01 Jan

একটি তেজস্ক্রিয় কাব্যগ্রন্থ

লিখেছেন:মৃদুল দাশগুপ্ত


কবি দেবজীবন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার যে খুব একটা আলাপ ছিল, তা নয়। কিন্তু সে ছিল, সেই ধরনের মানুষ, যারা জোটের ভেতর, জমায়েত হট্টমেলার মধ্যে বসে, একটিও কথা না-বলে, হাসি হাসি মুখে, শান্ত ব্যাক্তিত্বে হয়ে ওঠে লক্ষণীয়। হয়তো সে আমাদের সকলকেই বন্ধু বলে মনে করত, আমরা, অন্তত আমি তাকে স্রেফ পরিচিত মনে করতাম। তুমুল আড্ডার মধ্যে কফি হাউসের টেবিল চেয়ার না-পেয়ে, কাউকে বিরক্ত না-করে চুপটি করে দাঁড়িয়েও থাকত সে, ভর সন্ধেয় আচমকা হাজির হয়ে। আমাদের হয়ত দয়া হত, কখনও কখনও আমারও, একটু সরে বসে, একটু পাছা রাখার ভাগ দিতাম তাকে চেয়ারে। কৃতজ্ঞ সে, প্রীতিপূর্ণ চোখে তাকাত, বড়জোর অস্ফুট বলত, কফি কী খেয়েছেন? আমাদের একটাকা, দু-টাকার সঙ্গে যে বাড়িয়ে দিত ৫ টাকা কখনও ১০ টাকার নোট। কোথায় থাকে সে, বিয়ে হয়েছে কি না কেউ কক্ষনো জানতে চায়নি তার কাছে। ছোট পত্রিকাগুলিতে এদিক সেদিক লেখা বের হত তার। আমার কবি বন্ধুদের অনেকেরই লেখা থাকত সেসব লিটল ম্যাগে। টেবিলে আমরা যখন পাতা উল্টে উল্টে দেখতাম, লক্ষ করেছি সে কুণ্ঠিত তাকিয়ে থাকত তাঁর কবিতায় কেউ থামছে কিনা, করুণ উদ্বেগ ভরা মুখখানি তাঁর স্মিত হয়ে উঠত, ওই সময় কেউ তার দিকে তাকালে, এর ওপর কেউ যদি বলত, পড়লাম, প্রাপ্তির পুলকে লাজুক ভঙ্গিতে কফির কাপে চোখ নামিয়ে নিত সে, শীর্ণ, ফর্সা, চশমা পড়া সুভদ্র মানুষটি।

