12 Feb

নৈশ-ভ্রমণ

লিখেছেন:কৃষ্ণ বলদেব বৈদ


(কৃষ্ণ বলদেব বৈদ – জন্ম ২৭ জুলাই’১৯২৭, ভিগা পাঞ্জাব। কয়েক বছর অধ্যাপনা করার পর ১৯৬৬ সালে উচ্চশিক্ষার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট। ১৯৮৫তে নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পদ থেকে অবসর নিয়ে ভোপালে ভারত ভবনের সঙ্গে যুক্ত হন। ২০১০ সালে ফিরে যান মার্কিন দেশে। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক আর সাহিত্য সমালোচনা গদ্যসাহিত্যের নানা মাধ্যমে স্মরণীয় কাজের মাধ্যমে হিন্দি সাহিত্যে আধুনিকতার ভিন্নমাত্রা যোগ করেছেন। প্রথম উপন্যাস ‘উসকা বচপন’ (১৯৫৭) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা। এক ডজনের মতো বই ইংরেজিতে বেরিয়েছে। রচনা অনূদিত হয়েছে ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান, রুশ, পোলিশ আর জাপানি ভাষায়। মৃত্যু ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০।এই গল্পটি অনুবাদ করেছেন  অনিন্দ্য সৌরভ  ) 

ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে আর আমরা বয়স বেড়ে হয়েছি ভূতুড়ে। ওরা উড়ে গেছে যে যার নীড় বাঁধতে, কিন্তু আমাদের বোধ হয় শেষ দিন পর্যন্ত প্রেতের মতো বাড়িটা আগলে থাকতে হবে। ওরা চলে যাবার পরে ক’বছর আমরা ওদের অবলম্বন করেই জীবন কাটিয়ে দিলাম। কখনও ওদের গল্প করে, কখনও ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে, কখনও ওদের আসার অপেক্ষায় দিন গুনে, কখনও বা চলে যাওয়া নিয়ে অভিমান করে। ওরা এলে অবশ্য পুরনো মতভেদগুলো প্রায়ই চাগাড় দিয়ে উঠত। পরে তা-ই নিয়ে মরমে মরে যেতাম। সেই সময় কখনও স্ত্রীর দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখলে মনে হত যেন নিজেরই ভীত-সন্ত্রস্ত প্রতিচ্ছবি দেখছি। ছেলেমেয়েদের দৃষ্টিতে কোনওদিন দয়া বা ত্রাসের ইঙ্গিত পেলে আমার পরলোকগত বাবা-মা’র কথা মনে পড়ে যেত – বৃদ্ধ আর ভূতুড়ে। ভাবতাম তাঁরাও নিশ্চয়ই হঠাৎ একদিন বুঝতে পেরেছিলেন, সন্তানরা বড় হয়েছে এবং তাঁরা বৃদ্ধ আর ভূতুড়ে হয়ে যাচ্ছেন। হয়তো আমার কিংবা ভাইয়ের দৃষ্টিতে দয়া ও ত্রাসের ইঙ্গিত দেখে তাঁদের নিজেদের বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে যেত। এমনও একদিন আসবে, ছেলেমেয়েরা হঠাৎ করে বুঝতে পারবে যে ওদের সন্তানরা বড় হয়েছে এবং নিজেরা বৃদ্ধ ও ভূতুড়ে। তখন হয়তো ওরা আমাদের মনে করবে।
