বাতাসী জেলের মেয়ে। বাপ নাই, মা নাই, ভাই নাই – থাকিবার মধ্যে আছে এক বুড়ি ঠাকুরমা। সকলে মরিয়া গেল ; যাহাদের পরে মরিবার কথা, তাহার আগে চলিয়া গেল ; বুড়ি রহিল, আর রহিল তাহার বুড়া বয়সের একমাত্র অবলম্বন বাতাসী।
বাতাসী নামটার একটু ইতিহাস আছে। বাতাসীর বাপ মার অনেক দিন সন্তান হয় নাই। তাহারা কত দেবতার মানত করিয়াছে ; কিন্তু দেবতারা পাঁঠা, মহিষ, ষোড়শোপচারে পূজা প্রভৃতির লোভ সংবরণ করিয়াছিলেন – মৎসজীবীর পুত্র সন্তানলাভে হতাশ হইয়াছিল। অবশেষে একদিন তাহার গৃহিণী গঙ্গাদেবীকে এক মণ বাতাসা মানত করিল। গঙ্গাদেবীর সেসময় বোধহয় বাতাসা খাইবার সাধ হইয়াছিল ; তিনি বাতাসার লোভে ভুলিয়া গেলেন। জেলের ঘরে একটি মেয়ে জন্মিল। মেয়ের ষষ্ঠীপূজার দিন এক মণ বাতাসা গঙ্গাদেবীকে নিবেদন করিয়া দিয়া, পাড়ার সকলে তাহাতে যথাযোগ্য ভাগ বসাইল। পুরোহিত মহাশয় বলিলেন, “বাতাসা দিয়া যখন মেয়ে পাইয়াছ, তখন মেয়ের নাম থাকুক বাতাসী।” পুরোহিতের কথামত মেয়ের নাম হইল বাতাসী।
বাতাসীর বয়স যখন তের বৎসর, তখন তাহার পিতা বুঝিল, আর বিবাহের চেষ্টা না করিলে নয়। জেলের ঘরের মেয়ে একটু বেশী বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত থাকিলেও সমাজে বড় কথাবার্তা হয় না। রামমোহনের ঐ একটিমাত্র মেয়ে ; যে কয়দিন ঘরে রাখিতে পারা যায়, থাকুক না। এই ভাবিয়া পিতা মাতা বিবাহের বিশেষ চেষ্টা করে নাই। বিশেষত তাহারা মনে মনে বর স্থির করিয়া রাখিয়াছিল। হরি হালদারের পুত্র স্বরূপ বেশ ছেলে। হরি হালদার গাঁয়ের পার্শ্বের ইচ্ছামতী নদীর পাটনী ; দুপয়সা রোজগার করে। এই পাটনীগিরিটি সে একদিন মৌরসী করিয়াই লইয়াছিল। ঘাট – ডাকের সময় গ্রামের আর কেহ ডাকিত না, হরিই যাহা হউক দিয়া ঘাট ইজারা লইত। বাতাসীর পিতামাতার স্বরূপের সঙ্গেই কন্যার বিবাহ দিবার ইচ্ছা ছিল। এতদিন কথাটি বলি বলি করিয়া বলা হয় নাই। এখন মেয়ে তের বৎসরে পড়িল ; সুতরাং আর অপেক্ষা করা সঙ্গত নয়। রামমোহন প্রস্তাব করিল, হরি আনন্দে সম্মত হইল। মেয়ে সুন্দরী, স্বরূপের সঙ্গে বাতাসী শৈশবে কত খেলা করিয়াছে, নৌকায় চড়িয়াছে, দুইজনে খুব ভাব। কিন্তু বিবাহের কাল বিলম্ব হইল ; স্বরূপের তখন কুড়ি বৎসর বয়স ; জোড় বৎসরে ছেলের বিবাহ দিতে স্বরূপের মাতার আপত্তি হইল। রামমোহন বলিল, “বেশ এত তাড়াতাড়ি কি ? এক বৎসর পরেই বিবাহ হইবে।”
বৎসর যাইতে না যাইতেই স্বরূপের মা মরিল। গ্রামের দশ মাতব্বর বলিলেন, “এক বৎসর মরণাশৌচ ; তাহার পূর্বে বিবাহ শাস্ত্রসম্মত নহে”। রামমোহন বলিল “বেশ”।
