28 Feb

তৃষিতকাল

লিখেছেন:জীম হামযাহ


আমি যদি কোন চিত্রকর হতাম তাহলে পটে তার ছবি আঁকতাম। তারপর সে ছবি হয়তো ফেসবুকে আপলোড করে,পত্রিকার পাতায় ছাপিয়ে কিংবা পোস্টার বানিয়ে দেয়ালে দেয়ালে সাটিয়ে দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিতাম- এই সেই মেয়ে, এই সেই মেয়ে যাকে আমি খুঁজছি। যদি আমি আত্রেয়ি তীরের মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গের মতো হতাম, তাহলে তার পুত্তলি বানিয়ে লগে নিয়ে ঘুরতাম আর লোকজনকে দেখিয়ে বলতাম- এই মেয়েটাকে খুঁজছি। তোমরা তাকে চিনো? তার নাম ঠিকানা পরিচয় আমাকে দিতে পারবে? কিন্তু আমার অক্ষমতা যে, আমি কোন ভাষ্কর্য্য শিল্পীও নই। আমার কলমের কালির রং কালো। আমার কলম চালনা হাত কেবল কালো কালো অক্ষর এঁকে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে বাক্য বুনতে জানে। আমি নিরুপায় যে, সেই বাক্য দিয়ে মেয়েটির চেহারা তার অবয়ব সুরত হুবহু আঁকতে পারি না। যা পারি তা বর্ণনা। আর বর্ণনা দিয়ে কাউকে অবিকল বুঝাতে পারিনা যে, আমি ঠিক এই মেয়েটিকে খুঁজছি। একটি বারের জন্য হলেও তার সাথে আমি দেখা করতে চাই।

বলতে পারেন-তার সাথে কী এমন সম্পর্ক, কী এমন প্রণয় যার জন্য এতো ব্যাকুল!

প্রশ্নটি ফালতু নয়। সঙ্গত প্রশ্ন বটে। আমি তার নাম পরিচয় কিচ্ছু জানি না। তার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো একদিন মাত্র। তাও দিনের সামান্য অংশ। চলতি পথে ক্ষণকালের সম্পর্ক।  যেমন পথচারী দুই পথিকের রাস্তায় দেখা হয় আর পথ চলতে গিয়ে কিছুটা ভাব বিনিময় হয়। আবার কিছুদূর যাবার পর দুজনের গন্তব্য হয়ে যায় ভিন্ন। চলে যায় যে যার পথে, ঠিক তেমনই ধরে নিতে পারেন। কিন্তু সেই মেয়েটি এটুকু সময়ে আমার মরমে গভীর রেখাপাত করে গেছে, যা এখন মুছতে পারছি না কোন ইরেজারেও। তার ডাগর দুচোখের দৃষ্টিফলায় আমার হৃদয়ে গভীর গর্ত তৈরি করে গেছে। তার দরদি কণ্ঠ আমাকে আবদ্ধ করেছে ব্যঞ্জনার বৃত্তে। তার সুকোমল স্পর্স আমার রক্তকণিকায় সৃষ্টি করছে নৃত্যের পর নৃত্য। সামান্য একটি মেয়ের যে এতো শক্তি থাকতে পারে আমি আগে কল্পনাও করিনি। আজ আমি বুঝেছি সেদিন আদম কেন প্রথম দৃষ্টিতে এতো ব্যাকুল হয়েছিলেন।

