একটা গল্প বলছি। ১৯৯৫ সাল। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ভারতীয় শিল্পী (নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র এবং বিশ্বভারতীর প্রোফেসর এমারিটাস) পদ্মবিভূষণ শ্রী কে জি সুব্রমানিয়ানের শান্তিনিকেতনের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লো এক বছর বাইশের নবীন ছাত্র। এই ছাত্রটির বগলে কাঁচা হাতে আঁকা এক বান্ডিল ছবি। অনেকের বিদ্রুপ ও নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে শান্তিনিকেতনের ছাত্র না হয়েও সে এসেছে কে জি সুব্রমানিয়ানকে নিজের আঁকা কাজ দেখিয়ে মতামত চাইতে। অনেকে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন বিফল হয়ে অচিরেই বাড়ির রাস্তা দেখতে হবে এই নবীন ছাত্রটিকে। কিন্তু বাস্তবে তা হল না। শিল্পী কে জি সুব্রমানিয়ান তাঁর মূল্যবান সময়ের দুই ঘণ্টা ব্যায় করলেন এই নবীন শিল্পীর জন্য। প্রতিটি ছবি খুঁটিয়ে দেখে নির্দেশ করে দিলেন তাদের ভুল ত্রুটি। সব শেষে নিজে থেকে প্রস্তাব দিলেন প্রতি এক দেড় মাসে একবার করে এসে কাজ দেখিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ বিষয়ে আলোচনা করবার। এইভাবেই এক নবীন ছাত্রশিল্পীর কাছে অনায়াসে এই কিংবদন্তী শিল্পী ‘মানিদা’ হয়ে গেলেন । সেইদিন যে সম্পর্কের শুরু, দীর্ঘ ২১ বছর পরে ২০১৬ সালে কে জি সুব্রমানিয়ানের মৃত্যুর সঙ্গেই তার সমাপ্তি হল। সেদিনের সেই নবীন ছাত্রটির বয়েস এখন তেতাল্লিশ, এবং সে বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যকলা বিভাগের অধ্যাপক, যে বিভাগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কে জি সুব্রমানিয়ান স্বয়ং। বর্তমান লেখকই সেই দিনের সেই নবীন ছাত্র, আর যা লিখলাম তা গল্প হলেও সত্যি।
মানিদা তাঁর জীবনের শেষ দেড় দশক কাটিয়েছিলেন গুজরাতের বরোদা শহরে। ঘটনাচক্রে এই সময়টায় আমিও ছিলাম বরোদার বাসিন্দা এবং আমরা খুবই কাছাকাছি পাড়ায় থাকতাম। মানিদা আমাকে বলতেন ওঁর পড়শি এবং সন্ধ্যে বেলা ওঁর বসার ঘর কাম স্টুডিওতে মাঝে মাঝেই ‘আড্ডা’ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রন জানাতেন। সেই আড্ডায় ধূমায়িত চা বা কফিতে চুমুক দিতে দিতে মানিদার মুখে শুনতাম ওঁর জীবনের নানা গল্প। একবার বলেছিলেন ওঁর দুই মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের এক আশ্চর্য ঘটনার কথা। নন্দলাল তখন তাঁর জীবনের শেষ পর্বে। কাগজের টুকরো ছিঁড়ে কোলাজ করে,তার ওপর ড্রয়িং করে নতুন রকমের সব ছবি আঁকছিলেন। বিনোদবিহারী যখন শুনলেন এইসব ছবির কথা, দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। উনি তখন সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তিহীন। নন্দলাল ওঁকে প্রশ্ন করলেন ‘তুমি তো চোখে দেখতে পাও না, কি করে দেখবে আমার ছবি?’ বিনোদবিহারী বললেন ‘আপনি আমাকে মুখে বলে দিন কি করেছেন, আমি তাতেই ঠিক দেখতে পাবো’ । নন্দলাল মুখে মুখে বলে চললেন আর বিনোদবিহারী ছবির ওপরে হাত বুলিয়ে ‘দেখতে’ থাকলেন একটার পর একটা ছবি। একটা পাখির ছবি ‘দেখে’ বিনোদবিহারী বললেন ‘মাস্টারমশাই এই পাখিটার গায়ে একটু রঙ দিতে পারতেন’। নন্দলাল অবাক হয়ে বললেন ‘তুমি কি করে বুঝলে যে আমি পাখিটার গায়ে কোন রঙ দিই নি’। বিনোদবিহারী হেসে বললেন ‘আমি এখন চোখে দেখতে পাই না, কিন্তু যখন পেতাম তখন অনেক বছর ধরে আপনার কাজ দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আন্দাজ করলাম যে পাখিটার গায়ে নিশ্চয়ই আপনি কোন রঙ দেন নি’। চলে আসার সময় নন্দলাল মানিদা কে বলেছিলেন ‘এই মানুষটির দিব্য দৃষ্টি আছে’!
