01 Jan

নিশ্চিন্দপুরের হারিয়ে যাওয়া কাহিনী

লিখেছেন:দেবাশিস মজুমদার


[১৯৯৫ সালে এটি লেখেন লেখক।ওই বছর নিশ্চিন্দপুর গ্রামে সত্যজিৎ রায়ের আবক্ষ মূর্তির উন্মোচন করেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের  মাননীয় রাজ্যপাল। উদ্যোক্তা পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও পথের পাঁচালি সংস্থা। ওই অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহের জন্য তৎকালীন একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের সাংবাদিক হিসাবে নিশ্চিন্দপুর গিয়েছিলেন লেখক। নেহাতই অনুসন্ধিৎসার বশে  সেদিন গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে আর এলাকার মানুষগুলোর সঙ্গে কথা  বলতে বলতে খোঁজ পান নানা কাহিনীর।সেই মৌখিক কাহিনীর সন্নিবেশে জন্ম হয়েছিল এই লেখার।‘গল্পের সময়’ সেই অপ্রকাশিত কাহিনীটিকে অপরিবর্তিত রেখেই প্রকাশ করল। মৌখিক ইতিহাসে পাঠক খুঁজে নিতে পারেন এক হারিয়ে যাওয়া সময়কে।]   

গড়িয়া মেন রোড থেকে ডান দিকে যে রাস্তাটা ঘুরে গেছে তার নাম বোড়াল মেইন রোড। বোড়াল মেইন রোড ধরে বাদামতলার মাঠ, সরল দীঘি কে বাঁদিকে রেখে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেলেই পড়বে ঠন্‌ঠনিয়া মোড়। ঠন্‌ঠনিয়া মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরে রাস্তাটা সোজা চলে গেছে নেপালহাট, নতুন গঞ্জের দিকে। ঠন্‌ঠনিয়া মোড় থেকে কয়েক পা এগোলেই ডান দিকে সরু আকাবাঁকা একটা মাটির রাস্তা। মাটির রাস্তা ধরে পায়ে পায়ে এগোলেই চোখে পড়বে আম, বাঁশ, দেবদারু, কাঠাঁল গাছে ঘেরা একটা ছোট্ট জঙ্গল। এই জঙ্গলের সামনে দাঁড়িয়ে কোনাকুনি তাকালেই সাদা রং করা একখানি বাড়ি। একটু এগোলেই আর নতুন করে চেনাতে হবে না বাড়িটিকে। সেই পুকুর, ভাঙাচোরা পাঁচিল, তুলসীমঞ্চ, জবাগাছ সব সঙ্গে করে নিয়ে দাড়িয়ে আছে হরিহর, সর্বজয়াদের সেই দুখানি ঘর। সামনে একটু পলেস্তরা এবং রং এর আঁচড় পড়েছে। বেশীরভাগ জানলা দরজাই ভাঙা। সেই সর্বজয়া, হরিহর কিংবা অপু দুর্গা। কিন্তু তাদের স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে  দাড়িয়ে আছে ত্রিপুরীচরণ মুখোপাধ্যায়ের এই ঐতিহাসিক বাড়ি। ঠিকানা – গ্রাম – বোড়াল, মৌজা – নিশ্চিন্দপুর। জেলা – দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। আজ বাড়িতে থাকে না অপু, দুর্গা। কিন্তু অপু – দুর্গার বেশ কিছু সহপাঠি এখনও আছেন এই গ্রামে। হয়ত বা যাতায়াতের পথে তারা একটু থমকে দাড়ান। ঝালিয়ে নিতে চান নিজেদের ছেলেবেলার স্মৃতিকে। ” সালটা কত হবে ? পঞ্চাশের কাছাকাছি। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। ওই আমবাগানটা ছিল আমাদের স্বর্গরাজ্য। একদিন আমরা খেলছিলাম। হঠাৎ কয়েকটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। আমরা বেশ বিব্রত বোধ করলাম। দেখলাম লোকগুলো গাড়ি থেকে নেমে কি সব বলতে বলতে এই দিকে এগিয়ে আসছে। ওই দলে একজনকে সবার আগে চোখে পড়ল, খুব লম্বা। চারদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ আমাদের দিকে তাকালেন। দূর থেকে হাত নেড়ে ডাকলেন, নাম জিজ্ঞাসা করলেন। সবাই নাম বললাম। উনি হঠাৎ আমার নাম ধরে বললেন ‘ কৃষ্ণ বাবু, তোমাদের এই রাজ্যে আমি কয়েকদিন রাজত্ব করব, আপত্তি নেই তো ?’ তারপরেও বহুবার এসেছেন, দেখতাম অপুদের বাড়ির ঘাটে বাঁধানো সিমেন্টের বেদির অপর চুপ করে বসে থাকতেন। আর এক দৃষ্টে জলের দিকে তাকিয়ে একমনে কি সব ভাবতেন। আমরা বন্ধুরা কয়েকজন দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। হঠাৎ চোখাচোখি হলে আমরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেই উনি ইশারায় ডাকতেন।” বাগানের সামনে দাড়িয়ে নিজেদের ছোটবেলার স্মৃতি চারণা করছিলেন কৃষ্ণপদবাবু (দত্ত)। অনিলবাবু (মুখার্জী), দীনবন্ধুবাবু (ভট্টাচার্য), ভোলানাথবাবু (মুখার্জী) দের নিয়ে চারজনের একটি দল ছিল কৃষ্ণবাবুদের। এই দলেরই একচেটিয়া আধিপত্য ছিল অপু – দুর্গার বাড়ির বাগানে। এরা প্রত্যেকেই বোড়াল গ্রামের বাসিন্দা। অপু – দুর্গার প্রতিবেশী। পথের পাঁচালির ছায়াছবির শুটিং এর  সাক্ষী। আজও পথের পাঁচালির মাটির গন্ধকে নিজেদের নিশ্বাস প্রশ্বাসে উপলব্ধি করে। স্মৃতির পাতা উলটিয়ে পায় সত্যজিতের উষ্ণ সান্নিধ্য। সেই সান্নিধ্য কাউকে ভাগ করে দিতে রাজি নয়। একেবারে নিজেদের অনুভবের জায়গা থেকে পাওনা। সেই সান্নিধ্যের গল্প অন্যকে শুনিয়ে আনন্দ পান।

