নাম ছিল রমেশচন্দ্র সেন। কিন্তু লোকে তাকে রমেশ বলে জানত আর রাজ্যসুদ্ধ ছেলেমেয়ে সকলেই তাকে ঐ নামেই ডাকত। ছেলেবেলা মারপিট করে স্কুল থেকে তাড়িত হয়ে জিমন্যাস্টিক আর গুন্ডামি করে বেড়াচ্ছিল, একটু – আধটু ছবি আঁকার দিকে ঝোঁক থাকায় বাড়ির লোকে তাকে আর্টস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলে কিন্তু সেখানেও তার কিছু হল না। লতা–পাতা–ফুল আঁকার ক্লাস থেকেই বিদায় নিয়ে সেই স্কুলেরই এক বন্ধুর বাবার গয়না তৈরীর কারখানায় রমেশ ভর্তি হয়ে গেল সেকরার কাজ শিখতে।
বাঙালীর সমাজ তখনো আজকের মতো উদার হয়নি, তাই রমেশ যখন নিজে সেকরার ব্যবসা খুলে বসল তখন কায়স্থের ছেলের এ কি অধঃপতন হল বলে তার বাপ–মা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন – আত্মীয়–স্বজনদের তো কথাই নেই। এত নিন্দে হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু রমেশের বিয়ে আটকায়নি। বাঙলা দেশে কন্যার দুর্ভিক্ষ কখনো ঘটেনি।
রমেশ ভাল কারিগর, নেশা–পত্তর করে না, তার ওপরে সৎলোক। এতগুলো গুণের সমাবেশ কারিগর মানুষে সেকালে দেখা যেত না, তাই তার কারবার দিনে দিনে খুব ফলাও হয়ে উঠতে লাগল। রমেশ তাদের বাড়িরই বাইরের দিকে খানকয়েক ঘরে দোকান ও কারখানা বসালে, কয়েকটি ভাল কারিগরও রাখলে। দেখতে দেখতে পাড়া ছাপিয়ে তার নাম সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। অন্তঃপুরেও রমেশ সেকরার সুনাম গৃহিণীদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল।
রমেশ সেকরার যখন ব্যবসা খুব জমজমাট, ঠিক সেই সময়ে বোম্বাই শহর থেকে প্লেগ এসে কলকাতায় খুব রঙ জমিয়ে ফেললে। শহরবাসীরা ভয়ে পালা–পালা শুরু করে দিলে – যার যেখানে আশ্রয় আছে সকলে উঠি – কি – পড়ি করে পালাতে লাগল। রমেশদের পাড়ায় একজনের প্লেগ হতেই পরদিনই পাড়া সাফ হয়ে গেল। কিন্তু পালাই – পালাই করেও রমেশ পালাতে পারছিল না। ব্যবসা ও দোকানের একটা ব্যবস্থা না করে কোথাও যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। রাজ্যসুদ্ধ লোকের টাকা নিয়ে বসে আছে সে, তাদের গয়না তৈরী করে না দিয়ে গেলে বদনাম হবে। আর এ ব্যবসায়ে একবার বদনাম হয়ে গেলে সুনাম ফিরিয়ে আনা দুষ্কর। ওদিকে রমেশের অধিকাংশ কারিগরই পলাতক। যা দু’ এক জন তখনো আসা – যাওয়া করছিল, তাদের নিয়ে সে দিনরাত খাটতে আরম্ভ করলে – অন্তত খুব জরুরি অর্ডারগুলো শেষ করবার জন্যে। ইতিমধ্যে তাদের বাড়িতে প্লেগ এসে তার বাপ – মাকে নিয়ে গেল। রমেশ স্থির করলে যে, তার স্ত্রী – ছেলেকে বাড়ি থেকে আগে সরিয়ে তার পরে সেও যাবে। কিন্তু বন্দোবস্ত করতে করতে তার স্ত্রীটিও একমাত্র ছেলে রেখে চলে গেল। ব্যস!দিন পনেরোর মধ্যে রমেশ একেবারে হাত-পা ঝাড়া। তার একমাত্র ছেলে গণপতির বয়স তখন বছর চারেক হবে।
সংসারের সব হারিয়ে রমেশ প্রাণপণে তার ব্যবসাকে আঁকড়ে ধরলে। সকাল–সন্ধে সব সময়ই সে দোকান – ঘরেই কাটায়, অবিশ্যি গণপতিও সঙ্গে থাকে। সেই বয়সেই দিনরাত বয়স্কদের সঙ্গে কাটিয়ে গণপতির হালচাল হয়ে উঠতে লাগল বুড়োদের মতো। আট বছর বয়সে কোনো রকমে অক্ষর পরিচয় শেষ করেই সে তামাক টানতে শুরু করে দিলে।
রমেশ তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলে। প্রথম কিছু দিন উৎসাহের ঝোঁক কেটে যাবার পর সে সেখানে সত্যিকারের গণপতি হয়ে দাঁড়াল – পড়াশুনো যা হাতে লাগল তা না–বলাই ভালো।
ওদিকে রমেশের উদ্যমে তার ব্যবসা বাড়তে লাগল হু হু করে, বাড়ির পর বাড়ি উঠতে লাগল, গাড়ির পর গাড়ি। কিন্তু সিন্দুক ভরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শূন্য অন্তঃপুরের হাহাকার তাকে মাঝে মাঝে উদাস করে যেতে লাগল। থেকে থেকে তার মনে হতে লাগল, এই অর্থ, এই গাড়ি বাড়ি বিভব সবই বৃথা। প্রকৃতি দেবীও আলস্যে বসে ছিলেন না – রমেশের মনের এই অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে ধনীর সুন্দরী কন্যা সুষমাকে তার ক্ষুধিত মনের সামনে টোপ ধরতেই সে গিলে ফেলল।
রমেশ যখন দ্বিতীয় বার বিয়ে করলে, তখন তার প্রথমপক্ষের ছেলে গণপতির বয়স বছর বারো হবে। স্কুলে কুসঙ্গ ও বাড়িতে দোকানের কারিগরদের সঙ্গে মিশে তখন সে নেশার ধূম্রলোকে অনায়াসে বিচরণ করতে শিখেছিল। মাঝে মাঝে বাপের পকেট মেরে ধরা পড়লে রমেশ তাকে বেদম প্রহার দিত বটে, কিন্তু তাকে শায়েস্তা করতে পারত না। ছেলেকে মানুষ করতে হলে যে সতর্কতা, শিক্ষা ও সহিষ্ণুতা দরকার, রমেশের তা ছিল না। যাও–বা ছিল তার সমস্তটাই সে লাগিয়ে রেখেছিল কারবারে – ফলে কারবার উঠতে লাগল, আর গণপতি পড়তে লাগল।
