[রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র সিরিজের নবম খন্ডের অন্তর্গত বিচিত্র বিষয়ের চিঠিগুলির (২৬৪ টি) প্রাপক হেমন্তবালা দেবী, কিছু রবীন্দ্র অনুরাগীর পরিচিত হলেও সাধারণ বাঙালি পাঠকের কাছে অপরিচিতই। ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত কবির শেষ জীবনের অধ্যায়ে তিনি পত্রলেখার মাধ্যমে তাঁর স্নেহ সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। বহুবার তাঁদের সাক্ষাৎ হয়েছে। হেমন্তবালা দেবী সম্পর্কে তাই আজও কৌতূহল রয়েছে বিদগ্ধ সমাজে। কবি ও হেমন্তবালার চিঠিপত্র ও সম্পর্ক নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর নিজের সাহিত্য সৃষ্টির বিষয়টি থেকে গেছে আড়ালেই।
হেমন্তবালা দেবীর জন্ম বাংলা ১৩০১ সনের ২৪শে কার্তিক কলকাতায়। পিতা ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। মা অনন্তবালা দেবী। শৈশবে বাড়িতে গৃহ শিক্ষকের কাছে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করে তিনি। শ্বশুরালয়ে নানাধরনের ধর্মমূলক গ্রন্থ পড়ার সু্যোগ পেয়েছিলেন। স্বামী তাঁকে কলকাতা থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘গান’ বইটি উপহার দিয়েছিলেন। মার আদেশে অল্পবয়স থেকেই তিনি ভক্তিমূলক কবিতা লিখতে শুরু করেন। কবিকে লেখা চিঠিতে জানা যায় ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায় হেমন্তবালার কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। শনিবারের চিঠি, গল্প ভারতী ইত্যাদি পত্রিকায় সত্যবাণী দেবী নামে নানা বিষয়ে তিনি লেখালিখি করেন। কবির উৎসাহেই রূপকথা ও গল্প রচনা শুরু। পঞ্চাশের দশকে তাঁর বিভিন্ন ধরনের গল্প প্রকাশিত হতে শুরু হয় গল্পভারতী, উজ্জয়িনী, ঊর্ব্বশী, মহিলা, মহিলামহল ,চতুরঙ্গ ইত্যাদি পত্রিকায়।‘ওঁ জয়দুর্গা’ গল্পটি ১৩৭৪ সালের শারদীয়া সংখ্যা ঊর্ব্বশী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পত্রিকা সম্পাদক ছিলেন রানু ভৌমিক। এই গল্পটি নিজের সংগ্রহ থেকে ‘গল্পের সময়’কে দিয়েছেন হেমন্তবালা দেবীর দৌহিত্রী জয়ন্তী সান্যাল ]
এত বড় একটা কাণ্ড হয়ে যাবে, ভাবতেই পারি নি ছোট কাকা, সুনীল রুমালে চোখ মুছে বলল। বাবাকে জানেন তো – প্রথমে গরীবের ছেলে, সবদিন খেতেও পেতেন না। হঠাৎ মামার মৃত্যুতে নগদ বারো লাখ টাকা, আর বালিগঞ্জের সেই বিরাট বাড়িখানা পেয়ে গেলেন তিনি। তিনি বাড়িখানা পাঁচ লাখ টাকায় বেচে দিয়ে সমস্ত টাকার সোনা কিনে ফেললেন এবং সোনা দিয়ে নারীমূর্তি তৈরি করে তার গায়ে রঙ – বার্ণিশ চড়িয়ে সেটাকে পাথরের মূর্তির মত করে ফেললেন। নারীমূর্তিটিকে স্বপ্নপ্রাপ্ত সিংহবাহিনী জয়দুর্গা প্রতিমা বলে চালিয়ে দিলেন ; শিষ্যরা মন্দির গড়ে দিল। বাবার বিয়ে দিলেন তাঁর পিসীমা। আমরা দুটি ভাইবোন এলাম। এ পর্যন্ত মন্দ দিন যাচ্ছিল না। ইতিমধ্যে দুর্দিন এলো। বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসার জন্যে ধার করতে হল মাড়োয়ারি মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে। বাবা যখন সেযাত্রা উঠে বসলেন, তখন এদিকের আর কিছুই নেই, ওই বাড়িখানি ছাড়া। তার উপর বিপদ, বাড়িতে ডাকাতি হল। বাবা ছিলেন অসামান্য বলশালী মল্লযোদ্ধা। পাশের গ্রামের জমিদারের বড় পালোয়ানকে হারিয়ে দিয়েছিলেন বলে ওদের বড় আক্রোশ ছিল। ডাকাতেরা আমার দিদিকে লুটে নিয়ে গেল। দিদির শোকে মা মারা গেলেন। আমি তখনও ছোট, বছর দশেকের ছেলে। বাবা