কৃষ্ণপদবাবুদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল সত্যজিতের স্মৃতি বিজরিত সেই আমবাগানে দাঁড়িয়ে। (সত্যজিতের আবক্ষ স্মৃতির উদ্ভোধন হচ্ছে তাদের গ্রামে। তাদের পাড়ায় সেই মানুষটাকে শ্রদ্ধা জানাতে কেউ কাজে যাননি  সারাটা দিন) শুধু ছেলেবেলার স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করবার পরিকল্পনা তাদের। কৃষ্ণপদবাবু বললেন “ কত ছোট ছোট অজানা গল্প। যা হয়তো স্থানীয় লোকের মুখে লোক কথার মত ফিরবে। এই বাগানটায়  অনেক ফজলি আমের গাছ ছিল। মানিক বাবু মোড়া নিয়ে বসে থাকতেন এই বাগানটায়। তখনও শুটিং শুরু হয়নি। উনি আসতেন খুব সকালে। রোজই প্রায় ছ’টার মধ্যে পৌঁছে যেতেন। আর আমাদের বাড়ি বাগানের পূব দিকে। আমি সকালে উঠে পড়তে বসে পড়া ফেলে বাগানের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শুটিং এর মজা উপভোগ করতাম। দেখতাম হয় উনি বাগানে বসে খাতায় কি সব লিখছেন, না হয় গালে হাত দিয়ে দূরে তাকিয়ে আছেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বংশীবাবু , সুব্রত বাবুদের সঙ্গে একটা বড় আমগাছের নীচে বসে গল্প করতেন। উনি যে গল্প করছেন পড়ার ঘরের জানলায় না থাকলেও টের পেতাম। খুব জোরে হাসতেন। প্রায় এক মাইল দূর থেকে বোধ হয় শোনা যেত। তা যে কথা বলছিলাম, সময়টা গ্রীষ্মের দুপুর। ওই সময় তো ওঁনারা লাঞ্চ করতেন। আর আমরা সব দূরে দাড়িয়ে ওদের কান্ড কারখানা দেখতাম। দেখতাম, যেই আম পড়ত অমনি দুদ্দাড় করে সব দৌড়াতেন আম কুড়োতে। উনি কিন্তু চুপচাপ মোড়ায় বসে দেখতেন। ঘটনাটার কয়েকদিন আগে আমাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন- আচ্ছা ‘কেষ্টবাবু এই যে এত আম পড়ে তোমরা বাড়ি নাও না ? আমি বললাম -ধ্যাৎ পাড়াগাঁয়ে কেউ আম বাড়ি নেয় নাকি ? আম পড়লে যে পাবে তার। উনি চোখ দুটো ওপরে তুলে বললেন ও তাই বুঝি। সেদিনও কয়েকটা আম পড়েছে। যথারীতি বংশীবাবুরা ছুটে যাওয়ার  জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন। কারণ বংশীবাবু খুব জোড়ে ছুটতে পারতেন। আর তাই উনিই আম গুলো পেয়ে যেতেন। এগোতে যাবেন এমন সময় মানিকবাবুকে দেখলাম পা টা একটু বাড়িয়ে ছিলেন। ব্যস আর কি। বংশীবাবু একেবারে চিৎপাত। উঠে দাঁড়াবার আগেই আমটা একেবারে মানিকবাবুর হাতে। ততক্ষণ বংশীবাবু গা ঝাড়তে ঝাড়তে চিৎকার করছেন – মানিক শেষে তুমি কিনা আমায় ফাউল করে আম কুড়ালে। এ আমি কিছুতেই সহ্য করব না। আর তখন আমাদের সে কি আনন্দ। কারণ ওই বংশীবাবুই রোজ আমাদের বল করে আউট করে দিত। শীতের দিকে আমরা এপাশের খালি জায়গাটায় ক্রিকেট খেলতাম। আর আমাদের খুব রাগ হত – খেলার জায়গাটা তো চলে গেছে ওই শুটিং কোম্পানির হাতে। মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে এসে খেলতেন বংশীবাবু। আর এত জোড়ে বল করতেন যে আমরা সহজেই আউট হয়ে যেতাম। সেইজন্য আমরা ওনাকে নিতে চাইতাম না। তাই সেদিন যখন আমরা বংশীবাবুকে পড়ে যেতে দেখেছিলাম খুব আনন্দ হয়েছিল আমাদের।”