দ্বিতীয় পক্ষে বিয়ে করে রমেশ হাঙ্গামায় পড়ে গেল। স্ত্রী, ব্যবসা ও গণপতি এই তিনকে নিয়ে সে হিমশিম খেতে আরম্ভ করলে। বছরখানেকের মধ্যেই সে বেশ বুঝতে পারলে যে, তিন দিক রক্ষা করবার চেষ্টা করলে কোনো দিকই বাঁচবে না। বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি এ ক্ষেত্রে শাস্ত্রমতে অর্ধেক ত্যাগ করত ; কিন্তু রমেশ শুধু বুদ্ধিমান্ নয় – সে পাকা ব্যবসাদার – সে ভেবে – চিন্তে এ ক্ষেত্রে এক – তৃতীয়াংশ ত্যাগ করেই সামলে নিলে। সে দিনের বেলায় ব্যবসা ও রাত্রে স্ত্রী – চর্চায় মন দিলে – গণপতিকে এক রকম ছেড়েই দিলে।
বাপের আওতা থেকে বেঁচে গিয়ে গণপতির প্রতিভাও খুলে গেল। সে গিয়ে ভর্তি হল পাড়ার জিমন্যাস্টিক ক্লাবে। শাসনমুক্ত অবকাশে তার দেহ হতে লাগল যেমন দশাসই, সেই সঙ্গে তাল রেখে তার প্রকৃতিও হয়ে পড়ল তেমনি দুর্দান্ত। এ–স্কুল ও-স্কুল, এ–পাড়া সে–পাড়া মারামারি খুনোখুনি করে বেড়ানোই হল তার কর্তব্য। ব্যাপার দেখে স্কুলের কর্তৃপক্ষ তাকে মুক্তি দিলেন।
দুর্দান্ত হলেও গণপতি পাড়ার ছোট ছেলেদের ওপর খুব সদয় ছিল। আমরা সবাই তাকে গণাদা বলে ডাকতুম। সে আমাদের প্রায়ই চানাচুর, লজেঞ্জুস প্রভৃতি খাওয়াত আর মাঝে মাঝে বিকেল বেলায় অনেকগুলি ছোট ছেলে নিয়ে বসে নিজের কীর্তি – কাহিনী শোনাত। কোথায় কোন্ পাড়ার কোন্ গুন্ডার সে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে, কাকে ছুরি মেরে ফাঁসিয়ে দিতে হয়েছে ইত্যাদি অনেক কাহিনী শুনতে শুনতে শুধু যে আমাদের রোমাঞ্চ হত তাই নয়, ভবিষ্যতে গণপতি হয়ে ওঠার সম্ভাবনার বীজ আমাদের মনের মধ্যেও রোপিত হয়ে যেত।
কিন্তু গণপতি এই রকম উদ্দাম জীবন বেশি দিন চালাতে পারল না। অচিরেই পিতা রমেশচন্দ্র তাকে কারবারে কাজ শিখতে লাগিয়ে দিলে। সে রমেশ সেকরার ছেলে, কারিগরি তার রক্তে প্রবাহিত হচ্ছে, সে ভালই কাজ করতে লাগল। শুধু তাই নয়, কিছুদিনের মধ্যেই সে বুড়ো ঘাগী কারিগরদের চেয়ে ভাল কাজ করতে লাগল। কেমন করে কি মিশিয়ে কোন্ ফাঁক দিয়ে সোনা গায়েব করা যায়, অথচ খদ্দেরে টের পায় না–কিছুদিনের মধ্যে সে–সব অঙ্কে গণপতি একেবারে পাকা হয়ে উঠল, অথচ স্কুলে মিশ্র – যোগ সে একটাও ঠিক করে করতে পারেনি।
ইতিমধ্যে নেশার ধূম্রলোক থেকে নেমে এসে সে জলপথে বিচরণ করতে শিখলে। দু’ একটি এদিক – ওদিকের সঙ্গে তো আগেই পরিচয় ঘটেছিল – পূর্ব – জীবনের এই কালিমা তার চরিত্র থেকে গেল না। ফলে মধ্যে মধ্যে দোকান থেকে সোনাটা – দানাটা মেরে দোকানেরই অন্য দু’টি অল্পবয়স্ক কারিগরদের সঙ্গে লুকিয়ে ফুর্তিটা–আসটা করে আসত। মাঝে মাঝে রমেশের কাছে ধরাও পড়ে যেত, সে ধমক – ধামক দিয়ে, বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেব – শাসিয়ে ছেড়ে দিত – বুড়ো ছেলেকে এর বেশি আর কে কি করতে পারে ?
সেবার শীতকালে বিয়ের খুব মরশুম পড়েছে, রমেশ সেকরার এক পুরোনো খদ্দেরের বাড়িতে একসঙ্গে দু’-দুটো বিয়ে, তাদের গয়নার সোনা কেনবার জন্য নগদ কিছু টাকাও তারা অগ্রিম দিয়েছিল। টাকাটা রমেশ দোকানের বড় সিন্দুকের মধ্যে তুলে রেখেছিল। দিন দুই পরে বড়বাজারে সোনা কিনতে যাবার সময় রমেশ সিন্দুক খুলে দেখলে যে টাকা উধাও হয়েছে। সে তো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। যা হোক, তখুনি নিজের গাঁট থেকে টাকা বের করে সোনা কিনে নিয়ে এসে রমেশ দোকানের প্রত্যেক লোককে ডেকে বললে –টাকা যদি কেউ নিয়ে থাক তো দিয়ে দায়, নইলে পুলিশে খবর দেব। কিন্তু টাকা নেওয়ার কথা কেউ স্বীকার করলে না। রমেশ বাধ্য হয়ে পুলিশে খবর দিলে।
একদিন সকাল বেলা পাড়ার এক দোকান থেকে মুড়ির চাক্তি কিনে ফিরছি, এমন সময় রমেশ সেকরার বাড়ির সামনে মস্ত ভিড় দেখে দাঁড়িয়ে গেলুম। দেখি, তাদের বাড়ির সামনে একখানা সেকেন্ড ক্লাস ভাড়াটে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির মধ্যে এক পাশে রমেশ সেকরা ও একজন দেশী পুলিশ কন্স্টেবল বসে, আর এক পাশে গণপতি ও তার পাশে একটা লালমুখো সার্জেন্ট বসে। গণপতিদার হাতে হাতকড়া লাগানো। লালমুখো সার্জেন্ট দেখে তো একেবারে শিউরে উঠলুম। কিন্তু গণাদাকে দেখলুম যে বেশ হাসছে, কথাবার্তা বলছে। পাড়ার ছেলে – বুড়ো প্রায় সকলেই জমা হয়েছে সেখানে। সবাই কথা বলছে – কিন্তু কি হয়েছে ঠিক বুঝতে পারলুম না। পাড়ার মুখুজ্জেদের বাড়ির ক্ষেন্তি ঝি ছিল প্রচন্ড মুখরা, সেও সেখানে দাঁড়িয়েছিল। অন্য বাড়ির একজন ঝি ক্ষেন্তিকে দেখে জিজ্ঞাসা করলে – কি হয়েছে ক্ষেন্তি মাসী ?
ক্ষেন্তি বললে–এমন কান্ড কেউ দেখেছে না শুনেছে ! টাকা চুরি করেছে বলে বাপ ছেলেকে ধরে পুলিশে দিলে ! আরে, বাপের টাকা চুরি করেনি এমন সাধু দুনিয়ায় আছে ক’ ব্যাটা ? হয় তাদের বাপ নেই, নয় বাপের টাকা নেই –
ক্ষেন্তি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু গাড়ি থেকে গণাদা তাকে ধমক দিলে–এই ক্ষেন্তি, চুপ কর। ক্ষেন্তি গজ – গজ করতে করতে সেখান থেকে চলে গেল। ভিড়ের মধ্যে পাড়ার অনেক মুরুব্বিও দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা নানা জনে নানাপ্রকার মন্তব্য করতে লাগলেন। কেউ বললেন–রমেশ ঠিক করেছে, এমন না হলে ও–ছেলে সায়েস্তা হয় ?