এইভাবে দুই বৎসর গেল ; বাতাসীর বয়স তখন পনের। বিবাহের আয়োজন হইতে লাগিল। হরি হালদারের বিশেষ আগ্রহ ; তাহার ঘরে স্ত্রীলোক নাই। কিন্তু তাহাদের আগ্রহ হইলে কি হয়, প্রজাপতি ঠাকুর নিতান্তই বাঁকিয়া বসিলেন। ঠাকুরই মন্ত্রণা করিয়া ওলাদেবীকে গ্রামে ডাকিয়া আনিলেন। গ্রামে হাহাকার উঠিল। দেবী প্রথমেই জেলে – পাড়ায় প্রবেশ করিলেন – পাড়াটি নদীর তীরেই কিনা। আজ ও–বাড়ির রসিক দাস গেল, কাল ফটিকের ছেলেটি গেল, তার পর দিন হরি হালদার আক্রান্ত হইল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সে মরিল। রামমোহন ওলাওঠার বীজ লইয়া ঘরে গেল। সে ঘরে গিয়া দেখে, তাহার স্ত্রী অগ্রে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছে। একই দিনে একই সময়ে স্বামী স্ত্রী চলিয়া গেল। দেবী রামমোহনের বৃদ্ধা মাতাকেও কিছু বলিলেন না, বাতাসীকেও কিছু বলিলেন না। তাহার পর ক্ষুদ্র হরিশপুর গ্রামের ১৩৯ জনের হিসাব নিকাশ করিয়াই দেবী গ্রামান্তরে চলিয়া গেলেন। বাতাসীর বিবাহ চাপা পড়িয়া গেল, – কাহার বিবাহ কে দেয় ?
দুই তিন মাস কাটিয়া গেল। রামমোহন মেয়ের বিবাহের জন্য তিনশত টাকা সঞ্চয় করিয়াছিল। তাহাই ভাঙ্গিয়া বাতাসী ও তাহার ঠাকুরমার দিন চলিতে লাগিল। এমন সময়ে একদিন পুরোহিত মহাশয় রামমোহনের বাড়িতে পদধূলি দান করিলেন। অন্যান্য কথার পর তিনি বলিলেন, “মোহন ত চলিয়া গেল, এখন আমাকেই ত তোমাদের মঙ্গল অমঙ্গল দেখতে হয়। তা এখন মেয়েটার কোনো রকমে সাত পাক দিতে ত হয় কি বল ?”
বুড়ি বলিল, “তা ত বটেই। আমাদের ত আর কেউ নেই ; আপনিই আছ ; যা হয় আপনিই কর।” পুরোহিত মহাশয় বলিলেন, “আমি স্বরূপকেও বলি, গ্রামের দশজনকেও বলি, যাতে শুভকর্মটা এই মাসেই হয়ে যায়, তাই করা যাবে ; সে জন্য তুমি ভেব না।” এই বলিয়া পুরোহিত ঠাকুর চলিয়া গেলেন।
বাতাসী ঘরের মধ্যে বসিয়া ছিল ; সে সব কথা শুনিল। পুরোহিত চলিয়া গেলে বাতাসী ঠাকুরমাকে বলিল, “ঠাকুরমা আমি সব শুনেছি। তোমরা যাই বল, আর যাই কর, আমি বিয়ে করব না। বাবা গেল, মা গেল, এ পাপ বিয়ে আর যায় না।” নাতিনীর কথা শুনিয়া বুড়ি একেবারে অবাক্। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বুড়ি বলিল, “তুই বলিস কি বাতাসী, বিয়ে করবি নে ? সে কি কথা ! অমন কথা মুখেও আনিস নে, লোকে বলবে কি ?’ বাতাসী রাগিয়া বলিল, “লোকে যা বলতে হয় বলুক। আমার দশটি ভাইও নেই, বোনও নেই যে, লোকের কথায় ভয় পাব। তুই চোক্ বুজলেই আমার সব গেল ; আমি বিয়ে কিছুতেই করব না।” বুড়ি রাগিয়া বলিল, “আবাগী বিয়ে করবি নে, খাবি কি ? তো বাবা ত জমিদারী রেখে যায় নি, আর বসে খেলে রাজার ভান্ডারও ফুরিয়া যায়। শেষে একটি কলঙ্ক কিনবি নাকি?’’ বাতাসী বলিল, “তোর মুখে আগুন; রামমোহন মাঝির মেয়ের কলঙ্ক রটায়, তার দিকে কুনজরে চায়, এমন লোক এ সাতগাঁয়ের মধ্যে নেই। খাব কি বলছিস্ ? জেলের মেয়ে খাব কি ? তুই বুড়ো হয়েছিস, ঘরে বসে থাকবি, আমি গাঁয়ে গাঁয়ে মাছ বেচে তোকে খাওয়াব, – তার জন্য ভয় কি ?”
