রিয়া প্রতিদিনের মত হাঁপাতে হাঁপাতে অফিসে ঢুকলো। তারপর যা কথার তুবড়ি – যা জ্যাম – কন্ডাকটারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি – মা কেন খেতে দিতে দেরি করেছে – আসলে বড় মামা-
অজন্তা এই ব্রাঞ্চে আসার পর থেকে সবার আগে আসে। এসে নিজের ডেস্কে একটু বিশ্রাম নেয়। এই প্রজন্ম কথায় কথায় গুডমর্নিং ম্যাম – থ্যাঙ্ক য়্যু ম্যাম ইত্যাদি বলতে অভ্যস্ত। অজন্তা এ সব পছন্দ করে না। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার পর্যন্ত ব্যাপারটা জানে। সেও ভাল আছেন তো দিদি বলে কাজ সারে। অজন্তা বলল, আগে একটু বিশ্রাম নে – ঠান্ডা হ – তারপর কথা বল। অজন্তা জানে লাঞ্চের সময় ওর অন্য বিষয় এসে হাজির হবে। কাউন্টারে নিত্যনতুন ঘটনা বাঁধা। কোন কোন কাস্টমারের সঙ্গে কি কি হয়েছে শুনতে শুনতে অজন্তা আর স্বাগতা হেসে মরে। এর অদ্ভূত সব ক্যারিকেচার। পারেও মেয়েটা।
রিয়া এসব পাত্তা দেয় না। বলে চলে, অজন্তাদি তোমাকে তো বড়মামার কথা বলিই নি। দিল্লিতে থাকে। মাকে ডাকে ঝিন্নি বলে। মা বলে, দাদা তুমি যতদিন বেঁচে আছো – ঝিন্নিও ততদিন বেঁচে থাকবে – আমার পৃথিবীতে ওই নামে একজনই ডাকে।
অজন্তা ভুল করে বলে বসে, তোর মায়ের আসল নাম কি। ব্যাস রিয়াকে আর পায় কে। মায়ের কেন অতসী নামকরণ হয়েছে। দাদু কি বলে ডাকতো। বাবা গোপনে মাকে কি বলে ডাকে – গলগল করে বলে চলে।
স্বাগতা আর স্বপন বরাবরই একটু দেরী করে অফিসে আসে। ওদের এখন কাউন্টার সার্ভিস নেই। স্বপন নিজের ডেস্কে চলে গেল। স্বাগতা দাঁড়িয়ে গেল। বলল, কিরে পাগলি ঘড়িটা দেখেছিস। তোর কাউন্টারে অলরেডি জনা দশেক লোক দাঁড়িয়ে গেছে। কাউন্টার খোল। বড়সাহেব এক্ষুনি ডেকে পাঠাবে। রিয়া চটজলদি জবাব দেয়, এক্ষুনি খুলছি স্বাগতাদি। অজন্তাদি লাঞ্চের সময় মনে করে দিও – বড়মামার কথা তোমায় ডিটেলসে বলবো – বলতে বলতে প্রায় ছুটে হেড ক্যাসিয়ারের কাছে চলে যায়। অজন্তা হাসে। জানে রিয়ার তখন অন্য বিষয় চলে আসবে। সুনীলদা রিয়ার জন্য সব রেডি করেই রাখে – না হলে রিয়া বকবক করে সুনীলদাকে পাগল করে ছড়বে। তবে মেয়েটাকে ব্রাঞ্চের সবাই ভালোবাসে। বড় সাহেবতো ঠাট্টা করে বলে ব্রাঞ্চের প্রাণ। একদিন রিয়া না আসলে ব্রাঞ্চটা কেমন মরা ভেটকি মাছের মত হয়ে যায়। কাস্টমাররা পর্যন্ত ওকে মিস করে।
লাঞ্চের সময় যথারীতি বড়মামা হারিয়ে যায়। একজন পেনশনারের খুব ইচ্ছা ছেলের সঙ্গে রিয়ার বিয়ে দেবার। আড়েঠাড়ে প্রায়ই জানায়। মাঝে সাঝে দু একটা গিফটও দিয়েছে। ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার – বছরে দুমাস বাড়ি থাকে। আজ তাকে নিয়ে চলল। স্বাগতা টিফিন ভাগ করতে করতে বলল, দেখ রিয়া, একজন বয়স্ক মানুষকে নিয়ে এরকম ঠাট্টা ঠিক না। ওনাকে জানিয়ে দে তুই এনগেজড। রিয়া বলে, মোটেই ঠাট্টা করছি না স্বাগতাদি। জয় যা টলাচ্ছে। মাতৃভক্ত। বুঝলে না। আমার তো খুব ইচ্ছে এখানে বিয়ে করার। বছরে দুমাস সংসার। দারুন ইন্টারেস্টিং