জীবনের এই কঠিন সময়টাতে কখনও সখনও শখ হত উপকথার বৃদ্ধ পিতাদের মতো ছেলেমেয়েদের সবাইকে কাছে ডেকে কয়েকটা শেষ উপদেশ দেবার, যাতে তাদের বার্ধক্য আমাদের মতো ভূতুড়ে না হয়। তবে ভয় হত, আমার কথা শেষ পর্যন্ত শোনবার ধৈর্য তাদের থাকবে কি না কিংবা আমার নিজেরই কথাটা পুরো বলবার হয়তো ইচ্ছে হবে না। হয়তো সে কথার মূল্য সম্বন্ধে নিজেরই সন্দেহ হবে আর সেই দ্বিধাকে চাপা দিতে গিয়ে দেখব, আন্তরিকতার অভাবে কথাগুলো কেমন অলীক শোনাচ্ছে। পরে মনে হত, হয়তো শেষ বয়সে বাবারও এ রকম ইচ্ছে হয়েছিল। তিনিও কি আমার মতো ভয়ে-দ্বিধায় ইচ্ছেটা প্রকাশ করতে পারেননি? যদি বা কোনওদিন সমস্ত ভয়-দ্বিধা জয় করে ছেলেমেয়েদের কাছে ডেকে সব বুঝিয়ে বলতে শুরু করি, তবুও জানি সেকথা শেষ করা যাবে না। ওদের চোখে দয়া ও ত্রাসের ইঙ্গিত সহ্য করতে পারব না, হয়তো আমাদের চোখে ত্রাস দেখে ওরাও যেনতেন প্রকারে বয়সের আগেই বৃদ্ধ আর ভূতুড়ে হয়ে যাবে।
স্ত্রী আর আমি কঠিন সময়টা পেরিয়ে আজও বেঁচে আছি। এই আশাটুকু থেকে যতটা পারি সান্ত্বনা নিংড়ে নেবার চেষ্টা করি। অসতর্ক মুহূর্তে মনে হয় এরকম বেঁচে থাকার চেয়ে শেষ হয়ে যাওয়াই ছিল ভাল। এই সমস্ত অসতর্ক মুহূর্তের তীব্রতা অবশ্যই ইদানীং কমে আসছে। ইচ্ছেগুলি জন্ম নেবার সঙ্গে সঙ্গেই মরে যায় – আরও অনেক আকাঙ্ক্ষার মতো। বোধ হয়, সেই জন্যই ইদানীং সারাক্ষণ নিজের শরীর থেকে একটা মৃদু অথচ ভয়ানক গন্ধ পাচ্ছি। স্ত্রীর কথা অবশ্য জানি না। আমরা আজকাল নিজ নিজ জগতে বাস করি। একই বাড়িতে বাস করি- দুটি বন্ধু প্রেতের মতো কিংবা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া  বৃদ্ধ ভাইবোনের মতো। পরস্পরের দিকে না তাকিয়ে, কথা না বলে দিনের পর দিন কেটে যায়। আমাদের অবস্থা এই। কিংবা বলা যায় সাম্প্রতিক জটিল বিপদটি ঘটবার আগে পর্যন্ত এ হাল ছিল। এদিকে নতুন বিপদ এসে হাজির, তারই জট ছাড়াবার জন্য আজ বহু বছর পর ক্রন্দন-কক্ষে এসে বসেছি।
বিপদটির শিকড় খুঁজতে গিয়ে আবার পৌঁছে যাই সেই গন্ধে, যা জীবনের এই পর্যায়টিকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। আমার বিশ্বাস, বার্ধক্যে ভূত হয়ে যাওয়া সবাই শেষের দিকে এই গন্ধে কম বেশি বেহাল হয়ে পড়ে। তবে গন্ধটা সবাই সমানভাবে পায় না। এর প্রভাবও  সবার ওপরে সমান না। আমার ক্ষেত্রে গন্ধটার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম সম্পূর্ণভাবে অন্তর্ধান করল। ঘুমের অভাবে রাত কাটানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে। কোনও ঘুমের ওষুধেই কাজ হয় না। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটানো অসহ্য হয়ে উঠলে ঠিক করি নৈশ-ভ্রমণ করে সময়টা কাটাব। ভাবলাম কয়েক ঘণ্টা ঘুরে বেড়ালে বেশ খানিকটা ক্লান্তি আসবে, ঘুমের মতো কিছু একটা এসে দেহমনকে সাময়িকভাবে মুক্তি দেবে – রাতের মরুভূমিটা এই করে পেরিয়ে যাব।
