শুরু ও শেষ দুইই কাম্য – প্রকৃত অর্থে শিল্পে এ দুই বোধের সমঞ্জসতা কাম্য। কমলকুমার মজুমদারের গল্প – ধরা যাক ‘খেলার বিচার’ – আরম্ভে আছে ‘মাধবায় নমঃ তারা ব্রম্ভময়ী মাগো, জয় রামকৃষ্ণ ! ঠাকুর করুন, যাহাতে আমরা অতীব গ্রাম্য – আমাদের নিজস্ব জীবনের ঘটনা সরলভাবে লিখিয়া ব্যক্ত করিতে পারি…।’ রামকৃষ্ণ যেমন রূপক বলতেন এবং গল্পে সমগ্র চৈতন্য ভেসে উঠত, তাতে আলোকিত হ’ত অজ্ঞান অন্ধকার দিকটুকু ; তেমনই কমলকুমার গল্পে বিভাসিত করতে চেয়েছিলেন প্রকৃত অনুধাবনের চৈতন্যকে। রামকৃষ্ণের চূর্ণকে তত্ত্বব্যাখ্যার প্রাণপ্রতিমা মূর্ত হয়েছে, কমলকুমারের গল্পে তা স্মরণীয় অর্থবোধক হয়ে উঠতে চেয়েছে। অনায়াস দক্ষতাতে জীবনলীলার হৃদয়মধ্যে এক একটি সংজ্ঞাকে তিনি ছুঁয়ে যাবেন এই ছিল কমলকুমার মজুমদারের গল্পসৃষ্টির অনুপ্রেরণা। সরলভাবেও তিনি বলতে চেয়েছেন, কিন্তু যেহেতু তিনি সমগ্রের পিয়াসী ছিলেন তাই তাঁর গল্পে যেন অ্যাবস্ট্রাক্ট দূরূহের চলাচল তিনি প্রাচুর্যে ও নিয়মে পরিণত করেছেন। রামকৃষ্ণ স্মরণও এই সমগ্র ব্যঞ্জনা লাভের দিশা পেতে বুঝি। জড় ও চৈতন্যের অস্তিত্ব ও প্রাণেও চৈতন্যের অস্তিত্ব যে আছে তা তাঁর গল্প পটে বিশিষ্ট রূপে অঙ্কিত হয়েছে। গল্প যেহেতু পুরোনো কথা, সে কারণে গল্পে সেই জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্ঘন্ট থাকবে। তাঁর গল্পে বিশ্লেষণ পল্লবিত, চিত্র সুসমগ্র ও চরিত্র সৃজন ব্যক্তিক অলক্ষ্য স্পন্দনের এক এক পরিমণ্ডল।
গল্পের ভাঁজে ভাঁজে জটিল জীবনীপ্রত্যয়ের হাজার স্তর। মানব মনের পরিশীলিত অপরিশীলিত আবেগ প্রকাশকে সহজে ধরে রাখতে চান লেখক। যেহেতু নিসর্গের সঙ্গে মানুষের চির আবেগ অনুভূতির ভাবময় বন্ধন সেহেতু তাঁর অধীত ও অভীপ্সিত বিষয়ে নিসর্গের চিত্রকল্প প্রচুর এসেছে –
১. ‘হোগলার চালের একটুখানি কেটে জানলা হয়েছে, সেই অবকাশ দিয়ে দেখা যায় শর্ব্বরীময় শূন্যতা। প্রকাশ হয়ে পড়েছে মেঘব্যথিত তিমির – লজ্জিত তারাভরা খানিক আকাশ। শ্রবণের সাথে অনন্ত গানের ধ্বনি মনে এলো অনন্ত চেতনা !’ (মধু)
২. ‘অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়, কৃষ্ণ হিম, নিঃসন্দেহে বলা যায় ঝিল্লির মুখরিত বনরাজি আবেষ্টন করিয়া আছে, চিমনীর লহর করা শিরস্ত্রাণ, প্রসাদের শীর্ষ ত্রিভুজে জড়োয়া নক্সা, মাঝে মাঝে কপোতের ঝটিতি উড়ে চলা, নীলিম ধোঁয়ার ঊর্ধ্বগতি রেখা, আর অসংখ্য রাস্তা যাহাতে প্রতীকের কোন মেয়েলী দুঃস্বপ্ন নাই, এপাশে গম্ভীর মন্দিরের চূড়া, অন্যদিকে প্রার্থনা স্থাপত্যে রূপান্তরিত, মসজিদ। কোথাও গঙ্গা – স্নানার্থী, কোথাও ব্যস্ত মানুষ, লাঞ্ছিত কুকুর, ফেরিওয়ালা সকল কিছু মিলিয়ে স্বামী যে শয্যায় শয়ন করেন তাহাই যেমন মহিলাগনের সুখদায়িনী তেমনি এক পরম রমণীয় অধৈর্য বিছানায় মায়া সৃষ্টি করিয়াছে।’ (রুক্মিণীকুমার)