না। তারপর দশমাস মুক্ত বিহঙ্গ। ওই সময়টা জয়কে দেওয়া যেতে পারে। জয়কেও বলেছি। অজন্তা খুব গম্ভীর ভাবে বলে, দুমাস এসে কি করবে জানিস, একটা করে ভরে দিয়ে যাবে। তারপর তুই হ্যাঁপা সামলা। রিয়া বলে, ওমা তাই নাকি। তাহলে তো খুব বাজে ব্যাপার হবে। স্বাগতা বলে, কেন বাজে ব্যাপার কেন – বছর বছর একটা করে বাচ্ছা – তুই আর জয় মানুষ করবি – বুড়োর ছেলে তখন ভেসে বেড়াবে সাগর থেকে সাগরে। কোন কথা থেকে যে কোন কথা এসে পড়ে। রিয়া বলল, স্বাগতাদি তোমার ছেলে জাপান থেকে কবে ফিরবে গো। অজন্তা বলল, কেন তোর তাতে কি। রিয়া বলল, ব্যাস অমনি লেগে গেল। আরে বাবা এখনো তো শাশুড়ি হও নি। এখন থেকে জামাই কে আগলাচ্ছ। স্বাগতা হাসে। বিষয় ঘোরাবার জন্য বলে, হ্যারে রিয়া, পোস্তটা কে রেঁধেছে রে। রিয়া বলল কেন – মালটা দাঁড়ায় নি। স্বাগতা বলল, পোস্ততে আমরা কোনওদিন পাঁচফোরন দিই না। সুনীলদা বাইরে টিফিন করে। পেটের রুগী। ঠোঙায় করে মুড়ি খেতে খেতে এদের গল্পে যোগ দেয়। বলে, পোস্ত ব্যাপারটা এক এক জেলায় এক এক রকম ভাবে রান্না হয়। ব্যাস, রিয়া ভেসে গেল পোস্তর স্রোতে। অজন্তা আর স্বাগতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। রিয়া খুব মজা করে বলতে লাগলো ওদের পাশের বাড়ির এক মাসিমা পোস্তর বড়াতে কেমন করে আটা পাইল করে। সবাই হাসতে লাগলো। কাউন্টারের বাইরে থেকে একজন পরিচিত কাস্টমার চিৎকার করে বলল, দিদি আড়াইটে বেজে গেল এবার কাউন্টারটা খুলুন। আজকের মত মধ্যাহ্ন আড্ডা ভেঙে গেল। রিয়া ব্যাস্ত হয়ে আঙ্গুল চুষতে চুষতে টিফিন কৌটো নিয়ে বেসিনের দিকে চলে যায়। অজন্তা চিৎকার করে বলল, এই রিয়া মিষ্টিটা খেয়ে যা। রিয়া যেতে যেতে বলল, অজন্তাদি মুখটা ধুয়ে আসি – মিষ্টিটা আমার মুখে পুরে দিও।
অজন্তা আর স্বাগতার আলাপ সেই নিউ আলিপুর ব্রাঞ্চ থেকে। মাঝে অজন্তাকে মাস ছয়েকের জন্য পদ্মপুকুর ব্রাঞ্চে যেতে হয়েছিল। তারপর একে ওকে ধরে ভাবানীপুর ব্রাঞ্চ। স্বাগতাও কলকাঠি নেড়েছিল। গত বছর পুজোর কয়েকদিন আগে – অজন্তা আর স্বাগতা বিকালের দিকে বেশ হই হই করে গল্পে মেতে উঠেছে। হাতে কাজকম্মোও বিশেষ নেই। সাড়ে পাঁচটা বাজতে দেরি আছে। মূল বিষয় পুজোয় বেড়াতে যাওয়া। এবার রসিক বিল। স্বাগতা কার কাছ থেকে শুনেছে ভুটান নাকি খুব কাছে। অজন্তাকে বলল, অশোকদাকে বল না এই ফাঁকে থিম্পুটাও ঘুরে আসি। অজন্তার অবশ্য একটা ট্যুরে দু রকম জায়গা কোনোদিনও পছন্দ নয়। সেটা এড়িয়ে স্বাগতাকে বলল, পুজোর সময় থিম্পু যাবি। তাহলে আমরা কলকাতায় থাকছি না কেন।