মানিদার বাড়ির এইসব আড্ডায় মাঝে মাঝে অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতাও হত। একবার একজন ধনী সংগ্রাহক বাক্স ভর্তি টাকা নিয়ে পেল্লায় গাড়িতে চেপে এসে হাজির হলেন। নগদ টাকায় ছবি কিনতে চান। মানিদা খুব ভদ্র ভাষায় জানালেন এইভাবে তিনি ছবি বিক্রি করেন না । এতে না দমে গিয়ে ওই ব্যক্তি ভাবলেন আসলে মানিদা আরো বেশি টাকা চাইছেন। উনি আমাদের সামনেই মানিদা কে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা অফার করলেন। মানিদা যে এতটা রেগে যেতে পারেন তা আমিও ভাবতে পারিনি। উনি একরকম ঘাড় ধরে লোকটিকে বাড়ি থেকে বার করে দিলেন। আবার এই ঘটনার কিছুদিন পরেই পূজোর ঠিক আগে একদিন মানিদার বাড়িতে গেছি, চলে আসার আগে আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন এটা তোমার জন্য উপহার। বাড়ি এসে খাম খুলে দেখি তার মধ্যে ওঁর আঁকা একটা ওরিজিনাল ছবি এবং সঙ্গে শুভেচ্ছা বার্তা। উপহার পাওয়া সেই ছবিটা পাঠকদের জন্য এখানে দিয়ে দিলাম।
না চাইতেই এইরকম ছবি আরও কয়েকবার উপহার পেয়েছি মানিদার কাছ থেকে। আবার লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে যারা ছবি কিনতে এসেছে তাদের কি দশা হয়েছে তাও নিজের চোখেই দেখেছি। এও তো গল্পকথার মতই।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে লন্ডনের স্লেড স্কুল অফ আর্টে পড়তে গিয়েছিলেন মানিদা। একদিন সান্ধ্য আড্ডায় সেই প্রসঙ্গ উঠেছিল। উনি একটা দারুন অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। সেইসময় সাধারণত বিলেত যাওয়ার উপায় ছিল জলপথে। বোম্বাই থেকে এডেন হয়ে সুয়েজ খাল পেরিয়ে ভুমধ্যসাগর ধরে ইউরোপ। মানিদাও সেইভাবেই গিয়েছিলেন। কিন্তু মুস্কিল হয়ে গেল ফেরবার সময়। মধ্যপ্রাচ্যে একটা যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। সুয়েজ খাল দিয়ে অসামরিক জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হল। এদিকে ঠিক সেই সময় লন্ডনের পাঠ শেষ করে দেশে ফেরার জাহাজের টিকিট কেনা হয়ে গেছে ওঁর। এই অবস্থায় যাত্রা বাতিল করবার কোনও উপায় ছিল না। অগত্যা জাহাজে উঠে বসলেন। মানিদার জাহাজ দীর্ঘ কুড়ি পঁচিশ দিন ধরে, গোটা আফ্রিকা মহাদেশ প্রদক্ষিন করে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছল। যাত্রাপথে জাহাজটি পশ্চিম ও পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে বিভিন্ন বন্দরে বন্দরে থামতে থামতে এসেছিল।“আর এই সুযোগে আমারও বিনা খরচে আফ্রিকার অনেকগুলি দেশ দেখার সুযোগ হয়ে গেল” বলেছিলেন মানিদা।
শান্তিনিকেতনে ছাত্রাবস্থায় সুশীলাদির সঙ্গে পরিচয় হয় মানিদার। পরে প্রেম এবং বিবাহ। মূলত সুশীলাদির স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়াতেই চিকিৎসার কারণে পাকাপাকি ভাবে শান্তিনিকেতন ছেড়ে বরোদাতে ফিরে আসেন তিনি এবং কিছুকাল পরে বরোদাতেই মৃত্যু হয় সুশীলাদির। ২০১৬ সালে মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে যখন পায়ের হাড় ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হলেন মানিদা, তার দু একদিনের মধ্যেই ওঁর একটা হার্টের সমস্যা হল। বুকে অসম্ভব ব্যাথা অনুভব করলেন। কার্ডিয়াক স্পেশালিষ্ট দেখতে এসে মানিদাকে প্রশ্ন করলেন ‘আপনার আগে কখনো হার্টের প্রবলেম হয়েছিল কি?’ বুকে প্রচণ্ড ব্যাথা নিয়ে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে মানিদা উত্তর দিলেন ‘একবার হয়েছিল, যখন আমি প্রথম সুশীলার প্রেমে পড়ি তখন’। এই ছিলেন মানিদা। মৃত্যুর ঠিক চার দিন আগে শেষবারের মত ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। চলে আসার সময় বলেছিলাম আপনি বিশ্রাম করুন আমি পরে আবার আসবো। মানিদা ম্লান হেসে বলেছিলেন ‘হ্যাঁ এখন তো শুধুই বিশ্রাম’।
নন্দলাল, রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারী এরা আমার কাছে গল্পকথার চরিত্র, । ইতিহাসের অংশ সবাই হয়ে ওঠেন না। তার থেকেও কম মানুষ পারেন গল্পকথা হয়ে উঠতে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মও মানিদাকে তেমন একজন গল্পকথার মানুষ বলেই জানবে এবং এমন মানুষও যে হতে পারে তা ভেবে বিস্ময় অনুভব করবে। আমার সৌভাগ্য তাঁকে বাস্তবে আমি চলে ফিরে কথা বলে কাজ করে বেড়াতে দেখেছিলাম, তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছিলাম দীর্ঘ ২১ বছর।
……………
লেখক চিত্রকর । জন্ম শ্রীরামপুরে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এবং বরোদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিল্পকলায় স্নাতোকত্তর । চার্লস ওয়ালেশ ফেলোশিপ প্রাপক হওয়ার সুবাদে গ্লাসগো প্রিন্ট স্টুডিয়োতে কাজের অভিজ্ঞতা। একক ও যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে বিদেশের লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস, বার্লিন, মিউনিখ, গ্লাসগো, আলেকজান্দ্রিয়া, টোকিও, সিঙ্গাপুর, হংকং ইত্যাদি শহরে । দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা, বেঙ্গালুরু, ভোপাল, আমেদাবাদ, বরোদা শহরে নিয়মিত প্রদর্শনীতে অংশ নেন। বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলা বিষয়ে অধ্যাপনা করেন।
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।