এই রকম আরও একটা ঘটনা শোনালেন কৃষ্ণবাবু। শুটিং দেখা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের দলের লোকেদের সঙ্গে তাদের দলের মতবিরোধের ঘটনা। “প্রথম দিকে যখন শুটিং শুরু হবে তখন ইলেকট্রিকের জন্য বড় বড় মেশিন ওয়ালা গাড়ি – টাড়ি এসেছে। আমরা বাচ্চাদের দল যথারীতি ভিড় করেছি। তখন তো খুব মজার ব্যাপার। শুটিং ব্যাপারটা কি তাই জানি না। এখানের ছবিগুলো কি ভাবে সিনেমায় দেখতে পাব ? কিন্তু আমাদের আশায় বাদ সাধলেন সত্যজিৎ ইউনিটের অনিলবাবু। অনিলবাবু ছাড়াও আরও একজন ছিলেন। যাকে আমরা একেবারে দেখতে পারতাম না। ভদ্রলোকের দাঁতটা উঁচু মত ছিল।  উনি আমাদের দেখলেই তাড়া করতেন। সেদিনও তাই করলেন। আমরাও ছাড়বার পাত্র নই। বাড়ী থেকে ভাঙা টিন আর লাঠি জোগাড় করে ক্যানেস্তারার মত পেটাতে শুরু করলাম। ব্যস, আর যায় কোথায় ? ভদ্রলোকের অবস্থা একেবারে বেসামাল। যেই তাড়া করেন। অমনি দূরে গিয়ে ক্যানেস্তারা পেটাই। ফলে কিছুতেই শুটিং শুরু করা যাচ্ছেনা। আর আমাদেরও তো খুব মজা। একটু পরেই ব্যাপারটা চোখে পড়ল সত্যজিৎ রায় আর বংশী চন্দ্রগুপ্তর। সত্যজিৎ বাবু এগিয়ে এসে আমাদের হাতের ঈশারায় ডাকলেন – ‘ কি গো কৃষ্ণবাবু ? কি খবর তোমাদের ? শুটিং দেখবে তো। তা হলে এস। এইখানে কিন্তু চুপটি করে বসে থাকবে, কেমন ?’ ব্যস আমরাও একেবারে চুপ মেরে গেলাম। পরে বড় হয়ে মনে হয়েছে কি অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল লোকটার। ছোটদের সামাল দিতে হয় কি করে তা উনি খুব ভালভাবেই জানতেন। আর শুটিং চলার সময় দেখতাম কি রকম গম্ভীর। একবার ক্যামেরায় চোখ লাগাচ্ছেন। কি সব বলছেন সুব্রত বাবুকে। ওঁনার বসবার জায়গার কোনও ঠিক ছিল না। বেশিরভাগ সময় পাঞ্জাবী পাজামা পরে আসতে দেখতাম। বাগানে বা অপুদের বাড়ির দাওয়াতেই সরাসরি বসে পড়তেন। কোনও আসন বা টুল নিয়ে বসতে দেখি নি।”

পথের পাঁচালির এক ঐতিহাসিক দৃশ্য সৃষ্টির সাক্ষী কৃষ্ণপদ বাবু। দুর্গার মৃত্যুর পর তার আনা হারটি যখন অপু তার বাড়ীর পাশের পানাপুকুরে ফেলে দেবে, তখন পানা জল ফাঁক হয়ে হারটি গলে যাবে। তারপর পাশের পানা জল এগিয়ে এসে সেই জায়গা ঢেকে দেবে। “এই দৃশ্যের জন্ম দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। অপুর বাড়ীর পাশের পুকুর পাড়ের শান বাঁধানো ঘাটে বসে”- বলছিলেন কৃষ্ণপদ বাবু। “ আমরা পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট খোলামকুচি নিয়ে পুকুরে ছুঁড়তাম। কারণ আর কিছুই নয়। ফাঁকা জায়গার পুকুরের জলে ইট পড়লেই শব্দ হত – ‘ঘুপ’। আর জলটা ফাঁক হয়েই আবার মিলিয়ে যেত। একদিন আমরা এই কান্ড করছি। বাঁশ ঝাড়ের দিক থেকে উনি ওই শান বাঁধানো থামে চুপ করে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। অনেকক্ষন ধরে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন। আমি তো খুব ভয় পাচ্ছিলাম – এই বোধহয় খুব জোর বকা দেবেন। হঠাৎ দেখলাম উনি হাত তুলে ডাকছেন। কাছে যেতেই বললেন – আরও কতকগুলি ঢিল ছোঁড়োতো। ছুঁড়লাম। দু-একটা ঢিল ছোঁড়ার পরই দেখলাম – উনি আপন মনে বলে উঠলেন – বাঃ এই তো পেয়ে গেছি। এই বলেই উঠে পড়ে আমার পিঠে একটু মৃদু চাপড় দিয়ে হন্ হন্  করে এগিয়ে গেলেন বাগানের দিকে। তার কয়েকদিন পরে দেখলাম পুকুর ধারে ক্যামেরা বসিয়ে সুবীরকে (অপু) দিয়ে হার ছোঁড়ালেন। এখন হলে কি হত জানিনা তখন কিন্তু বেশ রাগ হয়েছিল আমার।”