কেউ বললেন – এতটা না করলেও হত। ও – ছেলে যখন ফিরে আসবে, তখন বাপকে খুন করে ফাঁসি যাবে।
আমরা গুটিকয়েক ছোট ছেলে এক দিকে দাঁড়িয়ে ছিলুম। গণাদাকে ও–রকম পুলিশ – পরিবৃত ও হাতকড়া পরানো অবস্থায় দেখে আমরা খুব স্বস্তি পাচ্ছিলুম না। কারণ গণাদা যাই হোক, আমরা তাকে আমাদেরই একজন বলে মনে করতুম। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি জিজ্ঞাসা করে ফেললুম – গণাদা, কোথায় যাচ্ছ ?
ভিড়ের অনেকেই নিজেদের মধ্যে কথা – বলাবলি কচ্ছিলেন, আমি গণাদাকে ও – কথা জিজ্ঞেস করা মাত্র তাঁদের গুঞ্জন থেমে গেল – গণপতি কি বলে তা শোনবার জন্যে সকলেই উৎকর্ণ হয়ে রইল।
গণাদা আমার কথা শুনে বললে – বোম্বাই যাচ্ছি ভাই, পাস পাওয়া গেল কিনা !
– কবে ফিরবে ?
গণাদা পাশের সার্জেন্টকে দেখিয়ে বললে – ঐ ওরা যদ্দিন না ছাড়ে, এখন বলতে পারছি না। তোরা ভাল করে সব লেখাপড়া করবি। আমি এসে যেন দেখি ডবল প্রোমোশন পেয়েছিস।
গণাদার কথা শুনে ভিড়ের কেউ কেউ হেসে উঠলেন, কেউ চুপ করে রইলেন। আমাদের সামনে দিয়ে তাদের গাড়িখানা চলে গেল।
দুবছর বাদে গণপতি যখন জেল থেকে ফিরে এল – তখন তাকে আর আমরা চিনতে পারি নে। চেহারা তার আরো লম্বা – চওড়া হয়েছে, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। সে জেলে গিয়েছিল না অন্য কোনো স্বাস্থ্যকর জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিল তা বোঝাই দায়। আমাদের মনে হতে লাগল যে, জেল – ফেল ওসব বাজে কথা। নিশ্চয়ই সে বোম্বাই গিয়েছিল। যা হোক, আমরা তো ভয়ে ভয়ে ক’দিন তাকে এড়িয়ে–এড়িয়েই চললুম। শেষকালে একদিন সে নিজেই আমাকে ডেকে জিজ্ঞেসা করলে – কি রে ; কেমন আছিস ?
ভালো আছি। তুমি কেমন আছো গণাদা ?
আরে আমার কথা ছেড়ে দে। দেখছিস না চেহারা, চারটে বাঘে খেতে পারে না। গণপতিদা নিজেই জিজ্ঞাসা করলে – কেমন দেখছিস ? আগের চাইতে চেহারা ঢের ভালো হয়নি ?
বললুম – তুমি কোথায় গিয়েছিলে গণাদা ? বোম্বাই ?
না রে, সে তখন তোকে মিছে কথা বলেছিলুম। আসলে গিয়েছিলুম কোথায় জানিস ? জেলে।
ও বাবা – জেলে ?
হ্যাঁ, বাবার টাকা চুরি করেছিলুম সিন্দুক থেকে। বাবা পুলিশে ধরিয়ে দিলে – দু’বছর জেল খেটে এলুম।
আমাদের সুধাংশু বললে – তোমার বাবা পুলিশে ধরিয়ে দিলে !
গণপতিদা হাসতে হাসতে বললে – তা বাবার দোষ নেই। অতগুলো টাকা নষ্ট হয়ে গেলে কোনো বাবারই মাথার ঠিক থাকে না। চুরি করলেই জেল খাটতে হবে, খবরদার – চুরি করিস না যেন।
এর পর থেকে প্রায় রোজই বিকেলে আমাদের সভা বসতে লাগল। সভার বক্তা হত গণাদা আর বক্তৃতার বিষয় ছিল জেলের মাহাত্ম্য – বর্ণনা।
গণাদা বলত – জেল হচ্ছে ফার্স্টক্লাস জায়গা। আমি তো দু বছর ছিলুম কিন্তু আমি বাজি রেখে বলতে পারি যে দু মাস সেখানে থাকলে মানুষের শরীর ভালো হয়ে যায়। কেন যে লোকে শরীর সারাবার জন্যে পয়সা খরচ করে বিদেশে যায় তা বলতে পারিনে ; একটা কিছু করে জেলের মধ্যে গিয়ে ঢুকলেই হয়।
আমরা শুনে বলতুম – তোমাকে কি করতে হত গণাদা ?
গণপতি উৎসাহী হয়ে বলত – কি করতে হত শুনবি ? সেখানে সব ঘড়ি ধরে কাজকর্ম, সময়ের একটু এদিক্ – ওদিক্ হবার যো নেই। ভোর পাঁচটার সময় চাকর এসে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে চলে যায়, মুখ – টুখ ধুয়ে আধ ঘণ্টাটাক ব্যায়াম করে ছটার মধ্যে সকালের জলখাবার খেয়ে নিতে হয়। তার পরে যার যে রকম শক্তি ও ইচ্ছা সে সেই রকম কাজে লেগে যায়। আমি বাগানের কাজ করতে ভালবাসতুম। নিজের হাতে কপি তৈরী করে সেই টাটকা কপির তরকারি খাও – নিজের ক্ষেতের সরষে নিজের হাতে ভেঙে তেল করে নাও – বাবা – ভেজালের কারবার পাবে না সেখানে। মাঝে মাঝে একজন মাস্টার এসে আমাদের ক’জনকে ইংরেজি পড়াত। পাঁচ বছর ইস্কুলে যা শিখেছি, দু’বছর জেলে তাই শিখেছি। এগারোটার মধ্যে কাজ বন্ধ করে দিতে হবে, তার পরে স্নান করে খেয়ে সেই বেলা তিনটে অবধি বিশ্রাম। এই সময়টা তুমি ঘুমোতেও পার, শুধু শুয়ে থাকতেও পার। তার পর পাঁচটা অবধি কাজ করে ছুটি – এর বেশি কাজ করতে চাইলেও তোমাকে দেওয়া হবে না। সন্ধে বেলা খাইয়ে – দাইয়েই বাতি নিবিয়ে দেওয়া হয় – না ঘুমোলে পাছে শরীর খারাপ হয় সেদিকে ওদের কড়া দৃষ্টি। সপ্তাহে তিন দিন মাছ, একদিন মাংস।
একদিন বললুম – কিন্তু জেলে গেলে বড় নিন্দে হয়।
গণপতি মুখে চকচক আওয়াজ করে বললে – আরে সেদিন আর নেই। এখন জেলে যাওয়া একটা ইজ্জতের ব্যাপার হয়েছে। কত লোক জেল থেকে বেরিয়ে এসে ভালো ভালো চাকরি পেয়ে যায় তার ঠিকানা নেই। সেখানে কত লোক দেখেছি শুধু চাকরি পাবার জন্য জেলে এসেছে।
