28 Feb

যে গল্পটা লেখা হলনা

লিখেছেন:অনিলেশ গোস্বামী


নাছোড়বান্দা মেয়েটা প্রায়ই বলে কথাটা।

—  একটা কিছু করুন স্যার

—  কী করবো বল্ ? আমি বললেই কি শুনবে ?    তাছাড়া আমি তো তাকে চিনিনা , দেখিইনি    কখনো।

—  শুনবে , ঠিক শুনবে । আপনার কথা ফেলতে    পারবেনা। যদি আপত্তি না থাকে তাহলে    আপনার কাছে একদিন নিয়ে আসবো ?

এইরকম কথোপকথন মাঝেমাঝে চলে। ছন্দা এককালে আমার ছাত্রী ছিল, বাড়িতে এসে পড়তো। সপ্তাহে দুদিন হায়ার সেকেন্ডারীর বাংলা । অসম্ভব মেধাবী আর তেমনই মিষ্টি দেখতে । বর্তমানে বাংলা অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সিতে পড়ছে। এখনো মাঝেমধ্যে কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে আসে। ছন্দা একটু একটু করে আমার বাড়ির মেয়ের মতো হয়ে গেছে। আমার স্ত্রীও ওকে খুব ভালবাসে, তবে মনের প্রাণের যত কথা সবটাই বোধহয় আমার সঙ্গে। আমার ওপর ওর খুব ভরসা।

ইদানিং সে একটা ব্যক্তিগত সমস্যার মধ্যে আছে। একটি প্রায় অশিক্ষিত হাফবেকার ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস। ছন্দার বাড়িতে জানাজানি হয়ে যাবার পর ওদের রক্ষনশীল পরিবারে এই নিয়ে নিত্য অশান্তি।

একদিন ওকে জিজ্ঞেস করলাম,

—  তোর সঙ্গে কোথায় আলাপ হলো ?

ছন্দা মুচকি হেসে বললো, আপনাকে একদিন সব বলবো, আপনাকে তো বলতেই হবে।

সেই ‘ একদিন ‘ এলো মাসখানেক পরে। ইতিমধ্যে আমারও অনেক ব্যস্ততা ছিল। স্কুল থেকে তিনবছর আগে অবসর নিলেও বাড়িতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের আসা-যাওয়া লেগেই আছে। একটা ব্যাচে চারজনের বেশি পড়াইনা । সবাই জানে আমি ধরাবাঁধা নিয়মে পড়াই না । ভালো লাগলে ঘন্টার পর ঘন্টা চলে।

এইরকম একটা সন্ধ্যায় ছন্দা এসে হাজির। সেদিন আমারও বিশেষ কাজ ছিলনা। বসতে বলে সরাসরি প্রশ্ন করলাম ,

—  কিরে,ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলিনা,কী করে বা কী পড়ে কিছুই জানিনা।

ছন্দা বেশ গুছিয়ে জবাব দিল, কীভাবে পড়বে বলুন । ও তো বলতে গেলেএকা । মা-বাবা অনেক আগেই মারা গেছে।দাদা বৌদিরা এসব ব্যাপারে দায়িত্ব নেয়না। পৈত্রিক বাড়িতে একটা ঘরে থাকে । অল্পকিছু রোজগার করে নিজের হাতখরচটা চালায়।

—  তাহলে, কাজটাজ  কিছু করে। কোথায় ?

ছন্দা একটু চুপ করে থাকলো । আস্তে বললো, একটা গয়নার দোকানে ।‌ আঁকার হাত খুব

ভালো, তাই নতুন গয়নার ওপর নকশা তোলে । আগেই অভয়দার দোকানে এই কাজটা করতে করতে শিখে নেয় ।

আমি কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। কোথায় ছন্দা , একজন সুন্দরী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে আর কোথায় একটা চালচুলোহীন অশিক্ষিত ছেলে, স্যাকরার দোকানে সামান্য রোজগার করা কারিগর যে কাজ আজ আছে তো কাল নেই। এই ছেলের সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছে যে মেয়েটা সেকি পাগল  ?  জিজ্ঞেস করলাম,

—  আলাপ হলো কীভাবে ?

—  বছরখানেক আগে একদিন গয়নার ক্যাটালগ নিয়ে আমার বৌদিকে দেখাতে এসেছিল।

সেইদিনই প্রথম দেখি । তারপর…

—  ব্যস্ , তাইতেই হয়ে গেল ?

ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো । বললাম,  তোর বাড়িতে কিছু জানে ?

—  হ্যাঁ , আস্তে আস্তে সবাই জেনে গেছে। জানেন    তো আমার বাড়ির লোকেদের কাছে আসল    হচ্ছে ছেলের বংশ, স্ট্যাটাস, লেখাপড়া বা   তার প্রতিষ্ঠা । এসব নিয়ে অতিরিক্ত সচেতন।   ওর তো এইসমস্ত কিছুই নেই আর তাছাড়া…

—  তাছাড়া কী ?

—  তাছাড়া ইদানিং ও খুব বাজে লোকেদের    সঙ্গে মিশছে । নানা বিপজ্জনক ঝামেলায়    জড়িয়ে পড়েছে। আমাকে অবশ্য সবকিছু    বলে , কিছু লুকোয়না । বাঁকা রাস্তায় টাকা    আসতে শুরু করলে স্বাভাবিক ছন্দে জীবন    কাটানো কঠিন হয়ে পড়ে। সবসময় ভয়ে ভয়ে    থাকা ।

এসব শুনতে শুনতে মনটা খারাপ লাগছিল। বললাম, মানে গুন্ডামি করে বেড়ায় । এরকম একটা

ছেলেকে তোর ভালো লাগলো ? এই ফালতু সম্পর্ক থেকে তুই বেরিয়ে আয় ।

ছন্দার দিকে তাকিয়ে মনে হলো কোথাও যেন মেয়েটাকে আঘাত দিয়ে ফেলেছি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, কাল সন্ধ্যার সময় ওকে নিয়ে আমার কাছে আসবি । দেখি সে কেমন।আমি আলাপ     করতে চাই

ছন্দা যেন এই কথাটাই শুনতে চাইছিল। ভীষন খুশীর ছাপ তার চোখে ।

#

পরদিন সন্ধ্যাটা ওদের জন্যেই কিছুটা ফাঁকা রেখেছিলাম। সাতটার একটু আগেই ওরা এলো।

ছন্দার সাথে যে ছেলেটি ঘরে ঢুকেই সলজ্জমুখে আমাকে প্রণাম করলো , তার দিকে তাকিয়ে আমি অবাক। এমন সুন্দর একজনকে দেখে ভাবলাম এর পক্ষে কোনো খারাপ কাজ করা সম্ভব হতেই পারেনা। ফর্সা গায়ের রং, আয়ত দুটি চোখ , মাথাভর্তি একরাশ ঢেউখেলানো কালো চুলের সঙ্গে মিষ্টি একটা হাসি । যেকোনো মানুষ একে দেখলেই ভালবাসবে। ছন্দার কোনো দোষ নেই, সে কেন এর জন্যে পাগল আমি বুঝতে পারলাম। যৌবন চিরকাল সৌন্দর্যের পূজারী, সে বেহিসেবি , বেপরোয়া। সে উচ্ছল, উদ্দাম আর এটাইতো তার ধর্ম। সে প্রেমে পড়ে যায় পাগলের মতো, হয়তো কখনো রক্তাক্ত হয়, প্রেম ব্যর্থ হলে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাহাড় থেকে। সর্বদা সে প্রাণের উৎসবে মেতে থাকে । জীবনের

উড়ন্ত বলটাকে সে স্টেপআউট করে চওড়া ব্যাটে ছক্কা হাঁকাতে ভালবাসে । যৌবন কখনো নিয়মের বা নিরাপত্তার ধার ধারেনা। আমার মন বলে উঠলো এ ছেলেটি ছন্দার জীবনসঙ্গী হলে ভালোই হবে । তাদের উদ্বেলিত তারুণ্যকে আমি মনে মনে কুর্নিশ জানালাম। এরা সত্যিই যেন মেড ফর ইচ আদার । ওরা বসার পর জিজ্ঞেস করলাম,  তোমার নামটা বলোনি এখনো।

—  আমার নাম দেবব্রত । দেবব্রত তরফদার।

সবাই ডাকে দেবু বলে ।

যদিও কিছুটা জানতাম, তবু বললাম,  আচ্ছা দেবু , পড়াশোনা ছাড়লে কেন, এখন কী করছো ?