তা ছিল আমাদের ছাত্রগন্ধ মুছে ফেলার বয়স, জীবিকা জোটানোর হেস্তনেস্ত চেষ্টার সময়, চাকরি বাকরি জুটিয়েও ফেলেছিল কেউ কেউ, যেমন আমি, হেভেনস গার্ডেন নামে এক প্রসাধনী সংস্থার সেলসের কাজে আমাদের ধরত হত, এ-জেলা সে-জেলার বাজার। সেসময় এখানকার মতো মফস্বলেরও এত বিউটি পার্লার ছিল না বটে, কিন্তু আমাদের চেষ্টা চলত সিউড়ি, বিষ্ণুপুর, রামপুরহাট, কৃষ্ণনগর, মায় সেসময়ে পুরুলিয়াতেও রেড রোজ, পিঙ্কি পারফিউম, মনালি ট্যালক ছড়িয়ে দেওয়া। মাসে কুড়ি বাইশ দিন এ-জেলা সে-জেলা ঘুরে ফাঁক ফুরসতে ফের এসে বসতাম কফিহাউসের টেবিলে। আমি নিজে কবিতা লেখার চেষ্টা কস্মিনকালে করিনি যদিও, কিন্তু ছাত্রবয়সের চক্করেই সমবয়সি লেখালিখির বন্ধুদের এই টেবিলে একজন হয়ে গিয়েছিলাম। আমার ভালো লাগত ছোটো পত্রিকার পাতায় পাতায় বন্ধুদের নাম দেখা, পড়েও ফেলা তাদের কবিতা। ওদের ‘কারুভাষা’ পত্রিকার সহ-সম্পাদকের তালিকায় আমারও নাম ছেপে দিত ওরা, আমার লাজুক লাজুক গর্ববোধ হত। কিন্তু কবিতা লিখতে আমি কখনও চেষ্টা করিনি, ওরা জোরজার করে কয়েক লাইন এলোমেলো গদ্যও আমাকে লেখাতে পারেনি। কিন্তু ওদের সাহিত্য সংক্রান্তও নানা আলোচনা, এমনকি কুটকাচালিও শুনতে ভালো লাগত। তেমনভাবে না বুঝলেও, কখনও কখনও ভালো লেগে যেত ওদের কারো কারো লেখা, আমি আড্ডায় প্রশংসা করতাম ওদের সে-সব লেখার। তবে আমি মনে করি, সে প্রশংসা স্রেফ বন্ধুত্বের, আমার প্রশংসার যুক্তি, ব্যাখ্যা আমি দিতে পারতাম না। আমি বরং আনন্দ পেতাম সিউড়ি ঘুরতে ঘুরতে সেখানকার কোনো বুক স্টলে ওদিককার কোন ছোটো পত্রিকায় আমাদের বন্ধুদের কারও কারও কবিতা আবিষ্কার করে, এরকম আবিস্কারে আমার ফেরিওয়ালা চাকরির নিঃসঙ্গতা কাটত। মনে হত বন্ধুরা আমার সঙ্গে সঙ্গে আছে। মফস্বল শহরে বইপত্রের দোকানে আমার এই পত্রপত্রিকা ওলটানোয় সেসব অঞ্চলে যারা লেখালেখি করেন, তাদেরও দু-এক জনের সঙ্গে আমার অল্পবিস্তর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আরামবাগের সাধন বারিক আমাকে বলতেন, আপনি কেন লেখেন না মনোজ? পুরুলিয়ার নিমর্ল হালদার আমাকে তাঁর একটি চিত্রিত পাঞ্জাবি দিয়েছিলেন, আমি ‘সত্তরের যিশু’ পত্রিকায় কলকাতার বন্ধুদের  লেখাপত্র এনে তাঁকে দিয়েছিলাম। সিউড়িতে আমাদের ডিলারের স্টক রুম লাগোয়া একটি প্রেস সদ্য ছাপা হওয়া অমর দে-র ‘রাক্ষসের সঙ্গে আলাপ’ কাব্য পুস্তিকাটি এক কপি চেয়ে নিয়ে আমিই কফিহাউসের টেবিলে পেশ করি। আমাদের ‘কারুভাষা’ পত্রিকাটিও আমি জেলায় জেলায় ছড়িয়ে দিতাম, বুক স্টলে, বন্ধুদের হাতে হাতে। আমার কাজ, মানে চাকরিও তো সেই রকম এ-জেলা, সে-জেলা ঘুরে এসে ফের বসতাম কফি হাউসের আড্ডায়, আমার ঝুলিতে তখন হরেক বই, পত্রপত্রিকা।

যেমন হয়, কিশোর বয়সেই আমাদের কেউ কেউ প্রেমে পড়েছিল, কেউ সদ্য তারুণ্যে, আবার কারও দ্বিতীয়া, তৃতীয়া। আমাদের বান্ধবীরা কেউ সে আমলে কফিহাউসে আসত না। এলেও, স্রেফ ডেকে নিত। ওদের সঙ্গে কোনো কোনো বন্ধু যখন নেমে যেত, তাঁর আগে আমরা সমস্বরে ‘কী ভালো,’ একটু হেসে ওইটুকু বলতাম।

আমি নিজে, খুচরো ঘটনার মতো করে বলব, সেই কলেজ-পড়ুয়া বয়সে যে কিশোরীটিকে চুমু খেয়েছিলাম, তাঁর গর্ভেই আমার পুত্র-কন্যা জন্মাবে ভেবে, সে-সম্পর্ক চুম্বনেই শেষ হয়েছিল। কফিহাউসে বন্ধুদের দলে আমি ছিলাম প্রেমিকহীন, স্ফূর্ত। তুমুল আড্ডার মধ্যে আসামির মতো গ্রেপ্তার হয়ে নেমে যেতে হত না আমাকে, সিনেমা হলের কয়েদ বন্দি হতে।