বুড়ি আসল কথাটি আর চাপিয়া রাখিতে পারিল না ; বলিল, “দিদি ভয় সবই। তোর এই সমোত্ত বয়েস, তারপর এই রূপ ; সবই ভয় ! এতবড় মেয়ে কি আইবুড়ো থাকতে আছে – না কেউ থাকে ?” বাতাসী বলিল, “তা তুই যা বল ঠাকুরমা ! আমি এ জন্মে আর বিয়ে করছিনে।” বুড়ি বলিল, “ কেন স্বরূপকে কি মনে ধরে না? তা তাকে বিয়ে না করিস অন্য বর দেখি।” বাতাসী বলিল “তুই ফের যদি বিয়ের কথা বলবি তা হলে আমার যে দিক দুই চোখ যাবে, সেই দিকে চলে যাব”। বুড়ি তখন বিমর্ষ ভাবে বলিল, “তা, আমি ত আর তোর সঙ্গে কথায় পেরে উঠব না। যাই তোর বরের কাছে ; সে যদি পারে।”
বুড়ি সত্যসত্যই স্বরূপের বাড়ি গেল ; তাহাকে সমস্ত কথা খুলিয়া বলিল। স্বরূপ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল, “ঠাকুরমা, তুমি ঘরে যাও। আমি বাতাসীর মন বুঝিব।” স্বরূপ অনেক চেষ্টা করিয়াছে, অনেক কথা বুঝাইয়াছে ; বাতাসীর সেই এক কথা – “আমি বিবাহ করিব না। তোমাকেও না – আর কাহাকেও না।”
একদিন স্বরূপ বাতাসীকে বলিল, “দেখ বাতাসী, তোমার জন্যে আমি এতদিন বসে আছি। আমার এ সংসারে কেউ নেই। তুমি কি মনে কর, আমি তোমায় ভালবাসিনে। তুমি কি’ভাব, আমি তোমার যত্ন করব না ? বাতাসী, আমি তোমায় দিনরাত ভাবি। ঝড় বৃষ্টিতে রাত্রিতে যখন নদীতে লোক পার করতে যাই, তখন তোমার মুখ মনে করেই আমি বল পাই। যখন খালি ঘরে আধাঁর রেতে একলা রাঁধিবাড়ি, তখন তোমার কথাই মনে করি। কতদিন তোমার কথা ভাবতে ভাবতে রাত হয়ে যায়, আর রাঁধিনে – না খেয়েই পড়ে থাকি। তারপর সকাল বেলায় যখন তোমাকে দেখি, তখন মনেও হয় না যে, আগের রাত্রি আমার উপবাস গিয়াছে। বাতাসী,” – স্বরূপ আর কিছু বলিতে পারিল না, তাহার চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠিল।
স্বরূপের কথা শুনিয়া বাতাসীর মন নরম হইল কিনা, বলিতে পারি না ; কিন্তু আজ সে স্বরূপের সঙ্গে অনেক কথা কহিল। অন্যদিন স্বরূপের কথায় সে কানও দিত না। আজ সে স্বরূপকে বলিল, “তোমাকে সোজা কথা বলি। দেখ তোমার কেউ নেই, আমার বুড়ি ঠাকুরমা আছে। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হলে ঠাকুরমা কোথায় যাবে ? তুমি বলবে ‘আমার বাড়িতে এসে থাকবে’। তা হতেই পারে না ; রামমোহন মাঝির মা দুটো ভাতের জন্য তার নাতজামায়ের বাড়িতে থাকবে, – তা’ আমি কিছুতেই সইতে পারব না। আমি নিজে রোজগার করে আমার ঠাকুরমাকে খাওয়াব। তাকে তোমার দোরে আসতে দেব কেন ? অহঙ্কারই বল, আর যাই বল, তোমায় আমি বলছি, আমার যে কথা সেই কাজ। হয় ত তুমি বলবে, তুমিই আমাদের বাড়ি এসে থাকবে। তোমাকে ভালবাসি আর নাই বাসি, তুমি ঘরজামাই হতে যাবে কেন ? যে নিজের বাপের ভিটে ছেড়ে বিয়ের লোভে ঘরজামাই হতে চায়, আমি তাকে বিয়ে করব না, তুমি আর আমাকে কিছু বোলো না। এরপর থেকে তুমি যদি আমার বিয়ের কথা তোলো, তোমার সঙ্গে আমি কথাও কইব না।” স্বরূপ নির্বাক হইয়া বাতাসীর কথা শুনিল। তাহার কথা শেষ হইলে স্বরূপ কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু বাতাসী তাড়াতাড়ি ঘরে চলিয়া গেল। স্বরূপ কি ভাবিতে ভাবিতে খেয়া নৌকায় গিয়া বসিল।
বাতাসী এখন মাছ বিক্রয় করিয়া বেড়ায়। নদীর তীরে তীরে ঘুরিয়া জেলেদের নিকট হইতে সে মাছ কিনিয়া ওপারের হাটে যায় ; সেখানে মাছ বিক্রয় করিয়া হাটের পরে আবার নদী পার হইয়া ঘরে আসে। প্রথম প্রথম কয়েকদিন সে স্বরূপের নৌকাতেই পার হইত, স্বরূপও সুবিধা পাইলে বাতাসীকে কত কথাই বলিত। বাতাসী কোনও কথার উত্তর দিত না। একমাস পরে একদিন বাতাসী মাসের পারের পয়সা চারি আনা স্বরূপকে দিতে গেল। স্বরূপ ‘পয়সা’ লইয়া জলে ফেলিয়া দিল। তাহার পর বলিল, “বাতাসী তুমি কি মানুষ ? কি বলে আমায় পারের পয়সা দিতে এলে ?” বাতাসী এ কথার আর উত্তর করিল না ; চুপ করিয়া ঘরে চলিয়া গেল। সেই দিন হইতে সে স্বরূপের ঘাটে আর পার হইত না ; এক ক্রোশ ভাটিতে আর একখানি খেয়া ছিল, বাতাসী সেই খেয়ায় পার হইত। তাহাতে এপারে ওপারে প্রায় দুই ক্রোশ পথ হাঁটিতে হইত, কিন্তু সে তাহা গ্রাহ্যই করিত না। এদিকে স্বরূপের খেয়ায় প্রতিদিন কত লোক পার হইত, দূর হইতে লোকে যখন আসিত, তখন স্বরূপ মনে করিত, উহাদের মধ্যে বাতাসী নিশ্চয় আছে। তাহারা ঘাটে আসিত – বাতাসী তাহাদের সঙ্গে নাই, স্বরূপ একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া নৌকা ছাড়িয়া দিত। কতদিন সে নৌকা লইয়া বসিয়া থাকিত, তাহার বুক ভাঙ্গিয়া কান্না আসিত। বাতাসীকে পার করিবার জন্য কত আগ্রহে পথের দিকে চাহিয়া বসিয়া থাকিত । দিনের পর দিন গেল- বাতাসী আর পার হইবার জন্য আসে না। সন্ধ্যার সময় যখন পারের লোক আসিত না, স্বরূপ তখন নৌকায় বসিয়াই আকাশ–পাতাল ভাবিত ; একটু শব্দ হইলেই পারের দিকে চাহিয়া দেখিত। তাহার মনে হইত, এইবার হয়ত বাতাসী আসিতেছে।