আর তুই তো পুজোয় ঢাকের বাদ্যি শুনতে চাস না। এ মা, ভুটানিরা আবার দুর্গাপূজা করে নাকি, স্বাগতা হাসতে হাসতে বলে। অজন্তা গম্ভীর হয়ে যায়। ব্যক্তিত্বের মাপকাঠিতে অজন্তা বেশ খানিকটা এগিয়ে। ব্রাঞ্চ ম্যানেজারও অজন্তার সঙ্গে বেশ সমীহ করে কথা বলে। স্বাগতা চুপ করে যায়। খানিক পরে বলে, শুধু রসিক বিলই থাক বুঝলি। চুপচাপ চারটে দিন বিলের পাশে বসে থাকব আর পাখি দেখবো। অজন্তা বুঝতে পারে এভাবে চললে স্বাগতা একটু পরেই ঝাঁপি খুলে ফেলবে। ও একটু দুঃখবিলাসী টাইপের। অজন্তা বলল, চ আজ নিউমার্কেট ঘুরে যাই। স্নাক্সগুলো কিনে ফেলি। আর তুই তো নিমকি নিচ্ছেস। স্বাগতা অশোকের কথাকে বেশি গুরুত্ত্ব দিতে ভালবাসে। বলল, সে তো অশোকদা যেদিন বলেছে তখনই রেডি করে ফেলেছি। অজন্তা মনে মনে হাসে। যতদূর মনে পড়ছে অশোক কথাটা স্বাগতাকে বলেছিল গত ট্যুরে। তখন থেকেই স্বাগতা যদি নিমকি রেডি করে রাখে – তাহলেই হয়েছে। রিয়া কাউন্টারের কাজ শেষ করে এদের মাঝে এসে পড়লো। বলল প্রথম বার লিভ ফেয়ার নিয়ে বেড়াতে যাব তো – বেশ চাপে আছি। কেন চাপের কি আছে, অফিস এতগুলো টাকা দিচ্ছে, এতদিন তো বাপের পয়সায় যেতিস, স্বাগতা বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলে। রিয়া বলল, সেইটাই তো চাপ। কোনো হিসাবের গপ্পো ছিল না – সব বাপি। অবশ্য বাপি বলেছে বিল-টিল নিয়ে ভাবার কিছু নেই, অফিস যা দেবার দেবে তারপর ম্যায় হুঁ না। হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটে বলল, তোমরা এবার পুজোয় কোথায় যাচ্ছগো অজন্তাদি। স্বাগতা এই সব প্রশ্নের জন্য রেডি থাকে। মেট্রো রেলের সহযাত্রী থেকে বাজারের আলুওয়ালা পর্যন্ত জানে এবার পুজোয় ও কোথায় যাচ্ছে। রিয়া এত বড় নিউজটা জানে না – বলল, এমা তুই জানিস না – রসিক বিল। চারদিন বিলের ধারে বসে দুজনে শুধু গল্প আর গল্প। রিয়া একটা চেয়ার টেনে আয়েশ করে বসে পড়ে। বলল রসিক বিল। কুচবিহারে না। কিন্তু এখন পাখি কোথায় পাবে স্বাগতাদি – সে তো শীতকালে – দুজনে কেন। তোমরা বরদের সঙ্গে নেবে না। তোমাদের ছেলেমেয়ে – তারা যাবে না কেন। স্বাগতা কিছু বলার আগে অজন্তা তড়িঘড়ি বলে উঠলো – ওরা তো বাইরে – দু তিন বছরে একবার করে আসে। আমার মেয়ে জাপানে এর ওর ছেলে স্টেটসে। দুজনেরই দুজনকে খুব পছন্দ, এবার ফিরলেই বিয়ে দেব। রিয়া সত্যিই খবরটা জানতো না। ব্রাঞ্চে প্রায় সবাই নতুন। কাজলদাকে বলে অজন্তা এই ব্রাঞ্চটাই বেছে নেয়। এই তো কটা বছর। বছর কেন মাস বললে হিসাবটা ঠিক দাঁড়ায়। এখন কেউ নিজের পিছনটাই দেখতে চায় না – তো অন্যের জীবন। মোটামুটি সবার সঙ্গে হাই– হ্যালো সম্পর্ক। অজন্তা আরও বলল, দেখ রিয়া, এ কথাটা আর কাউকে বলিস না। বুঝতেই পারছিস আমরা ঠিক করেছি – ওরা যদি বেঁকে বসে। স্বাগতা চার্জড হয়ে গেল। আর বলিস না এখনকার ছেলেমেয়েরা – আমার ভাইঝি – সব ঠিকঠাক – কার্ড সব ডিসট্রিবিউট হয়ে গেছে – বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এসে গেছে – বিয়ের ঠিক আগের দিন। হই হই করে বলে চলে। অজন্তার এ গল্পটা বার দশেক শোনা হয়ে গেছে। বলল, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি বুঝলি। স্বাগতাকে যেতে যেতে বলল, নিউ মার্কেটে নামলে রেডি হয়ে নে।
