01 Jan

ভিড়

লিখেছেন:মুর্শিদ এ এম


তীব্রগতির একখানা গাড়ির ধাক্কায় যে-মানুষটি পড়ে গেল রাস্তার বুকে, তাকে আমরা চিনি। গাড়িটি যথানিয়মে পালিয়ে গেলে দৃশ্যে থাকল সেই মানুষ আর তার রক্তাক্ত দেহটি। আমরা ভিড় করতে ভালোবাসি বলেই ভিড় করলুম তাকে ঘিরে। দেখলুম সে আমাদেরই কারও ভাই সন্তান পিতা অথবা স্বামী।

ভিড়ের মাঝে যে-দুজন লাল ব্যক্তি উঁকি মারল, তারা বুঝতে চাইল মানুষটির বর্ণ লাল কি না। লালবর্ণের কেউ নয় দেখে তারা ‘বাঁচলে হয়’, বলে, কেটে পড়ল।

ভিড়ের মাঝে যে-দুজন মহিলা উঁকিঝুকি মারল, তারা মা ও মেয়ে।  জানতে চাইল, কোনো মেয়ের ওই দশা কি না। কোনো মেয়ে নয় দেখে তারা ‘ও কিছু হবে না, হসপিটালে দিতে হবে’, বলে সরে পড়ল।

ভিড়ের মাঝে আমাদের দুজন সবুজ ব্যক্তি ঝুঁকে পড়ল মানুষটির দিকে। তারা যখন দেখল, সে সবুজবর্ণের কেউ নয়, তখন একজন আরেকজনকে বলল, ‘চল চল এসব দেখে লাভ নেই, এর’ম কত হচ্ছে, আমার গা কেমন করছে।‘ বলে দাঁড়াল না সেখানে।

ভিড়ের মাঝে যে-দুজন হলদে সবাইকে সরিয়ে ‘দেখি দেখি’ বলে ত্রস্ত ভঙ্গিতে দেখতে গেল মানুষটিকে, তারা যখন নিশ্চিত হল সে হলুদের কেউ না, তখন স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভেগে গেল এলাকা ছেড়ে।

দুজন সমাজশাসক লালবাতি-কার থামিয়ে ‘এখানে ভিড় কিসের? সরে যান সরে যান’ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পথদুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার সম্বন্ধে নাতিদীর্ঘ লেকচার ঝেড়ে গাড়িতে উঠে হুটার বাজিয়ে ঝড়ের বেগে…

দুজন বুদ্ধিজীবী ও লেখক উঁকি মেরে ঝোলা হাতড়ে মোবাইল বার করে পিক তুলতে তুলতে বললেন, ‘এটা কি সভ্য দেশ? একটা লোক পড়ে আছে বাট প্রশাসনের কোনো কনসার্ন নেই ! এটা নিয়ে স্টোরি করা দরকার।’বলে, তারা পিটটান দিল যথারীতি।

এভাবে ভিড়ের কোনো হেরফের হল না, কেননা একদল যায় আর একদল আসে । তারা খোজে, খুঁজতে থাকে নিজেদের বর্ণের, বর্গের, জাতের, গোত্রের কিংবা ধর্মের। কিন্তু আশ্চর্য, মুমূর্ষু মানুষটির সঙ্গে মিল হয় না কারোরই। সুতরাং ভিড় ভিড়ের মধ্যে ভিড় হয়ে থাকল। সেই দৃশ্যমান মানুষটি ততক্ষণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের দরুন বস্তুখণ্ডে পরিণত হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। তার বাকশক্তি নেই, চেতনা আছে কি না বোঝা যায় না। একসময় স্তব্ধ হয়ে গেল তার যাবতীয় যন্ত্রণা।

ভিড় এবার হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। যাক বাবা ,কারও ঘাড়ে দোষ চাপল না। কিন্তু পরক্ষণেই মানুষটি এক ঝটকায় নিজেকে অন্য আদলে নিয়ে যেতে পারল। সে এখন ক্রমশ ভীষণাকার এক অতিকায় মানব যেন। অট্টহাসি হেসে সে  গমগম স্বরে আদেশ করল—তোমাদের মেরুদণ্ড কই, দাও আমার হাতে ।

