ্ধারা নিজেদের কাছে রাখতো । যা কিনা তাদেরকে যে কোন বিপদ থেকে রক্ষা করত এবং স্বয়ং বুদ্ধ সামুরাই অস্ত্র উদ্ধার করতে। যদিও সেই শিখ মেজর সেযাত্রায় আর বাঁচেনি , কিন্তু মরার আগে কোন এক বাঙালির হাতে তা দিয়ে যায়। তাই হাতঘুরে ওই অকশন হাউস এসেছে। সব শুনে বলল তৃষা বলল—-” ঐ বাক্স আর ওই পুতুলকে এখনই দূর কর! কোন দরকার নেই ওটাকে বাড়িতে রাখার। ওসব  তন্ত্র-মন্ত্রের জিনিস ।”
“কিন্তু ওটাকে কি দুম্ করে এখানে সেখানে ফেলে দেওয়ার ঠিক হবে!  আর এমনিতে আমাদের কোন অনিষ্ট করেনি । তার চেয়ে বরং কালকে একবার ভট্টাচার্য্য দাদুর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলা যাবে।”- বলল অবিনাশ ।কিন্তু তৃষা জোর করতেই থাকে, ওটাকে আজকেই দূর করার জন্য তার কোনোভাবেই ইচ্ছা না ওটাকে একমুহূর্ত আর বাড়িতে রাখতে । তবুও শেষমেশ যখন অবিনাশ টাকার দোহাই দিয়ে বললো —“দেখো কত ভালবাসে, এতগুলো টাকা খরচ করে তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য এনেছি ! তখন কালকে একবার দাদুর সাথে কথা বলি, তারপর যা হয় তা করব ক্ষন!” শেষমেষ মেনে নেয় তৃষা। তখুনি ল্যান্ড ফোনটা বেজে ওঠে ওপরের ঘরে । তৃষা উপরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে, ওদিকে অবিনাশ আস্তে আস্তে বাক্সটা খুললে পুতুলটাকে খুব ভালো করে দেখতে থাকে । আর আস্তে আস্তে, হাঁটতে হাঁটতে খোলা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে খুব কাছ থেকে ওটাকে নিরীক্ষণ করতে থাকে ।  তৃষাকে ওর এডিটর বলে যে কাল একবার লালবাজার যেতে কারণ নাকি কাল বা পরশু ওই ভিখারি প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান নেয়া হবে।
তৃষা , বাইরে পড়ে থাকা চেক বইটা ঢুকাবে বলে অবিনাশের কাগজপত্রের আলমারিটা খোলে আর খুলতেই কোত্থেকে একটা শুকনো টুকরো পাতা ওর পায়ের কাছে এসে পড়ে। ওটাকে দেখে অবাক হয়ে যায় সে। দরজা-জানলা বন্ধ আলমারির ওখানে কোথা থেকে ওটা এলো ! সত্যিই অবাক করা কান্ড। অবিনাশের বেখেয়ালি, অগোছালো ছেলেমানুষি ভাবটা মনে করে নিজেই খানিক হেসে ওঠে। ওটাকে হাতে তুলে বেশ ভালো করে দেখতে থাকে—- তারপর ধূস্ বলে নিজেই নিজের উপর হেসে ওঠে। কিন্তু পরক্ষনেই গাম্ভীর্যে মিলিয়ে যায় ওই হাসির রেশ কোথায় যেন, কিসের সাথে ওই পাতা টুকরোটার বড় মিল। এসব আকাশ-পাতাল ভাবছে, এমন সময় ঘড়ির ঘন্টা জানান দিল রাত প্রায় বারোটা বাজে তড়িঘড়ি করে আলমারি বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে শুতে চলে যায় ও।