কিন্তু ঘটনা এই, নৈশ-ভ্রমনের সময়েই শরীরটা নিস্তেজ হবার বদলে হয়ে ওঠে আরও সক্রিয়। তাই ঘুমের জন্য অপেক্ষা করার ঝেমেলা থেকে একেবারে মুক্ত হয়ে গেলাম। গোড়ার দিকে এ রকম অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়ায় খুশি হবার বদলে বেশ চিহ্নিতই হয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল আমার সঙ্গে যেন কেউ ঠাট্টা করছে কিংবা আমি নিজের আর স্ত্রীর সঙ্গে নির্ঘাৎ প্রতারণা করছি – বার্ধক্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের অভব্য ও বিপজ্জনক লড়াই চালিয়ে। ভাবলাম, ছোট্ট বাড়িটা পায়চারি করতে করতে হঠাৎ এক রাতে দুম করে মরে যাব। শেষ চিন্তাটা থেকে বিকৃত ধরনের স্বস্তি পেতাম, অন্য ভয়গুলো চাপা পড়ে যেত। পুনরায় সতেজ হয়ে উঠে এমনভাবে পদচারণা শুরু করতাম যেন অন্ধকার বাড়িটা কোনও খোলামেলা উদ্যানের চেয়ে কম নয়।
গোড়ার দিকে অন্য চিন্তা ছিল। কোনও শব্দ শুনে স্ত্রীর ঘুম ভেঙ্গে গেলে তাকে কি করে বোঝাব, কোথায় যাচ্ছি বা কোত্থেকে ফিরছি? সেজন্য আরও কয়েকটা কৈফিয়ত মনে মনে তৈরি করে রাখতাম। বিছানা ছাড়ার আগে নিশ্চিন্ত হবার চেষ্টা করতাম যে ও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বিছানায় সশব্দে পাশ ফিরতাম, ইচ্ছে করে কাতরাতাম, ওকে নাম ধরে ডাকতাম, এমনকি আধা-কাল্পনিক মেয়েদের নাম ধরে ডেকে দেখতাম। ওর ঘুম কিছুতেই ভাঙবার নয়, নিঃসন্দেহ হলে, শুরু হত আমার ভ্রমণ।
এখানে কেউ আপত্তি জানাতে পারে – নিজের ছোট্ট বাড়িটা চষে ফেলাকে তুমি ভ্রমণ করা বলছ? ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটা কাগজে লিখে উঠতে পারলে যে আপত্তি জানাচ্ছে সে অবশ্যি চুপ করে যাবে। তবে আমার বিশ্বাস, রাতের ব্যাপারটা কাগজে জানাতে পারব না। চেষ্টা করলেই তা স্বপ্নের মতো উবে যায়। কয়েকটা বিচ্ছিন্ন শব্দ দিয়ে ঘটনাগুলি বর্ণনা করার চেষ্টা করছি।
প্রথম ক’রাতের পরে বিছানা ছাড়বার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম আমি বাড়িতে নেই। আসলে কোথাও নেই। যেখানে আছি সেটা আদৌ বাড়ি নয়। ভ্রমণের এই দ্বিতীয় পর্যায়ে আমার চারপাশে ছড়ানো আলোর বৃত্ত দেখতে পেতাম, যা ঠিক করে বর্ণনা করবার উপযুক্ত ভাষাজ্ঞান আমার নেই। চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যেত দেয়াল আর দরজা। সমস্ত আসবাবপত্র, মায় আশা-আকাঙ্ক্ষা পর্যন্ত কোথায় উবে যেত। কোনও শব্দ কানে আসত না, একটা মানুষও চোখে পড়ত না। এমনকী নিজের শরীরটাকেও বায়ুভূত মনে হত। কোনও স্মৃতি, বিপদ বা সম্ভাবনার ভস্মাবশেষও তখন কোথাও উড়ছে না।
কেউ চেঁচিয়ে উঠতে পারে – কী চোখে পড়ত – তাই বলো না কেন! ভ্রমণের সেই পর্যায়ে আমার চোখে পড়ত শুধু একটা আলো – যার বর্ণনা করা অসম্ভব। পরের পর্যায়ে যা দেখতাম তা বর্ণনা করতে পারি শুধু দুটি শব্দে – কিছুই না। এই মামুলি কথায় নিজের সংশয় মেটে না – অন্যের কীভাবে মিটবে!