মালার সঙ্গে আমার আলাপ সারা বাংলায় এই লেখালেখি তথা আমার চাকরির ঘোরাঘুরির সূত্রে। রৌরব পত্রিকায় শুভ আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওদের বহরমপুরের এক নাটক দলের নাটক দেখাতে। পিছনের সিটে আচমকাই শুনতে পেয়েছিলাম তরুণী কন্ঠ, ইস দিদি, কী গন্ধ রে দিদি, সন্ধেবেলাই গিলে এসছে। তৎক্ষণাৎ আমি উঠে দাঁড়াই, ঘুরে আধো আলো ছায়ায় দেখি মেয়েটিকে, তার দিদিকেও। শুভ হাত ধরে আমাকে বসাবার চেষ্টা করলেও, আমি বাইরে এসে বসে থাকি রবীন্দ্রভবনের সিঁড়িতে, শুভর অপেক্ষায়। অন্তত নাটক ভাঙলেও তো শুভ আসবে। না, আসে সেই মেয়েটিই। নতমুখে, কাছে এসে বলে, প্লিজ, কিছু মনে করবেন না, ভেতরে আসুন, নাটকটা দেখুন। ওই মালা, আলোর দিকে যেমন দেওয়ালি পোকা যায়, আমি তার পিছু পিছু গিয়ে ফের বসে পড়ি শুভর পাসে। আবেগে পুলকে আমার মনে হতে থাকে ঘাড়ে শান্ত বাতাস এসে পড়ছে, নিঃশ্বাসের। নামও জিজ্ঞাসা করিনি তখন। কেন ডাকতে বাইরে চলে এসেছিল সে, শুভ কি কিছু বলেছিল তাকে? পরে আমাকে মালা বলেছে, অনুশোচনায়!

আমার কর্মসফরসূচিতে এরপর বহরমপুর গুরুত্বপূর্ণ শহর হয়ে ওঠে। কোম্পানিকে আমি বোঝাতাম নর্থ বেঙ্গলের এন্ট্রি পয়েন্ট, ক্রস পিপল, স্পিডি মার্কেট এসব। এমনকি কাজ ছাড়াও আমি হুটহাট চলে আসতাম বহরমপুরে। ফলে কফি হাউস যাওয়া ক্রমে কমে এল আমার, লালবাগ, হাজারদুয়ারি টানতে লাগল আমাকে। বন্ধুদেরও অনেকেরই তখন ওই দশা, কফি হাউসে অবরে সবরে যাই, টেবিলে দু-একজনকে মেলে। বন্ধুদের অনুপস্থিতে ভাঙা হাটে এমন হয়েছে হঠাৎ গিয়ে কেউ নেই, আধচেনা দু-একজনের সাথে বসে আছি, ওইরকম দিনেও একটু সন্ধের দিকে হাজির হয়েছে দেবজীবন। হাতে চাঁদ পাবার মতো বলেছি, লিখছেন তো? কফি খান।