জীবনযাপন সুসহ নয় – বাহুল্য হ’লেও একথা আমাদের প্রায়ই বলতে হয় ; কমলকুমারের ভাষায় … ‘যে মানুষ, বহু সভ্যতাকে আপন রক্ত দিয়া পচাইয়াছে, সে অস্থির, তাহার চেতনা নিশ্চল…’
কমলকুমার মজুমদারের ভাষা আলাদা অথচ অনিন্দ্যসুন্দর। কমলকুমার মজুমদারের দর্শন কঠিন অথচ তা সংবেদনশীল করে ; তাঁর গল্পের পরিণতি বা প্রতীতি ভয়াবহ ব্যর্থতাদীর্ণ সত্তার তাও তাঁর গল্পের প্রত্যয় দৃঢ় ভিত্তিতে স্থাপিত অপরাজেয় থাকে। আশানিরাশার স্নায়ুযুদ্ধের পর পাঠককে ভারাতুর করে অথচ প্রচুর চিন্তার রসদ রেখে যায়। কমলকুমার পছন্দ করেন কোন একটি বিষয়ের সমস্ত সারভার অক্ষুন্ন রেখে পরিবেশন করতে। কখনও গল্পের প্রত্যয়ভার নিয়ে পাঠক অ্যাটলাসের মত প্রস্তুরীভূত হ’য়ে যান। বেদনাকাতর হয়ে প্রতিক্রিয়ায় খন্ডখন্ড হ’তে চাইলেও তা তিনি পারেন না, কেননা লেখকের বৈদদ্ধ্য তথা মননশীলতা পাঠকের মননের প্রান্তে প্রান্তে দীপ্তির স্পন্দন তোলে। অপ্রমেয় শব্দভান্ডার অর্থের লক্ষ্যভেদে সমর্থ হওয়ার ভাষার তথাকথিত নিয়মের সঙ্গে এই লেখককে আপোষ করতে হয়নি। বহু আঞ্চলিক শব্দ ঔপভাষিক ধরনও তাঁর দ্বারা প্রযুক্ত হয়ে বিলসিত হতে পেরেছে।
‘জল’ গল্প শেষ হয় এই বাক্যে –
‘ফজল হয় ভাল লোক, কেননা খোদা তার উপর দয়া রাখেন।’
‘তেইশ’ গল্পের উপসংহারটা এরকম –
‘আলমের দেখতে চেষ্টা, দুচোখেই তার বাঁ চোখ হেয়েছে, বাঁ চোখ ছিল এতাবৎ অন্ধকার। বললে, ‘দেখতে পারছি না –
… ‘টীউবওয়েলের শব্দ আসে, এটা কি টুনটুনী ? বাবুরা হয় সজ্জন।…
…দেখ বউ – এবার ভিক্কে মিলবে রে আমি রাখ ডুমনীর ওষুদ খেয়েছি –
‘জমি গেছে তাতে কি – খাবার আর ভাবনা নেই – ভিক্কে পাব রে আমার উপর সবার দয়া হবে রে -’
‘এখনও তার গলায় লাঙলের শশস্বর, গলার আওয়াজে আওয়াজে।
বউ খুশী হয়েছিল।’
– শরৎচন্দ্রের গফুর পথে এসে দাঁড়িয়েছিল, কমলকুমারের কৃষক চরিত্র আলম অন্ধ ভিক্ষুক হয়ে খাবার ভাবনা দূর করেছিল। জল গল্পের ফজল বারো বছর বয়সেও মায়ের বুকের দুধ খেত, সে মাকে কদিনের অভুক্ত অবস্থায় তারই আনা সন্দেশ খেতে দেখে আর সইতে পারল না। দুর্বল ফজল ফতিমাকে চড় মেরে বসল। পরিবারের জন্য ভাবনা করেছে সারাক্ষণ। শুধু ফতিমার আহত স্বর গুঞ্জিত হয় – ‘বাপজে বাপজে আমায় মারলি, তুই আমায় মারলি।’ ফতিমা তারপর আত্মহত্যার পথই বেছে নেয়। ফজলের ডাকাতির গুরু নন্দ মায়ের গায়ের কাঁথাখানা হাতে করে এনে বলে – ‘কাঁথাখান আমি নে এস্চি, তোর মা নয় মরেছে কাঁথাখান তো শুগনো…’ লেখক কিন্তু ফজলের অন্যায় অপরাধ বোধের অন্য সাক্ষ্যই দিলেন, মাকে সন্দেশ খেতে দেখে সে জ্বলে ঝলসে উঠে।’ নিরুপায় ফজল নন্দর হাতেই ‘বুন’টাকেও দিতে চেয়েছিল। সমস্ত অসহায়তার রোষ আঘাত হয়ে উঠল। কমলকুমার ফজলকে উপস্থিত করতে সমর্থ হয়েছেন। সে ফজল সমগ্র ফজল। লেখক লিখছেন –
‘প্রচন্ড অব্যর্থ ভয়ঙ্কর সে চড় একপ্রকার।
চড়ের শব্দ সশব্দে তদ্দণ্ডে সে চমকে উঠে স্থির।’ (জল)
অবিচার বোধ লেখক পরে রচনা করেন আর এক ধ্রুবপদ এবং তাকে সংভুক্ত করেন গল্পের মধ্যে ‘ফজল অবিচার হয় ভাল লোক, কেননা খোদা তার উপর দয়া রাখেন।’সত্যিই প্রমাণিত হয় ‘কথা ইসারা বটে’ যা ভগবান রামকৃষ্ণ বলিয়াছেন’
অনেকেই কমলকুমার মজুমদারের লেখায় অন্তর্বিরোধ দেখেছেন ; নরেশ গুহ দেখেছেন ‘তাঁর স্বাভাবিক দুরূহতা।’ তাঁর কমলকুমারের ওপর বিশ্লেষণ কিন্তু স্পষ্ট, প্রাঞ্জল এবং গ্রহণযোগ্য। “…কমলকুমার মজুমদার আমার কাছে অন্তত একজন অপরিমাণ শক্তিশালী শিল্পী যাঁর রচনার প্রধাণ গুণ বিষয় নির্বাচনে নয়, বিষয় অবলম্বনে গড়ে তোলা রচনার কারিগরিতে। সেই কারিগরি না থাকলে অভিসন্ধি ব্যর্থ হতো, মানুষের দুঃখ নামক একটা নিরাকার ভার কান্নাচাপা পরিহাসের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে এসে আমাদের বুকের মধ্যে প্রবেশ করতে এবং চলাফেরা করতে পারতো না, সমাজবব্ধ মানুষের প্রতিকারযোগ্য দুর্দশার চাইতে গভীরতর কোন নিঃসঙ্গ হাহাকারের প্রতিমূর্তি তিনি খোদাই করতে পারতেন না তাঁর গল্পে কাহিনীতে।’ (নানা দৃষ্টিতে কমলকুমার মজুমদার, সম্পা. অর্ঘকুসুম দত্তগুপ্ত)
নানা স্তরবিশিষ্ট একটি সার্থক ছোটগল্প ‘তাহাদের কথা’। তিনি বিষয় গ্রহণেও আলাদা ছিলেন। অভিনব একটি বিষয়ের গল্প ‘তাহাদের কথা’, ‘লাল জুতো’, ‘খেলার বিচার’ প্রভৃতি। ‘তাহাদের কথা’ গল্পের বিষয় আমাদের আকাঙ্খার প্রকৃতি নিয়ে। গল্পটি যেন বহুভূজের মতো। শৃঙ্খল ও আমরা অর্থাৎ শিবনাথ, হেমাঙ্গিনী, জ্যোতি, অন্নপূর্ণারা। দুঃখের গ্রন্থিবব্ধ রূপ ফুটে উঠেছে এই গল্পে। চিত্র অসামান্য, যেখানে জ্যোতি ও অন্নপূর্ণা এই ভাইবোনকে স্থাপন করা হয়েছে। উন্মাদ পিতার প্রতি জ্যোতির ভীষণ মমতাবোধের প্রকাশ রয়েছে। সেই জ্যোতি শেষাবধি সরল সবুজ। লেখক বলেছেনঃ ‘আতা গাছটির পাশেই জ্যোতি দাঁড়িয়েছিল। এখন পড়ন্ত বেলা, পাতা ছিঁড়ে বিকালের আলোর ছিনিমিনি তার মুখমণ্ডলে, অধিকন্তু পাতার সবুজতা।’ জ্যোতির কোমরের প্যান্টালুন থাকছে না, তাও শিবনাথের হেনস্থা দেখে ‘জ্যোতির দেহে ছুটে যাবার ব্যগ্রতা, অদ্ভূত, ঈষৎ বাঁকা।’ শিবনাথ মাস্টারি করতেন। স্বদেশপ্রেমিক শিবনাথ ব্রিটিশের কারাতেও শৃঙ্খলিত থাকতে পারতেন, বাড়িতেই যেন সেই শৃঙ্খল তিনি অঙ্গে বরণ করলেন। দারিদ্যের সীমা নেই, তাই অন্নপূর্ণাকে কাজ করতে যেতে হয়। মা হেমাঙ্গিনী অন্নপূর্ণার প্রথম মাইনের টাকা দিয়ে কেনে শিবনাথের ‘আগড় লিগড়’। তা দিয়ে বাঁধা হয় গায়ক শিবনাথকে। ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল জ্যোতি, তার হাত উঠল মা – দিদির ওপর। শেষে শিবনাথের উত্তর – “জ্যোতি, মারিস নি”, বলে লৌহের শৈত্য আপনকার গালে অনুভব করত বলেছিল, ‘খুব ঠান্ডা রে খুব ঠান্ডা।’ একথাও মনে হয় যে গল্পটিতে ‘ভববন্ধন’ বিষয়কে অঙ্গুলিনির্দেশ করতে চাওয়া হয়েছে। আবার এও মনে হতে পারে যে গল্পটির বিষয়, ‘অভিমান, আবার এও বলা যায় যে আমাদের ‘অন্তিম অবধি মায়িক বন্ধনই আমাদের বেঁধে রাখে – একথাই এই গল্পে আছে। বাঁধনের ব্যথা শিবনাথের কন্ঠে গান হয়েছে – ‘এমন ধনী কে শহরে আমরা পাখী রাখলে ধরে – মিছে হিয়ার দিলে যন্ত্রণা।’ বহু লাঞ্ছনার কেন্দ্রে গানটি গীত হয়। বিষয়ের ব্যঞ্জনা বৃদ্ধি করেন দক্ষ গল্পকার।
এখানে দেখা যায় ধনী দয়ার দৃশ্যও। প্রতি দৃশ্যই তাহাদের কথার সাপেক্ষে উপস্থাপিত করা হয়েছে। আত্মারামবাবু মাড়োয়ারি – তিনি ব্রত উদ্যাপন করেছেন পাখি মুক্ত করে। দৃশ্যটি ব্যঞ্জনাকে পরিপূর্ণ করেছে –
‘আত্মারামবাবু এখানে উপস্থিত ঠিক কাঁটার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন, মুখে তাঁর অনর্গল শ্লোকধারা। তাঁর পায়ের কাছে বেনারসী পাখমারা। ছেঁড়া জুতোর মত মুখটা সকল সময়ই আড়াল করে, এটা তাদের মুদ্রাদোষ। এখন সে আঁঠরা লতার ঢাউস ঝুড়িটার মধ্যে হাত দিয়ে উঁ উঁ শব্দ করে কিছু নিশ্চয়ই খুঁজছিল। সহসা বলে উঠল, ‘আকাশ পাবি গো ; ডর কিরে, আর জন্মে আমায় আকাশ দিবিস্ গো পরান।’ এবং অত্যন্ত দক্ষতা সহকারে একটি পাখি বার করে আনল। একটি নীল স্পন্দন। মনের কিছুভাগ, বনের কিছুভাগ দিয়ে গড়া নীলকন্ঠ পাখি……।’ …নীলকন্ঠ এদিক সেদিক করেই বিমানচারী হয়ে গেল’ – সে সময় বলতে লোভ হয় গল্পের ইঙ্গিত ‘মুক্তি বা স্বাধীনতা’র দিকে।