তবে কৃষ্ণপদ বাবুদের কাছে এইটাই বিষ্ময় তখন এই বাগানে বা আশেপাশে বেশ কিন্তু হনুমান থাকত। সেই হনুমান বেশ তান্ডব চালাতো এই বাগানে। তার কতগুলো দৃশ্যও উনি তুলেছিলেন। কেন যে ছবিতে রাখেননি কে জানে ? পরে অবশ্য ‘অপরাজিত’তে হনুমানের দৃশ্যও রেখেছিলেন। সে তো বেনারসে বাড়ীর হনুমান এখানকার নয়। এই নিয়ে একটু ক্ষুব্ধ কৃষ্ণপদ বাবুরা। তবে কৃষ্ণবাবুর নানারকম গল্পের মধ্যে থেকে এদিন এক অসাধারণ গল্প শোনা গেল যা সিনেমায় ডিটেল সম্পর্কে সত্যজিতের বোধের কথা মনে করিয়ে দেয়। গল্পটা তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক। “ তখনও শুটিং শুরু হয়নি। উনি বাগানে যে জায়গায় মোড়ায় বসে লেখালিখি করতেন তার উল্টোদিকেই ছিল আমাদের দত্তবাড়ি। সেই বাড়ির বারান্দায় আমার ঠাকুরদার একটা পুরোনো চেয়ার ছিল, যেটা বেশ নড়বড়ে। দেয়ালের দিকে হেলান দিয়ে রাখতে হত। নইলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আমি মাঝেমাঝেই ওই চেয়ারে বই নিয়ে বসতাম পড়ব বলে। যদিও আসল উদ্দেশ্য ছিল ওঁনাকে পর্যবেক্ষন করা। কারণ ততদিনে বাবার মুখে ওঁনার আসল পরিচয় পেয়ে গেছি যে উনি আসলে সুকুমার রায়ের ছেলে।

তাই কবির ছেলে কি করে ছবি করে এটাই ছিল আমার কাছে একটা বিরাট বিষ্ময়। মাঝেমাঝে দেখতাম তাকিয়ে রয়েছেন আমার বারান্দার দিকে। একদিন বেলার দিকে যখন বাগানে গিয়েছি উনি আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন – যে চেয়ারটায় তুমি রোজ বসে পড় সেটা কার ? আমি বললাম – আমার ঠাকুরদার। উনি বললেন – চেয়ারটা কয়েকটা পা নড়বড়ে তাই না। আমি বললাম – হ্যাঁ। তারপর বহুদিন কেটে গেছে। পথের পাঁচালি রিলিজ হয়ে গেছে। আমিও মাধ্যমিক দিয়ে কলেজে ঢুকেছি। ওইসব কথাবার্তা ভুলেই গেছি প্রায়। হঠাৎ একদিন আমাদের গ্রামের দুলাল (সত্যজিৎ বাবুর ইউনিটে কাজ করত) এসে বলল মানিকদা তোর নাম করে বলেছে – কৃষ্ণবাবুকে বোলো তার বাড়িতে যে চেয়ারটায় বসে সে পড়াশুনো করত, সেইটা একবার আমার চাই। শুটিং এর জন্য। কাজ হয়ে গেলে ফেরত দিয়ে দেব। আমি তো অবাক। এতবছর পরও মনে আছে ওই চেয়ারটার কথা। যাই হোক তো দুলালকে বললাম – হ্যাঁ নিয়ে যেও। ও একটা গাড়ী করে নিয়ে গেল চেয়ারটা। কয়েকদিন পর ফেরৎ দিয়ে গেল চেয়ারটা। শুনলাম ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে পোস্টমাষ্টার বলে একটা ছবি শুটিং হয়েছে। গ্রামের পোস্ট অফিসের জন্য ভাঙা নড়বড়ে গোটা চেয়ারের দরকার ছিল। সেই জন্যই নাকি ওই চেয়ারটা নেওয়া হয়েছে। যাই হোক পরে ‘তিনকন্যা’র  ‘পোস্টমাষ্টার’ অংশে দেখলাম আমার বাড়ির ওই নড়বড়ে চেয়ারকে কত সুন্দরভাবে উনি ব্যবহার করেছেন।”