কিন্তু গণপতি নিজে জেলে যাওয়ার জন্য কোনো ইজ্জতই পেলে না, না বাড়িতে – না বাইরে। রমেশের দ্বিতীয় পক্ষ চেঁচামেচি করে স্বামীকে জানিয়ে দিলেন যে, ও – ছেলে বাড়ির মধ্যে এলে তিনি বাপের বাড়ি চলে যাবেন। ফলে গণপতি কারখানারই একটি কোণে ঠাঁই করে নিলে, দোকানের কয়েকজন কারিগর ওদের বাড়িতেই খেত, তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল – গণপতিরও তাদের সঙ্গে খাওয়ার ব্যবস্থা হল। সুষমা তার নিজের ছেলে পশুপতিকে গণপতির ত্রিসীমানার মধ্যে যেতে বারণ করে দিলে।
কিন্তু রমেশ গণপতিকে একেবারে ত্যাগ করতে পারলে না, হাজার হোক ছেলে তো ! সে তাকে আস্তে আস্তে আবার দোকানের কাজে লাগাতে আরম্ভ করলে। এবার কিন্তু গণপতি আর ভুল করলে না। সে মন দিয়ে কাজ শিখে কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতার একজন শ্রেষ্ঠ কারিগর বলে নাম করে ফেললে। তা’ছাড়া জেলে গিয়ে গণপতি লেখাপড়া ও কিছু অঙ্ক শিখেছিল, হিসেবেও সে একজন পাকা লোক হয়ে উঠল।
কয়েক বছর যেতে না যেতেই গণপতি দোকানের একেবারে ভোল ফিরিয়ে দিলে। সে তাদের ব্যবসার নামকরণ করলে রমেশ এন্ড কোং, জুয়েলার্স। চৌরঙ্গী ও পার্ক স্ট্রীটের সেকরাদের মতো ঘর ভেঙে বড় করে বড় বড় কাচের জানালা – দরজা বসালে। দোকানের দরজায় বন্দুকধারী গুর্খা দারোয়ান বসাল। মাসিক ও দৈনিকে রমেশ এন্ড কোম্পানির গয়নার বিজ্ঞাপন বেরুতে লাগল, – হৈ হৈ করে কারবার চলতে আরম্ভ করল।
রমেশ সেকরাকে এখন সকলে সমীহ করে রমেশবাবু বলে। রমেশ গণপতির বিয়ের সম্বন্ধ করতে লাগল। একদিন সে খেতে বসেছে, এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে তার সৎমার তীব্র কন্ঠস্বর তার কানে এসে লাগল। রমেশ বোধহয় গণপতির বিয়ের সম্বন্ধে সুষমার সঙ্গে কথাবার্তা বলছিল। সুষমা বলছিল – ঐ জেলফেরতকে কোন্ ভদ্রলোক মেয়ে দেবে ! তোমার মতো আদিখ্যেতা তো সবার নেই ? সেই দিনই গণপতি তার বাবাকে বলে দিলে যেন সে তার বিয়ের চেষ্টা না করে, সে বিয়ে করবে না। রমেশ কোনো কথা না বলে গুম হয়ে গেল।
পুত্রবধূর মুখ দেখবার জন্য রমেশকে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। বছর খানেক পরেই তার দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে পশুপতি আই–এ পাস করায় সুষমা নিজে ব্যবস্থা করে ধনীর কন্যা অণিমাকে পুত্রবধূ করে ঘরে নিয়ে এল। রমেশ খুব ধুম করে ছেলের বৌ – ভাত করলে। শহরের প্রায় সব বড়লোকই তার খদ্দের – সে কারুকেই বাদ দিলে না। আলো বাজনা আহার আনন্দে কদিন ধরে তাদের পাড়াটা একেবারে জমজমাট হয়ে উঠল। এই আনন্দের মধ্যে শুধু গণপতিই রইল আড়ালে, কারণ জেলখাটা ছেলে আড়ালে থাকাই ভাল। যদি কোনো কথা ওঠে তবে ধনী আত্মীয় – সমাজে রমেশ ও সুষমার মাথা কাটা যাবে।
আনন্দের জোয়ার কেটে গেলে, সংসার আবার চলতে লাগল আগেরই মতো। নতুন আত্মীয়তার গর্বে রমেশ সেকরার আর প্রথম জীবনের কথা মনেই পড়ে না, এত দিন পরে তার জীবনে এসেছে শান্তি ও আরাম। গণপতি দক্ষতার সঙ্গে ব্যবসা দেখে, পশুপতি বি–এ পড়ে, স্ত্রী সুষমার ব্যবস্থায় সব চলেছে ঘড়ির কাঁটার মতো, এমন সময় একদিন অতর্কিতে মৃত্যু এসে টপ করে সুষমাকে তুলে নিয়ে গেল।
সুষমার মৃত্যুতে রমেশ অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়ল। গণপতির সঙ্গে সুষমা যে রকম ব্যবহারই করুক না কেন, রমেশকে সে কোনো দিক দিয়েই অবহেলা করেনি। বরং সে তাকে সর্বরকমে সুখেই রেখেছিল। শুধু তাই নয়, সুষমার উপর সব বিষয়ে একান্ত নির্ভর করাই রমেশের অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। সুষমার মৃত্যুতে সে একেবারে অকূল সাগরে পড়ল। তার সময়ে আহার হয় না, জামার বোতাম কোথায় খুঁজে পায় না, ঠিক সময়ে আফিং আনিয়ে রাখা হয় না। আফিং খেত বলে রমেশ রাত্রে প্রায় তিন সের দুধের ক্ষীর খেত – এখন কোনো দিন ক্ষীর বেশি পাতলা – কোনো দিন বা বেশি ঘন হয়ে যায়। ঠাকুর – চাকরকে বকে – ঝকে কোনো ফল হয় না, পশুপতি তার পড়াশুনা ও নব – বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়েই ব্যস্ত, আর গণপতি আছে ব্যবসা নিয়ে। রমেশকে দেখবার কেউ নেই।
শেষ কালে গণপতিকেই বাপের সেবার ভার নিতে হল। সে চাকরদের বলে দিলে বাবার কাজে কোনো ত্রুটি হলে আর আস্ত রাখবে না। সবাই তাকে গোঁয়ার বলে জানত, কাজেই চাকরদের কাজে যে শৈথিল্য এসেছিল তা ঠিক হয়ে গেল। গণপতি নিজে বাবার জন্যে বাজার করতে আরম্ভ করলে। তার আফিং, তার ক্ষীর – সব ঠিকভাবে চলতে লাগল। মোট কথা, সুষমা থাকতে রমেশের যে আরাম ছিল, গণপতির হাতে পড়ে সে আরামের মাত্রা বেড়ে গেল। এই সময় থেকে গণপতি রাত্রে বাড়ির ভেতর রমেশের কাছে শুতে আরম্ভ করল।
পশুপতি বি–এ পাস করবার পর এক দিন রমেশ গণপতিকে ডেকে বললে – পশুপতি তো আর পড়বে না বলছে, সে দোকানেই বেরুতে চায়, তুমি কি বল ?