কমলকুমার মজুমদার নিজে ছবি আঁকতেন, গান ও উডকাটও করতেন, সমালোচক ছিলেন ক্রিয়েটিভ আর্টের। তাঁর সমঝদারির জন্য তিনি এমন রিয়ালিস্ট ছিলেন, যে তাঁর গল্পের সমালোচনা প্রায় অসম্ভব। মন্ত্রের মত করে এক একটি লাইন লেখা, কোথাও শৈথিল্য নেই। তিনি রিয়ালিস্ট সর্বপ্রথম ও সবশেষে। প্রথমে তিনি রিয়ালিটির বিশ্লেষক। স্বতন্ত্র বা বিশিষ্টতার এটি অন্যতম কারণ। ‘বাবু’ গল্পে বাবুর চাবুকে রাখহরি কেমনভাবে জড়বৎ হয়ে যায়, কিংবা ‘চাবকে ঠিক করে দেওয়া যে কি’ – তা বাবু গল্পে কমলকুমার দেখিয়েছেন। ‘প্রেম’ গল্পে অনীতাকে চিঠি লেখার পরে ডেপুটি গৃহে প্রেমার্থী সতীশের নিগ্রহে অবশ্যম্ভাবী করে তোলেন বাস্তবের জ্ঞাতা লেখক। ‘প্রিনসেস্’ গল্পেও অসার্থক প্রেমের বাস্তবোচিত শ্লেষ দিয়ে পরিণতি টানা হলঃ-
“রাজকন্যা চোখে রুমাল দিয়ে রাজসিক কায়দায় – শালুর উপর দিয়ে
চলে গেল সেলুনের দিকে।
মন যখন সব … তখন নাইবা বলো ওদের – মিলন।’ (প্রিন্সেস্)
‘ক্রিয়েশন’ তথা ‘সৃজন’ বিষয়টির মূর্তি গল্পগুলি। তা সত্ত্বেও তার মধ্যে অনিবার্য ঘটনার টান – গতি। কাহিনীর টানে গল্পের চলা বোঝা যায় ‘লুপ্ত পূজাবিধি’, ‘মল্লিকাবাহার’, ‘নিম অন্নপূর্ণা’, ‘আমোদ বোষ্টুমি’ প্রভৃতি গল্প শেষ হলে। ‘লুপ্ত পূজাবিধি’ গল্পে মৃত শিশুর প্রতীক পুতুল এবং শিশুর শৈশবকে অবহেলা করার চালচিত্র সামগ্রিক লেখা হয়েছে। অনুভূতিশুন্য শিক্ষায় বিভূতিভূষনের ‘রাণু’ই শুধু ভাবায় না – আজও ভাবায় কমলকুমার মজুমদারের ‘পুতুল হাতে শিশু’ কিংবা আরও কয়েকটি সংকটাপন্ন শিশু কিশোর তরুণ চরিত্র। ‘আমোদ বোস্টুমি’তে প্রেমের বলি হ’ল কিশোর গোরা। ‘বাগান কেয়ারি’ গল্পে সামাজিক নির্বিকার অবস্থা কতখানি অপ্রকৃতিস্থতা তা লেখক বলেছেন –
‘এক বিশাল শিল্প নগরীর গোড়া লাগিতেছে।
‘এখানে একটিতে মরিয়াছে।
‘এই তুমুল অতিকায়, দারুণ ক্ষিপ্র কর্মপদ্ধতির মধ্যে
ঐ দেহখানি পড়িয়া আছে…
‘ঐ বেচারার মরদেহ পত্তনটির একান্তে পড়িয়াছিল …
যাহার প্রতি ছটাক জমিতে কর্ম্মকুশলতা গোঁয়ার।
‘ঐ সাড়হীন দেহের পাশ দিয়া লৌহশিকল দ্রুতবেগে চলিয়াছে।’
বিশ শতকের যন্ত্রায়ণে পিষ্ট মানুষ পড়ে থাকছে। তিনি অসহায়তা ও অচৈত্যকে বহু সময় পরিস্ফুট করেছেন, তাই বিশ্লেষণ করেছেন পার্থিব বিশ্বকেও সময় অনুরূপ করে। রামকৃষ্ণের কথা, উজ্জীবক- উনিশ শতাব্দীর মানবতা, এসব তিনি স্মরণ করেও কালের ক্ষণস্থায়ী উজ্জীবনকে নিভে যেতে দেখেছেন ও দেখিয়েছেন।