অবশ্য যতদিন নৈশ ভ্রমণ চলছিল ততদিন তার বর্ণনা বা ফলাফল বিশ্লেষণ করার প্রশ্নও ওঠেনি। প্রথম ক’রাতের পর তো এও মনে পড়ে না, ভ্রমণ কখন শেষ হত আর কীভাবে বিছানায় ফিরে আসতাম। ক’রাত ভ্রমণ করেছি, তাও মনে নেই। সেদিন আচমকা স্ত্রী আমার ঘোর কাটিয়ে না দিলে হয়তো আজও প্রতিটি রাত সেই অবস্থায় কাটাতে পারতাম, যার কথা না পারি বলতে আর না পারি ভুলতে! স্ত্রী খুব আটপৌরে ভঙ্গিতে কথাটা শুরু করে, ‘আজকাল তোমার বুঝি ঘুম হয় না?’
অস্বস্তি বুঝতে না দিয়ে উত্তর দিলাম – ‘না, সত্যি ঘুম হচ্ছে না।’ দীর্ঘ অর্থপূর্ণ নৈঃশব্দ্যের পর সে জিজ্ঞেস করে, ‘সারা রাত কোথায় বেপাত্তা থাকো?’
মনের চাঞ্চল্য প্রকাশ না করে বললাম, ‘কোথায় আর যাব! বাড়িতেই একটু এদিক-ওদিক ঘুরি যাতে আমার ছটফটানিতে তোমার ঘুম না ভাঙে।’
ভেবেছিলাম প্রসঙ্গটার এখানেই ইতি হবে। এই বয়সের একটা সুবিধে, আজকাল কোনও বিষয়কে নিয়ে বেশি টানা হ্যাঁচড়া করতে হয় না। যে কোনও আলোচনা মাঝখানে ছেড়ে দিয়ে যে যার নৈঃশব্দ্যে আশ্রয় নিতে পারি। কিন্তু সেদিন তা হল না।
আর একটি দীর্ঘ ও অর্থবহ নৈঃশব্দ্যের পর ও আমাকে যা বলল তার সারমর্ম এই; বোধহয় জানো না, যখন তুমি রাতে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াও তখন ঠিক তোমার মতো দেখতে একটা লোক বিছানায় পড়ে থাকে। প্রথম রাতে তোমাকে বিছানা ছাড়তে দেখে চুপচাপ শুয়ে লক্ষ করছিলাম, তুমি কী করো! তুমি চলে যাবার পরই চোখে পড়ে তোমার বিছানায় একজন লোক। ভাবলাম দুস্বপ্ন দেখছি। উঠে এসে লোকটাকে ঝাঁকাতে শুরু করি। ওর মুখের ভাবশূন্যতা অবশ্য আগের মতোই রইল, কিন্তু মনে হল শরীরটা যেন ক্রমশ সজাগ হয়ে উঠছে। ভয় পেয়ে নিজের বিছানায় ফিরে এলাম, সেখান থেকে ওটাকে একটা মৃতদেহ মনে হল। তোমার ফেরার অপেক্ষা করতে করতে জানি না কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। সেই থেকে প্রতিরাতে এই তামাশা চলছে – তুমি বিছানা ছেড়ে উঠলে স্পষ্ট দেখতে পাই তোমার মতো দেখতে একজনের দেহ থেকে তুমি আলাদা হয়ে যাচ্ছ। আমি তোমাকে ডাকতে চাইলেও পারি না। তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাই অথচ নড়তে পারি না। কেবল তোমাদের পরস্পরের দেহ থেকে আলাদা হয়ে যেতে দেখি আর ভাবি, দুঃস্বপ্ন দেখছি। ঘর ছেড়ে বেরোবার আগে তুমি ওর আর আমার প্রতি এমন নির্মম দৃষ্টি হানো, যে মনে হয় কাউকে ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছ। যতক্ষণ এ সমস্ত হয়, ততক্ষণ ঘরে আবছা আলো ছড়িয়ে থাকে – আর তুমি চলে গেলে সব আলো চারপাশ থেকে গুটিয়ে লোকটার ভাবশূন্য মুখের ওপর এসে পড়ে। ক’বার উঠে লোকটাকে ঝাঁকুনি দিয়েছি – তার মুখখানা তেমনি ভাবলেশহীন থাকলেও শরীরটা বেশ সতেজ মনে হয়। ভয়ে ভয়ে আমি নিজের বিছানায় ফিরে এলে ওকে আবার একটা মৃতদেহের