তখন বেশ রাত একটা কি দুটো হবে, তা ঠিক জানেনা তৃষা। হঠাৎ একটা জোরালো শব্দে ঘুমটা ভাঙ্গে ওর। আবার !—-আবার!  সেই শব্দ । আসছে নিচের ওই ঘরটা থেকে । কালকের ঘটনাগুলো মনে পড়ে যায় ওর আবারো । তৃষা যেন আবার সেই ভয়াল স্রোতে অতলে হারিয়ে যেতে থাকে ক্রমাগত । মনের মধ্যে থাকা সেই অশান্তি আর ভয়ের মৃদু রেশটা যেন ক্রমেই প্রকট হতে হতে তার শত সহস্রা ফনা বিস্তার করে একাকিনী তৃষাকে গিলে খেতে আসে । ঘরের দেওয়াল গুলো যেন তার কাছে ছুটে এসে ওকে পিষে ফেলতে চেষ্টা করে । দম বন্ধ হয়ে আসে ওর!  হঠাৎ যেন ওর কানে ভেসে আসে কিছু সুরেলা মন্ত্র,  কোন এক দুর্বোধ্য ভাষায় । কারা পড়ছে ওই মন্ত্র!  কোথা থেকে আসছে?  এবার সে যেন স্পষ্ট দেখতে পায় কিছু ছায়ামূর্তি ঘরের মধ্যে ঘুরে চলেছে গোল করে। কারা এরা ? এবার ওই দুর্বোধ্য মন্ত্রের সাথে শুরু হয় কিছু অদ্ভুত বাজনার শব্দ ।  কোন সুর নেই ,তাল নেই একটা না একটা গোঁ গোঁ শব্দ। সেই শব্দ যেন পাঁক খেতে থাকে ঘরে দেওয়াল থেকে ও দেওয়াল । কিছু একটা ঢোল বা ঐ জাতীয় কিছু আওয়াজ নির্দিষ্ট সময়ের অন্তরে তাল ঠুকছে। আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হয় ! কানে তালা লাগার জোগাড় । দুকানে হাত চাপা দেয় সে ! কিন্তু কিছুতেই যেন সে শব্দের জোরকে আটকাতে পারছেনা ।সে শুনতে চাইছে না। তবুও কিচ্ছুটি করার নেই ,সে বাধ্য! শুনতে হবেই ওকে । ওকি ! ওটা কি ! হঠাৎ সামনে চেয়ে দেখে ,কি জানো এক বীভৎস জন্তুর ছায়া নেচে বেড়াচ্ছে ওই গোল হয়ে ঘোরা ছায়ামূর্তি গুলোর চারপাশে। অসহ্য এবার ছায়ামূর্তি গুলো নেচে উঠছে । নাহ্ !  সে আর পারছে না । চোখ বন্ধ করেই সে চিৎকার করে ওঠে —“না ……না ……তোমরা কারা ?……থামাও ,থামাও!’
ধড় মড় করে উঠে বস খাটের উপর । কোথায় কি ! কেউ নেই কোথাও ! তো তবে কি স্বপ্ন? কিন্তু সে তো স্পষ্ট শুনলো!  নাহ্ ,ওইতো  কালকের মত শব্দগুলো । কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে নিচের ঘরে। নাহ্!  একটা ফয়সালা করতেই হবে। মনের সমস্ত জোর একত্র করে সে ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে চলে যায়। ওই ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে । তাড়াহুড়োতে টর্চটা আনতেই ভুলে গেছে। যাইহোক আস্তে আস্তে দরজা খুলতে , যাবে ঠিক তখনই সে শুনতে পায় জানলা খোলা আওয়াজ । তাড়াতাড়ি সে ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালায় । আর এরপর সে যা দেখে তা তার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেয়। বাগানের দিকে জানালা খোলা ,আর —–আর টেবিলের উপর ঐ বাক্সটা আছে ঠিকই কিন্তু ঢাকনা খোলা ! আর হাতে তুলেতেই দেখে ভেতরে পুতুলটা কই? নেই তো!  সেখানে ভালো করে হাত ঢুকিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে, না নেই তো! কোথায় গেলো ?কে বার করল? সে ছুটে গেল জানলার সামনে; মনে হয় জানলার সামনে কে যেন একটা দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তাকে আসতে দেখেই ওই ছায়ামূর্তি সরে গেল। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বাক্সটা রেখেছে মাত্র, তখন নিজের হাতের দিকে চেয়ে দেখে কোথা থেকে যেন খানিকটা লাল রক্ত ওর হাতে লেগে গেছে ! সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ওর । ভালো করে বাক্সের ভেতরটা  দেখতেই , দেখে বাক্সের ভেতরের দেয়ালে জায়গায় জায়গায় চাপ চাপ রক্ত লেগে। রক্ত এলো কোত্থেকে ! কিন্তু ভেতরটা দেখতে গিয়ে তৃষা আরেকটা জিনিস চোখে পড়ে কি যেন একটা লেখা। আলোতে আনতেই সে চিনতে পারে ওটা চীনা শব্দ। কিন্তু সে তো চীনা ভাষা জানেই না । তবে কি করা যায় ! লেখাটা সে একটা কাগজে নকল করে তখনকার মতো সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।
পরদিন সকাল। অবিনাশ বাড়ি এসেছি ,আজ ওর  মনটাও একটু ভারাক্রান্ত বস্ কালকে খুবই বাজে কথায় অপমান করেছে । এরকমটাই  জানায় সে তৃষাকে । সকাল-সকাল ওই চীনা শব্দের প্রতি লিপিটা  পাশের পাড়াতেই থাকা তারই বন্ধু চন্দ্রিমার কাছে পাঠিয়েছে । এখানে বলে রাখা ভাল চন্দ্রিমা চীনা ভাষায় দক্ষ এবং সে প্রাচীন তিব্বত নিয়ে বর্তমানে গবেষণা করছে । অবিনাশ বাড়ি ফেরা সঙ্গে সঙ্গে সে আবার কাল রাতের সব ঘটনা বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে । এভাবে কতদিন আর!  অবিনাশ শুনে অবাক —“কি বল!  পুতুলটা নেই! ” তৃষা —“না নেই —-“গেল কোথায় ? কিভাবে সম্ভব ?”
—“তুমি কি বলতে চাইছো ! আমি মিথ্যা বলছি ? নিজে দেখবে চলো—- চলো!”
অবিনাশ কে টানতে টানতে নিয়ে চলল ওঘরে । ঘরে ঢুকেই তারা সোজা চলে যায় ওই টেবিলটার সামনে আর প্রথম দেখা দৃশ্যটাতে  হতবাক তৃষা। কারণ তার স্পষ্ট মনে আছে কাল শেষবার যখন সে ঘর থেকে বের হয় তখন ঐ বাক্সটার ঢাকনা খোলাই ছিল। কিন্তু!— কিন্তু এখন তা বন্ধ । এমনকি সামনের আগলটাও আটকানো । এবার তৃষা নিজেই হাত বাড়িয়ে বাক্সটা খোলে আর খুলতেই দেখে সেই হাড় হিম করা ক্রুর দৃষ্টি নিয়ে একজোড়া কুতকুতি চোখ ওর দিকে চেয়ে রয়েছে । আর সেটা দেখতেই আর সহ্য করতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গে তা অবিনাশের হাতে দিয়ে হাঁপাতে থাকে । অবিনাশ একবার ওই পুতুলটিকে দেখছি তো আরেকবার তৃষার দিকে চাইছে। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তৃষা বলে —“সর্বনাশা পুতুল!  যতদিন থাকবে ততদিন আর শান্তি নেই!  আমাদেরকে শেষ করবে , আমাদের মেরে তবেই ওর শান্তি ! ——-কেন ?—-কেন আনতে গেলে?  এক্ষুনি তাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসো । আর আমিও ওটাকে  দেখতে চাই না ! অবিনাশ —“আমি তো বলেছি ভট্টাচার্য দাদুর সাথে আজকেই দেখা করব।  তৃষা—” না আমি কোন কথা শুনতে চাই না!” বাক্স টা বন্ধ করে রেখে গটগট করে অবিনাশ চলে গেল।  