সত্যজিৎ রায় বলেছেন, ‘তাঁর পরিবেশকে তিনি যেমন তীক্ষ্ণ অনুভূতির সঙ্গে দেখতেন, তেমনি দেখতেন কোন শিল্পবস্তুকেও।’ (নানা দৃষ্টিতে কমলকুমার মজুমদারঃ সম্পা, অর্ঘ্যকুসুম দত্তগুপ্ত) – একই সঙ্গে তীক্ষ্ণতা ও ইন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষগত বিস্তার কমলকুমারের লক্ষ্য ছিল। লেখার মধ্যে চিত্র ও সঙ্গীত ছিল না শ্রুতিমধুর আবৃত্তিও যেন ছিল। উদাহরণ অনেক পাওয়া যাবেঃ-
১. ‘অনেক দূরে দুটি লালচে আলো, মধুর ঠুংঠাং শব্দ, অদ্ভূত লয়ে পড়ছে, এই সঙ্গে ঘট ঘড়ঘড়র্ মৃদু আওয়াজ ক্রমান্বয় অক্ষর হয়ে উঠছে।’ (কয়েদখানা)
২.. ‘…একটির পর একটি দৃশ্যকাব্যের সঙ্গে সংঘাত হল। ওপাশে মেহেগনির উপর, চালাক্ষীর (চেলজি) পুতুল নৃত্যরত; কখন বা ফরাসী ঘড়িসেবনায়, – দারুণ ষাঁড়ের উপর আলুলায়িত বসনে মেয়েটি সময় ধরে বসে। তালদার বাতিদানের রূপার দন্তে ফুলকারী করা। কভু বা ভিনিসীয় কাঁচের পাত্রের আয়তলোচনা মাতৃমূর্ত্তিতে। অথবা এবার ঊর্ধ্বে।’ (কয়েদখানা)
এককথায় বহু গুণান্বিত রচনা। চিত্রগুণ তার নিশ্চয়তায় আকৃষ্ট করে – বৈচিত্র্যেও। দয়াময়ী মজুমদার বলেছেন যে, ‘এককথাই বলতে হয় যে তার সাহিত্য এবং শিল্প (আঁকা) যেন একে অপরের পরিপূরক ছিল, অর্থাৎ স্পষ্টও এই দুটিই ছিল যে কমলকুমারের একই ধ্যানের দ্বিবিধ মূর্তি। তাই তাঁর গল্পে ফুটে উঠতো চিত্রধর্মী সৌন্দর্য, যাকে বলা হয় Pictorial effect। তাছাড়া তাঁর আঁকায় থাকে গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং অতি সূক্ষ্ম রেখার পূর্ণাঙ্গ দক্ষতা (perfection skill)। সব মিলিয়ে লেখার অনুষঙ্গে আঁকার প্রতিক্রিয়া যেন অনিবার্যই ছিল।
(অগ্রন্থিত কমলকুমার)
কয়েদখানা গল্পে হুজুর শাজাদের যে ঘোড়াকে মেরে ফেললেন তার বর্ণনায় ছবি ও আয়রনি দুই বোঝা যায় –
‘যেহেতু সন্ধ্যা হয়; আকাশ অনন্ত হয়েছে, টিলাগুলি সোনা হলুদ ; ঊর্ধ্বে বাদুড়ের টানা স্রোত, এখন পথভোলা পাখীর ডানা লাট খায় এবং গঙ্গাচিল বিন্দু হতে বিশাল প্রতীয়মান। ঘোড়াটি এখনও নির্লিপ্ত হয়েই ঘুরে ফিরে, জলে তার নিকট কালছায়া। এমতকালে, দূরে ডুকরে উঠা টিলার সোনা হলুদ ভেদ করে ক্রমে কে একজন বেঁকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
শাজাদ প্রতিশোধ নিল। হেঁতেলের বাড়িতে হুজুর মোহনগোপালকে হত্যা করল – সেই বর্ণনাটিও স্মরণযোগ্য –
‘ফার্ণ গাছে যে রক্ত লেগেছিল তা টুপ টুপ করে পড়তে লাগল। হাতের ছাপ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল।”