গণপতি বললে – বেশ তো, সে তো ভাল কথা, ব্যবসা আগের চেয়েও ঢের বড় হয়েছে, আমি আর সব দিক সামলাতে পারি না।
পশুপতি দোকানে বেরুতে লাগল। প্রথমেই সে নিয়ম করলে – দোকানের সকলকে ঠিক সময়ে আসতে হবে। পুরোনো দিনের টেবিল – চেয়ার সব বদলে ফেলে সে নতুন সজ্জায় অফিস সাজাতে আরম্ভ করলে। বিলেত থেকে বিজ্ঞানসম্মত নিক্তি এল, পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বিলিতী সিন্দুক কেনা হল। জনকতক কেরানী থাকলেও আসল হিসেবের খাতা গণপতির অধীনেই ছিল, কিন্তু পশুপতি মোটা মাইনে দিয়ে একজন অ্যাকাউন্টেন্ট রাখলে এবং হিসেবের খাতা পত্র সব তার কাছেই চলে গেল। কারিগরেরা চলে গেল সেই পেছনকার ঘরে।
এই সব নতুন ব্যবস্থা করবার সময় পশুপতি একবারও গণপতির পরামর্শ নেবার প্রয়োজন বোধ করলে না। দোকানের পুরোনো কারিগর ও কর্মচারীদের এতদিন গণপতি কাকা, দাদা বলত – পশুপতি একেবারে তাদের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলে। হাবে – ভাবে সে জানিয়ে দিতে লাগল যে, এতদিন যে রকম এলোমেলো ভাবে ব্যবসা চলত আর তা হবে না, এবার আসল মালিক এসেছে। এতদিন যা চলছিল, গণপতি তাতে কিছু আপত্তি করেনি। সে মনে করেছিল যে, উৎসাহের প্রথম ঝোঁকটা কেটে গেলে পশুপতি আপনিই ঠান্ডা হয়ে যাবে। কিন্তু একটা ব্যাপারে এবারে তার টনক নড়ল। ইদানীং পশুপতি নিজের হাতে দোকানের বিজ্ঞাপনের ভার নিয়েছিল। একদিন গণপতি দেখতে পেলে একটা মাসিক পত্রিকায় তাদের বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে, বিজ্ঞাপনের শেষে পশুপতি নিজেকে দোকানের ম্যানেজার বলে জাহির করেছে। গণপতি তখুনি রমেশকে গিয়ে জানালে এবং বললে–এতদিন ম্যানেজার বলে কোনো পদার্থ ছিল না, এখন যদি সেখানে কোনো ম্যানেজার নিযুক্ত হয়, তবে সে পদের দাবী তারই প্রথম হওয়া উচিত, যোগ্যতার কথা ছাড়াই দেওয়া গেল।
রমেশ তা–না–না–না করতে লাগল। গণপতি জিজ্ঞাসা করলে – পশুপতি নিজেকে ম্যানেজার বলে ঘোষণা করবার আগে রমেশের অনুমতি নিয়েছিল কি না ?
রমেশ প্রথমটা না বলে আবার বললে – না, ঠিক মনে পড়ছে না – যাক্, আর ঝগড়া করে কি হবে – আমি ওকে বলে দেব, ইত্যাদি।
গণপতি বললে – আপনি ওকে আলাদা দোকান করে দিন কিংবা এ দোকান যদি ওকে দিতে চান তাও দিতে পারেন। আমি এতদিন প্রাণপাত করে এ দোকানের জন্য খেটেছি, তার জন্য আমাকে টাকা দিন, না হয় আমিই আলাদা দোকান করি। পশুপতি চিরদিনই আমাকে ঘৃণা করতে শিখেছে, আমার সঙ্গে একসঙ্গে কারবার করা তার পোষাবে না।
রমেশ সমস্ত ব্যাপারটা হেসেই উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে বললে – সে পশুপতিকে এ বিষয়ে বলবে এবং ভবিষ্যতে তার নামই ম্যানেজার বলে কাগজে বেরুবে।
গণপতি তখনকার মতো ঠান্ডা হয়ে আবার কাজ করতে লাগল বটে, কিন্তু পশুপতির ঔদ্ধত্য দিনে দিনে বেড়েই চলল। ইদানীং সকলের সামনেই সে গণপতিকে হেড মিস্ত্রী বলে ডাকতে আরম্ভ করে দিলে। কাগজে আগের মতো পশুপতির নামই ম্যানেজার হিসাবে বেরুতে লাগল। গণপতি আর রমেশের শান্তিভঙ্গ না করে কারুকে কিছু না বলে একদিন বিছানাপত্র বেঁধে বাড়ি ত্যাগ করে নিজের ভাগ্য – অন্বেষণে বেরিয়ে পড়ল।
গণপতি কলকাতা থেকে সোজা বোম্বাই চলে গেল। তখন বোম্বাই শহরে বাঙালী কারিগরদের খুবই চাহিদা ছিল। তাদের দোকানের দু’তিন জন কারিগর বোম্বাই গিয়ে ভাল টাকা রোজগার করছিল। গণপতি তাদের সঙ্গে দেখা করে কাজকর্মের কথা বললে। ভাল কাজ জানে বলে কারিগরদের মধ্যে গণপতির বেশ নামডাক ছিল – এক সপ্তাহ যেতে না যেতে তার ভাল কাজ জুটে গলে।
গণপতি মন দিয়ে কাজ করতে লাগল ও সেই সঙ্গে খাওয়া – দাওয়া ও সামান্য পরা ছাড়া ভবিষ্যতে নিজে ব্যবসা করবে বলে পয়সা জমাতে লাগল। কাজকর্মের সূত্রে দু’এক জন ধনীর সঙ্গেও তার পরিচয় হল – নিজে ব্যবসা করলে তাদের কাছ থেকেও সাহায্য পাবে বলে সে আশা পেলে।
প্রায় পাঁচ – ছ’ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে কিছু পয়সা জমিয়ে সে নিজে আলাদা ব্যবসা করতে আরম্ভ করল, কিন্তু তখনও সে দোকান করতে সাহস করেনি।
কিছুকাল নিজে ব্যবসা চালিয়ে জাভেরি বাজারে মাঝারি গোছের একখানা ঘর নিয়ে গণপতি এণ্ড কোম্পানি নাম দিয়ে সে দোকান ফেঁদে বসল। গণপতি তারের কাজ জানত – বোম্বাই শহরে তখনও পর্যন্ত তারের কাজ কেউ জানত না। তারের কাজের দরকার হলে তারা কটক কিংবা ঢাকা থেকে তৈরি করিয়ে আনত। এ বিদ্যাটা সে এতদিন কারুর কাছে প্রকাশ করেনি। দোকান খুলে তারের কাজ আরম্ভ করায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তার নাম – ডাক ও পসার বেড়ে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই সেখানকার জুহুরীদের মধ্যে মাতব্বর লোক হয়ে দাঁড়াল।
গণপতির প্রকান্ড ব্যবসা, বাজারময় গণপতি শেঠের সুনাম, কিন্তু গণপতির মনে শান্তি নেই। অন্য দিন সকাল থেকে আরম্ভ করে রাত্রি প্রায় বারোটা অবধি কাজের হুল্লোড়ে কেটে যায়, কিন্তু রবিবার ও অন্যান্য ছুটির দিন বাড়িতে একলা তার প্রাণ হাঁফিয়ে ওঠে। সে ভাবতে থাকে এই ব্যবসা, নিজের সংসার থাকত, যদি তখন সে বিয়ে করত, তাহলে আজ তাদের নিয়ে তার জীবন সার্থক হয়ে উঠত। এখন তার বয়েস হয়ে গিয়েছে–এ বয়সে বিয়ের কথা আর কল্পনাতেও আসে না। গণপতি ভাবতে থাকে পশুপতির ছেলেপিলে হয়েছে, তাদের মধ্যে যদি একটাকে পায় তো ছেলের মতো মানুষ করে, কিন্তু সংসারে তার আপনার বলতে কেউ নেই। সেই ছেলেবেলাতে তার মা মরে গিয়ে সবই গিয়েছে। বাড়ির কথা ভাবতে ভাবতে তার বাবার কথা মনে পড়ে যায়, তার মনে হয় অতি সামান্য হলেও স্নেহ – ভালবাসার পরশ সে একমাত্র বাবার কাছে থেকেই পেয়েছে, মাঝে মাঝে বাবার প্রতি একটা আকর্ষনও সে অনুভব করতে থাকে। আজ প্রায় দশ বছর হল বাবার সে কোনো খবরই রাখে না। কয়েকদিন ভেবে ভেবে এক ছুটির দিন সমস্ত দিন বসে গণপতি তার বাবাকে চিঠি লিখলে। দীর্ঘ দশ বছর গণপতির খোঁজ কেউ করেনি কিংবা সেও কারুর খোঁজ – খবর নেয়নি।
বাবার কাছে চিঠি লেখবার প্রায় সপ্তাহ খানেক পরে গণপতি দোকানে গিয়ে দেখলে তার নামে কলকাতা থেকে এক ‘তার’ এসে উপস্থিত।
টেলিগ্রাম খুলে সে দেখলে – আগামীকাল ক্যালকাটা মেলে তার বাবা আসছেন, সে যেন স্টেশনে উপস্থিত থাকে।
পরের দিন সকাল বেলা স্টেশনে রমেশকে দেখে গণপতি কেঁদেই অস্থির। এ কি চেহারা হয়েছে তার বাবার ! রমেশ স্যাকরাকে দেখে আর চেনাই যায় না। চেহারা রোগা হাড্ডিসার, দু চোখ প্রায় অন্ধ, কুঁজো হয়ে পড়েছে। – একমুখো দাড়ি–গোঁফ। গণপতি এক রকম তাকে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসালে। রমেশ হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কথা বলতে লাগল – আর বাবা, এখন গেলেই হয়। তাকে দেখবার লোক নেই, কেউ তাকে দেখেও না। পশুপতি ব্যবসা নিয়ে মত্ত, বৌমা তার ছেলেপিলে ও সংসার নিয়ে সারা, এ বুড়োকে আর কে দেখবে বল ?