উপস্থিত ভিড় তাই করতে চাইল। ভয়ে, ভীতিপ্রদ আকারের কাছে, আনত দশায়।

–খুঁজে পাচ্ছ? হুংকার ছাড়ল মানুষটা।

কেউ সত্যিই খুঁজে পাচ্ছে না তার মেরুদণ্ড। ভিড় ক্রমে জমাট বাধল, তারপর বেলুনের মতো চুপসে গেল, তারপর মাটির সঙ্গে লেপটে চলা এককোষী প্রাণীর মতো দেখতে হয়ে গেল। যেন বিছিয়ে থাকা কালো কালো ডট দেওয়া কোনো কার্পেট।

–দেখো আমার হাতের দিকে। মানুষটি জানাল।

সকলে মাটি থেকে অনেক অনেক উঁচুতে গাঢ় আদেশের স্বর লক্ষ্য করে দেখল তার এক হাতে সরু সরু কাঠির এক গোছা। কী এগুলি? প্রশ্ন করল সকলে।

–তোমাদের মেরুদণ্ডের হাড়!

–সে কী! সকলে একইসঙ্গে আঁতকে উঠল। ভিড়ের ভেতর ভিড় হয়ে থাকা ভিড়-মানুষগুলো ঘাবড়ে উঠল। সত্যিই তো, ওগুলো তাদের মেরুদণ্ডই বটে!  ফেরত না পেলে তারা দাঁড়াবে কী করে! অফিস, মেয়ের লেখাপড়া, শপিং, ইয়োগার ক্লাস, তোমায় আমায় মিলে, পুরিধাম, বইমেলা!

–ফেরত দাও, ওটা ফেরত দাও। আর্তস্বরে  মেরুদণ্ডহীনতায় তারা  ভরিয়ে তুলল গোটা শহর।

বলল মানুষটা, এগুলো রেখে দিলাম। ততক্ষণ, যতক্ষণ না তোমাদের নিকট আত্মীয় বা পরিজন কেউ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। এরপর থেকে তোমরা খুঁজতে থাকবে অবিশ্বাস, ঘৃণা, স্বার্থপরতা। ধাওয়া করতে থাকবে খুন, ধর্ষণ, দখলদারিত্বের পেছনে। যে পারবে সেই সার্থক ব্যক্তিকে আমি  ফেরত দেব তার মেরুদণ্ড।

মাটিসাপটা সেই জনগণ মহা প্রমাদ গণল। কে আর সাধ করে নিজের প্রিয়কে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়াতে চায়? অথচ এমনটা না করলে যে মাথা টানটান  করে, বুক চিতিয়ে  বেঁচে থাকা দায়। তাই সবাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, যেমন করেই হোক পাশের লোকটিকে টার্গেট করতে হবে। নিজে শুধু ভালো থাকলেই আনন্দ হবে না, অপরে যাতে কিছুতেই না ভালো থাকে তার জন্যে প্রাণ বাজি রাখতে হবে। তাতেই সর্বাপেক্ষা আনন্দ ও আহ্লাদ! পড়শিকে লড়িয়ে দিতে হবে মৃত্যুর সঙ্গে। ফেলে দিতে হবে মৃত্য-বিভীষিকার মধ্যে। সন্ত্রস্ত আর সন্দেহভাজনের তালিকায় রাখতে হবে অনবরত। তবেই সকলের সুখ, শান্তি। তবেই তারা ফিরে পাবে যে-যার মেরুদণ্ড।

 

Tags:

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • শফিউল আজম মাহফুজ on April 4, 2017

    খুব সুন্দর লিখেছেন, রুপকের ব্যাবহার ও বেশ ভালো হয়েছে। তবু মনে হয়না আমরা কোনভাবে মেরুদন্ড ফেরত পাবো…

    মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