কথিত, শ্রুত, পঠিত হয়ে কমলকুমার মজুমদার সঠিক অভিঘাতের জন্ম দিতে চেয়েছেন। লেখক স্বয়ং বলেছেন – ‘গল্প অর্থই পুরাতন পৃথিবী ; বিশ্বাস, সম্পর্ক বুকে টানা। ঐ বৃত্তিতে আমরা কোনজনকে আসিতে দেখি, যদি তিলতম মুহূর্তের জন্যই, আমরা খুশী, আবার বিচার করি ইহা কি আমাদের মনগড়া; যেহেতু লেখকের মনে, অনেক গভীরেই ভক্তি ভালবাসা ইত্যাদি পরীর মতন আছে।’ পুরাতন পৃথিবীকে আধুনিকের করে তুলতে হয় গল্পকারকে। গভীরতা যেমন প্রয়োজন তেমনই প্রয়োজন দ্বিধা থাকলে তার সম্পূর্ণ রূপায়ণ। কোন সময় সে জন্য বক্রতাও আসে কাহিনীতে। চমক আসে পরিণতিতে যেমন ‘খেলার বিচার’ গল্পে। ‘মল্লিকাবাহার’ গল্পে যে লেসবিয়ান ভাবনা তাতে মানবরস মিলেছে। মতিলাল পাদরীও ধর্মের মোড়কে মানবীয় ভালবাসাকে দেখতে চেয়ে দেখতে পায়নি, পরে সংশয় দূর হয়েছে তাঁর। মনে হয়েছে, প্রথমত তিনি মানবসন্তান, মানবজীবনরসই তিনি অঞ্জলি ভরে পান করেছেন, ভামরের শিশুপুত্রকে তিনি কোলে তুলে নিয়েছেন। তাঁর ধর্মানুরক্তি মানব জীবন সত্য দিয়েই গ্রহণ করতে তিনি প্রস্তুত হয়েছেন। ‘জাসটিস’ গল্পের বাঙালি জজ গৌরদাসবাবু তাঁর কেশহীন মাথা উইগে ঢেকে রাখেন। আদিম নারীদেহ দর্শনের লোলুপতাও লোকের অলক্ষ্যে মেটান। ‘আদিম সম্পর্কে’ তিনি রমণী দেহ দর্শনের কামনা সম্পর্কে নিশ্চয় হন। অথচ তাঁর ‘সামাজিক সম্পর্কে’র স্ত্রী নন্দরানী তখন তাঁর পাশে বসে। ফরাসী সাহিত্যের পাঠক কমলকুমার যে মননে কতটা নাগরিক তা বোঝা যায় এই গল্পের শেষে। লেখক যে দিনলিপিতে বলেছেন – ‘Hypocrisy শব্দটা স্তাঁদাল বড় চতুরভাবে ব্যবহার করেন।’ – জাসটিস গল্পের উপসংহার তাই এইরকম পর্যবেক্ষণলব্ধ সজীব – “মিঃ জাসটিস দেখলেন … তাঁর উইগ পরা মাথাটায় ‘লম্পট’ কথাটাই টিক মারছে। তিনি শুধু গম্ভীরভাবে বললেন হঁ…..।’ (জাসটিস)
যেমন বিশ্লেষণের বক্রতায় পাঠক মনন তৃপ্ত হয়, ঠিক সেইরকম মানুষটিকে বুঝে অনুভব করানোর জন্য লেখকের আকর জীবনপ্রীতি ও উপলব্ধ করা যায়। একদিন হঠাৎ এই গভীর পুরোনো কথার জগতে প্রবেশাধিকার দেওয়া যাবে না তা লেখক জানতেন; আর জানতেন বলেই তিনি সমগ্রত এই পারাবারে পেঁছে দিতে ছোট ছোট বিন্দু এক এক করে ঢেলে দিয়ে গিয়েছেন। লেখকের বিশ্লেষণ অথচ স্তাঁদালীয় নয় বলে তিনি মনে করেছেন। উপলব্ধিগত হওয়াই গল্পের আদিবস্তু।
‘… এক ভদ্রলোক ও এক মহিলা ট্রেনের যাত্রী – দেখা গেল দুজনের গন্তব্যস্থল এক – এবং একই কাজে যাইতেছেন – অর্থাৎ রোগী দেখিতে। ভদ্রলোকের স্ত্রী এবং মহিলার স্বামী যথাক্রমে পাগল – যাত্রীদের মধ্যে এমন ঘনিষ্ঠতা হইল যে তাহারা স্থির করিল কোন সমুদ্রতীরে যাইবে। এখানে আসিয়া বিশেষত মহিলা নিয়ত স্বামীর খোঁজ লন – ধীরে দুজনে পরামর্শ করিয়া নিজ নিজ স্বামী স্ত্রীকে পাগলা গারদ হইতে লইয়া আসিলেন এবং কোথাও স্বস্তি না পাইয়া অবশেষে একদা ভদ্রলোক মহিলার অনুমতিক্রমে সেই সমুদ্রতীরে পাগল ও পাগলিনীকে মারিলেন। কিন্তু তাহাদের দেহ যতবার সমুদ্রে ভাসাইয়া দেওয়া হয় ততবারই ফিরিয়া আসে। এইভাবে অনেকানেক গল্প।’