এদিকে মালার চাপে ততদিনে বিস্তর খেটেখুটে প্রসাধনী সংস্থা থেকে চলে গেছি মোটামুটি নামি একটা সংস্থায়। ওই অবস্থাতে বিয়ে – সহজ করে বললাম বটে, বিস্তর ঝামেলা টপকে এসেছে মালা-ই, গোরাবাজারের গোঁড়া পরিবারের প্রাক্‌ উত্তর আধুনিকা। নচেৎ আমিই বা কেন আরও দৌড়ঝাঁপে দিশি ছেড়ে বহুজাতিকে যাব, বিয়ের বছর ঘুরতে-না-ঘুরতে।  সেলসে আমার তৎপরতা চোখে ধরেছিল, মালা-ই আমাকে ঝকঝকে হয়ে উঠতে বাধ্য করায়। সেসময় আমাকে পাটনা, রাঁচি, আগরতলা, গুয়াহাটি, শিলং যেতে হত। ওই অবস্থাতেও দু-মাসে একবার, তিনমাসে দু-বার কফিহাউসে গেছি। ওই রকমই এক সন্ধ্যায় তিন বন্ধুকে টেবিলে পেয়েছি, পঞ্চম হাজির হল দেবজীবন, স্মিত মুখখানি অধিক আহ্লাদিত মনে হল, লাজুক ভঙ্গিতে দেবজীবন তার ঝোলা ব্যাগ থেকে দিল তার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি ‘আইভিলভা ও  অন্যান্য কবিতা’। হালকা নীল তুলোট কচুরিপানা-বেগনি রঙে নামাঙ্কিত প্রচ্ছদ। আমরা তারিফ করলাম তার। বাড়ি ফিরেই আমি সযত্নে আমার বন্ধুদের দেওয়া  বইগুলির সাথে রাখলাম। পরদিন গুয়াহাটি যাচ্ছি। মালাকে বললাম, দেখো এই এখানে সুপ্রকাশের বইটার পাশে রাখলাম, এলোমেলো করে দিওনা, ফিরেই একটু পড়ব দেবজীবনের লেখা, কতদিনের বন্ধু। মালা তাচ্ছিলের ভঙ্গিতে চলে গেল।

গুয়াহাটি থেকে ফিরে দেবজীবনের বইয়ের কথা আমার মনে পড়ল না। মাস ছয়েক বাদে ওই ঘরে ঢুকে হঠাৎ আলো জ্বালতে দেখি দেওয়ালে একটা গঙ্গাফড়িং। সেটা তাড়াতে যেতেই  তাকে সুপ্রকাশের বইয়ের পুটে বসল পোকাটা, দেখি পাশেই রয়েছে দেবজীবনের বই। ভাবলাম, ছি, একটা পাতাও ওল্টাইনি! নেশা সেদিন জোরদার, তাই বিছানায় সেদিন যখন মালা প্যান্ট শার্ট টেনে খুলছে, বললাম, দেবজীবনের বইটা, বইটা, কাল, কাল, সকালে দিয়ো  তো। পড়ব।

সে দেয়নি। আমারও মনে পড়েনি। দেবজীবনের বইয়ের কথা, মায় গত রাতের গঙ্গাফড়িংটার কথাও।

গত বছর পিসতুতো ভাইয়ের বিয়েতে হাতিবাগানে ওদের হরি ঘোষ স্ট্রিট দুপুর দুপুর গেছি, বিকেল বেলা মনে হল টুক করে একটু কফিহাউস ঘুরে আসি। গুণে দেখলাম ১১ বছর পর। ট্রামে বসে মান্না দে-র গানটাও মনে মনে আওড়ালাম দু-এক কলি। সেই যে ‘কফিহাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই…’। কফিহাউসে ঢুকে দেখি, কেউ নেই। একা টেবিলে বসে আছি, সন্ধে সন্ধে উঠব, দেবজীবন এসে দাঁড়াল। উল্লাসে আমি তার হাত ধরে বসলাম। লাজুক ভঙ্গিতে তার ঝুলি থেকে দেবজীবন এগিয়ে দিল ফের ‘আইভিলভা ও  অন্যান্য কবিতা’। বলল, ‘এই প্রথম, বইটা করে ফেললাম’। নীল-বেগুনি সেই প্রচ্ছদ-আমি হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে বসলাম, এ বই-এ বই তো আমাকে দিয়েছেন, আমি পেয়েছি এই বই, এতো বছর পরে এলাম, তাই হয়তো ভুল করছেন। শান্ত হাসিতে মুখ ভরিয়ে দেবজীবন বলল, সবে তো বেরিয়েছে, বন্ধুদের মধ্যে আপনাকে প্রথম দিচ্ছি, কেউ তো আর তেমন আসে না, আপনিও তো, কতদিন বাদে দেখা হল।