দেবুর সহজ উত্তর,  কোনোরকমে উচ্চমাধ্যমিক । দাদা এরপর    আর পড়ার খরচ দেওয়া বন্ধ করে দিলো।     অবশ্য মিথ্যে বলবোনা, আমার নিজেরও     আর ইচ্ছে ছিলনা। আসলে পড়তে আমার    কখনো ভালো লাগেনা। বাড়িতে বেশীরভাগ    সময় থাকিনা, শুধু রাতে ঘুমোতে যাওয়া।     কাজ একটা ছোটোখাটো করি যাতে নিজের    খরচটা চালিয়ে নিতে পারি ।

—  কোথায় ?

—  একটা জুয়েলারী দোকানে।

—  তোমার সেখানে ঠিক কী কাজ ?

দেবু প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে সপ্রতিভ হয়ে আমাকে বোঝালো,  আমি নতুন গয়নার ওপর নকশা তোলার     কাজটা করি । ছবি আঁকতে আমার বরাবরই    ভালো লাগে। এই কাজটা তাই ভালোই লাগে    যদিও কারিগরদের পয়সা খুব কম। একটা    গয়না তৈরি করতে অন্তত ছ’সাত জন লাগে।    কেউ করে পিস-কাটাই , কেউ পালিশ, কেউ    মিনে করে, কেউ ফস্টিং আবার কেউ নকশা।

আমি বলে ফেললাম,  তুমি আর্ট স্কুলে পড়লে ভালো করতে। ছন্দা    বলেছিল যে তোমার আঁকার হাত খুব ভালো। সেসব অনেক খরচের ব্যাপার। খালিপেটে ঐ স্বপ্ন দেখে লাভ নেই।

#

সেদিনের পর থেকে বেশ কিছুদিন ওদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলনা। ছন্দা নিজেও পার্ট টু ফাইনাল নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তারপর একদিন একপ্যাকেট মিষ্টি নিয়ে হাসতে হাসতে ঢুকে আমাকে প্রণাম করলো।

—  কী ব্যাপার ?

—  দাঁড়ান, আগে কাকিমাকে প্রণাম করে আসি।    রেজাল্ট বেরিয়েছে।

জানলাম খুব ভালো রেজাল্ট করেছে ছন্দা, এবার এমএ করবে। ভবিষ্যতে অধ্যাপনার ইচ্ছে। ভীষন খুশী। আমিও ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করলাম । মনে হলো আমার নিজেরই মেয়ে আরো সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

—  হ্যাঁরে, দেবুকে জানিয়েছিস ?

একটু লাজুক মুখে ও বললো,  ও খুব টেনশনে ছিল ।ওকে তাই সঙ্গে সঙ্গে     মেসেজ করে জানিয়ে দিলাম ।

ছন্দার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি দেবুর সমসাময়িক আমার দুতিন জন ছাত্রকে ওরসম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বলে দিলাম। ছন্দা যেদিন বলেছিল যে ইদানিং কিছু সন্দেহজনকলোকজনের সঙ্গে দেবুর মেলামেশা, মারপিট করছে আবার হঠাৎ করেই টাকা আসছে – এসবখবরের পর দেবুর গতিবিধি জানার চেষ্টা করতে চাইছিলাম কারণ এর সঙ্গে ছন্দার ভবিষ্যত জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

প্রথমদিকে এগুলো শুনেও বিশেষ মাথা ঘামাইনি। কিন্তু দেবুকে দেখার পর থেকে ছন্দার মুখটা আমার চোখে ভাসে। তাই একটু ভেতরের খবর জানার ইচ্ছে। জুয়েলারী দোকানে কাজ করা কোনো খারাপ কাজ নয় অথবা লেখাপড়া অনেকের নাও হতে পারে কিন্তু আমার জানা দরকার সে ছেলে হিসেবে কতটা খাঁটি । তার সঙ্গে ঘর বাঁধা ছন্দাকে সুখী করবে কিনা।

কিছুদিন পরে খবর যা পেলাম সেটা জেনে আমি শুধু হতাশ নয় যথেষ্ট ভয় পেলাম। দেবুর নিজের একটা গ্যাং আছে যারা নাকি ক্রশবর্ডার চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। কাঁচা পয়সা রোজগারের হাতছানি আছে , বিপদও আছে সবসময়ই। খুনোখুনি যখনতখন লেগে আছে। দেবুর পকেটে সবসময় গুলিভর্তি পিস্তল থাকে।