মতো দেখায়। বুঝতে পারি, তুমি ওর কাছে আমাকে একলা ছেড়ে কোনও গোপন, বিপজ্জনক কাজে বেরিয়ে গিয়েছ। প্রতিরাতে মনস্থির করি যে তোমার ফেরা পর্যন্ত একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকব যাতে দেখতে পাই, কখন কী ভাবে তোমরা আবার এক হয়ে যাও, কিন্তু প্রতিরাতেই কেন যেন চোখদুটো ঘুমে জড়িয়ে আসে। এতদিন এই দুশ্চিন্তা নিয়ে আছি। এখন দেখছি, তুমি এ সমস্ত কিছু জানো না। এদিকে এক নতুন ভয় আমার রক্ত শুষে নিচ্ছে। আশঙ্কা হয়, কোনও রাতে তুমি আমাকে ওর কাছে ফেলে রেখে চিরকালের মতো গা ঢাকা দেবে।
ওর দীর্ঘ বৃত্তান্তের উত্তরে যা বললাম তা এতই অর্থহীন শোনাল যে কথার মাঝখানেই ও উঠে বিছানায় শুতে চলে গেল। এরপর থেকে আমরা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেছি। আমার নৈশ-ভ্রমণ বন্ধ। সারারাত অস্থির হয়ে ভাবি -কোনটা তাহলে সত্য! স্ত্রী সারাক্ষণ পাশ ফেরে না তবু জানি ওর চোখে ঘুম নেই। সে হয়তো ভাবছে, কোনটা সত্য।
কখনও ভাবি, আমার অহেতুক নৈশ-ভ্রমণ বন্ধ করাবার জন্যই ও এই উপায়টা ভেবে বের করেছে। পরে অমন নীচ সন্দেহে নিজেই লজ্জা পাই। ভাবি – ওকে বুঝিয়ে বলব, এতদিন আমরা একটা যুগ্ম-দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। হয়তো সেই দুঃস্বপ্নের মধ্যে আমি ঘুরে বেড়াতাম, আর ও দুঃস্বপ্নের মধ্যেই আমাকে বিছানা ছাড়তে দেখত, সেই সঙ্গে শুয়ে থাকতে। কথাটা নিজের কাছেই এমন অবাস্তব শোনাচ্ছে যে ও কিছুতেই বিশ্বাস করবে না।
মাঝে মাঝে ভাবি, ওকেও সারারাত বেড়াবার পরামর্শ দিই, কিন্তু জানি অন্ধকারে নিরর্থক ঘুরে বেড়াবার প্রস্তাবে ও সম্মত হবে না। যদি সেই আলোকবৃত্তের কথা বলি বা ভ্রমণের কৈফিয়ত দেবার চেষ্টা করি, তাহলে ভাববে আমি ওকে ছেড়ে কোথাও চলে যাবার কথা ভাবছি। ও হয়তো মেনে নেবে যে আমি রাতের অন্ধকারে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াই, তবু কিছুতেই বিশ্বাস করবে না – এভাবে ঘুরতে ঘুরতে আমি মায়া ও কায়ার বন্ধন-মুক্ত হয়ে যাই। ওর জন্য মাথা না ঘামিয়ে আবার বেড়ানো শুরু করব। হয়তো এভাবে ভ্রমণ করতে করতেই কোনও রাতে সত্য খুঁজে পাব। কিন্তু এই বয়সে, জীবনের এই কঠিন পর্যায়ে ওর প্রতি অতটা নির্দয় হতে পারি না। কখনও বা ভাবি, ওকে কিছুদিনের জন্য ছেলেমেয়েদের কারো কাছে চলে যেতে বলব। কিন্তু ভয় করে, ও চলে গেলে আমার কী হবে! চুপচাপ শুয়ে থাকি এই আশায় যে হয়তো কোনওদিন এই সমস্যার নিজে থেকেই সমাধান হবে। তারপর সব ভুলে দু’জনে আবার শেষদিনের অপেক্ষা শুরু করব। আর একটা আশাও হয় – হয়তো কোনও রাতে দু’জনে একসঙ্গে ভ্রমণে বেরুব। তখন বিছানায় আমাদের মতো চেহারা এবং বয়সের দুটি মৃতদেহ পাশাপাশি পড়ে থাকবে, পরস্পরের অজ্ঞাতে, বিচ্ছিন্ন।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