দিল্লির সানরাইজ হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ। রাস্তার মোড়ে এসে একজন অটোওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই, এয়ারপোর্টে যাবে ?’
প্রতুত্তরে জানাল, ‘সাব, আপ কৌন এয়ারপোর্টে যায়েঙ্গে ? ইন্টারন্যাশানাল অর ডোমেস্টিক ?’
‘ডোমেস্টিক’ বলতে জানাল, আইয়ে সাব। আমার সঙ্গে ছিল ডাঃ কল্যাণ মুখার্জী। আমরা চন্দননগর থেকে এসেছিলাম দিল্লিতে আইএমএ-র ন্যাশনাল কনফারেন্সে যোগ দিতে।
দুদিনের কনফারেন্সে শেষে ফিরছি কলকাতায়। শীতের সকালে অটো দ্রুতগতিতে ছুটতে থাকায় একেবারে হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছিল। গায়ে দু-তিন প্রস্থ গরম জামা ও মাথায় টুপি ও গলায় মাফলার লাগিয়েও শীতকে বাগে আনা যাচ্ছিল না। যেতে যেতে অটোওয়ালার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা হচ্ছিল – দেশের কথা, রাজনীতির কথা, দিল্লিবাসীর দুর্ভোগের কথা। কথার ফাঁকে অটোওয়ালার ব্যঙ্গোক্তি মন্দ লাগছিল না। মোট কথা সময়টা কেটে যাচ্ছিল বেশ।
শেষমেশ এয়ারপোর্টের গেটে এসে দাঁড়াল অটোটা। নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিতেই নমস্কার জানাল অটোওয়ালা। প্রত্যুত্তরে আমরাও নমস্কার জানালাম। লাগেজ কিছু ছিল না আমাদের। শুধু একটা হ্যান্ড ব্যাগ। টিকিট আর আইডি কার্ড দেখাতেই সিকিউরিটি আর কোন উচ্চবাচ্য করল না। পথ ছেড়ে দিল। সিকিউরিটি চেকের পরে বোর্ডিং পাশ নিয়ে লক্ষ্য করলাম যেতে হবে ২ নম্বর গেটে। ২ নম্বর গেটটা আবার দোতলায়। তাই লিফটে করে চলে গেলাম দোতলায়। অপেক্ষা করতে হল। তখনও আমাদের ফ্লাইটের সময় হয় নি।
মাঝে একবার টি স্টলে ঘুরে এলাম। ডাঃ মুখার্জীর চা পান না করলে চলছিল না। অনেক বেশি দাম দিয়ে এক কাপ কফি নিলেন। আমার আবার ওসব রসে কোনও আগ্রহ নেই। যাইহোক গল্প করতে করতে সময়টা পার হয়ে গেল। বোর্ডে ভেসে উঠলো স্পাইসজেট ৭২৯ এর ছাড়ার সময় ও গেট নম্বর। সিকিউরিটি অফিসারকে বোর্ডিং পাশ দেখিয়ে আমরা রওনা দিলাম ফ্লাইটের দিকে। রানওয়েটা একটু দূরে। তাই আমাদের সকলকে এয়ারবাসে করে পৌঁছে দিল প্লেনের কাছাকাছি। আমাদের সিটটা ছিল পেছনের দিকে। তাই পিছনের গেট দিয়ে ঢুকতেই, দরজার মুখে দাঁড়িয়ে সুবেশী সুন্দরী মেঘবালিকা সাদর সম্ভাষণ জানালেন আমাদের। প্রত্যুত্তরে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম প্লেনের পেটের ভেতরে।
সিট দেখে নিয়ে হ্যান্ড ব্যাগগুলো মাথার ওপরের সেলফে রেখে দিয়ে বসে পড়লাম নিজেদের সিটে। দেখলাম আমাদের বামদিকের সিটে একজন বছর ৪০ এর ভদ্রমহিলা ও তার ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে বসে । মেয়েটির বয়স হবে খুব জোর ৩-৪ বছর। একটা প্যাকেট তার হাতে ধরা। মার সঙ্গে কত কি কথা বলে যাচ্ছে। বাংলা ভাষায় আধো আধো স্বরে কথা বলছে। তবে উচ্চারণটা বেশ স্পষ্ট। আর ভারি মিষ্টি গলা। খুব ভাল লাগছিল ওর কথাবার্তা শুনতে। তাই বারে বারে ওর দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল। সেইসঙ্গে মায়ের চোখাচোখি। উনিও বুঝতে পারছেন ওনার ছোট্ট মেয়েটাকে আমাদের খুব ভাল লেগেছে।
একটা ব্যাপারে খুব কৌতূহল লাগছিল। ভদ্রমহিলা মাঝে মাঝে পেছন ফিরে কাকে যেন দেখছেন আর মেয়েকে সিটে বসিয়ে কখনও কখনও পেছনের দিকে উঠে যাচ্ছেন। যখন উঠে যাচ্ছেন, বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গে চোখাচোখি আর মিষ্টি হাসি দিয়ে হাতে রাখা প্যাকেটটায় হাত বুলিয়ে কি যেন বলছেন বিড় বিড় করে।