দেবু নিজেও একবার কয়েকদিন গাঢাকা দিয়েছিল। মাসদুয়েক আগে কমলাসিনেমার সামনের রাস্তায় দিনের আলোয় একজন মোটরসাইকেলে করে এসে একটা লোককে প্রচুর মানুষের উপস্থিতিতে পয়েন্টব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে চোখের নিমেষে উধাও হয়ে গিয়েছিল। খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। এরা নাকি দেবুর দলের দুষমন । পুলিশ কোনো ক্লু না পেলেও সন্দেহবশে যাদের আটক করেছিল তাদের মধ্যে দেবুও ছিল।

শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেলাম । আশঙ্কা হলো ছন্দা এর সঙ্গে জীবন কাটাবে কেমন করে। আমি ঐ ছেলেদের জিজ্ঞেস করলাম, শেষ পর্যন্ত দেবুর কী হলো ?

—  সেইদিনই সন্ধ্যায় ছন্দা উকিলের ব্যবস্থা    করলো । পরদিন কোর্ট খুলতেই কিছুক্ষণের     মধ্যেই দেবু জামিন পেয়ে গেল।

কয়েকদিন পর একটা রবিবার সকালে ছন্দা এলো।

কোনো ভূমিকা ছাড়াই আমি সরাসরি প্রশ্ন করলাম, দেবু খুনের ঘটনায় জড়িয়ে গেছে ? এতো    সাংঘাতিক কান্ড হয়ে গেছে আমাকে কিছু    বলিসনি তো।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎ ও কান্নায় ভেঙে পড়লো। কাতর স্বরে বলল,  একটা কিছু করুন স্যার ,আপনি ছাড়া আমার    কোনো উপায় নেই। আপনাকে ও খুব সম্মান    করে । আপনি বুঝিয়ে বললে দেবু নিশ্চয়ই ঐসব বদ সঙ্গ ছেড়ে চলে আসবে।

খানিকটা ভাবলাম । সবকিছু তুচ্ছ করে ওদের এমন তীব্র প্রেম , পরস্পরকে ভালবেসে জীবনকে সাজিয়ে নেবার স্বপ্ন সবটাই কি নষ্ট হয়ে যাবে ? বললাম, তোদের ভবিষ্যৎ প্ল্যানটা খোলাখুলি বল ।     ঠিক ধরতে পারছিনা।

ছন্দা বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানালো ,  দেবু নিজেও এখন এই লাইন থেকে, এইসব    সঙ্গ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভয়ে ভয়ে    সবসময় থাকে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু শত্রু     তৈরি হয়েছে । আমরা বিয়ে করে একটা ভদ্র,    স্বাভাবিক সুন্দর সংসার চাই । আমি একটু    চেষ্টা করে কোনো কলেজে অধ্যাপনার চাকরি    পেয়ে যাবো, দেবু ছবি আঁকতে চায় তাই ওকে    আর্টস্কুলে ভর্তি করবোই যাতে ভবিষ্যতে ও    ভালো আর্টিস্ট হতে পারে। সমাজে একদিন    মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। আপনি বলুন আমার    এই চাওয়া কি অবাস্তব ?

মনে মনে ভাবলাম এমনটি হওয়াইতো বাঞ্ছনীয়।মোটেও অসম্ভব নয় । এই দুটি সুন্দর ছেলেমেয়ে

যারা পরস্পরকে ভালবেসে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছে তাদের সাহস ও সাফল্য কামনা করলাম। আমি নিজেও সর্বশক্তি দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াবো ঠিক সময়ে। বললাম,  পরশু আমার বিশেষ কিছু কাজ নেই। তোকে     আসতে হবেনা , দেবুকে একা আমার কাছে     পাঠিয়ে দিবি।

নির্দিষ্ট দিনে দেবু একাই আমার কাছে এলো। একইরকম বিনীত , ভদ্র ও সুদর্শন একটা ছেলেকে দেখে তার সম্পর্কে যাসব শুনেছিলাম সেগুলো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল । সে নাকি ভদ্রসমাজের ত্রাস , অনেকেই তাকে অচ্ছুৎ ভাবে। ভাবছিলাম যে ছেলেটি ছবি আঁকে, ফুল ভালবাসে সে কি মানুষ খুন করতে পারে ? তার মুখোমুখি বসে সোজা বললাম,

—  তোমার সম্পর্কে যেসব কথা কানে আসছে     সেগুলো কি সব সত্যি ? তুমি জানো আমার      প্রচুর ছাত্র শহরের চারদিকে ছড়িয়ে আছে।     তাদের কাছ থেকে জানলাম তুমি নানারকম     বেআইনি এবং অবশ্যই বিপজ্জনক পথে     টাকা রোজগার করে থাকো । এটাও শুনেছি     তোমার বেশ কিছু শত্রু আছে যারা তোমার     ক্ষতি করে দিতে পারে।

