[বিশিষ্ট চলচিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ ১৯৯৫ সালে ‘গল্পের সময়’ পরিবারের অন্যতম সদস্য দেবাশিস মজুমদারের সঙ্গে দীপাবলির এক দ্বিপ্রাহরিক আড্ডায় নিজের বেড়ে ওঠা নিয়ে এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন অধুনালুপ্ত একটি বহুল প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্রের জন্য। কিন্তু তৎকালীন সাংবাদিক দেবাশিসবাবু পেশাগত কারণে অন্য পত্রিকাগোষ্ঠীতে যোগদান করায় অপ্রকাশিত অবস্থায় পড়ে ছিল সাক্ষাৎকারটি। ‘গল্পের সময়’ সেই দীর্ঘ আলাপচারিতাটির কিছুটা অংশ জীবনের গল্পের আকারে পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হল । পরবর্তীকালে বাকি অংশ প্রকাশ করা হবে।]
ছেলেবেলার দিনগুলো
ছেলেবেলার কথা বলতে গেলে অনেক স্মৃতি ভিড় করে আসে। আমার বাবা – মা এসেছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকে। শৈশবের কথা যেটুকু মনে পড়ে তাতে আমরা প্রথমে থাকতাম গ্রে – ষ্ট্রিটে। পরে ভবানীপুরে চলে আসি। খুব কাছেই ছিল মামার বাড়ি। ফলে মামাতো, পিসতুতো ভাইবোন মিলে আমাদের একটি বিরাট দল ছিল। খেলাধূলা, গানবাজনা, নাটক সব একসঙ্গে করতাম। আমার বেশ পরিষ্কার মনে আছে প্রতি মাসে আমরা একটা করে নাটক করতাম, আর পরিবারের লোকেরা সবাই মিলে সেগুলো দেখত। আর একটি বিষয় ছিল যা আমাকে খুব টানত, তা হল- ম্যাজিক শো। সে সময় ভীষণ জনপ্রিয় বিষয় ছিল ম্যাজিক। আর তখন ম্যাজিক সংক্রান্ত প্রচুর বইপত্র পাওয়া যেত। পি.সি. সরকারের লেখা, এ.সি. সরকারের লেখা। আমরা এই সব ম্যাজিকের বই দেখে আমরা ম্যাজিক শিখতাম। পরে বাড়ীর সবাইকে দেখানো হত। আর খেলাধূলার ব্যাপারে তো একটা হৈ হৈ ব্যাপার ছিল। এত লোকজন। ক্রিকেট, ফুটবল, হকি এ তিনটে তো একেবারে বাঁধা ব্যাপার। খেলতেই হবে এরকম একটা ব্যাপার ছিল। এছাড়াও একটা ভয়ঙ্কর খেলা সেসময় খেলতাম। চোর – চোর। পাঁচিলে পাঁচিলে লাফিয়ে খেলতে হত। পাঁচিল থেকে নেমে গেলেই আউট হয়ে যেত। সেসময় ভাবানীপুরে দুটো দল ছিল। প্লেয়ার্স কর্ণার এবং বালক সংঘ। যেখানে প্রায় দুবেলাই খেলাধূলো করতাম। আসলে এই খেলাধূলা, গানবাজনা, ম্যাজিক শো এসব নিয়েই মেতে থাকতাম। কারণ তখন তো টিভি, ভিডিও এসমস্ত আসেনি। ফলে একটা কল্পনার জগতে আমরা সবসময় বিচরণ করতাম। যেমন কোন গল্প বা উপন্যাস পড়লে সেগুলোর মধ্যে নিজেরা ঢুকে যেতাম। চরিত্রগুলোর সঙ্গে তুলনা করা এসবগুলো ছিলই। আর আমার মামা আমাকে একটা ব্রাউনি কোডাক ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন ছবি তুলি না তুলি সেই ক্যামেরার ব্লু ফাইন্ডার দিয়ে