সেই শুরু। রিয়া মাঝে মাঝেই অজন্তা আর স্বাগতার কাছে ওদের ছেলেমেয়ের কথা জানতে চায়। ফুকুওকাতে রিয়ার এক বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড চাকরি সূত্রে থাকে। সে রিয়ার ফেসবুক ফ্রেন্ড। প্রায়ই অজন্তার কাছে রিয়া ওর মেয়ের ঠিকানা চায়, ফোন নাম্বার চায়। ফেসবুকে আছে কিনা জানতে চায়। মেয়ের নামটা জানাতে অজন্তার কোনো অসুবিধা হয়নি। রিয়া ফেসবুকে সার্চ করেও এমন কোনো অনামিত্রা সান্যালকে খুঁজে পায় নি যে জাপানে থাকে। স্বাগতার ছেলের নামটা অজন্তাই রিয়াকে জানায়। একদিন স্বাগতাকে রিয়া বলে, সুনন্দন ফেসবুকে নেই। স্বাগতা আকাশ থেকে পড়ে। অবাক হয়ে বলে, কে সুনন্দন। রিয়া হেসে গড়িয়ে পড়ে। অজন্তা কাছেই ছিল। রিয়া অজন্তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, দেখ অজন্তাদি – নিজের ছেলের নামটাই ভুলে গেছে – বলে কে সুনন্দন। অজন্তা পরিস্থিতি সামাল দেয়। আসলে ও ডাক নাম গুড্ডুটাই সব সময় বলে তো। তিন বছর এদেশে নেই। তুই হলে নিজের নামটাই ভুলে যেতিস।
শ্বশুর বাড়িতে স্বাগতার প্রথম জীবনটা ভাল কাটে নি। ও দেখতে সুন্দর নয়। ছোটবেলা থেকেই এটা ও জানে। স্কুল বা কলেজ জীবনে কোনো ছেলের চোখে কখনো অন্য কোনো দৃষ্টি দেখে নি। ছেলেবন্ধু অনেক ছিল। কিন্তু কেউ কখোনো ওর মনের খবর নেবার চেষ্টাও করে নি। বাবা তো সোজাসুজিই বলত, তোর কোনোদিন বিয়েই হবে না। আস্তে আস্তে স্বাগতা গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। কোনো আড্ডা বা কারো বিয়েতে যেত না। তারপর গ্রাজুয়েশান করেই মাসখানেকের মধ্যে চাকরী পাবার পর পৃথিবীটা হঠাৎ বদলে গেলো। বাসবের সঙ্গে বিয়ে হবার দুদিনের মধ্যেই ভুলটা ভাঙল। বাসব ওর চাকরিকে বিয়ে করেছে। ওকে সবসময়ই এড়িয়ে চলত। বিশেষ করে রাতে। ফুলশয্যার অনেক মাস পরে বাসব ওর কাছে প্রথম আসে। সে রাতটা স্বাগতা কোনোদিন ভুলবে না। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল গরমে। হঠাৎ লোডসেডিং। পাখা বন্ধ। বুঝতে পারে বাসব ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। শরীরের মধ্যে অদ্ভূত এক অনুভুতি। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর যত সুখ একসঙ্গে ওর বিছানার পাশে হাত ধরাধরি করে নাচছে। স্বাগতাও বাসবকে আঁকড়ে ধরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছিল। কতক্ষণ স্থায়ী হয়েছিল সে সুখ আজ আর মনে করতে পারে না। কিন্তু অপমানটা ওর প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী। ওর দোতলার ঘরের জানলা দিয়ে ল্যাম্পপোষ্টের আলো আসে। বেশি গরম না থাকলে জানলাটা বন্ধই রাখতে হয়। হঠাৎ কারেন্ট চলে আসে। বাসব ছিটকে সরে যায়। দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে। সেই মুখ ওর দিকে আর কোনোদিন ফেরে নি। স্বাগতা বলেছিল, চল ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার তো তোমাকে দেখানো দরকার, কসমেটিক সার্জন। শেষ শব্দদুটো বাসব চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল। স্বাগতা এ কথা কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারেনি। অনেক পরে বিনসারে অজন্তাকে