—  ঠিকই শুনেছেন স্যার । আমি বুঝতে পারি    লোকে আমাকে দেখে ভয় পায় ,এড়িয়ে চলে।    আমাকেও ভয় নিয়ে চলাফেরা করতে হয়।    শত্রু আছে, যারা আমাকে ধরতে পারলে খুন    করে দেবে। এ লাইনে ভীষন ঝুঁকি, লাইফ     রিস্ক । তাই আমার পকেটে সবসময় লোডেড    রিভলবার থাকে। সাধারণত একা একা     কোথাও যাইনা । এখন আপনার ঘরে যদিও    একা কিন্তু বাইরে তিনজন অপেক্ষায় আছে।    একসাথে ফিরবো ।

দেবু সবকথা খোলাখুলি বলার জন্যে ওর সততাআমার ভালো লাগলো কিন্তু ছন্দার কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বললাম,  কেন তুমি এমন কাজ করো ?

—  না করলে কীভাবে চলবে বলুন ? আমি যখন    থেকে অপরাধ জগতে নাম লিখিয়ে ফেললাম    তার কিছুদিন পরই কেসে ফেঁসে গেলাম।    এখন আমার নামে তিনটে কেস চলছে।    যেদিন যেদিন আদালতে শুনানি হয় তার    আগে উকিলের ফি জোগাড় করতে হয়।     লাগাতার খরচ জোগাতে আমি নতুন করে    অপরাধে জড়িয়ে যাই ।

—  হঠাৎ এইসব শুরু করলে কেন ?

—  ঐযে স্যার লোভ । টাকার লোভ। সোজা পথে    হচ্ছেনা বলে বাঁকা রাস্তায় চলা । বিপদ আছে,    কিছু শত্রু, অনেক টক্কর আবার পয়সাও     আছে।

আমি মনস্থির করে বললাম,  তুমি এই লাইন থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক     জীবনে ফিরে এসো দেবু । আমি তোমাকে    সবরকম সাহায্য করবো । যেসব কেসগুলো    চলছে তার জন্যে আমার ভাই যে এশহরের    একজন বিখ্যাত উকিল ও সমাজসেবী তাকে    নিযুক্ত করবো । তার প্রফেশনাল ফি নিয়ে    তোমাকে ভাবতে হবেনা যদি তুমি কথা দাও    যে তুমি এসব ছেড়ে দেবে। তোমাকে নিয়ে    ছন্দার যে অনেক স্বপ্ন । তুমি জানো সে    আমার কন্যাসমা বা তার চেয়ে বেশি। সেই    কারণে তুমিও আমার স্নেহভাজন।

দেবু চুপ করে অনেকক্ষন ভাবলো ।

—  স্যার , ছন্দা আপনাকে কী চোখে দেখে আমি    জানি । আমি আপনাকে কথা দিলাম এই    মূহুর্ত থেকে এসব আর নয় । আমার জীবনে    ছন্দাই সব । আপনিও কথা দিন আমাদের    মাথার ওপরে আপনার হাত সবসময়ই    রাখবেন ।

কথাগুলো বলতে বলতে আমাকে চমকে দিয়ে দেবু হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলো । তারপর দ্রুত প্রণাম করে বেরিয়ে গেল।

আমার মনটা খুব হালকা লাগছিল কারন মন বলে উঠলো একটা ভালো ছেলেকে অনিবার্য বিপর্যয় থেকে বাঁচার রাস্তায় আনতে পেরেছি। কয়েকদিন পর ছন্দা এলো । ভীষন খুশী খুশী।

তার উজ্জ্বল হাসিমুখ দেখে খুব ভালো লাগলো।

হাসতে হাসতে বলল,–  আপনি যাদু জানেন স্যার নাহলে কি এমন    অসাধ্যসাধন এতো সহজে করতে পারতেন?    আমি জানি  আত্মিয়দের ওপর আর এই    সমাজের ওপর অনেক ক্ষোভ অভিমান ওর    জমেছে। আপনি ওর কষ্টের জায়গাটা ছুঁতে   পেরেছেন। দেখবেন ও একদম বদলে যাবে।   আমাকে কথা দিয়েছে ।