প্লেনটা ছেড়ে দিল ঠিক ৯টা ৪০ মিনিটে। রানওয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে দৌড়াতে লাগলো। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেনের ঘোষণা মত আমরা সবাই সিট বেল্ট কোমরে বেঁধে নিয়েছি। মোবাইল আর ল্যাপটপকে ফ্লাইং মোডে রেখে দেওয়া হয়েছে। উড়ানটা আগের থেকে একটু গতি বাড়িয়ে সবেমাত্র দৌড় লাগিয়েছে।
ওমা ! হঠাৎ করে দেখি উড়ানটা গতি কমাতে কমাতে একবারে থেমে গেল। কি ব্যাপারটা বোঝার জন্যে পাশে বসা ডাঃ মুখার্জীকে জিজ্ঞাসা করলাম। বললেন, ‘দিল্লি এয়ারপোর্ট’ ভীষণ ব্যস্ত। এয়ারপোর্টের মধ্যে দিয়ে যখন তখন এয়ার বাসগুলো ছুটে যায়। হয়তো তেমন কোন এয়ার বাস রানওয়ের সামনে এসে পড়েছে। তাই থেমে গেছে।’
আমরা উৎসুক হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। হঠাৎ করে ক্যাপ্টেনের গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে আসলো মাইক্রোফোনের মাধ্যমে তিনি যা বললেন তা সংক্ষেপে এইরকম : আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। প্লেন ছাড়তে আধঘন্টারও বেশি সময় লাগবে। কেননা প্লেনের একজন যাত্রী হঠাৎ করে খুব নার্ভাস বোধ করছে। প্লেনে ওনার প্যানিক এ্যাটাক হয়েছে। ওনার দম বন্ধ হয়ে আসছে। উনি যেতে চাইছেন না। তাই ওনাকে নামিয়ে দেওয়ার জন্যে এয়ারবাসকে ফোন করা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। আপনারা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করুন ও আমাদের সহযোগিতা করুন।
আমরা সবাই এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছি সেই যাত্রীকে। যিনি অসুস্থ বোধ করছেন। ওমা ! ঠিক একটা তরতাজা যুবক ছেলে আমাদের সিটের বামদিকে এসে ওই ভদ্রমহিলা আর বাচ্চা মেয়েটিকে কি যেন বললেন, তারপর দেখি ওনারা তিনজনে হনহন করে প্লেনের সামনের গেটের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন।
আমি তো হতবাক ! একটা তরতাজা যুবক ছেলে, তার এরকম মনের অবস্থা ! আমি আবার ডাঃ মুখার্জীকে বললাম, দেখি না আমরা একবার চেষ্টা করে। বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করানো যায় কি না। শারীরিক অসুবিধা তো তেমন কিছু নেই, যা হচ্ছে মানসিক সংকট।
ডাঃ মুখার্জী একেবারে হৈ হৈ করে বললেন, ‘কিছু দরকার নেই আমাদের পরিচয় জানানোর। উল্টো কিছু ঘটে গেলে সকলেই দুষবে আমাদের। সে রিস্ক কেন নিতে যাবো আমরা ?
ডাঃ মুখার্জী আমার সিনিয়র দাদা। তাই সিনিয়র যখন বলছেন, চুপ করে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করলাম।
ইতিমধ্যে বাচ্চা মেয়েটার হাত ধরে তার মা ও বাবা সামনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল প্লেনের বাইরে।
ওদিকে প্লেনের ক্যাপ্টেন জানালেন সব যাত্রীকে চুপচাপ বসে থাকতে। সিকিউরিটির লোকজন কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। সব যাত্রীর মালপত্র ও যাত্রীদের বসার আসনসহ পুনরায় চেক করা হবে। অনুগ্রহ করে সকলকে সহযোগিতার আবেদন জানালেন তিনি।
শবরীর প্রতিক্ষায় আমরা সকলে বসে আছি। কখন সিকিউরিটির লোকেরা আসবেন।
হঠাৎ আমার চোখ চলে গেল বাচ্চা মেয়েটা যে আসনে বসে ছিল তার দিকে। আরে ! একটা প্যাকেট পড়ে আছে তো ওই সিটে ! তাড়াতাড়িতে বোধহয় ভুলে ফেলে গেছে।
ডাঃ মুখার্জীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই তিনি উত্তেজিত হয়ে মেঘবালিকাদের একজনকে ডেকে জিনিসটা দেখালেন। প্রশ্নও ছুঁড়ে দিলেন, ‘প্যাকেটায় কোন বোম-টোম নেই তো ?