তখনই টেলিফোনটা বেজে উঠলো । ওপার থেকে তৃষার কানে ভেসে এলো চন্দ্রিমার গলা —“বুঝলি ! কথাটার মানে হলো প্রতিশোধ নতুন চিনা হরফে লেখা। এই বছর দুয়েক হলো ওহরফ বেরিয়েছে ।” শেষ কথাটা শোনামাত্র তৃষার কপালে চিন্তার ভাঁজ আরো বেড়ে গেল। তবে অবিনাশ বললো—” প্রাচীন চীনা বাক্স ! অকশন হাউস !”আর সহ্য হচ্ছে না এসব তৃষার সে এবার একটা নিষ্পত্তি করবেই ঠিক করে নিয়েছে। হাতে সেদিনের খবরের কাগজটা নিয়ে নাড়ছে চাড়ছে আর এইসব আকাশ-পাতাল ভাবছে। হঠাৎ করেই ওর চোখ যায় সেদিনের প্রধান খবরটাতে , আরেকটা খুন ! আর এইবার এই শহর তথা সরকার প্রশাসন জুড়ে পুরো হুলুস্থুলু শুরু হয়ে গেছে । কাগচ জুড়ে শুধু ওই একই খবর । নানা দিক থেকে নানাভাবে । এইবারেও ওই একই কায়দায় কোন ধারালো শোডের আঘাতে ছিন্নভিন্ন পাঁজর ফুসফুস । আর এবারেও ওই তপন রায়চৌধুরী সহকর্মী বিপ্লব দাশগুপ্ত আর তার মৃতদেহের পাশেও ওই একই কায়দায় পরা লাল চিনার পাতা । হলুদ তারা। যদিও ওর উপরের লেখা শব্দটা ভিন্ন । যা ওই বিপ্লব বাবুর মত ক্ষুরধার সাহসী অস্ত্র বিশেষজ্ঞ কে নির্দেশ করে । ব্রেভারী । এই খুনের  পেছনে যে চীনের কোন ষড়যন্ত্র আছে তা বুঝতে কারোরই কোনো অসুবিধা হয় না। আর কাগজে ওই লাল চিনার পাতাটারো ছবি দিয়েছে। আর ছবিটা দেখতেই একটা কথা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো ওর মনে খেলে যায়। ওই পাতার সরু ফলার মতো অংশটা!  ঠিকই!  তাইতো, কাল যে শুকনো পাতার টুকরো খোলা আলমারি থেকে ওর পায়ের কাছে এসে পড়েছিল ঠিক সেরকমই । দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে যাচ্ছে যে ! তাহলে কোন ভাবে—- অবিনাশ —-ওর স্বামী ! কথাটা ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে অবশ হয়ে আসে। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে । কাল রাতে শোনা ওই  চোঙার একটানা শব্দ যেন ওর মাথার মধ্যে পাক খাচ্ছে অনবরত। ঠিক সেইসময় অবিনাশ এসে দাঁড়ায় ওর সামনে । ওর চোখের নিষ্পাপ চাহনির সাথে কোনভাবেই যেন মেলাতে পারছে না ওর মনে রচনা হওয়া ঘটনার জালকে। তৃষার মন যেন ভেসে চলেছে ওই চিনার পাতার শিরা উপশিরা স্রোতে । আর বাঁকে দাঁড়িয়ে এটাকে ? সামুরাই পোশাক পরা । মাথায় সেই তেকোনা চিনা টুপি আর হাতের সেই শোড্ টা ! যা থেকে টপ্ টপ্ করে তাজা রক্ত ঝরছে!  একি দেখছে সে ! স্বপ্ন না বাস্তব না ইলিউশন !  সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে । শুধু মাত্র ওই ক্রুর দৃষ্টির চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে বাকি কুয়াশায় আচ্ছন্ন । যে চাহনি হাড় হিম করে দেওয়া, শরীরের সমস্ত শক্তি কে কেড়ে নিয়ে অবশ করে দেওয়া। মনে হয় সমস্ত শক্তি দিয়ে শেষ করে দিই ওই শয়তানটাকে!  কিন্তু পারা যায়না। অবশ হয়ে গেছে তৃষ্ণার হাত-পা আর একটু এগোতেই যেন কোথা থেকে আসা লালচে আলোয় স্পষ্ট হয় ওই সামুরাইয়ের চোখ। চোখ থেকে ধীরে ধীরে নাক ঠোঁট  ! হাতে ধরা তরোয়াল ।  