গণপতি শহর থেকে দূরে সমুদ্রের ধারে বাড়ি ভাড়া করে রমেশকে সেখানে রাখল। শহরের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক দিয়ে তার চিকিৎসা করাতে লাগল। রমেশ খুব খারাপ ও যন্ত্রণাদায়ক হাঁপানিতে কষ্ট পাচ্ছিল। ডাক্তারেরা বললেন – রোগ ভাল হবে না, অনেক দিনের অবহেলার ফলে রোগ বেড়ে গিয়েছে।
তবুও কিছুকাল চিকিৎসার পরে রমেশ অনেকটা আরাম পেলে। দুই চোখেই ছানি পড়ে সে প্রায় দৃষ্টিহীন হয়ে গিয়েছিল, একে একে দু’চোখেরই ছানি কাটানো হল। রীতিমত চিকিৎসা, শুশ্রুষা ও সেবার গুণে বছর খানেকের মধ্যেই রমেশ বেশ ভাল হয়ে উঠল।
শরীর ভাল হবার সঙ্গে সঙ্গে রমেশের মনও বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠতে লাগল। ক্রমেই কলকাতার প্রতি তার আকর্ষণ বাড়তে লাগল – সেখানে নাতি – নাতনি আছে, পশুপতি আছে, বিষয় – সম্পত্তি আছে। একদিন সে গণপতিকে বললে – এবার যাই, আর ক’দিন তোকে ভোগাব ?
গণপতি বললে – আবার যাবে ? আবার তারা তোমায় অবহেলা করবে। একটু সেরেছ কিন্তু দু’দিন যেতে না যেতে আবার পড়বে।
রমেশ বললে – বিষয় – আশয় রয়েছে সেগুলো তো দেখা দরকার, যদিও পশুপতি সব দেখে, তবুও আমাকে মাঝে মাঝে তদারক করতে হয়।
রমেশ কথা দিলে সেখানকার কাজকর্ম দেখে মাস দু’তিন পরে এসে আবার ছ’মাস গণপতির কাছে কাটিয়ে যাবে। এই রকম দুই ছেলের কাছে ছ’মাস করে থেকে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে।
রমেশ কিন্তু আর ফিরল না। বাড়ি ফিরে গিয়ে সে প্রথম প্রথম কয়েকটা চিঠি লিখেছিল বটে কিন্তু ক্রমে চিঠিপত্র কমে আসতে আসতে একেবারে বন্ধই হয়ে গেল। বাপ আবার ফিরে আসবে বলে গণপতি সমুদ্রের ধারের সেই বাড়িখানা ভাড়া করেই রেখেছিল, কিন্তু বছর খানেক দেখে সে বাড়িখানা ছেড়ে দিল।
উপরি উপরি পাঁচ–ছ’খানা চিঠি লিখেও রমেশের কাছে থেকে যখন কোনো জবাব এল না, তখন গণপতি দস্তুরমত চিন্তিত হয়ে পড়ল। গত দশ বছর কারো সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকায় বাপের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে তার কোনো চিন্তাই ছিল না, কিন্তু রমেশ তার কাছে এসে কিছুদিন থাকায় তার অসহায় অবস্থা দেখে বাপের প্রতি গণপতির একটা টান ও কর্তব্যবোধ জেগেছিল। তাই এতদিন কোনো খবর না পেয়ে সে কলকাতায় একটা টান ও কর্তব্যবোধ জেগেছিল। তাই এতদিন কোনো খবর না পেয়ে সে কলকাতায় একটা ‘তার’ করবে কি না ভাবছে, এমন সময় কলকাতা থেকেই তার কাছে এক টেলিগ্রাম এসে হাজির – বাবার অবস্থা খারাপ – দেখবার ইচ্ছে যদি থাকে তো আসতে পার।
সেই দিনই রাতের মেলে গণপতি কলকাতায় রওনা হল। বাড়িতে এসে সে দেখলে, বাপের অবস্থা সত্যিই খারাপ। রমেশ কাঁদতে কাঁদতে সবাই – এর সামনেই তাকে বলতে লাগল – বাবা, তোমার কাছ থেকে চলে এসে খারাপ করেছি, এরা কেউ আমাকে দেখে না।
পশুপতি ও তার স্ত্রী সেইখানেই দাঁড়িয়েছিল। রমেশের কথা শুনে পশুপতি গুম হয়ে রইল, কিন্তু তার স্ত্রী বললে – বাবার যেমন কথা ! রোগে ভুগে – ভুগে ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। দিনরাত সেবা করেও ওঁর মন পাওয়া যায় না।
গণপতি পশুপতিকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে জানলে যে পাড়ারই একজন ডাক্তার রমেশের চিকিৎসা করছে। বড় ডাক্তার কেন ডাকা হয়নি – একথা জিজ্ঞাসা করায় সে বললে – সব বড় ডাক্তারই ওঁকে দেখেছেন, তাঁরা বলে দিয়েছেন ও আর সারবে না।
গণপতি আর বাক্যব্যয় না করে ধুলো পায়ে ছুটে গিয়ে কলকাতার সেরা ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এল।
রমেশ সে যাত্রা বেঁচে উঠল বটে, কিন্তু তার বয়স হয়েছিল ও বহুদিন ভুগে ভুগে শরীরেও কিছু ছিল না। ডাক্তাররা বলে দিলে স্বাস্থ্যকর জায়গায় দিয়ে থাকলে আরো কিছু দিন বাঁচতে পারেন। কিন্তু কে তাকে স্বাস্থ্যকর স্থানে নিয়ে যাবে ! ব্যবসা ফেলে পশুপতি যেতে পারে না, সঙ্গে কেউ – না গেলেও চলে না, কারণ রমেশ সববিষয়েই অকর্মণ্য হয়ে পড়েছিল – তাকে নিরন্তর দেখা – শোনার লোক চাই। অগত্যা গণপতি বোম্বাই গিয়ে জলের দরে তার ব্যবসা গাড়ি সব বিক্রি করে দিয়ে ফিরে এসে তার বাপকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