আমার মনে হয়, সৃষ্টিকর্র্তা সমগ্র ধরিত্রীতে যতো রহস্য রেখেছেন, তার অর্ধেক রেখেছেন নারীর মাঝে। আর রহস্য বলে সে বিচিত্র শক্তির অধিকারীনীও বটে। একজন মেয়ের, একজন নারীর এতই শক্তি যে, তার সুহাসিনী কথামালা চারদিকে মায়াজাল ফেলে ঘোরের আবেষ্টনী তৈরি করতে পারে। তার দু চোখের দৃষ্টি হতে পারে ধারালো তরবারি কিংবা সু তীক্ষè তীরের ফলা যা হাজারটি নয় একটি মাত্র দৃষ্টি পুরুষ হৃদয়কে যখম করার জন্য যথেষ্ট। তার পলকের ওঠা নামা মুহূর্তে চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে। তেমনি তার হাসির ক্ষমতাও অপরিসীম। যদি তার কোমল স্পর্সের কথা বলি-তার কোমল স্পর্স তৃষিত মরুকে সিঞ্চিত করে তাতে ফলবান বৃক্ষের উদ্যান জন্মাতে পারে। শুধু কি তাই? তার সামান্য ইঙ্গিতে যুদ্ধ যেমন প্রণীত করতে পারে তেমনি আবার যুগপৎ সন্ধিতেও আবদ্ধ করতে পারে। সে যেমন শান্তির সুশীতল আশ্রয় আবার অশান্তির দাবানল বটে! শুনেছি জ্ঞানীর জবানে- নারীকে বেশি জানতে যেয়ো না, তার বক্রতাও বেশি খুঁজতে যেয়ো না, জীবনের পথে অশান্তি নেমে আসবে।

যদি আমি বুঝাতে নাও পারি, তবে সেদিনের পর আমি ঠিকই অনুভব করি একজন নারীর কতো শক্তি। সেদিন যখন সে চলে যায়, পেছনে রেখে যায় একটি বিবশ মূর্তি! যখন তার স্পন্দন ফিরে আসে, নিজেকে দেখতে পায় আফসোসের  বন্দরে মাথা ঠুকে মরছে!

তার ছবি এঁকে রেখেছি আমার হৃদয়ের পটে। জীবন্ত সে ছবি শুধু আমি দেখি কিন্তু কাউকে দেখাতে পারি না। পরিস্থানের শাহজাদির মতো সে কখনো দৃশ্যমান হয়। আমার সাথে কুহেলিকাও খেলে। তাকে জিজ্ঞেস করি বালিকা তোমার নাম কী? সে হাসির উতরোল ছড়িয়ে দেয়। আমার ব্যাকুলতা তাকে কৌতুকের স্বাদ দেয়। ব্যাকুল মন আবারও যখন জিজ্ঞেস করে, সে বলে- দাও না একটা নাম রেখে যে নামে তুমি আমায় ডাকবে। তারপর আবার সে আমাকে হাসির উতরোলে ডুবিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।

আচ্ছা বলো, আমি তার কী নাম দিবো, কী নামে তাকে ডাকবো? আর আমার দেয়া নামে কি তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব? আমি তো তাকে আপাতত তার নামেই খুঁজে পেতে চাই। কিন্তু তার নামটা যে আমি জানি না! আমাকে কুড়ে কুড়ে খায় কেন আমি তার নাম জিজ্ঞেস করলাম না। যদি তার নামধাম জেনে যেতাম তাহলে আজ এ কাহিনী অবতারণার কোন প্রয়োজন থাকতো না। যা থাকতো তা একান্ত ব্যক্তিগত। কিন্তু এখন যা আছে তা আর একা নিজের ভেতর চেপে রেখে বইতে পারছি না। নিজেকে একটু হালকা করার প্রয়োজনীয়তাও তীব্র। সেই মেয়ে আমাকে পীড়িত করে চেতনে অবচেতনে। আমি প্রতিনিয়ত অনেক চেহারার মুখোমুখি হই। মনে মনে মিলাই, মিলে না। কেউ সে নয়, কেউ তার মতো অবিকলও নয়, যার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো ১৪ই ফেব্রুয়ারি!