ঝলমল করছে জামার ঘন্টা ড্রাগনটা । এ পোশাকটাও ওর খুব চেনা। এ পোশাক সে আগেও দেখেছে । হ্যাঁ মনে পড়েছে ওই পুতুলের পোশাকটার অবিকল পোশাক পড়ে দাঁড়িয়ে ওটাকে ? মুখে সেই নিষ্পাপ হাসি। এ হাসি ওর বড্ড চেনা ,জানা, আপন ! হ্যাঁ তাইতো! হাসিটা তো ………কথাটা মনে হতেই প্রাণ যেন তৃষার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাবে । চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ! মুখের উপরের কুয়াশার আবডাল কেটে গিয়ে পরিষ্কার হতেই  আঁতকে ওঠে সে । এতো ওর  আপনারজন ——অবিনাশ! হা ঈশ্বর ! ………অবিনাশে ডাকে —-” তৃষা ……তৃষা……তৃষা !” আর সে ডাকেই ও যেন ফিরে আসে বাস্তবে। অবিনাশ দাঁড়িয়ে ওর সামনে । কোথায় সেই রক্ত ভেজা তরোয়াল! কোথায় সেই সামুরাইদের বেশ ! ঘরোয়া জামায় ওর স্বামী । তৃষা বলে—“পুতুলটা যত নষ্টের গোড়া! আজও ওটাকেই শেষ  করব।” হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় সেই ঘরে, বাক্স খুলে তুলে নেয় পুতুলটা । অবিনাশও ছোটে ওর পেছনে । বাঁধা দেয়,  কিন্তু তৃষা কোন কথাই শুনতে নারাজ আজ । ও বদ্ধপরিকর ধ্বংস করে তবেই শান্ত হবে । নিশ্চিহ্ন করবে সব শয়তানীর, দুষ্টের উৎসকে।  প্রচন্ড ধস্তাধস্তি চলতে থাকে ওদের মধ্যে হঠাৎ অজান্তেই হাত থেকে ছিটকে পড়ে যায় পুতুলটা। দুজনেই সে দিকে চেয়ে আর মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে চৌচির হয় তা । আর সাথে সাথেই যা বেরিয়ে আসে তা  দু’জনকেই হতবাক করে দেয়। একজন প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় আর আর অন্যজন প্রকাশিত বস্তু থেকে । দুজন আজ দুপ্রান্তে ! একটা যন্ত্র কালো। রংয়ের , আর তা থেকে বেরিয়ে আসতে থাকা কোন দুর্বোধ্য কথা, যে কথার মানে তৃষার জানা নেই কিন্তু তার সাথে উচ্চারিত হওয়ার নামটা— “অ্যাবি—-“ অ্যাবি—– নাশ ” অবিনাশের দিকে চেয়ে দেখতেই দেখে এক হিংস্র বীভৎস দৃষ্টিতেই সে তৃষার দিকে চেয়ে । কোন কথা না বলেই মুহূর্তের মধ্যে বেরিয়ে যায় সে বাড়ি থেকে।
সন্ধ্যা নেমেছে । সারাদিনের ধাক্কা তৃষার মন-প্রাণ সব নিস্তেজ করে দিয়েছে স্নান করে একটু ধাতস্থ হবে বলে বাথরুমে যায় তৃষা । শাওয়ারটা ছাড়ে এদিকে কে যেন একটা বাড়িতে ঢুকেছে চুপিসারে , ওর অজান্তে । জলের আওয়াজে হালকা ভাবে কানে এলেও শুনতে পায় না তৃষা । স্নান সেরে  সবেমাত্র টাওয়েলটা জড়িয়েছে তখনই এক প্রচণ্ড ধরালো আঘাত ধারাল শোডের আর পেছনে ফিরতেই দেখে এক চিনা সামুরাই ! কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে , অস্ফুট গোঙানীতে কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু পারে না । পুলিশ ওই দেহের সামনেও একই রকম একটা লাল চিনার পাতা খুঁজে পায় এযে ওই একই লোকের কাজ তা বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না তাদের।