আমি ভূতগ্রস্থ বললাম, এই তো প্রচ্ছদ, এই নীল-আমি পেয়েছি, আমাকে দিয়েছেন আপনি-

দেবজীবন বলল, তা কী করে হয়? আপনি বোধকরি, কারো সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন। এই দেখুন প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯৯।

বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে ঘরে ঢুকেই আমি বইপত্রের  তাকের দিকে তাকালাম। এই তাকে, কবিতার বইগুলো মালা ধরেই না। ওই তো সুপ্রকাশের বই, আমার মনে পড়ে গেল সেই গঙ্গাফড়িং-এর কথা, সুপ্রকাশের পাশে ছিল দেবজীবনের বই। সারা তাক খুঁজেও পেলাম না ‘আইভিলতা’। সব বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুঁজছি দেখে মালা ছুটে এল। আমি বিশ্রীভাবে তাকে বললাম, এই তুমি, তুমিই সব এলোমেলো করে দাও। আহত মালা বলল, বাজে কথা বোলো না, নিজের বই নিজে গুছিয়ে রাখো না কেন? আমি বললাম, এই তো সুপ্রকাশের বইয়ের পাশেই ছিল, কে হাত দিয়েছে তুমি ছাড়া? মালা বলল, সরো আমি দেখছি। মেয়েরা যেমন, এঘর ওঘর, পুরনো কাগজের স্তূপ, মায় বিছানার তোশকের তলাতেও খুঁজল সে। পেল না।

তিনদিন পর। আগরতলার প্লেন দমদম থেকে উড়তেই ব্রিফকেস খুললাম, এই, সেদিন দেবজীবন আবার যে ‘আইভিলভটা দিল, সেটা ব্রিফকেসেই রেখেছিলাম। আছে। স্বস্তির বদলে এল খটকা। আমি নিশ্চিত ‘আইভিলভা ও  অন্যান্য কবিতা’ বইটা আমি দ্বিতীয় বার পেলাম। আধঘণ্টার আকাশে এই খটকাই আমার মাথায় চেয়ে রইল। একঘেয়ে গুঞ্জনের মতো যেন মালার গঞ্জনা শুনে যেতে লাগলাম- নিজের বই নিজে গুছিয়ে রাখতে পারো না, নিজের বই নিজে গুছিয়ে রাখতে পারো না…

সান্ধ্য বিমান পৌঁছানোর পর হোটেলে ঢুকেই স্নান করে নিলাম ভারি মাথার জট ছাড়াতে। কফিতে চুমুক দিতে দিতে হাল্কা ম্যাগাজিন ওলটাচ্ছি, এই সেই ‘পরমা পত্রিকা’। আমার যত অপছন্দ মেয়েদের এই পত্রিকা, মালা তত গেলে এই রঙচঙে পাক্ষিকের গুঞ্জন, গোপন কথা, গৃহসজ্জা, রূপচর্চা, প্রশ্নোত্তর। প্রায় সব লেখায় সফট পর্নোর হালকা প্রলেপ ঝুলানো- মেয়েরা এসব পড়ে? বইয়ের প্রায় কিছুটা উসকে দিতেই মালাকে বলেছিলাম, এই স্তন সংখ্যা? এর পর কি যোনি সংখ্যাও বেরোবে? হাসি আর ইঙ্গিতের ঝিলিক দেওয়া চখে মালা বলেছিল, ছেলেরাই বেশী পড়ে, স্টলে গিয়ে দেখো না খাবলে ‘পরমা’ নিয়ে যাচ্ছে। তোমরা পুরুষেরাই। হবেও-বা।