এমনই করিয়া কিছুদিন গেল। একদিন অপরাহ্ণে বড় ঝড় উঠিল। বেলা তিনটা হইতে আকাশে মেঘ সাজিতেছিল। চারিটা বাজিতে না বাজিতেই ঝড় উঠিল – যেমন ঝড় তেমনই বৃষ্টি। ইছামতী নদী গর্জন করিতে লাগিল, চারিদিক অন্ধকার হইয়া গেল। আকাশে প্রলয়ের মেঘ গর্জিতে লাগিল। স্বরূপ খেয়া নৌকাখানি ডবল কাছি দিয়া তীরে সংলগ্ন করিল। বৃষ্টিতে তাহার কাপড় ভিজিয়া গেল। সে তখন তাড়াতাড়ি তাহার কুটীরে যাইয়া আশ্রয় গ্রহণ করিল। ভিজা কাপড় ছাড়িয়া এক ছিলিম তামাক সাজিয়া স্বরূপ ধূমপানের আয়োজন করিতেছে, এমন সময় বাহিরে যেন একটি শব্দ হইল ; স্বরূপ কান পাতিয়া শুনিল, কে যেন ঘরের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার পরেই অতি কোমলকন্ঠে কে ডাকিল “স্বরূপ”?
এ যে চেনা গলা ! এই কন্ঠস্বর শুনিবার জন্য স্বরূপ যে আজ কতদিন কান পাতিয়া প্রতীক্ষা করিতেছিল ! কিন্তু আজ এ কি ? এমন অসময়ে, এই দুর্যোগে, প্রবল ঝড়বৃষ্টি মাথায় করিয়া বাতাসী আসিবে কেন ? না, না, বাতাসী নয় ! স্বরূপ মনে করিল তাহার ভ্রম হইয়াছে। এই ঝড়ে দুর্দিনে বাতাসী তাহার কুটীরে দ্বারে আসিবে। তাও কি হয় ! তবুও স্বরূপ কান পাতিয়া রহিল। হায় মোহ ! এবার শব্দটি আরও একটু স্পষ্ট হইল। কে ডাকিল, “স্বরূপ স্বরূপ ঘরে আছ ?” আর ত সংশয় নাই। এ নিশ্চয়ই বাতাসীর কন্ঠস্বর। স্বরূপ তখন তাড়াতাড়ি হুঁকা রাখিয়া দ্বার খুলিল। দেখিল দ্বারের সম্মুখে বাতাসী একটি ঝুড়ি মাথায় করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। তাহার সর্বাঙ্গ সিক্ত ও কর্দমাক্ত।
স্বরূপ আর বাতাসীকে কথা কহিবার অবকাশ দিল না। তাড়াতাড়ি তাহার মস্তক হইতে মাছের ঝুড়ি নামাইইয়া লইল, এবং তাহার হাত ধরিয়া ঘরের মধ্যে টানিয়া আনিল। তাহার পর সে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তখন বাতাসী বলিল, “স্বরূপ, আমায় পার করে দেবে ? আমাকে এখনই ওপারে যেতে হবে।” পার ! এমন ভয়ানক দুর্যোগে, এই ঝড়ে পার ! বাতাসী বলে কি ? এই প্রলয়ের ঝড়ে পার করিতে হইবে – তাও যাকে তাকে নয়, বাতাসীকে ! বাতাসী বলে কি ?