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। অবিনাশ ওই পড়ার ঘরে ঢোকে কি যেন একটা বের করবে বলে ,  ওই ঘরে থাকা আলমারি থেকে। কি মনে করে ঐ বাক্স রাখা টেবিলটার দিকে তাকাতেই ওর চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসে । তাকিয়ে দেখে টেবিলটার উপর দাঁড়িয়ে সেই সামুরাই পুতুলটা ! কিন্তু এ কী করে সম্ভব!  ওটাতো তৃষা ভেঙ্গে ফেলেছিলো। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে হঠাত খেয়াল হয় আজ তাকে তো শেষ কাজটা করতেই হবে , না হলে ওরা ছাড়বেনা । তৃষ্ণার জন্যে এক ফোঁটা জল মুক্তোর দানার মতো চোখের পাতায় চিকচিক করছে । ও  সেটা হাত দিয়ে সরাতে গিয়েই কেমন একটা অদ্ভুত ঠেকে । চোখের সামনে হাত দুটো নিয়ে এসে দেখে , হাত দুটো যেন তাজা রক্তে ভেসে যাচ্ছে ! ছুটে যায় বেসিনে , বার বার জল দিয়ে , সাবান দিয়ে ধুতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই ওঠেনা ও রক্তের দাগ ! কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারে না সে। এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে অগত্যা আলমারি থেকে একটা গ্লাভস বের করে হাতে পড়ে নেয় সে। তারপর পোশাকটা নেবে বলে আলমারি খুলতে যায় ওদিকে।

পুলিশ ওই ভিখারি প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় পাওয়া খুনির  স্কেচটি করে ফেলে । আর তাতে যে মুখটা ভেসে ওঠে , সে মুখই তৃষা শেষবারের মতো চোখ বোজার আগে দেখেছিল । অবিনাশ আলমারিটা খুলে হাতল থেকে মুখটা তুলে সামনে চাইতেই যা দেখে তা দেখেই বেশ কয়েক হাত ছিটকে যায় । এ কে ? কি করে হতে পারে ? সেই চোখের চাহনি ! সেই হিংস্র প্রতি হিংসা মাখানো চোখ ! আর ঠোঁটে সেই নিষ্পাপ হাসির রেখা । এ কী করে সম্ভব সেতো নিজেই এই হাতেই  ওকে ধারালো শোডের আঘাতে —–আর হতে পারে না সে! আর তখনি ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় ভেসে আসে কিছু কথা ঐ সামুরাই পোশাক পরা মহিলার মুখ থেকে । যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে শব্দ সে গলা—– তৃষার —-হ্যাঁ তৃষারই তো !
—–“অবিনাশ ! আমি ছাড়বো না ! ছাড়বো না তোমাকে ! দেশের ক্ষতি ! আমারও ক্ষতি , শেষ করেছ তুমি আমাকে!  আমি ছাড়বো না !!!!!!”
এতটা বলে ছোট্ট দাদু থামে । আমরা সব হতবাক।  কে যেন জিজ্ঞেস করল “তারপর-“তারপর?” বলল দাদু । আর বলে যা দেখালো,  আমরা সবাই পড়ি কি মরি করে ছুটে  পালালাম সেখান থেকে । হাতের গ্লাভসটা আস্তে করে খুলে,  লম্প কাঁপা আলোর সামনে আনতেই  দেখি তাজা রক্তে ভেজা দাদুর হাত !!!!
বাইরে আবার বিদ্যুত চমকাচ্ছে । বৃষ্টিটা আবার আসবে বুঝি !

 

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