‘পোস্টমাষ্টার’ ছবির বেশ কিছু অংশে সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কিন্তু এই বোড়াল গ্রাম। ঠনঠনিয়া মোড়ের সেই বিখ্যাত চায়ের দোকানের মালিক সমীর কুমার ঘোষ কিন্তু  ভুলতে পারেন না সেই গম্ভীর গলার দীর্ঘকায় মানুষটির কথা। পথের পাঁচালির শুটিংয়ের অন্যতম সাক্ষী সমীর বাবু। কারণ তার দোকানের চা – ই ছিল সত্যজিৎ বাবুর ভীষণ প্রিয় ক্লান্তি দূর করার একমাত্র উপকরণ। মাঝে মাঝেই শ্তটিংয়ের ফাঁকে আসতেন সমীর বাবুর চায়ের গুমটিতে। বাঁশের কঞ্চি কেটে তৈরি করা বেঞ্চে বসে কতদিন আড্ডায় মেতেছেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত কিংবা সুব্রত মিত্রদের সঙ্গে। সমীর বাবু কাঁচের গ্লাসে চা সরবরাহ করতেন। তাদের আড্ডায় অন্যতম রসদ ‘চা’। তখন চায়ের দাম ছিল এক আনা প্রতি গ্লাস।

সমীর বাবুর দোকানের চায়ের সঙ্গে আর একটা জিনিস খুব প্রিয় ছিল সত্যজিৎতের। মচ্ মচে্  এক ধরনের গোল বিস্কুট। প্রায়ই নাকি সমীর বাবুকে বলতেন – আপনার ওই গোল বিস্কুট নেই ? বেশ মচ্ মচে্। খেতে খুব ভাল। সত্তর ছুঁই ছুঁই সমীর বাবু আজও গর্ব করেন একটা বিষয় নিয়ে। তার চায়ের সুনাম করে একখানি ক্যাপসন লিখে দিয়েছিলেন বিশ্বজয়ী ওই মানুষটি। সেও এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। “পথের পাঁচালির শুটিং চলছে ওই বাগানের পাশে। খুব সকালে ওঁনারা আসতেন। সন্ধের মধ্যেই ফিরে যেতেন। তখন শীতকাল। সামনের মাঠে যাত্রা হবে। তা যারা যাত্রার আয়োজন করেছে তারা আমায় বলল আমার চায়ের দোকানের বিজ্ঞাপন দিতে হবে। কি আর করি, রাজি হতে হল। পাড়ার ছেলেরা ধরেছে বলে কথা। শেষে ভাবলাম কাপড়ের একটা ব্যানার ঝোলালে কেমন হয় ? কিন্তু কি লেখা থাকবে ব্যানারে ? কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিনা। এই সময় একদিন সকালে দোকানে চা খেতে এলেন মানিকবাবু। বললাম – মানিকবাবু আমি তো খুব বিপদে আছি। উনি আপনমনে চা খেতে খেতে বাইরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন। সব সময়ই দেখতাম কেমন জানি নিজের মধ্যে ডুবে থাকতেন। আমার কথা শুনে বললেন- সেকি আপনার কি বিপদ ? আমি সমস্ত খুলে বললাম, এখন আপনি যদি আমার দোকানের চা নিয়ে একটা ক্যাপসন লিখে দেন তাহলে ওইটা কাপড়ে লিখতে পারি। আমার মাথায় তো কিছু আসছে না। উনি বললেন হুঁ, তা কিসে লিখতে হবে ? বাংলায় না ইংরাজিতে ? ইতস্তত করে বলেই ফেললাম – ইংরাজিতে। উনি একটু ভেবে বললেন, আচ্ছা লিখুন। আমি বলছি – এনি টাইম ইজ টি টাইম। ইফ ইট ইজ সমীরস্ টি। লিখে ফেললাম। দেখে বললেন – কি? বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া গেল তো? এই বলে উঠে গেলেন। সেই দুলাইনের ক্যাপসন ব্যানার ঝোলাতেই তো গায়ের লোকেরা ছেঁকে ধরল। কে এমন সুন্দর ক্যাপসন করে দিল। আমি বুক ফুলিয়ে বললাম – কেন ? মানিক বাবু। সত্যি আজও গর্ব হয় ওই বিশ্ববিখ্যাত মানুষটার জন্য এক ফোঁটা দাম্ভিকতা দেখি নি কোনদিন। অথচ কি বিনয়! পরে বেশ কয়েকবার গেছি ওঁনার লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে। ঘরে বসে এমনভাবে কথা বলছেন – যে মনেই হয় নি উনি তখন খ্যাতির শীর্ষে রয়েছেন। তিনটে ঘটনা খুব মনে আছে। প্রথমে যখন গিয়েছি ওঁনার মা তখন জীবিত। নাতি সন্দীপকে কোলে নিয়ে চামচ বাটিতে করে খাওয়াচ্ছিলেন বাইরের ঘরে বসে। আমি গিয়ে ডাকতেই মানিকবাবু বাইরে বেরিয়ে এলেন – আরে সমীর বাবু যে! আসুন। একটু পরে চাকর এসে চা দিয়ে গেছে সুন্দর কাপে। হঠাৎ গল্প করতে করতে উনি বললেন – যাই বলুন সমীরবাবু যত ভাল চা খাই না কেন আপনার দোকানের সেই চায়ের স্বাদ এখনও মুখে লেগে রয়েছে। সত্যি এত বিনয় দেখানো বোধহয় ওঁনার মত বড় হৃদয়ের মানুষর পক্ষেই সম্ভব। এইযে অত দামি কাপে অত দামি চা আমি কোনদিনই তৈরি করতে পারবনা আমার দোকানে। অথচ আমার দোকানের চা কে এত বড় জায়গা দিয়ে গেলেন।