পৃথিবীকে দেখার একটা সুযোগ হয়ে গিয়েছিল। হয়ত ছবি তুলতাম না কিন্তু ফ্রেমের মধ্যে দিয়ে দাদুর হাত পা দেখতাম কিংবা জানলা দিয়ে বাইরের গাছপালা দেখতাম। আসলে ফ্রেম সম্পর্কে একটা দুর্বলতা সে সময়ই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ছেলেবেলায় আমার কাছে সবথেকে আশ্চর্যজনক খেলনা ছিল এটি। আর ম্যাজিকের মধ্যে যে ইলিউশান রয়েছে সেটাও আমাকে খুব ভাবাত। এখন মনে হয় এগুলোই আমাকে পরবর্তীকালে ছবির জগতে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। আর আমাদের বাড়িতে এবং মামার বাড়িতে গানবাজনার একটা চর্চা সে সময় ছিল। বহু মানুষ গান গাইতে আসতেন। আমরা বুঝি না বুঝি দল বেঁধে বসে গান শুনতাম। সেসময় মাঝে মাঝে আমরা বড়দের সঙ্গে দলবেঁধে স্ট্রান্ডের ধারে বেড়াতে যেতাম। তখন তো পঞ্চাশের শেষ দিক। ঔপনিবেশিক প্রভাব কিছুটা ছিলই। আমার বেশ পরিষ্কার মনে আছে তখনকার কলকাতায় এত বেশি যানজট হয়নি। বেশ পরিচ্ছন্ন কলকাতা। আর আউট্রামের উপর একটা বড় রেস্টুরেন্ট ছিল। আর সেখানে ব্যান্ডস্ট্যান্ডে ব্যান্ড বাজত। সেই সব বিকেল গুলো ভীষণ আনন্দে কাটত। আসলে সব মিলিয়ে ছেলেবেলাটা ভীষণ আনন্দে কেটেছে।
রবীন্দ্রনাথ ছিল অবশ্যপাঠ্য
সে সময় ‘সন্দেশ’ পত্রিকা পুনঃপ্রকাশিত হতে শুরু করে। আমার মামা আমাকে সন্দেশের গ্রাহক করে দিলেন। এছাড়া বাবার কাছ থেকে প্রচুর অ্যাডভেঞ্চার গল্পের বই উপহার পেতাম। ইংরেজি এবং বাংলা দুই ভাষাতেই এগুলো পড়তাম। যেমন বেশ মনে আছে বাবার দেওয়া ট্রেজার আয়ারল্যান্ড পড়ে আমি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। জুল ভার্নের ও আমি খুব ভক্ত ছিলাম। ওঁনার লেখা প্রায় সব গল্প উপন্যাসই আমি সেসময় পড়েছি। আর ‘শুকতারা’ পড়তাম। ভীষণ ভাল লাগত। ‘দেব সাহিত্য কুটীর’ সেসময় প্রচুর শিশুদের জন্য ক্লাসিক উপন্যাস বের করত। সেগুলো একেবারে গোগ্রাসে শেষ করে ফেলতাম। তবে সব সময় শিশু বা কিশোর সাহিত্যই বেশি পড়েছি। আরও একটু বড় হয়ে রবীন্দ্রনাথ পড়েছি। কারণ রবীন্দ্রনাথ পড়া আমাদের বাড়ীতে প্রায় অবশ্যপাঠ্য বিষয় ছিল। আরও বড় হয়ে অবশ্য অন্যান্য সাহিত্যিকদের লেখা বই পড়া শুরু করি।
ছবি দেখা/ প্রথম দেখা ছায়াছবি
আমার দেখা প্রথম বাংলা ছায়াছবি ‘ভক্ত ধ্রুব’। খুব ছেলেবেলায় দেখাছিলাম পূর্ণ সিনেমা হলে। তবে ছবিটা পুরোটা দেখতে পারিনি। বাঘ সিংহ দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে কান্নাকাটি করেছিলাম। আমার বেশ পরিষ্কার মনে আছে আমাকে হলের বাইরে নিয়ে আসা হয়েছিল। আর একটা ছবির কথা মনে আছে দ্য এলিফ্যান্ট বয়স্। কোডাক তৈরি করেছিল