স্বরূপ কথাটা হয়ত শুনিতে পায় নাই মনে করিয়া বাতাসী আবার বলিল, “স্বরূপ ! আমায় পার করে দেবে !” স্বরূপ বলিল, “বাতাসী ! তোমাকে পার করাবার জন্য আমি ত দিনরাত পথ চেয়ে আছি। তুমি ত আমার খেয়ায় পার হতে এস না বাতাসী ?” বাতাসী কোমলস্বরে বলিল, “স্বরূপ আমাকে পাঁচটার মধ্যে এই মাছ ওপারে মুখুজ্যে বাবুদের বাড়ি দিতে হবে। তিন টাকা বায়না নিয়েছি। আমাকে যেতেই হবে। ও – ঘাটে গিয়েছিলাম তারা এ ঝড়ে খেয়া দেবে না। তাই বিপদে পড়ে তোমার কাছে এসেছি। তুমি আমায় পার করে দাও। আজকের এই ঝড়ে তুমি ছাড়া আর কেউ পারে যেতে সাহস করবে না।” এই বলিয়া বাতাসী স্বরূপের মুখের দিকে চাহিল। স্বরূপ এমন রূপ আর কখনও দেখে নাই ; এমন কথাও আর কখন শোনে নাই। সে বলিল, “বাতাসী, তোমায় পারে নিয়ে যাব, তার আর কথা কি ? কিন্তু তোমার না গেলে হয় না ? তুমি এইখানে থাক, আমি ওপারে মাছ পৌঁছে দিয়ে আসি। বড় তুফান বাতাসী, আজ বড় তুফান।” বাতাসী বলিল, “তা হবে না স্বরূপ ! তুমি যে একলা এই ঝড়ে আমার জন্য পারে যাবে, তা হবে না ; আমিও যাব। চল আর দেরী করো না, ঝড় ক্রমেই বাড়ছে”।
স্বরূপ বলিল, “বাতাসী আমার জন্য তোমার ভয় ! এ কথা ত আর কখনও বলনি। চল তোমাকে আজ পারে নিয়ে যাই। স্বরূপ হালদার আজ ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে পাড়ি মেরে দেবে চল, আজই তোমার নিয়ে পারে যাবার সময়”। স্বরূপের চক্ষু দিয়া আগুণ বাহির হইতেছিল। সে তখন মাছের ঝুড়ি মাথায় তুলিয়া লইল। বাতাসী দুইখানি বৈঠা লইল।
নদীর মধ্যে কি যাওয়া যায় ? অনেক কষ্টে তাহারা নৌকায় উঠিল। স্বরূপ একবার আকাশের দিকে চাহিল ; তাহার পর নৌকার কাছি খুলিয়া দিল। নৌকা নাচিয়া উঠিল। স্বরূপ বলিল, “বাতাসী, ওখানে নয় ; আমার এই হালের কাছে এসে বোসো। দেখ, স্বরূপ তোমায় পারে নিয়ে যেতে পারে কিনা ?” সত্যসত্যই স্বরূপ আজ ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে করিতে অগ্রসর হইতে লাগিল। বাতাসী থাকিয়া থাকিয়া বলে, “বাঁয়ে স্বরূপ, বাঁয়ে টান রেখো।” “ঐ ঢেউটা কেটে ওঠো” আর বিহ্বল দৃষ্টিতে সে এক একবার স্বরূপের দিকে চায়। কি অপূর্ব কৌশল ! কি আশ্চর্য শক্তি। স্বরূপ নিজে নিজেই বলিতে লাগিল, “চল মোর ভাই, আর একটু, আর একটু, ঐ ঢেউটি কাটাতে পারলেই হয়” “সাবাস জোয়ান” ! নিজের বলবৃদ্ধির জন্যই স্বরূপ কথা কহিতেছে। যখন এক একবার সে ক্লান্ত হইয়া পড়ে, তখন সে বাতাসীর মুখের দিকে চায়, আর তাহার বুকে নূতন করিয়া বল আইসে।