আর একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। ওঁনার মৃত্যুর কয়েক বছর আগের ঘটনা। আমি গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের সামনে দিয়ে আসছি। প্রথমে খেয়াল করি নি। হঠাৎ চোখ তুলতেই দেখি দূরে একজন লম্বা ভদ্রলোক হাতে চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে আসছেন। কাছাকাছি আসতেই চোখাচোখি হল। আমি ভাবলাম – বোধহয় চিনতে পারবেন না। কত বছর আগের ঘটনা। মনে না থাকারই কথা। তাই ঠিক করলাম উনি না চিনলে আর পরিচয় দেব না। এখন তো এত বিশ্ববিখ্যাত হয়ে গেছেন। হয়ত বিরক্ত হবেন। হঠাৎ দেখলাম উনিই গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন – আরে, সমীর বাবু না? কেমন আছেন। বাড়ির সব খবর ভাল? আচ্ছা আপনার সেই চায়ের দোকান আছে এখনও ? আচ্ছা বোড়ালের লোকেরা কিরকম আছে? আমি তো অবাক। বলে কি লোকটা। এক ফোঁটা স্মৃতিভ্রম নেই। পঁয়ত্রিশ বছর আগের লোকটা এত খ্যাতির শীর্ষে উঠেও এক ফোঁটা বদলায় নি। রাস্তাতেই প্রায় টানা দশ মিনিট ধরে বোড়াল নিয়ে গল্প করলেন।

তৃতীয় ঘটনাটা অনেক দিন আগেকার। তিনকন্যার শুটিং এর গল্প। পথের পাঁচালির শুটিং চলাকালীন একদিন গল্প করতে করতে উনি আর বংশীবাবু আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি বাড়িতে আসতে  বলায় উনি বাড়িতে ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেন বাবার সঙ্গে। কিন্তু কথাবার্তার ফাঁকে উনি বাড়ির খুব প্রশংসা করে চলে গেলেন। এরপরের ঘটনা ষাটের কাছাকাছি কোনও এক সময়ের। তা আমার বিয়ে হয়ে গেছে। হঠাৎ আমাদের গ্রামের দুলাল এসে বলল – মানিকদা একদিন আসতে পারেন। তোমাদের বাড়িতে বোধহয় শুটিং করবেন। আমি তো একেবারে থ। আমার বাড়িতে আবার এমন কোন জায়গা পেলেন যেখানে শুটিং করা যায়। যাই হোক একদিন সত্যি সত্যি এলেন স্পট দেখতে। বাবাকে বললেন, আপনাদের বাড়ির কুয়োতলায় একটু শুটিং করব। আপত্তি নেই তো? বাবা বললেন – আপত্তি কিসের? যাইহোক, যাবার সময় আমার স্ত্রীকে বলে গেলেন – বৌমা তোমাদের একদিন একটু বিরক্ত করব। একটু কষ্ট করে নীচের ঘরের জিনিসপত্র ওপরে সরিয়ে রেখো। শুটিং এর জন্য প্রচুর যন্ত্রপাতি, লোকজন আসবে তো। ঘরটা একটু ফাঁকা  হলেই ভাল হয়। যাই হোক যথা সময় শুটিং হয়ে গেল কুয়োতলায়। পোস্টমাষ্টারের সহকারী সেই বাচ্চা মেয়েটার জলতোলার দৃশ্যের।”

সমীরবাবু, কৃষ্ণপদবাবুরা আজও মনে মনে ভাবেন – একটা লোকের কত ক্ষমতা থাকলে কোনও লোককে একবার দেখে তার ছবি হুবহু এঁকে ফেলতে পারেন কয়েকটা রেখার আঁচড়ে। সেই গল্প শোনালেন ওঁনারা।