অসীম ধৈর্য ধরে আমাকে মানুষ করলেন ? আমি কলেজের সবকটা পরীক্ষায় পাশ করে আইন পড়লাম, বাবা আমাকে ল’ পরীক্ষা দিতে দিলেন না। বাড়িতে ডেকে এনে সংসারের কাজে লাগিয়ে দিলেন। সামান্য কিছু ক্ষেতখামার ছিল তখনও। গোশালায় দেড়শোর জায়গায় গরু – বাছুর তখন মাত্র দশটি। যাক্, কোনওরকমে দিন চলতে লাগল। বাবার অন্য কোনও বাতিক ছিল না, কেবল শরীর – চর্চা করতেন একটু, আর জমিদার–বাড়ির (আমাদের গ্রামের জমিদার) দারোয়ানদের কাছে বসে তুলসী রামায়ণ শুনতে ভালবাসতেন। বোধ হয় দিদির কথাই ভাবতেন একটু। ইদানীং বাবার বয়স হয়েছিল। এ পর্যন্ত তাঁর পূজার্চনা বন্ধ হয় নি। প্রতিদিন জয়দুর্গাকে অনাড়ম্বরে পুষ্পাজ্ঞলি দিতেন। কোনও ঘটা করে পূজার্চনা করেন নি কোনোদিন। বলেছেন, আমরা সামান্য মধ্যবিত্ত–ঘরের সন্তান, বাড়িতে মেয়েরা নেই, আমাদের আবার অত পুজোর ঘটা কিসের ? এ পর্যন্ত এইভাবেই চলছিল। আমি গ্রামে থাকতাম, নিজে উপস্থিত থেকে চাষবাস করতাম, গরুগুলোকে দেখতাম, আর আমাদের খাওয়াপড়া সব তারাই যোগাতো।
একটুক্ষণ ভেবে নিয়ে সুনীল বলল, বাবার বয়স হয়েছিল ছেষট্টি বৎসর। কিছুদিন ধরে তাঁকে বড় চিন্তান্বিত দেখতাম। একদিন হঠাৎ আমাকে বললেন, আচ্ছা সুনু, তোর মায়ের কথা তো তোর বেশ মনে আছে, না রে ? আছে তো। মাকে কি কখনও কেউ ভুলতে পারে ? বিশেষতঃ আমার মায়ের মত মাকে। আমার মায়ের রঙটি ছিল ঠিক মাখনের মত ঈষৎ পীতাভ গৌরবর্ণ। মায়ের ঠোঁট দুখানি ঈষৎ গোলাপী, মায়ের হাত–পা কি নরম ছিল, ফুলের মত বললে অত্যুক্তি হয় না। মা আমাকে মারতে পারতেন না কোনোদিন, তাঁর সে শক্তিই ছিল না। হাতে মারতে গেলে হাতে কালশিরে পড়বে, বেত দিয়ে সজোরে মারতে গেলে নিজের হাতেই লাগবে। আর তা কেমন বিসদৃশও দেখাবে, মেয়েমানুষের হাতে বেত ! তার চেয়ে তাল – পাখার ডাঁটি অনেক ভাল। কিন্তু অত কথা বলছি কেন, মায়ের মনটি এমন নরম ছিল যে, গায়ে হাত তোলা দূরের কথা, একটুখানি কড়া কথা পর্যন্ত বলতে পারতেন না। মুখখানি হাসি হাসি ছিল, কোনও কারণে মন খারাপ হলে সেই হাসিটুকু আর দেখতে পেতাম না। মায়ের মুখে হাসি না থাকলেই বোঝা যেত কোনও কারণে তাঁর মনে ব্যথা লেগেছে। আর তাই ছিল আমাদের শান্তি। মায়ের মুখে হাসি না দেখলেই আমরা ভাইবোন অস্থির হয়ে উঠতাম। বাবা বললেন, সুনু, তোর মায়ের কখানা হাত ছিল রে, চারখানা কি ? ঈষৎ সন্দিগ্ধভাবে বাবার মুখের দিকে তাকালাম, বাবার মনের দুঃখে মাথা খারাপ হয় নি তো ? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বাবা বললেন, কি, কথা কচ্ছিস না যে ! দুইখানা ছিল, তাই না ? মায়েদের হাত দুখানা করেই থাকে, সেই হাতে থাকে বরাভয়। তবে আমার মায়ের হাত দশখানা, আটখানা বা চারখানা কেন থাকবে, বল্ দেখি ? হ্যাঁ, চারখানাই বা থাকবে কেন ? এই নিয়ে কাল বাবুদের বাড়ির দ্বারপন্ডিতের সঙ্গে তিন ঘণ্টা ধরে তক্কো করে এলাম। আমার জয়দুর্গা মায়ের হাত দুখানাই থাকবে। বললাম, সে কি বাবা, পুজো করা ঠাকুরের হাত কেটে দেবে নাকি তুমি ?
বাবা বললেন, যা নয়, তা থাকবে কেন ? আর পুজো করা হলেও তার তো প্রাণ – প্রতিষ্ঠা করা হয় নি। তাতে দোষ নেই।
সেই রাত্রে বাবা একলা বাগানের ঘরে রইলেন। পরদিন আমি গিয়ে দেখি, জয়দুর্গা প্রতিমার দুখানি হাত আছে, আর দুখানি নেই। সেই হাতে অস্ত্রের বদলে সদ্য – তোলা টাটকা দুটি পদ্মফুল। রঙবার্নিশ দিয়ে ক্ষতস্থান বেমালুম মেরামত করে দিয়েছেন। তখনও মূর্তিরহস্য বলেন নি খুলে।
দিন সাতেক বাদে বললেন, সুনু, তোর দিদিকে দেখতে যাবি চল।
দিদি ?