ভালবাসতে কোন দিবস লাগে না। তবুও মাইনষে কয় ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালবাসা দিবস। আর নিসঙ্গ তৃষিত জীবনে এ দিন ভালবাসা দিবস হলেও কী আর না হলেও কী? সঙ্গিহীন একাকী মরমে এদিন আলাদা কোন তাৎপর্য নিয়ে আসে না। যা আনে কেবল হাহাকার। চারদিকের সুর,ছন্দ আর জুটিবদ্ধ কোলাহলের মধ্যে থাকে খুব নিরবে চাঙ্গা হওয়া একাকীত্বের বেদনা। কোকিলের ডাক- সেতো করুণ মূর্ছনা! দখিনা বাতাসে হু হু বিরহী সুর। যখন খুব নিরবে আমার কৃষ্ণচূড়া, পলাশ ঝরে ঝরে জৈব হচ্ছিলো তেমনি হাহাকার আর রোদন ভরা বসন্তের এই দিনে সে আমার জগৎব্যাপী নির্জনতায় খুব সুক্ষ্মভাবে আলোড়িত করে গেছে। আর আমার শাখায় প্রশাখায় ছড়িয়ে দিয়েছে ভরা ফাগুন!

আমার পাশের সিটে আনত তার হিজাবী মুখখানি জ্বলছিলো সন্যাসীর জ্যোতির মতো। তার অনাবৃত বাহু থেকে হাতের আঙ্গুলি হয়ে ঠিকরে ঠিকরে পড়ছিলো জোৎস্নাজ্জ্বোল আলো। তখন ফাগুনের শেষ বিকেলের রোদে তার টিকালো নাকের চূড়ায় কয়েক বিন্দু ঘাম মুক্তাণুর মতো বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো। আর রমণীয় লাজুকতা সে ছিলো এক অপার্থিব সুন্দর্য্য! সত্য কথা বললে আমি নিজেও ছিলাম সঙ্কুচিত।  কারো সাথে কোন কথা নেই কিন্তু সেই নিরব পথযাত্রায় আমাদের অজান্তে ক্ষণে ক্ষণে লেগে যাচ্ছিলো দু চোখের  সংঘর্ষ। সংঘর্ষে সংঘর্ষে কুয়াশা অনেকটা সরে যায়। তারপর একটু একটু করে ভাঁজ খুললো। লম্বা পথ শেষে গাড়ি যখন  হুমায়ূন রশীদ চত্ত্বরে থামলো আমরা নেমে গেলাম।

‘বন্দর বাজার যখন যাবেন আমাকেও সাথে নেন।’ জড়সড় কণ্ঠ তার।

এ শহরটা তার এতোটা চেনাজানা নেই। শ্রীমঙ্গল থেকে এসেছে। হ্যাঁ, সে শ্রীমঙ্গলের কথাই বলেছিলো। আমি এটুকু জবাবে সন্তোষ ছিলাম। আর কিছু জিজ্ঞেস করি নি। উঁচু-নিচু টিলা আর চায়ের বাগান।  সবুুজে বিস্তার শ্রীভূমির মেয়ে সে? অপার্থিব সুন্দর্য্য হাতছানীতে ডাকে । মানুষ ছুটে আসে চায়ের দেশে। চায়ের পাদদেশে বাড়ি হওয়ায় সে সব আমাকে হয়তো এখন আর খুব আকৃষ্ট করে না কিন্তু চায়ের কাপের উত্তাপ আর ঘ্রাণে কখনো সোনা মুখখানি জেগে ওঠে ধোঁয়ার ওপাশে। শিল্পকলা একাডেমিতে যাবে। সেখানে এখন পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপিয়েছে। এটুকু পথচলায় আমার ওপর যেন তার ব্যাপক নির্ভরতা। হাসি বিকশিত মুখে ক্ষণে ক্ষণে আমার দিকে তার চাহনি। রিক্সার ঝাঁকুনিতে নিবিড় স্পর্শ-মুহুর্তে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইলেও দূরত্ব ঘুচে না। আড়চোখের দৃষ্টিতে কখনো ধরা পড়ে সে আরক্ত হয়ে নিজেকে আরও সরাতে যেয়ে কাছেই থেকে যায়।