রমেশ কিন্তু আর সেরে উঠতে পারলে না। এক জায়গায় গিয়ে নতুন আবহাওয়া ও ওষুধপত্রের গুণে সে একটু ভালো হয়, কিন্তু দু’দিন পরে আবার অসুখে পড়ে। অসুখ বাড়লেই গণপতি তাকে আবার কোনো স্বাস্থ্যকর জায়গায় নিয়ে যায়। এই রকম খরচের ঠেলায় গণপতির দোকান বেচা অর্থও প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসতে লাগল। পশুপতির কাছে একবার টাকা চেয়ে কোনো উত্তর না পেয়ে সে তাকে আর লিখলে না। এই ভাবে পিতার আয়ুর সঙ্গে সঙ্গে পুত্রের অর্থভান্ডারও শেষ হয়ে আসতে লাগল, শেষকালে রমেশ একদিন তার অন্তিমকাল উপস্থিত হয়েছে বুঝতে পেরে গণপতিকে বললে, – বাবা, এবার আমায় কলকাতায় নিয়ে চল – আমি গঙ্গার ধারে মরতে চাই।
কলকাতায় এসে রমেশের অসুখ খুবই বেড়ে গেল – আজ যায় কাল যায় অবস্থা। তবু গণপতির চেষ্টার অন্ত নেই, সে বিশেষজ্ঞদের ডাকালে, কিন্তু তাঁরা বলে দিলেন আর কিছু হবে না। পাড়ার মুরুব্বিরা বলতে লাগলেন – গণপতি, এত তো করলে, ঘনেশ্বর বাবার মাদুলি দিয়ে দেখেছো ?
রমেশের অঙ্গে ঘনেশ্বর বাবার মাদুলি চড়ানো হল, কিন্তু যার দিন ঘনিয়ে এসেছে কোনো বাবাই তার কিছু করতে পারেন না – রমেশের অবস্থা উত্তরোত্তর খারাপের দিকেই চলতে লাগল। শেষকালে রমেশের ইচ্ছায় ও দশ জনের পরামর্শমত গণপতি তারকেশ্বরে হত্যা দিতে ছুটল।
গণপতি তিন দিন রাত্রি নিরম্বু উপবাস করে বাবা তারকনাথের পায়ে পড়ে রইল। তিন দিন তিন রাত্রি ধরে একমনে প্রার্থনা করলে – বাবা, আমার বাবাকে তুমি সারিয়ে দাও, কিন্তু সে কিছুই পেলে না। সেই দিন ভোরবেলা সে যেন স্বপ্নে শুনতে পেলে যে তারকনাথ তাকে বললেন – তোর বাবার সময় হয়ে গিয়েছে, সে আর সারবে না – তুই এখুনি বাড়ি চলে যা।
ভোরবেলা উঠে ছুটতে ছুটতে পাগলের মতো গণপতি বাড়ি এসে দেখে যে তার বাবার কন্ঠশ্বাস চলেছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রমেশ মারা গেল।
পিতার শবদাহ করতে করতে শ্মশানে গণপতি পাড়ার লোকদের মুখে শুনতে পেলে যে, সে যখন তারকেশ্বরে হত্যা দিয়ে পড়েছিল, সেই সময় তার বাবা উইল করে গেছে। উইল সম্বন্ধে জানবার জন্য গণপতির ভারি কৌতুহল হতে লাগল। একবার তার মনে হল, বোধ হয় রমেশ তাকে সমস্ত বিষয় দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাপ মরতে না মরতে উইল নিয়ে আলোচনা করাটা অত্যন্ত অশোভন হবে মনে করে তখনকার মতো সে চেপেই গেল।
দিন কয়েক বাদে পশুপতিকে উইল সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করায় সে বললে – হ্যাঁ, বাবা মরবার সময় উইল করেছেন। তার এক কপি আছে শ্বশুর মশায়ের কাছে, আর এক কপি আছে আমাদের এটর্ণীর কাছে। জানোই তো, বাবা আইন ছাড়া এক পা–ও চলতেন না।
পশুপতির শ্বশুর ছিলেন বড় উকিল। গণপতি স্থির করলে এ সম্বন্ধে পশুপতির শ্বশুরকেই সে জিজ্ঞাসা করবে। আগে বাবার কাজটা হয়ে যাক।
রমেশের শ্রাদ্ধের দিন এগিয়ে আসতে লাগল। গণপতি ঠিক করলে খুব ধুম করে বাপের শ্রাদ্ধ করবে, কিন্তু দেখলে যে সে সম্বন্ধে পশুপতির কোনো আগ্রহই নেই। যাই হোক, সে যখন বড় ছেলে তখন এ বিষয়ে তারই কর্তব্য বেশি।
একদিন সকালে গণপতি বাপের শ্রাদ্ধ সম্বন্ধে পরামর্শ করার জন্যে পশুপতিকে ডাকলে। পশুপতি সব শুনে অত্যন্ত উদাস ভাবে বললে – কয়েক বছর থেকে দোকানে বরাবর লোকসান যাচ্ছে, বাবা তো নগদ কিছুই রেখে যাননি – আমি বলি, তিলকাঞ্চন করেই শ্রাদ্ধ মিটিয়ে ফেলা উচিত।
গণপতি বললে – আমি ঘটা করে বাবার শ্রাদ্ধ করতে চাই। শহরে ধনী বলে আমাদের নাম আছে, কোনো রকমে বাবার শ্রাদ্ধ সারলে আমাদের নিন্দে হবে। আমার নিন্দেকে আমি গ্রাহ্য করি না, কিন্তু তোমার ছেলেমেয়ে আছে, তাদের বিয়ে দিতে হবে –
পশুপতি বললে – তোমার যদি ইচ্ছে হয় তো ঘটা কর নিজের টাকায়। আমার টাকাকড়ি নেই।
গণপতি বললে – নগদ টাকা বাড়িতে জমা করে রাখা বাবার অভ্যেস ছিল। আমার বিশ্বাস, এই সিন্দুকের ভেতর টাকা আছে। দেখি – আমায় সিন্দুকের চাবিটা দাও।
সিন্দুকের চাবি কোথায় আছে – এখন পাওয়া যাবে না – অশৌচ অবস্থায় সিন্দুক খোলা ঠিক নয় – ইত্যাদি করে পশুপতি নানারকম বায়না করতে লাগল।
গণপতির ক্রমে রাগ চড়ছিল। সে পশুপতিকে ধরে বললে – সিন্দুকের চাবি দাও বলছি। পশুপতি বললে – দেব না, কি করবে ? মারবে না কি ?