সমীরবাবুর দোকানে চা খেতে যেতেই চোখে পড়েছিল হরি মাস্টারকে কিংবা চিনিবাসওয়ালাকে। নাম জানতে পারেন নি। চেহারার বর্ণনাতেও যখন সমীরবাবুরা বুঝতে পারলেন না তখনই দোকান থেকে নেওয়া এক টুকরো কাগজে পেনসিলের তিন চারটি আঁচড়ে সোজা তুলে আনলেন হয় চরিত্রের মুখ না হয় পেছন থেকে দেখা চরিত্রের কোনও বিশেষ ভঙ্গিমা। ব্যস, সমস্ত সমস্যার মূহুর্তের মধ্যে সমাধান করে দিলেন সমীরবাবু কিংবা কৃষ্ণবাবুরা।

অপু–দুর্গার বাড়ির মালিক গৌর গোপাল মুখোপাধ্যায় বিশ্বাস করেন – “ওই মানুষটাই আমার বাড়িকে বিশ্বের দরবারে পৌছে দিয়েছে। নইলে কে আর আমার বাড়িকে চিনত। কেইবা আর আমার খোঁজ করত ?” বাড়ির একাংশের সংস্কার হলেও পুকুর পাড়ের ভাঙা পাঁচিল, সর্বজয়া – হরিহরের ঘর দুখানি একই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে তুলসি মঞ্চটি কিংবা উঠোনের জবা গাছটি। জবা গাছখানি আজও সত্যজিতের স্মৃতিকে বহন করে নিয়ে চলেছে। কারণ শুটিংয়ের প্রয়োজনে প্রায় চার হাত লম্বা ওই জবা গাছটি নিজে হাতে বসিয়েছিলেন সত্যজিৎ। এই কান্ড দেখে কৃষ্ণবাবু সেদিন দূর থেকে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন “এ বাবা, এত বড় গাছ কখনও বাঁচে নাকি?”  তখন নাকি সত্যজিৎবাবু ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন – দেখাই যাক না। ষাটের কোটায় ছুঁই ছুঁই কৃষ্ণবাবু আজ আক্ষেপ করেন কি ভুল কথাই যে সেদিন বলেছিলেন। যে লোক ক্যামেরা, পর্দার জড়বস্তুতেও প্রাণের স্পর্শ আনতে পারেন তাঁর যাদু হাতের ছোঁয়া যে একটা গাছের প্রাণ ফেরাবে আর এমন কথা কি? জবাগাছ খানা নিয়ে সত্যিই গর্ব সমগ্র বোড়ালবাসীর। একই রকম আছে সেই বাঁশঝাড় যে বাঁশঝাড়ের পাশে জীবনের শেষ নিশ্বাসটুকু ছেড়েছিলেন চূনীবালা দেবী। কিংবা ঘোষদের পুকুর। কেবল জলের অভাবে পুকুরগুলো শুকিয়ে কাঠ। একই রকম আছে অপু – দুর্গার বৃষ্টিতে ভেজার জায়গা। কিংবা সরল দীঘি। আধুনিকতার চাপে ভেঙে পড়েছে জমিদার বাড়িটি। সেই  বিখ্যাত গোষ্টতলার বাঁশ বাগান। ভূতের রাজার নাচমহল এখন মধ্যবিত্তদের দখলে।

বোড়ালে সত্যজিতের প্রিয় জায়গা, প্রিয় মানুষদের নানা গল্প শোনাতে শোনাতে সমীরবাবু হঠৎ চুপ করে গেলেন। “ জানেন – বোড়ালের একটা মানুষের কথা উনি দেখা হলেই জিঞ্জাসা করতেন। বোড়ালের ক্ষ্যাপা সুবোধ ভট্টাচার্যের কথা। কেন যে করতেন আজও বুঝি না। লোকটা বেহালা বাজাতে জানত। মানিকবাবু বিকেলের দিকে আমার দোকানে মাঝে মাঝে চা খেতে আসলেই বলতেন, – সুবোধবাবুকে আজ দেখতে পেয়েছেন? দেখা হলে জানাতাম। দেখতাম হন হন করে চলে যেতেন সুবোধ বাবুর খোঁজে। একটা সাঁকোর উপর বসে থাকতেন সুবোধবাবু। নানরকম আজগুবি কথাবার্তা বলতেন। মানিকবাবু গেলেই দুজনের মধ্যে নানারকম কথাবার্তা হওয়ার পরেই সুবোধবাবু বেহালা বাজাতেন। বেশ মনদিয়ে তার বাজনা শুনতেন মানিকবাবু আর সুবোধবাবুও এত অদ্ভুত মানুষ ছিলেন যে দু – একবার তার সংগ্রহ থেকে পাকা আম বের করে খেতে দিয়েছেন মানিকবাবুকে। কিংবা তামাকের গুঁড়ো খবরের কাগজে পাকিয়ে দিয়ে বলেছেন – খান না, খুব ভাল লাগবে। মানিকবাবুর সে কি হাসি। আমরাও তো অবাক সুবোধবাবুর কান্ড দেখে”।