জ্যামে যখন অনেক্ষণ যাবত চাকা আটকে আছে সে কিঞ্চিৎ উদ্বেগে বলেছিলো, সামনে কিছু হয়েছে নাকি? আমি তাকে নিয়ে নেমে পড়ি। কোন নির্দেশনা ব্যাতিরেকে সে আমার সাথে সঙ্গতি রেখে পাশাপাশি কদম ফেলছিলো। তার কথা বলার ভঙ্গিতে মুখাবয়ব জুড়ে অসাধারণ আর্টের কারিশমা! চোখের পল্লবের ওঠানামার সাথে তার ঠোঁটে ছিলো প্রসারিত হাসি রেখা। আমরা ধীর লয়ে সমান তালে পা ফেলছিলাম মানুষের ভিড়ে। গাড়ির ফাঁকফোকরে হাঁটতে সে হয়তো অভ্যস্থ নয়। তাকে খুব আগলে আগলে পার করতে হচ্ছিলো।  সে যখন আনত আনয়নে হাঁটছিলো, কথা বলার ফাঁকে তার আড় চোখের চাহনী আমার দৃষ্টি এড়ায় নি। আর আমার দুচোখের আকুলতা কি তখন কম ছিলো? চোখ চোখকে ঠিকই টানে।

মৃদু লয়ে তার সাথে কথা বলতে বলতে আমার হৃদয়ের কোন এক এস্রাজে বাসন্তী বাতাসের দোলায় অদ্ভূত শিহরণে আমি পুনঃপুনঃ কেঁপে উঠছি আর  এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলাম। সহসা  আন্দাজ করি অনুরূপ শিহরণে তার কণ্ঠও কম্পমান।  নিজেকে গোছাতে যেয়ে  আরো এলোমেলো হয়ে যাই।  যতো গোছাতে আসি গভীর অনুরাগে ততো এলোমেলো হই। আর এও প্রার্থনা করি- হে পথ তুমি আরও দীর্ঘ হও, ফুরিয়ে যেয়ো না। যতো দূরত্ব হোক এ পথে হাঁটতে আমার ক্ষøান্তি নেই!

প্রেম কি খুব আয়োজন করে আসে নাকি এভাবেও আসে? আমি তার নাম পরিচয় জানতে পারতাম। নাম্বারটাও নিতে পারতাম। সে মেয়ে ছিলো, লজ্জাবিষ্টতার দেয়াল টপকাতে পারে নি। কিন্তু আমি? হায়রে আমি! তাকে এভাবে ছেড়ে না দিয়ে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেই নি কেন? যে নির্ভরতা ছিলো চাইলে বিশ^াসের ডানায় ভর করে তাকে নিয়ে তেপান্তরের মাঠও পাড়ি দিতে পারতাম। কী এক ভাবনার দোলাচলে দোল খেতে খেতে আত্মমগ্নতার গভীরে ডুবতে থাকি। আর ডুবতে ডুবতে খেই হারাই। হারাতে হারাতে নিজের থেকে চলে যাই আরও দূরত্বে! অবিন্যস্থ মনে সহসা গাড়িতে উঠার নির্দেশ সে প্রত্যাশা করে নি। সে আমার দিকে তাকিয়ে রয় নিরব দৃষ্টিতে। আমি আবার বলি- উঠুন, এটা আপনাকে গন্তব্যে নিয়ে যাবে। সে আমার দিকে কেবল তাকিয়ে রয়। আমি তার চোখের ভাষা বুঝি না। তারপর সে ইতস্তত পা বাড়ায়। গাড়িতে উঠার প্রাক্কালে হাত নেড়ে নেড়ে আমার প্রতি যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলো, তার সে পূর্ণ চাহনী আমাকে শুধু ঝলসে দেয় নি, তার ডাগর ডাগর দুটি আঁখি আমাকে প্রচণ্ডভাবে যখম করেছে। পরক্ষণে অনেক প্রশ্ন এসেও আমাকে বিদ্ধ করতে থাকে।

চোখের সামনে থেকে সে যখন অদৃশ্য হয়ে যায়, পিছনে রেখে যায় বিশ^ব্যাপী সুর-সঙ্গীত আর কোলাহলের ভিড়ে রাস্তার পিঠে দাঁড়িয়ে থাকা নির্বাক-নিশ্চল, নিঃসঙ্গ-একলা এক বিবশ মূর্তি!

Tags: ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