উজাড় করে সব বলেছিল। তারপর দুইবন্ধু জড়াজড়ি করে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল। স্বাগতা ভেবেছিল কি লাভ এই বিবাহিত জীবন। শাশুড়ি ননদ সেই শরৎচন্দ্রের আমলের ভূমিকা পালন করছিল। বাসবের অবশ্য অন্য কর্তব্যে কোনও খামতি ছিল না। স্বাগতা ফ্ল্যাট কেনার কথা বললে বাসব বাধা দেয় নি। পজেসান পেলে বাসব সুরসুর করে চলেও এসেছিল। দুটো বেডরুমে দুজনের অভ্যাসের জীবন। জীবনটা একটা নির্দিষ্ট পথে গড়িয়ে গড়িয়ে বেশ চলছিল। তবে সেটা ছিল কেমন অন্ধকারের সঙ্গে আপস করা। ভোর থেকে অফিস আসা পর্যন্ত সময়টা কাজেকম্মে কেটে যেত। সমস্যা শুরু হত বাড়ি ফেরার পর। বাসব বাড়িতে বসা। স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে পঞ্চাশেই পেনশনার। বাসব বরাবরই একটু খিটিখিটে স্বভাবের। অজন্তা তো মজা করে বলে, বাসবদার মনে হয় কোষ্ঠকাঠিন্য আছে – ক্লিয়ার হয় না। অজন্তার সঙ্গে – বিশেষ করে অশোকদার সঙ্গে আলাপ হবার পর জীবনের মানেটাই বদলে গেল। বছরে অন্তত চারবার বেড়াতে যাওয়া। একটা বেড়ানো শেষ হলেই পরের বেড়ানোর জন্য প্রস্তুতি। প্রতি রবিবার একটা এন জি ও’তে যাওয়া। সময় কিভাবে যে কেটে যায় বোঝাই যায় না। বাসবও এখন আর সব সময় গুম মেরে থাকে না। অশোকদা কোত্থেকে যে নতুন নতুন জায়গা খুঁজে বার করে। সমস্যা হত উৎসবের সময়গুলো। বিশেষ করে দুর্গাপূজা। ঢাকের বাজনা যে এত বিরক্তিকর হতে পারে। স্বাগতার একটাই আবদার অশোকদার কাছে। দুর্গাপূজার সময় এমন জায়গা ঠিক করবেন, যেখানে ঢাকের বাজনা শোনা যাবে না। অশোক সেই রকমই জায়গাই নির্বাচন করে। সুনন্দন। নামটা স্বাগতার বেশ পছন্দ। অজন্তা পারেও বটে। যার কোনো অস্তিত্ব নেই সে রিয়ার কাছে কেমন জীবন্ত। যত দিন যাচ্ছে সুনন্দন বা গুড্ডুর একটা অবয়ব আবছা ভাবে স্বাগতার কাছে ধরা দিচ্ছে। মাতৃত্বর একটা অদ্ভূত টান আছে। সেই টান এখন তার শরীরে শরীরে ভ্রমণ করে। বালিগঞ্জ ব্রাঞ্চের নিয়তির ছেলে আজ পাঁচ বছর বিদেশে। নিউইয়র্কে। একদিনের জন্যও আসেনি। স্বাগতা ভাবে, নিয়তির সঙ্গে আমার পার্থক্যটা কি। নিয়তির ছেলের একটা নির্দিষ্ট মুখ আছে ওর সে দায় নেই। একজন পাকা শিল্পীর মত সুনন্দনের মুখ গড়তে গড়তে স্বাগতা রোজ ঘুমিয়ে পড়ে।
যেদিন রিয়ার কাছে গল্পটা নামিয়েছিল সে রাতে অজন্তা আর ঘুমোতে পারে নি। রিয়ার বয়সটা এত ঠিক ঠাক অনামিত্রার সঙ্গে মিলে যায় কি করে। রিয়ার অক্টোবরের তিন আর অনামিত্রার দশ। একই বছর একই বার। বুধবার। অজন্তা ইতিহাসের ছাত্রী। ওর মাঝে মাঝে মনে হয় এই পৃথিবীর ইতিহাসটা গড়ে উঠেছে কতগুলো ঘটনা আর মিথকে আশ্রয় করে। দুটোই সত্য। আলেকজান্দার যেমন সত্য অউদিপাউসও তেমনই সত্য। রাম বা অর্জুন কি আমাদের জীবনে শুধু কল্পলোকের বাসিন্দা। অনামিত্রার বেড়ে ওঠা – উচ্চশিক্ষা বা চাকরির জন্য জাপানে থাকার মধ্যে অবাস্তবতার ছিটে ফোঁটা ও খুঁজে পায় নি। অশোকের কাছে এই সত্যটা কতখানি গ্রহণযোগ্য হবে এটা ভাবতে ভাবতে আর শেয়ার করতে পারে