এল. এ এয়ারপোর্টের ফ্লোরিস্ট সিলভিয়া মিষ্টি হেসে অভ্যাসবশত জিজ্ঞেস করল, “হলুদ গোলাপ তো”?
উত্তর না দিয়ে গোলাপের তোড়া টা নিয়ে দাম মিটিয়ে অ্যারাইভ্যাল এর দিকে এগিয়ে চলে মুরশেদ।
আগমনের অপেক্ষারত মানুষদের দাঁড়াবার জায়গাটার মুখেই যে ক্যাফে টা সেখানকার ছোকরা কর্মচারি মেক্সিকান মারিও হিস্পানিক টোনে বলল
“তুদে ফ্লাইত অন রাইত তাইম?”
হ্যাঁ, না বা হতেও পারে এরকম একটা মুখের ভঙ্গি করে রোজকার মত ‘ল্যাটে’ টা নিয়ে রেলিং এর ধার ঘেঁষে দাঁড়ায় মুরশেদ।
সারি সারি মানুষের ভিড়। প্রিয়জনের আসার অপেক্ষায়। অনেকেই তার মত ফুলের তোড়া বা বাচ্চাদের জন্য ওয়েলকাম লেখা বেলুন হাতে।
একদম পেছনের সারিতে কোট প্যান্ট পরা হিল্টন, শেরাটন বা ম্যারিয়টের লোক, নামলেখা প্ল্যাকার্ড হাতে অচেনা অতিথির অপেক্ষায়। সেখানে পেশাদারী গাম্ভীর্য আছে, প্রিয়জন দের দেখতে পাবার আকুতি নেই।
এই এয়ারপোর্টের আগমনী টার্মিনালে একটা ঢালু টানেল এর মত জায়গায় বাঁক ঘুরলে যাত্রীরা অপেক্ষারত লোকদের দেখতে পায়, অল্পবয়সীরা খানিকটা দৌড়ে তাদের বাবা-মার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। টিনেজার রাও দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বন্ধুবান্ধব দের। লাতিনো দের উষ্ণতা বেশী তাই দীর্ঘ আলিঙ্গন পর্ব ও কুশল বিনিময় চলে তাদের।
অদ্ভুত জায়গা এই এয়ারপোর্ট। সব ধর্মের, সব ভাষার লোক দেখা যায়। তবে উচ্ছাসের মাত্রা কম বেশি হলেও ঘরে ফেরার ও প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হবার খুশি টা কোথাও যেন সকলকে মিলিয়ে দেয়।
একটা হংকং এর ফ্লাইট নামল। সারি সারি মোংগলীয় মুখের আনাগোনা। একটা ৭/৮ বছরের ফুটফুটে বাচ্চা মার হাত ছাড়িয়ে ও লাগেজ কে পেছনে ফেলে অনেকটা দৌড়ে এসে অপেক্ষমান বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
মুরশেদ মনে মনে এই দৌড়ে আসার জায়গাটার নাম দিয়েছে ‘রানওয়ে’। ঠিক যেন বিমান এর উড়ানের আগের দৌড়।
মুরশেদ মোবাইলে বাচ্চাটার দৌড়ে আসার ভিডিও তুলে রাখল। এর পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা আরেকটি বিমানের লোক সমাগম। অনেক ভারতীয় ও কিছু ককেশীয় যাত্রী সেখানে মিডল-ইস্ট বাসী দের সঙ্গে। আবার সেই পরিচিত দৃশ্য, হাসিমুখ, হাতনাড়া ও রানওয়ে তে দৌড়ে কোলে টেকঅফ। আরও কিছু ক্লিক করল মুরশেদ।
সপ্তাহে তিনবার এই সময় এই এয়ারপোর্ট দিয়ে যাওয়া পাইলট ইভান্স আজ থমকে দাঁড়াল। গত কয়েকদিন ধরে লোকটাকে দেখছে। একটা অস্বস্তি, সন্দেহ মনে খচখচ করছিল। আজ সে নিশ্চিত লোকটা গোলমেলে। প্রতিদিন অ্যারাইভ্যাল এর সামনে দাঁড়িয়ে অন্যদের ছবি তোলে, নিশ্চয় কোনও মতলব আছে। ইসলামি পোশাক ও দাড়ি আশংকাটাকে আরো দৃঢ় করছে। আজ তাই আর কোনও রিস্ক না নিয়ে সিকিউরিটি অফিসার হেন্ড্রিক্স কে জানায় ইভান্স।
মুরশেদ দাঁড়িয়ে, পেছনে চারজন সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মী কে নিয়ে নিঃশব্দে অপেক্ষায় হেন্ড্রিক্স। আরও দুটো ফ্লাইট এর লোক চলে যাবার পর ঘুরে দাঁড়াতেই মুরশেদকে ঘিরে ফেলে অফিসার হেন্ড্রিক্স ও তার সঙ্গীরা। পিছমোড়া করে মাটিতে শুইয়ে দেয়, তন্নতন্ন করে সারাদেহে তল্লাশি শুরু হয়ে যায়, ছিটকে পড়ে পদপিষ্ট হয় হলুদ গোলাপের তোড়া। কোনও প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিষণ্ণ মুখে তাকিয়ে থাকে মুরশেদ। ইতিমধ্যে এয়ারপোর্টে যাত্রী দের মধ্যে আতংকের সঞ্চার হয়েছে। নানা উড়ো খবর রটতে থাকে। হইচই শুনে ছুটে আসে সিলভিয়া আর মারিও, মুরশেদ কে দেখে ভিড় ঠেলে সামনে আসে তারা।
সিলভিয়া চিৎকার করে প্রায় কান্নার স্বরে বলে,”অফিসার কি করছেন এ লোকটার সঙ্গে ? প্লিজ ছেড়ে দিন ওকে!”
হেন্ড্রিক্স একটু অবাক হয়ে বলে,”চেনেন নাকি একে? হি ইজ এ টেররিস্ট সাসপেক্ট! গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে অ্যারাইভ্যাল টার্মিনালে আসে, ছবি তোলে, কিন্তু কখনও কোনও যাত্রী কে এর সংগে বেরোতে দেখা যায় নি।”
মারিও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে অন্য দিকে চোখ সরিয়ে নেয়। ধরা গলায় সিলভিয়া বলে,”হিসেবে একটু ভুল হল, অফিসার! এক সপ্তাহ নয় গত তিন মাস ধরে ও আসছে। তিন মাস আগে একদিন যখন সত্যি সত্যি ওর স্ত্রী আর ৪ বছরের মেয়েটার আসার কথা ছিল, ঠিক আজকের মতই হলুদ গোলাপের তোড়া হাতে এইখান এ অপেক্ষা করছিল ও।সেই রাতে এমিরেটসের ফ্লাইট টা ক্র্যাশ করে! তবে ও এখনও প্রতীক্ষায়। কোনওদিন হয়তো অলৌকিক ভাবে ওই টানেল দিয়ে ওর পরিবার হেসে হাত নাড়তে নাড়তে আসবে, আর মার হাত ছাড়িয়ে ওর বাচ্চা মেয়েটা অনেকটা দৌড়ে এসে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে।”
মুরশেদ হাঁটু গেড়ে উঠে বসে কি যেন বলে বিড়বিড় করে,এই প্রথম তার গলা শোনা যায়
“লস এঞ্জেলস…আই লস্ট মাই এঞ্জেল হিয়ার”
অফিসার হেন্ড্রিক্স অন্যদিকে ঘুরে চোখের থেকে কাল্পনিক ধুলো পরিষ্কার করে।
Tags: হিল্লোল ভট্টাচার্য
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।