ডাঃ মুখার্জীর কথা শুনে অন্যান্য যাত্রীরা হুড়মুড়িয়ে এসে সিটের মাঝখানটায় যেখানে প্যাকেটা পড়েছিল সেটা দেখতে লাগলো।
ঠেলাঠেলি, হৈ-চৈ, গুঞ্জনের মাঝে সিকিউরিটির দুজন অফিসার এসে পৌঁছালেন। ওনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই, উনারা গম্ভীর কন্ঠে বললেন, সব যাত্রীদের বলছি, আপনারা দুটো গেট দিয়ে ধীরে ধীরে সবাই বেরিয়ে যান। সিঁড়ি লাগানো আছে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে রানওয়ের বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়ান।’
উনাদের কথা শোনামাত্রই হুড়োহুড়ি ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেল। প্রতিযোগিতা শুরু হল কে আগে বাইরে বেরিয়ে যাবে ? সবার মনে বোমাতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ভাবটা এই যেন পালাতে পারলেই যেন বেঁচে যাবে। ঠেলাঠেলির ধাক্কায় দুএকজন তো হুমড়ি খেয়ে মেঝেয় গড়িয়ে পড়লো। তবুও প্রাণের মায়ায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল।
আমরা যে একটু বিচলিত হই নি তা নয়। তবুও কেমন যেন একটা কৌতূহল রয়ে গেল মনের মধ্যে। ওরকম একটা মারাত্মক জিনিস নিয়ে বাচ্চাটা কি করে বসেছিল ?
শেষ পর্যন্ত আমি আর ডাঃ মুখার্জী সিঁড়ি দিয়ে নেমে রানওয়ের মাঝখানে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে স্নিপার ডগ সহ বোম স্কোয়াডের লোকজন চলে এসেছে প্লেনের কাছাকাছি। স্নিপার ডগের ঘ্রাণশক্তি অতি প্রখর। গন্ধ শুঁকে জানিয়ে দিতে পারে প্যাকেটের মধ্যে বোমা রাখা আছে কি না। সেভাবে ওদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হয়।
স্নিপার ডগ নিয়ে দুজন অফিসার প্লেনের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। সবাই উৎকন্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছি। কি হয় কি হয়। সত্যি কি প্যাকেটাটায় বোমা আছে ?
বেশ কিছুক্ষণ বাদে অফিসার দুজন স্নিপার ডগটাকে সঙ্গে করে নিয়ে হাতে প্যাকেট সহ বেরিয়ে এলেন। প্যাকেটের কাগজটা খোলা। বোধহয় উনারা খুলে দেখেছিলেন প্যাকেটায় কি আছে যখন স্নিপার ডগ তাদেরকে নিশ্চিন্ত করেছেন।
হেসে বললেন, ‘যান আপনারা প্লেনে উঠে পড়ুন। ভয়ের কোন কারণ নেই। আপনাদের মালপত্র আমরা সব চেক করে নিয়েছি। খারাপ কিছু পাই নি। আপনারা নিশ্চিন্তে ট্রাভেল করুন।’
কৌতূহল হয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম অফিসার, ‘প্যাকেটে কি ছিল ?’
একটু মুচকি হেসে বললেন, এই দেখুন, বলে প্যাকেটের কাগজটা সরিয়ে দেখালেন, একটা বড় ধরনের ডল পুতুল সেটা বাচ্চা মেয়েটার বড় আদরের ধন। ভুল করে তাড়াহুড়োয় ফেলে গেছে।
ডল পুতুল থেকে বোমাতঙ্ক ! আমার হাসি পেয়ে গেল। এমনই ভীতু আমরা সকলে ! একটু ধীর স্থির হয়ে চিন্তাভাবনা করার মত মুরোদ নেই আমাদের। আমরা সবাই বীর পুঙ্গব।
ডাঃ মুখার্জী ততক্ষণে পরিস্থিতিটা বুঝে নিয়ে বললেন, ‘কি করা যাবে ? আজকাল তো এরকম ঘটনা হামেশাই ঘটছে। রাস্তায়, বাসে, কার পার্কিং –এ, হোটেলে তো এ ধরণের ঘটনা ঘটছে আগে। তাই তো আমাদের সকলের ভয় হয়ে গিয়েছিল।’
কথা না বাড়িয়ে সকলে চটপট প্লেনে উঠে পড়লেন। সবাইকে স্বাগত জানিয়ে আমাদের প্লেনটা উড়ে চলল আকাশপানে।
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।