নি। স্বাগতার একটা ছেলে থাকতেই পারে। তার নাম, সুনন্দন হতেই বা বাধা কোথায় ? অনামিত্রা তো একই জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে আছে। বিছানায় ছড়ানো এ্যালবামে অন্নপ্রাশন থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত। চোদ্দ বছর। এর মধ্যেই আনাগোনা করছে অজন্তা। অনেক চেষ্টা করেও অনামিত্রাকে বাইশ বছরে টেনে আনতে পারত না। মুখটা, শরীরটা কেমন ছিঁড়ে ছিঁড়ে যেত। আকাশের মেঘের মত। ইদানিং অনামিত্রার মুখে রিয়ার মুখ ফটোশপে কে যেন এডিট করে দিচ্ছে। অনামিত্রার বাইশ বছর কল্পনা করতে ভয় হচ্ছে অজন্তার। তবে কি আস্তে আস্তে অনামিত্রা হারিয়ে যাবে। মাঝরাতে অজন্তা অনামিত্রার শেষ ছবিটা অ্যালবাম থেকে খুলে বুকে চেপে ধরে বলতে থাকে – না মা, তোকে আমি কিছুতেই হারাতে পারবো না – কেউ তোর জায়গা নিতে পারবে না। প্রতিরাতের মত অনামিত্রার প্রিয় ফ্রকটা নিয়ে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ঘুমিয়ে পড়ে অজন্তা। অশোক মাঝরাতে বই বন্ধ করে অজন্তার কাছ আসে। ফ্রকটা আস্তে করে সরিয়ে নিয়ে চোখের কোন থেকে জলের রেখাটা মুছে দিয়ে বালিশে মাথাটা ঠিক করে দেয়। অজন্তার আত্মীয় স্বজন অনেকেই আর একটা বাচ্ছা নিতে বলেছিল। অজন্তা একটা কথাই বলেছিল, সেও যে আমাকে ছেড়ে যাবে না এর নিশ্চয়তা আছে কি। না। আমি বেশ ভালই আছি। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে বেঁচে আছি। রিয়ার কাছে হঠাৎ বানিয়ে বলা গল্পটা কেমন স্থান কাল পাত্রপাত্রী নিয়ে চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে দিন দিন।
মর্মান্তিক খবরটা ব্রাঞ্চে আসে ঠিক বারোটার সময়। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার শান্তনু সঙ্গে সঙ্গেই অজন্তাকে ডেকে পাঠায়। অজন্তা হাতের কাজ শেষ করে মিনিট পাঁচেক পর ঢুকে দেখে শান্তনু নার্ভাস হয়ে বসে আছে। একা। অজন্তাকে দেখে লাফিয়ে ওঠে। অজন্তাদি, একটা বাজে ব্যাপার হয়ে গেছে। এই মাত্র মেন অফিস থেকে ফোন এসেছিল। আমাদের সিমলা ব্রাঞ্চ থেকে একটা খুব বাজে খবর এসেছে। অজন্তা সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে যায়। কাল রাতে রিয়া ফোন করে বেড়ানোর খুঁটিনাটি জানিয়েছিল। দারুন মজা করছে। আজ ভোরবেলায় সিমলা থেকে কুলু যাবার কথা। ঠিক কি অবস্থায় আছে ওরা, অজন্তা খুব শান্ত হয়ে প্রশ্নটা করে। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না অজন্তাদি, আজ ভোর ছটার সময় সিমলা থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে ওদের গাড়িটা প্রায় ছশো ফুট নীচে – তোমার মিশ্রকে মনে আছে, বেলেঘাটা ব্রাঞ্চে কিছুদিন ছিল, ও এখন সিমলা ব্রাঞ্চের চার্জে। ওই ইনিসিয়েটিভ নিয়ে উদ্ধার করে সবাইকে সিমলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। শান্তনু আর বলতে পারে না। চেয়ার থপ করে বসে পড়ে। শান্তনু অজন্তার সঙ্গে বেলেঘাটে ব্রাঞ্চে ছিল। অজন্তার মেয়ের ব্যাপারটা যখন ঘটে, শান্তনু অজন্তার পাশে যে ভাবে দাঁড়িয়েছিল, তা অজন্তা ভুলতে পারে না। সেই থেকে তুতোকারি সম্পর্ক। অজন্তা শান্তনুকে ঝাঁকিয়ে বলে, রিয়া কেমন আছে – ওর মা বাবা। শান্তনু মাথা নীচু করে ভেঙ্গে পড়ে। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে, ড্রাইভার ছাড়া – বোধ হয় সবাই – একজ্যাক্ট খবরটা জানতে ভয় লাগছে অজন্তাদি। এসব খবর ছড়াতে দেরি হয় না। ব্রাঞ্চের সবাই ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের ঘরে ভিড় করে। স্বাগতা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। কাষ্টমারদের কাছেও খবরটা পৌঁছে যায়। স্বপন ব্রাঞ্চে ঠান্ডা মাথার মানুষ বলে খ্যাতি আছে। কিচ্ছুক্ষনের মধ্যেই ও রাশ নিজের হাতে তুলে নিয়ে যোগাযোগ করতে শুরু করে। সিমলা ব্রাঞ্চের ভরত মিশ্রকে ফোনে পেয়েও যায়।
আজ ভোরে রিয়াদের গাড়ি কুলুর উদ্দেশে রওনা হয়। রিয়া, রিয়ার মা – বাবা আর ওর বাবার একজন বন্ধু আর তার স্ত্রী। তখনো বেশ অন্ধকার। আর একটা গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে ওদের গাড়িটা ভাল স্পিডেই খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রিয়াকে আর রিয়ার বাবাকে গাড়ি থেকে অনেকটা দূরে পাওয়া যায়। ড্রাইভার ছাড়া সবাইকে মৃত অবস্থাতেই উদ্ধার করা হয়। ড্রাইভার হাসপাতালে মারা যায়। ব্রাঞ্চ বিনা নোটিশেই বন্ধ হয়ে যায়। কাষ্টমারদের তরফ থেকেও কোনো রকম আপত্তি আসে নি। রিয়া কাষ্টমারদের কাছে খুবই প্রিয় ছিল। স্বপন খোঁজ খবর নিতে শুরু করে। রিয়াদের ফ্ল্যাট তালাবন্ধ। ফ্ল্যাটের অন্যান্যরা খবরটা জানে না। রিয়ার আত্মীয়স্বজনদের অনেক গল্প অজন্তা আর স্বাগতা জানলেও তাদের হোয়ার এবাউটস ওদের জানা নেই। অজন্তা স্বাগতাকে বলল, ওর ড্রয়ারটা খোল তো, যদি কোনো ফোন নম্বর পাওয়া যায়। সিমলা থেকে মিশ্র স্বপনকে জানিয়েছে, ওদের কাছ থেকে কোনো মোবাইল পাওয়া যায়নি। সিমলার হলিডে হোমের কেয়ারটেকার খবরটা প্রথম পায়। কেয়ারটেকারই গাড়িটা ঠিক করে দিয়েছিল। সে মিশ্রকে জানায়। রিয়ার ড্রয়ার থেকে ওর বয়ফ্রেন্ড জয়ের একটা ভিজিটিং কার্ড স্বাগতা বের করে। স্বপন ওই নাম্বারে ফোন করে। ওকে কিছু জানায় না স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি ব্রাঞ্চে আসতে বলে। জয় ঠাকুরপুকুরে একটা এন জি ও’র পাবলিক রিলেসন অফিসার। ঘণ্টা খানেকার মধ্যে স্বপন সব কিছু ফাইনাল করে ফেলে। বিকালেই জয়, রিয়ার কাকা আর ব্রাঞ্চের অমিতকে নিয়ে প্লেনে দিল্লি রওনা হয়ে যায় স্বপন। রিয়ার কাকার ছেলে দিল্লিতেই থাকে। সে ইতিমধ্যেই সিমলার উদ্দেশে মাঝপথে। প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটার পর এইসব ঘটনা একটা নির্দিষ্ট খাতে গড়াতে থাকে। এখানেও অন্যথা হয় না। অজন্তা আর স্বাগতা আস্তে আস্তে ব্যাপারটা থেকে বেরিয়ে আসে। টিফিনের বাক্স ব্যাগেই পড়ে থাকে। দুজনে সামনা সামনি বসে থাকলেও কোনো কথা হয় না। সাড়ে পাঁচটার সময় স্বাগতা বলে, চ অজন্তা, বাড়ি যেতে হবে তো। দুজনে আর কোনো কথা না বলে ব্রাঞ্চ থেকে বেরিয়ে পড়ে।