স্বামী শান্ত মানুষ, ভালোও বাসে। আমাদের একটি ছেলে। ঘটনাচক্রে এক অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি মধ্যবয়স্ক, আকর্ষণীয় ব্যাক্তিত্বের। কী করে জানি না, জড়িয়ে পড়েছি। তিনি ডিভোর্সি। বিবাহিতা মেয়ে আছে। স্বামী না প্রেমিক- কাকে ছাড়ব আমি? ‘গোপন কথা’য় এ জাতীয় প্রশ্নোত্তরের আমি মালাকে বলেছি সব বানিয়ে লেখে, রসিয়ে রসিয়ে বিক্রি বাড়াতে । মায়ের খুড়তুতো বোনের মেয়ে, তাকে বিয়ে করার জন্য কেউ আইনি সাহায্য চাইতে পারে? মালা পরমার পাতা উল্টে উল্টে গেছে। ধারাবাহিক উপন্যাস পড়ি না, দুএকবার চোখ বুলিয়ে দেখেছি পার্ক স্ট্রিট থেকে ইস্টার্ন বাইপাস-এর বাইরে সেসব নায়ক নায়িকারা যায়নি। পড়া যায় এসব ট্র্যাশ? পড় কী করে? আমি যত বলেছি, তত মামলা তাচ্ছিলের ভঙ্গিতে বিছানায় উপুড় শোয়া, গিলেই চলেছে সেসব রসালো গল্প উপন্যাস। ওই ভঙ্গি, তা ভালোই লেগেছে, আমার।

মালার ওই সাজিয়ে রাখা পরমার ওপর, কোণের ওই খাঁজটাতে আমি একবার জুতোর বাক্স রেখেছিলাম। ইচ্ছে করে নয়, এমনি এমনি। সকালে মালা চটে লাল, বিদ্যা, বইয়ের ওপর জুতো রাখো, তোমরা সব লিখতে টিকতে না? ছি! শুনেই হেসে ফেলেছি, পরমাও বিদ্যা! কলকাতা, যাদবপুর, বিশ্বভারতীতেও চিঠি লিখে জানতে চাইব আমি। গজ গজ করতে করতে মালা বলেছে, এই দ্যাখো যাদবপুরের পণ্ডিত বিচিত্র ভট্টাচার্যও তিনি ম্যান্ডেলাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, এই যে-। সরে পড়েছি আমি।

সেই পরমা আগরতলার হোটেলে। কভারে প্রীতি জিনটার আধখোলা ছবি, মেয়েদেরই কাগজে, হুঁ। পাতা ওলটাতে থাকলাম, যোগাসনেও এমন এমন ছবি! ঝট করে ‘গোপন কথার’র প্রশ্নোত্তরে চোখ আটকে গেল : ‘ভালোবেসে বিয়ে। বিয়ের পর বহরমপুর থেকে কলকাতায়। অফিসের কাজে উনি মাসে প্রায় সবটাই বাইরে বাইরে। নিঃসঙ্গতায় ডুবে যাচ্ছিলাম যখন, ওর সঙ্গে দেখা, বহরমপুরেরই ছেলে, এখন কলকাতায়। একদিন দেখতে না পেলে ঘুম হয় না। কী করব? মনে হচ্ছে ও-ই আমার ভালোবাসা, বিয়ে ভুল করে করেছি’। বুকটা ধক করে উঠল। ফের গুঞ্জন শুরু হল, গুছিয়ে রাখতে পারো না, এ হল মালা, মালা-ই। কফি ছেড়ে হুইস্কি খেতে খেতেই মনে হল এক্ষুনি কলকাতা ফিরে যাই। আচমকা গিয়ে মালাকে জব্দ করি। ফোন করে ডেকে আনলাম শাসমলকে। ওকে ত্রিপুরার কাজটা চাপিয়ে দিয়ে বললাম, ভাই স্ত্রীর অসুখ। সকালের ফ্লাইটটায় টিকিট বুক করিয়ে দাও। সারা রাত ঘুম হল না। ছটফট করলাম। ভোর রাতে রাগ গিয়ে পড়ল দেবজীবনের বইটার উপর। ছিঁড়ে কুচিকুচি করে হোটেলের ব্যালকনি থেকে আগরতলার রাস্তায় ছড়িয়ে দিলাম।