ছবিটা। এছাড়া ‘থিফ অব বাগদাদ’ এর কথাও খুব মনে আছে। আর সেই সময় টার্জান সিরিজের প্রচুর ছবি দেখেছি। কারণ সে সময় এই সিরিজের বহু ছবি আসত। তবে আজকালকার ছেলেদের মত এত ছবি দেখার সুযোগ ছিল না। কারণ সে সময় ছবি দেখার ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি ছিল আর টিভি, ভিডিওর প্রবেশ ঘটেনি। বাবা খুব বেশি সিনেমা দেখতেন না। বাছাই করে ভাল ছবি দেখতেন। তবে মামাদের সিনেমা দেখার খুব ঝোঁক ছিল। তখন গ্লোব, মেট্রো বা এলিটে বাচ্চাদের ছবি মাঝে মাঝে দেখানো হত মর্নিং শোতে। সেই সব ছবি দল বেঁধে দেখতে যেতাম। আর গ্লোব সিনেমা হলও এত আধুনিক হয়নি (অধুনা অবলুপ্ত)। তখন গ্লোব ছিল পুরোনো অপেরা হাউসের মত। বড় বড় সব খিলান ছিল। আসলে সিনেমা দেখতে যাওয়ার সেই সব দিনগুলো ছিল ভারি মজার। আর আমারাও অপেক্ষা করে থাকতাম কবে ভাল ছবি আসবে ? তবে এই সমস্ত শিশু চলচিত্র যখন দেখতাম তখন আমার বয়স সাত – আট। আরও একটু বড় হওয়ার পর একদিন বাবা-মা আমাকে ‘পথের পাঁচালী’ দেখাতে নিয়ে গেলেন। হয়ত ভেবেছিলেন গ্রাম বাংলা সম্বন্ধে একটা ধারনা জন্মাবে। কারণ আমি তো ছোটবেলা থেকেই শহরে মানুষ। আর গ্রাম দেখার অভিজ্ঞতা বলতে পশ্চিমে বেড়াতে যাওয়ার পথে ট্রেন থেকে গ্রামবাংলাকে দেখা। কারণ তখনকার দিনে হাজারিবাগ অঞ্চলে বেড়াতে যাওয়া কলকাতার লোকেদের কাছে প্রায় নেশার মত ছিল। আমিও সে সময় হাজারিবাগে মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতাম। কারণ আমার দাদুর একটা বাড়ি ছিল সেখানে। এছাড়া ওদিকে মধুপুর গিরিডি ওই সমস্ত জায়গাতেও ঘুরে বেড়িয়েছি। আর শান্তিনিকেতনেও মাঝে মাঝে গিয়েছি। কারণ আমার মা শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিলেন একসময়। এই হচ্ছে আমার ট্রেন থেকে গ্রাম দেখার অভিজ্ঞতা কিন্তু, পথের পাঁচালী ছবিতে একেবারে পরিপূর্ণ গ্রামকে উপভোগ করার সুযোগ পেলাম। আর এখনও বেশ মনে আছে অপুর ট্রেন দেখতে যাওয়া, অপু দুর্গার দুষ্টুমি আমার মনে ভীষণ আলোড়ন তুলেছিল। ওই সময়কার একটা ঘটনার কথা খুব মনে পড়ে। দুর্গার মৃত্যুর পর আমি খুব কান্নাকাটি করেছিলাম হলে বসে। আসলে পথের পাঁচালী গ্রাম বাংলায় ঘুরে বেড়াবার একটা নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল আমাদের।
ছবি তৈরির ভাবনা