অজন্তা বাড়ি ফিরে যথানিয়মে অশোককে চা করে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ে। ফ্রেশ হয়ে চায়ের কাপটা নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। অশোক একটু অবাক হয়। অজন্তা নিজের মধ্যে থাকলেও এই সময়টা অন্তত অশোকের সামনে বসে চা বা সামান্য টিফিন একসঙ্গেই করে। কি ব্যাপার, শরীর খারাপ নাকি, অশোক একটু জোরেই বলে। অজন্তা কোনো উত্তর দেয় না। অশোক চায়ের কাপটা নিয়ে অজন্তার ঘরে যায়। অজন্তা আর নিজেকে সামলাতে পারে না। অশোকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাগলের মত কাঁদতে থাকে। অশোক অজন্তাকে একটু সময় দেয়। রিয়াকে অশোক চেনে। অফিসের ফ্যামিলি পিকনিকে গত জানুয়ারিতে ডায়মন্ডহারবারে রিয়াকে দেখেওছিল অশোক। কোনো মৃত্যুসংবাদ এই পরিবারে আর বাড়তি মাত্রা যোগ করে না। কিন্তু রিয়ার ব্যাপারটা একদম আলাদা। অজন্তা অশোককে প্রায়ই বলতো, মেয়ে বেঁচে থাকলে একদম রিয়ার মত হত। রিয়ার জন্য একটা আলাদা জায়গা আস্তে আস্তে এদের পরিবারে তৈরি হচ্ছিল। অশোক সব শুনে নিজের ঘরে গিয়ে বইয়ে মুখ গুঁজেছে। অজন্তা জানে ও পড়ছে না। শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে রাত্রে সম্ভবত অশোক খাবেও না। এই চোদ্দ বছর অজন্তা অশোকের প্রতিটা নিঃশ্বাসকে পড়তে পারে। ও ভেবেছিল রিয়ার খবরটা অশোককে জানাবে না, পারলো না।
অজন্তা ডিভানে আধশোয়া হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল জানতে পারে নি। যখন উঠলো রাত দুটো বেজে গেছে। তড়িঘড়ি অশোকের ঘরে গিয়ে দেখে, বুকে বই নিয়ে কখন ও ঘুমিয়ে গেছে। বইটা নিয়ে মশারিটা টাঙিয়ে দিয়ে আলোটা অফ করে দেয় অজন্তা। প্রতিদিনের মত মেয়ের ফ্রক আর এ্যালবামগুলো নিয়ে বিছানায় আসে। আজ অনেকদিন পর মেয়ের শরীরের ঘ্রাণ ফ্রকের মধ্যে ফিরে এল। ছবিগুলো একটার পর একটা দেখতে থাকে। তাজমহলের সামনে মা – মেয়ের একটা ছবি অশোক তুলেছিল। তখন ওর ছবছরের জন্মদিন কদিন আগেই পেরিয়েছে। ছবিটা দেখে অজন্তার দাদা বলেছিল, তোর মেয়ে তো একেবারে দ্বিতীয় অজন্তা রে। একেবারে তোর মত দেখতে হয়েছে। ছবিটা দেখতে দেখতে অজন্তা পৌঁছে যায় তাজমহলের সামনে। তিনজনে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে থাকে। অবয়বগুলো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে হতে সামনে এসে দাঁড়ায়। অজন্তা অনামিত্রাকে স্পর্শ করে। আঙ্গুল – ঠোঁট। চিবুকটা তুলে ধরে। অনামিত্রার মুখে এক রহস্যময় হাসি। সে হাসির সঙ্গে বাইশ বছরের অজন্তার হাসির মিল খুঁজে পায় অজন্তা। আজ থেকে অজন্তা অনামিত্রার মুখের সঙ্গে আর কারো মুখের মিল খুঁজবে না। রিয়ারও না।
Tags: তপন মোদক
email:galpersamay@gmail.com
Arnab Mukherjee on January 21, 2017
khub bhalo galpo.
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।