পরদিন দুপুর দুপুর ফিরে, ফ্ল্যাটে, ঠিকই মালা নেই। ডুপ্লিকেট খুলে বসে রইলাম বিশ্বাসঘাতিনীর অপেক্ষায়। সন্ধে গড়িয়ে গেল। নিশ্চয়তা বাড়ল মনে, মদ গিলতে লাগলাম একা একা। ৯ টা পার করে এল ও, দু-হাতে ব্যাগ। আচমকা দেখে উদ্বেগে বলল, কী হল শরীর খারাপ? চলে এলে? ত্রিপুরার অফিসে গন্ডগোল কোনও? জবাব দিলাম না। মুখ দেখে ও বুঝল। এবার হেসে বলল, এই যে তোমার জন্য পিটার ইংল্যান্ডের এই চেকটা পছন্দ হল খুব। আমি সে প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললাম, পরমার প্রীতি জিনতা ইস্যুটা, হ্যাঁ, হ্যাঁ এই মার্চের সংখ্যাটা দাও তো?

অবাক হয়ে সে তাকাল। কেন? আমি বললাম, কেন জান না তুমি? স্তম্ভিত সে। আশ্চর্য, চমৎকার গুছিয়ে রাখা পরমার স্তুপে চলতি সংখ্যাটাই সে পেল না। আমার সন্দেহ দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে দাঁড়াল। আমি আরো মদ গিলতে লাগলাম, কী হয়েছে তোমার?মালা এগোতেই পেপার  ওয়েট ছুঁড়লাম। ও ঘরে ঢুকে গেল, ওর ফোঁপানি থামল অনেক রাতে। আমি সোফায় বসে সারা রাত যাচ্ছেতাই অবস্থায় কাটালাম। পেশাদার, তাই ভোরের ফ্লাইটে ফের আগরতলার টিকিট বুক করাতে ভুল করিনি। ব্যানার্জি বলল, আসুন হয়ে যাবে।

কাকভোরে দাঁড়ি কামিয়েছি।আয়নায় উল্টোদিকে বইয়ের তাক দেখে, ঘুরে দেখলাম সুপ্রকাশের বইয়ের পাশেই তো নীল পুট, হ্যাঁ, ‘আইভিলতা ও অন্যান্য কবিতা’। এটা দ্বিতীয়বার পাওয়া বইটা, ত্রিপুরায় কুচিয়ে এসেছিলাম না? কী জানি, ছুঁড়ে ফেললাম সেটা জানলা খুলে নিচে ট্রাম রাস্তায়, তক্ষুণী ভোরের একটা ট্রাম চলে গেল বইটার ওপর দিয়েই যেন, যাক মিটল।

আগরতলার হোটেলে রুমের চাবি হাতেই রিসেপশনে বললাম ‘পরমা’ চলতি সংখ্যাটা পাঠিয়ে দেবেন তো। হোটেল কর্মচারী তক্ষুনি দিয়ে গেল। হ্যাঁ, প্রীতি জিনতার ছবি। গোপন কথায় সেই প্রশ্নোত্তর। কিন্তু কই মালার ওই প্রশ্নটা তো নেই! আশ্চর্য। আতি পাতি সব প্রশ্নই খুঁটিয়ে পড়লাম, নেই। নেই, ফুরফুরে লাগছে, রিসেপশনে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে মালাকে ফোন করব?  আগে এই দুপুরে রোদে একটু চক্কর দিয়ে আসি। বেরোব, রিসেপশন থেকে বলল, স্যার পরশু যাবার সময় এই বইটা ফেলে গিয়েছিলেন। আমি স্তম্ভিত, ফের সেই দেবজীবনের বই ‘আইভিলতা ও অন্যান্য কবিতা’।

লেখাটি ইতিপূর্বে ‘দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত।লেখকের অনুমতিতে এখানে প্রকাশ করা হল। 

Tags:

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • শুভঙ্কর on January 10, 2017

    দিব্যি গল্প। কিন্তু মৃদুলদার এর থেকে ভালো ছবি পাওয়া গেল না? এই পাতায় গল্পের প্রথম লাইন ও দ্বিতীয় লাইনের মধ্যে অতিরিক্ত ফাঁকটা বিসদৃশ লাগছে।

    admin on January 12, 2017

    আপনার পর্যবেক্ষণের জন্য ধন্যবাদ। মৃদুল দাশগুপ্তর ছবি ও লাইন ঠিক করা হল।

    মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