পশুপতি ও তার মা, স্ত্রী প্রভৃতির বিরুদ্ধে এতদিনকার সঞ্চিত সমস্ত ক্রোধ মাথায় উঠে গণপতির খুন চড়ে গেল।
তবে রে – বলে সে পশুপতির ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। পশুপতিও তাকে মারবার চেষ্টা করলে বটে কিন্তু তার সাধ্য কি গণপতির সঙ্গে পারে – গণপতি এক হাত দিয়ে তার গলাটা চেপে ধরলে। সে গোঁ – গোঁ করতে আরম্ভ করে দিলে। চেঁচামেচি শুনে তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে ছুটে এসেছিল, তারা চিৎকার করে কান্নাকাটি আরম্ভ করে দিলে। চেঁচামেচি শুনে তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে ছুটে এসেছিল, তারা চিৎকার করে কান্নাকাটি আরম্ভ করলে। পাড়ার কেউ কেউ এসে ব্যাপার দেখে স্তম্ভিত। গণপতির মুখে আর কথা নেই, সে কেবল চিৎকার করছে – দে সিন্দুকের চাবি, নইলে আজ তোর শেষ দিন। তোর ছেলে তে–রাত্তিরে তোর শ্রাদ্ধ করবে।
সামনে স্বামি–হত্যা দেখতে না পেরে পশুপতির স্ত্রী সিন্দুকের চাবিটা ছুঁড়ে গণপতির সামনে ফেলে দিলে-
চাবিটা তুলে নিয়েই গণপতি পশুপতিকে ছেড়ে দিলে। তখন পশুপতির প্রায় হয়ে এসেছে, সবাই ধরাধরি করে নিয়ে তাকে অন্য ঘরে শুইয়ে দিলে। হাঙ্গামা ও চিৎকার শুনে পাড়ার যে – যে সেখানে উপস্থিত ছিল তাদের সবাইকে এই গোলমালের কারণ বলে গণপতি তাদের সাক্ষী রেখে লোহার সিন্দুকের চাবি খুলে ফেললে। সিন্দুকের মধ্যে থরে – থরে নোট সাজানো ছিল – গণপতি তা থেকে হাজার পনেরো টাকার নোট তুলে নিয়ে পশুপতির ছেলেকে ডেকে তার হাতে চাবিটা দিয়ে বললে – তোর মাকে দিয়ে আয়-
শ্রাদ্ধ – শান্তি হয়ে যাবার পর জ্ঞাতিভোজনের দিন গণপতি কাজে ব্যস্ত, এমন সময় বাইরের ঘরে তার ডাক পড়ল। সেখানে গিয়ে সে দেখতে পেলে তাদের আত্মীয় – স্বজনের অনেকে এবং পাড়ার জনকেয়ক মুরুব্বি সভা আলো করে বসে আছেন। গণপতি সেখানে উপস্থিত হতেই পশুপতির শ্বশুর মশাই বললেন – এসো, আজ সবাই এখানে উপস্থিত আছেন, এইখানে তোমার বাবার উইলটা পড়া যাক। তিনি মরবার আগে উইলখানা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন যেন তাঁর শ্রাদ্ধের দিন উইলখানা পড়া হয়।
গণপতি আগ্রহভরে সভার এক দিকে বসল। পশুপতির শ্বশুর উইলখানা পড়তে আরম্ভ করলেন। রমেশ তার ব্যবসা, নগদ অর্থ, বাড়ি, গাড়ি, যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি পশুপতিকে দিয়ে গিয়েছে। উইলের এক জায়গায় মাত্র গণপতির নাম আছে, যেখানে রমেশ বলেছে যে, পশুপতি যদি ইচ্ছা করে তবে গণপতিকে তার বাড়িতে রাখতে পারে।
উইলখানা পড়া হয়ে যাবার পর সভার সকলেই স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ এই ভাবে কাটবার পর পশুপতির শ্বশুর উইলখানা গণপতির হাতে দিয়ে বললেন – তুমি তো তোমার বাবার সই চেন – দেখো এটা জাল সই কি – না। গণপতি একবার অবহেলা ভরে দেখে উইলখানা ফিরিয়ে দিলে।
অনেক্ষণ চুপচাপ কাটবার পর পাড়ার একজন মুরুব্বি বললে – আশ্চর্য। রমেশ গণপতিকে একেবারে বঞ্চিত করে গেল ?
আর একজন বললে – অথচ এই গণপতি না থাকলে তাকে পথে পড়ে মরে থাকতে হত – বিচিত্র মানুষের চরিত্র !
গণপতি কোনো কথা না বলে সভাক্ষেত্র থেকে উঠে এসে যেমন কাজকর্ম করছিল, তেমনি হাঁকডাক করতে লাগল।
আত্মীয় – স্বজনেরা খেয়ে বিদায় নেবার পর পশুপতিদের বাড়ির সবাই খেতে বসল, সেখানে দেখা গেল গণপতির আসন শূন্য রয়েছে। দু’-চার বার তার খোঁজ হল, তার পরে সবাই খেতে আরম্ভ করে দিলে।
রাত্রি প্রায় দশটার সময় গণপতি যখন বাড়ি ফিরল, তখন উৎসবান্তে তাদের বাড়িখানা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। ক্লান্ত দেহে সে নিজের ঘরখানায় গিয়ে ঢুকল। ঘরটা আসলে তার নিজের নয় – রমেশের। রমেশেরই সেবার সুবিধে হবে বলে সে বাপের কাছেই থাকত। সামনেই রমেশের একখানা বড় তৈলচিত্র ঝুলছিল – গণপতি তার নিচে গিয়ে বসে পড়ল। শরীরের কোনো অঙ্গে বিষম আঘাত লাগলে সে জায়গাটা যেমন অসাড় হয়ে যায়, এতক্ষণ তার মন সেই রকম অসাড় হয়েছিল – চিত্তে কোনো ক্ষোভ নেই, কারুর বিরুদ্ধে নালিশ পর্যন্ত নেই। ঘরের মধ্যে ঢুকে বাপের ছবির সামনে বসে বসে সে মনের সক্রিয়তা ফিরে পেলে। তার মনে হতে লাগল – এবার সে কি করবে ! অতীতে এক দিন সে অভিমান করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল ভাগ্য – অন্বেষণ করতে, আজ ভাগ্যই তাকে গৃহ থেকে বিতাড়িত করলে। সেদিন তার মনে শক্তি ছিল, সাহস ছিল, স্বাস্থ্য ছিল – এখন তার বয়স হয়েছে, চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ হয়ে এসেছে – আবার নতুন করে জীবন আরম্ভ করবার শক্তি কোথায় ? দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে পিতার তৈলচিত্রের দিকে চেয়ে মনে মনে প্রশ্ন করলে – কি করব !
ওদিকে পশুপতির স্ত্রী তাদের ঘরে পান চিবোতে – চিবোতে স্বামীকে জিজ্ঞাসা করছিল – তুমি কি ওকে বাড়িতে রাখবে নাকি ? বাড়িসুদ্ধ সবাইকে কোন্ দিন গলা টিপে খুন করে রেখে যাবে বলছি –
পশুপতি বললে – পাগল হয়েছ তুমি ? ঐ জেলফেরতকে বাড়ি রেখে বেঘোরে প্রাণটা যাক আর কি। সেদিন তো মেরেই ফেলেছিল –
কিন্তু পরদিন সকাল বেলায় উঠে জেলফেরতকে কেউ বাড়িতে দেখতে পেলে না !
Tags: জেলফেরত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।