বাবা বললেন, গেলেই সব টের পাবি। দিদি তোর বেঁচেই আছে রে, দেখে খুশিই হতে পারবি, চল।
একটা পান্সী নৌকায় চড়ে বাবার সঙ্গে গেলাম ভাগীরথী বেয়ে। মুরশিদাবাদ জেলার এক গ্রামের ঘাটে পান্সী বেঁধে বাবা আমাকে নিয়ে গ্রামের ভিতরে রাত্রে পায়ে হেঁটে চললেন। দিদিকে দেখি নি আজ কত বছর, দেখে চিনতে পারব কি ? যাই হোক, এক বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়লাম। পাকা বাড়ি, একতলা, তিন মহল। বার – বাড়িটাই পাকা, অন্দরমহলে কয়েকখানা চালাঘর, তার দেয়ালটা পাকা বটে। আরও ভিতর দিকে কাঁচাঘর খানকয়েক আছে। একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে মরচেপড়া কব্জা – সমেত কপাট গেল খুলে। হ্যারিকেন হাতে করে একটি সুন্দর মত ছোকরা এল সামনে।
কাকে চান ?
বাবা গম্ভীর ভাবে বললেন, তোমার দাদাকে। সে ভিতরে চলে গেল, পরক্ষণেই ফিরে এসে বলল, দাদা বাড়িতে নেই, দেখা হবে না।
কে বলেছে একথা ? দাদা তোমার সাতদিন হল জ্বরে পড়েছে না ? বলতে বলতেই বাবা হন হন করে ভিতরে চলে গেলেন, আমিও তাঁর পশ্চাদবর্তী হলাম। ভিতর মহলের পাঁচচালা খড়ের ঘরে তক্তপোষে পাতা বিছানায় যে শুয়েছিল, সে তখন উঠে বসেছে। রঙ তার শাদাটে, যেন ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে। বয়স তার বছর পঁয়ত্রিশ হবে। সে বলল, মিথ্যে কষ্ট করে এসেছেন আপনি। সুরমা এখানে নেই।
সে কোথায় ? বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
আকাশের দিকে আঙুল তুলে সে বলল, ওখানে। আমার বাবা, পাহাড়ের মত ধৈর্যশীল বাবা, তন্মুহূর্তেই বাঘের মত লাফিয়ে পড়ে তার টুঁটি টিপে ধরলেন। বুঝি আর সামলাতে পারেন নি নিজেকে। একবার মাত্র আঃ বলেই সে নেতিয়ে পড়ল। ঘরের ভিতরের বারান্দায় ধানের ডোলটা অসম্ভব নড়ে উঠছে। তার ভিতর থেকে ময়লা লালপেড়ে শাড়িপরা একটি শীর্ণ নারীমুর্তি ছিটকে এসে পড়ল বাবার পায়ের উপর। ও বাবা, একি করলে ! বাবা, গো ! জামাইবাবুর জ্ঞান ফিরে এসেছে বুঝি ! কাতরাতে কাতরাতে বলল। সুরমা, একটু জল। দিদি কুঁজো থেকে একটা কাঁচের গেলাসে করে জল আনতেই ওর দেওর ছুটে এসে বলল, ঠান্ডাজল দিও না বউদি, চা এনে দিচ্ছি। ইতিমধ্যে আমার বাবাও অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তারপর, তারপর আর বিশেষ কিছু নয়। বাবাও বাঁচেন নি, জামাইবাবুও না। দিদির পেটে একটা বাচ্চা আছে। মৃত্যুর আগে বাবার জ্ঞান ফিরেছিল, জয়দুর্গার কথা সেই তখন জানতে পারলাম। ওই সোনার হাত দুখানি ঘুষ দিয়ে বাবা দিদির সন্ধান পেয়েছিলেন। দিদিকে পাছে নিয়ে যান, এই ভয়ে ধানের ডোলের ভিতরে লুকিয়ে রেখে দিদি বেঁচে নেই এই মিথ্যে কথাই বলতে চেয়েছিলেন জামাইবাবু।
তোমাদের জয়দুর্গা এখন কোথায় ?
সেইজন্যই তো চিঠি লিখে আপনাকে এখানে আনলাম। ওর একটা বিলি ব্যবস্থা করে দিন। আমাদের কিছু ঋণ হয়ে গেছে। দিদির দেওরকেও নিয়ে এসেছি, আবার দিদির একটি ননদ আছে, এবারে সুনীল মুখ নীচু করল।
অতি গোপনে, পুলিশ বাঁচিয়ে, চোর ডাকাত বাঁচিয়ে, সেই সোনার জয়দুর্গা আমি তিব্বতে চালান করে দিলাম। সে আর এক কাহিনী।
Tags: ওঁ জয়দুর্গা, হেমন্তবালা দেবী
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।