ছবি তৈরির ভাবনা আসে অনেক পরে। আসলে ছবির থেকে সে সময় আমাকে আকর্ষন করতে শুরু করে থিয়েটার। ছেলেবেলায় যেহেতু অভিনয় করতাম সেইহেতু থিয়েটারের দিকে ঝোঁকটা ছিলই। আর ১৯৬২ সালের শেষের দিকে আমরা কালিগঞ্জের কাছে চলে আসি। সেই সময় পাড়ার ছেলেরা মিলে একটা দল করলাম এবং নাটক করাও শুরু হল। প্রথমে করলাম ‘মুকুট’ তারপর ‘মুক্ত ধারা’। সেই সময় নাটক লেখার শখ হয়। ষোল বছর বয়সে একটা নাটক লিখেছিলাম। নাটকটার নাম ছিল ‘কাহিনী’ আর আমাদের দলের নাম ছিল ‘অজানা’। নিজেদের লেখা নাটক নিয়েই অভিনয় হত প্রতি বছর দুর্গা পুজোর সময়। এছাড়া দুর্গাবাড়িতে নাটক হত। সে সব নাটকেও অভিনয় করেছি বহুবার। আসলে নিজেদের লেখা নাটক নিয়ে অভিনয় করা, পরিচালনা, পরে তা নিয়ে আলোচনা সব মিলিয়ে একটা হৈ হৈ ব্যাপার। এর পরবর্তীকালে ‘ঋত্বিক নাট্য গোষ্ঠী’ বলে গড়চা পাড়ায় এক বিখ্যাত নাট্য গোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসি। এদের রিহার্সাল রুমটা একটা ঐতিহাসিক বাড়ি। নিবেদিতা দাস, অভিনেতা অজয় দাসের বাড়ি। আর এক সময় আই. পি. টি এর বিখ্যাত সব লেখকরাও এই ঘরকে রিহার্সাল রুম হিসাবে ব্যবহার করেছেন। তখনও জ্ঞানেশদা (মুখোপাধ্যায়), সলিলদা (চৌধুরি) আসা যাওয়া করতেন। আসলে এই পরিবেশটা আমাদের সে সময় খুব প্রভাবিত করেছিল। কারণ এই সমস্ত বিখ্যাত নাট্যকার সঙ্গীতজ্ঞরা সেই সময় নাটক নিয়ে আলোচনা করতেন, নতুন নাটকের সম্ভাবনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করতেন। সেই সময় আমাদের নির্দেশক ছিলেন পৃথ্বীশ ভট্টাচার্য। ইনিই ছিলেন আমার নাট্যজীবনের গুরু। অসম্ভব ভাল শিক্ষক ছিলেন। উনি নিজে শেখর চট্টোপাধ্যায়ের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। পৃথ্বীশ বাবুর কাছেই আমি অভিনয়ের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় শিখেছি। কারণ উনি আমাদের ‘ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ’,‘মাইম’ এর ওপর জোর দেওয়ার কথা বলতেন। পরবর্তীকালে বুঝেছি এর গুরুত্ব কতখানি। যাই হোক ওনার কাছেই নাট্যভিনয় পরিচালনার নানা দিক ভীষণ ভালভাবে শিখেছি। এর পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল একটা বামপন্থী রাজনৈতিক পরিবেশ, যেটা ঐ বাড়িতে ছিল। যার ফলে ওই বয়েসটা ভীষণভাবে বামপন্থী চিন্তাভাবনা চেতনায় আকৃষ্ট করেছিল। আমার সিনেমায়, আমাকে কেন্দ্র করে সে সমস্ত ঘটনা খুব বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল তার মধ্যে এই ঋত্বিক গোষ্ঠীর নাট্য জগৎ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
দেবাশিস মজুমদার – জন্ম, বেড়ে ওঠা শ্রীরামপুরে। সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশা শিক্ষকতা, লেখালিখি। নেশা ভ্রমণ ও নিবিড় সাহিত্যপাঠ। অন্য পরিচয় কবি ও ছোটোগল্পকার।
Tags: গৌতম ঘোষ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।