এপ্রসঙ্গে পাঠককে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার এই সুবোধবাবুকে সত্যজিৎ রায় অমর করে রেখেছেন ‘বিষয় চলচিত্র’ গ্রন্থের ‘দুই চরিত্র’ প্রবন্ধে। সেখানে এক জায়গায় সুবোধবাবুর খুব সুন্দর একটি বর্ণনা দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়, ‘বোড়াল গ্রামের পথের পাঁচালির শুটিং হবে বলে ঠিক হল এক শীতের সকালে। লটবহর নিয়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে শ্যুটিং এর জায়গায় চলেছি। এমন সময় কানে এল- ফিল্মের দল এয়েচে। বল্লম নিয়ে লাফিয়ে পড়ো সব, বল্লম নিয়ে লাফিয়ে পড়ো’। (বিষয় চলচিত্র, পৃষ্ঠা ১০৪)।

বোড়াল গ্রাম যেমন সত্যজিত কে যুগিয়েছে তার ভাবনার খোরাক তেমনি সত্যজিৎও বোড়ালকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তার প্রাপ্য মর্যাদা। একথা একবাক্যে স্বীকার করেন বোড়ালবাসীরা। ‘পথের পাঁচালি’ তৈরির সময় সত্যজিত তার ইউনিটে নিয়েছিলেন বেশ কিছু স্থানীয় ছেলেকে। যারা আজ ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রির কোনও না কোন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। কেউবা হয়ত জীবনের পাট চুকিয়েই ফেলেছেন। যেমন বোড়ালের বাদল মন্ডল কিংবা দুলাল দাস। যারা কর্মনিষ্ঠায় হয়ে উঠেছিলেন সত্যজিতের অন্যতম প্রিয়পাত্র। বোড়ালের কোনও সাংস্কৃতিক কাজেও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন এই বিশ্ববিখ্যাত মানুষটি। অপুর গ্রামে লাইব্রেরি তৈরি হবে। নাম হবে প্রিয়নাথ লাইব্রেরি। অতএব কিছু টাকা পয়সা দরকার। ঠিক হল সত্যজিত রায়ের ‘পরশ পাথর’ এর চ্যারটি শো করে টাকা তোলা হবে। পরিকল্পনা মাফিক সত্যজিৎ এর কাছে গেলেন বোড়ালবাসীরা। সেদিনের ঘটনায় পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেন কৃষ্ণপদবাবু এবং সমীরবাবু। “ সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক । ইনিই সত্যজিতের অপুর সংসারের প্রথম দৃশ্যের অপুর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এঁনার সঙ্গে সত্যজিতের ছিল গভীর বন্ধুত্ব। বোড়ালবাসীর সমস্ত পরিকল্পনা শুনে সত্যজিৎ বললেন-সবই তো বুঝলাম, ছবিটা তো আমার নিজের সম্পত্তি নয়। প্রোডিউসারকে বলে দেখি। আমি বললে যদি প্রোডিউসার বিনে পয়সায় ছবি দেবে বলে আপনাদের বিশ্বাস, তবে কেন বলব না। যথাসময়ে সমস্ত ব্যবস্থা হয়েও গেল। পদ্মশ্রী সিনেমা হলের সেই ম্যটিনি শোয়ের টাকায় তৈরি হল – প্রিয়নাথ লাইব্রেরি।”

পরেও বোড়ালের দিকে কোন কাজে গেলে মাঝে মধ্যে যেতেন সত্যজিৎ। স্থানীয় মানুষরা তাই সত্যজিৎকে এখনও মনে করেন তাদের গ্রামের লোক, আপনজন। গ্রামের প্রবীনরা আজও একবাক্যে স্বীকার করেন – পথের পাঁচালির বোড়াল, অপু-দুর্গার নিশ্চিন্দপুর, সত্যজিতের প্রিয় বোড়াল আজ এত বছর পরেও খুব বেশি বদলায় নি। কেবল ইলেকট্রিক বাতি ঢুকেছে মাত্র। পাশাপাশি প্রোমোটারদের বেড়েছে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা। কতদিন তারা এই সুখ স্মৃতিকে বুকে আগলে রাখতে পারবেন সেটাই দেখবার। নতুবা কোন একদিন ইতিহাসের পাতা থেকে জেগে উঠে নিশ্চিন্দপুরের অপু-দুর্গা বলতেই পারে – ‘আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন – কতদিন আমিও তোমাকে খুঁজি নাকো; – এক নক্ষত্রের নিচে তবু – একই আলো পৃথিবীর পারে আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরোনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়, প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, হয় নাকি ?’

………………….

লেখক পরিচিতিঃ  জন্ম, বেড়ে ওঠা শ্রীরামপুরে। সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশা শিক্ষকতা, লেখালিখি। নেশা ভ্রমণ ও নিবিড় সাহিত্যপাঠ। অন্য পরিচয় কবি ও ছোটোগল্পকার।

Tags: , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • অতনু কুমার on January 9, 2017

    একটা অসাধারণ মানুষ আর একটা অসাধারণ গ্রামকে নিয়ে একটা অসাধারণ লেখা! অনেক ধন্যবাদ এই ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্য৷

    Biswadip Chaudhari on January 10, 2017

    Khub sundor lekha…

    মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