#

আজও ঘুমের মধ্যে একটা দৃশ্য আমাকে তাড়া করে।

মাসখানেক পরে একটা ঝকঝকে দিন। রোদে ভেসে যাচ্ছে পথঘাট । ফুরফুরে মেজাজে বারান্দায় বসে দ্বিতীয়বারের চা খাচ্ছি আরাম করে।

যেসব ছাত্রদের আমি দেবুর সম্পর্কে খবর নেবার কাজে লাগিয়েছিলাম তারা দুজন দৌড়ে আমার কাছে এসে খুব উত্তেজিতভাবে জানালো,

 

—  স্যার , সাংঘাতিক কান্ড হয়ে গেছে। দেবু একাস্টেশন প্ল্যাটফর্মে বসেছিল হয়তো কোনোট্রেন ধরবার জন্যে। ওর ওপর যাদের রাগছিল এবং হায়নার মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিলতাদের কেউ ওকে দেখতে পেয়ে যায় বোধহয়। ব্যস্ ওখানেই তাড়া করে , আরো অনেকে জড়ো হয়ে গেলে দেবু মরিয়া হয়ে দৌড়েছিল কিন্তু কিছুদূর ছুটে যাবার পর ওরাওকে ধরে ফেলে । ভীড় জমে গেছে , কয়েকটাছেলে মিলে ওকে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক মারছে ।

এক মূহুর্ত ভেবে বললাম,

—  তাড়াতাড়ি একটা রিক্সা ডাক, আমাকে নিয়ে চল ।

 

কিছুটা দূরে পৌঁছে দেখি একটা জায়গায় খুব ভীড়। ভীড় ঠেলে কোনোমতে কাছে গিয়ে দেখি রাস্তার ওপর শুয়ে দেবু প্রাণপণে ওদের বাধা দেবার চেষ্টা করছে আর ওরা অনেকে মিলে এলোপাতাড়ি লাথি, ঘুঁষি মারতে মারতে প্রায় আধমরা করে দিচ্ছে। একজন একটা থানইঁট হাতে নিয়ে মারতে শুরু করলো । আমি মরিয়া হয়ে তাদের আটকাবার নিষ্ফল চেষ্টা করছিলাম তখন কে একটা চিৎকার করে আমাকে সরিয়ে দিলো । লক্ষ্য করছিলাম কী এক ভয়ঙ্কর তীব্র বিদ্বেষে তাদের মুখগুলো বিভৎস পৈশাচিক দেখাচ্ছে। যখন হাঁটু ভেঙে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে দেবু তখন কোথা থেকে হঠাৎ ঝড়ের গতিতে ছুটে এলো ছন্দা । এসেই এক ঝটকায় ইঁটহাতে ছেলেটাকে ধাক্কা মেরে দেবুর সংজ্ঞাহীন দেহটার ওপর চিৎকার করে আছড়ে পড়ে দুহাতে দেবুকে জড়িয়ে ধরলো। উন্মত্ত জনতা তাকেও রেহাই দিলোনা। আঘাতে পর আঘাতে জর্জরিত করে দিলো। আমার চোখের সামনে ছন্দার শরীরটা থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে একসময় স্থির হয়ে গেল।

তারপর… যা হবার তাই হলো। অনেক কিছু। পুলিশ, স্ট্রেচার, হাসপাতাল ইত্যাদি।

#

সেদিনই বিকেলে সব খবর পেলাম। দেবু আর নেই। হাসপাতালে পৌঁছানোর পথেই সব শেষ। এখন শান্ত ছেলের মতো মর্গে শুয়ে আছে। ছন্দা কে ডাক্তার কড়া ঘুমের ওষুধ পুশ করার আগে দেবুর নাম ধরে ক্রমাগত চিৎকার গোটা হাসপাতালের লোকেরা শুনতে পেয়েছিলো, হয়তো ঘরের দেওয়ালগুলিও ।

পরদিন সকালে ভিজিটিং আওয়ারে গেলাম। দেখলাম তার নির্দিষ্ট বেডে ছন্দা শুয়ে আছে। প্রচন্ড শারীরিক আঘাতে তার সুন্দর মুখটা বিকৃত অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। চোখদুটি অবসন্ন, কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ।

আমি সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। কোনো কথা বলিনি , বলতে পারছিলাম না। ছন্দা আমার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।

সে চোখের ভাষা আমি বুঝতে পারিনি।

Tags: ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