কিন্তু লেখক বলেন – ‘ঘটনা প্রবাহকে আমি লেখার উপজীব্য বলিয়া ধরি না, তাই অনেক ঘটনা পরিশোধিত হইয়াও আমার নিকট রহিয়া গিয়াছে যথা… – “আমি ঠিক এনালিটিক কিউবিজমের পক্ষপাতী, এখানে টেনশনে রেখা সকল যতক্ষণ না সৃষ্টি (অনেকটা timbre –এর মত অথচ এইগুলিকে অনেকে image বলেন) এতক্ষণ গল্প হয় নাই বলিয়া আমার ধারণা, আমি আদতে ইয়েরোগ্লিফিক লেখক নই। লেখার বস্তুত্বের অনুভব হয়।’ … (পরিপ্রেক্ষিতঃ অগ্রন্থিত কমলকুমার)
তবু আমরা আগ্রন্থিত কমলকুমার থেকে ‘দেওয়ান-ই খাসের ঘুম’ রচনার মধ্যে দেখি গল্পের মোচড়। তাতে বক্রতা ও বৈদগ্ধ্য নজরে পড়ে এজন্য গল্পের মধ্যের একটি প্রতীতি বা ইম্প্রেশানও লক্ষিত হয়। ব্যঙের শীতঘুমে স্বপ্ন যে সে সমুদ্রে যাবে। যে যায় – ‘নীল জলোচ্ছ্বাসের সামনে ট্যুরিস্টের তাঁর ক্যামেরা, টেলিস্কোপ, ছাতা, অকসিজেন, তামাক নিয়ে উপনীত হয়। ব্যাঙের ক্রিয়াতেই গল্পের গল্পত্ব – ব্যাঙ খুব খুশী সে মহা অানন্দে দুয়েকটি ঝিনুক কুড়াইয়াছিল, সমুদ্রের কিঞ্চিৎ বারি লইয়া মস্তকে দিয়া বলিয়াছিল নারায়ণ নারায়ণ।” (দেওয়ান – ই – খাসের ঘুম)
লেখকের অভিহিত গল্পগুলি কিন্তু বহুস্তর সমাকীর্ণ, বহুধা বিস্তৃত, বিচিত্র, গভীর ও সমগ্র। রামকিঙ্কর বেইজের চিত্রসম্পর্কিত মতবাদ কমলকুমারের ক্ষেত্রে খুব সম্ভব প্রযুক্ত হবেঃ
“ডাইমেনশন মানেই হচ্ছে সামনে যেটা দেখছি তার পিছনটাও যে আছে, সেই পিছন দিকের ফিলিংটা ফোটানো। কিউবিজম ব্যাপারটারও মূল এখানেই নয় কি ? কিউবিক ছবিতে দেখবেন দু – রকমভাবে মুখ আঁকা। এটা অবশ্য আধুনিকালের সৃষ্টি। এটা কিউবিজমের শুধু নয়, চিরকালের কথা। অজান্তেও দেখবেন আয়নাতে চুল আঁচড়াচ্ছে মেয়েরা। তিনটে ফিগার। তার পা – টা উল্টে দিয়েছে, তলায় পা দেখা যাচ্ছে। তা এটা তো সেকালের জিনিস। আজকাল করলে বলা হত খুব মডার্ণ হয়েছে, কিউবিক হয়েছে। সবদিকের দেখাটাকে একসঙ্গে ধরে রাখাটাই কৃতিত্ব। এতে টোটাল এফেক্ট কিন্তু অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়ে যায়।”
তন্বী মুখোপাধ্যায় পেশায় অধ্যাপক। পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক।
Tags: কমলকুমার, তন্বী মুখোপাধ্যায়
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।