ঝড় বৃষ্টির সহিত তুমুল সংগ্রাম করিয়া স্বরূপের নৌকা পারে পঁহুছিল। স্বরূপ এক লম্ফে তীরে নামিয়া নৌকা টানিয়া ধরিল ; তাহার পর নদী – তীরের বটগাছের সঙ্গে নৌকার কাছি বাঁধিল। তখনও সন্ধ্যা হয় নাই। স্বরূপ ক্লান্ত হইয়া নদীতীরে বসিয়া পড়িল। তখন বৃষ্টি পড়িতেছে। বাতাসী তখন স্বরূপকে বলিল, “স্বরূপ, আজ আর ওপারে গিয়ে কাজ নেই। নৌকা এখানেই থাক্ তুমি উপরে চল ; বাজারের একটি দোকানে আজ তুমি থেকো। আমার সঙ্গে তো কিছুই নেই। বাবুদের বাড়ি যে টাকা পাব, তার থেকে কিছু তোমায় দিয়ে আসব ; তুমি খেয়ে দেয়ে রাত্রিটা কাটিয়ে দিও। আমি বাবুদের বাড়ির এক কোণে পড়ে থাকব। কি বল ?” স্বরূপ উঠিয়া দাঁড়াইল ; বলিল, “তা হবে না বাতাসী ! তোমাকে না নিয়ে আমি কোথাও যাব না। তোমায় পারে এনেছি, তোমায় ঘরে নিয়ে যাব। যতক্ষণ তুমি না আসবে, ততক্ষণ পথের দিকে চেয়ে আমি এই খেয়া নৌকায় বসে থাকব। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও মরব না”। বাতাসী হাসিয়া বলিল, “আর যদি আমি না আসি।” স্বরূপ বলিল, “তা হ’লে স্বরূপেরও এ জীবনের মত খেয়া দেওয়া শেষ। আর স্বরূপ কাউরে পার করবে না। যাকে পার করবার জন্যে সে এতদিন বেঁচে ছিল, সে যদি আর পারে না যায়, স্বরূপের খেয়া দিয়ে কাজ কি ?” বাতাসী মাথা নীচু করিয়া কি ভাবিল ; তাহার পর বলিল, “তুমি নৌকায় থাক ; আমি মাছ পৌঁছে দিয়ে আস্ছি ; তারপর দু’জনে ঘরে যাব”। এই বলিয়া বাতাসী মাছের ঝুড়ি মাথায় করিয়া তীরে উঠিল, স্বরূপ এক দৃষ্টে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। বাতাসী যখন অদৃশ্য হইল, তখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সে নৌকার উপর বসিয়া পড়িল।
যখন সন্ধ্যা হয় – হয়, তখন বাতাসী ফিরিয়া আসিল। তখন আকাশে আরও একখানা কালো মেঘ উঠিতেছিল। নদীতীর অন্ধকার, ঘাটে একখানিও নৌকা নাই। বাতাসী ডাকিল, “স্বরূপ।” স্বরূপ উত্তর দিল, “বাতাসী।”
এক লম্ফে নৌকা হইতে স্বরূপ বাতাসীর নিকট উপস্থিত হইল। বাতাসী আকাশের নূতন কালো মেঘখানি দেখাইয়া বলিল, “স্বরূপ ! ও মেঘখানি বড় ভালো নয়, মেঘের গতিক দেখে নৌকা ছাড়লে হ’তো।” স্বরূপ মেঘখানির দিকে চাহিয়া বলিল, “ও কিছু নয়, ও মেঘ উঠে আসতে আসতে আমরা পাড়ি জমিয়ে দেব। ঐ ত ওপারের ঝাউগাছ দেখা যাচ্ছে। দেখতে দেখতে চলে যাব। তুমি নৌকায় উঠে ভাল করে বস। কোনো ভয় নাই।” বাতাসী বলিল, “স্বরূপ, মেঘখানি একটু দেখে গেলেই হত। এখনই তুফান উঠবে। আকাশের গতিক ভাল নয়।” স্বরূপ সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া নৌকা ছাড়িয়া দিল। সিকিখানি নদী যাইতে না যাইতেই একেবারে আকাশ ভাঙ্গিয়া ঝড় আসিল। স্বরূপ বলিল, “বাতাসী ভয় নেই ; ঐ ডাঙ্গা দেখা যাচ্ছে। দেখতে দেখতে যাব।”
বাতাসী একটু দূরে বসিয়া ছিল ; সে তখন স্বরূপের আরও একটু নিকটে আসিয়া বসিল। স্বরূপ সিংহবিক্রমে হাল চালাইতে লাগিল। এমন সময় হঠাৎ হালখানি ভাঙ্গিয়া গেল ; স্বরূপ জলে পড়িতে পড়িতে বাঁচিয়া গেল। নৌকা ঢেউয়ের উপর আছাড় খাইতে লাগিল। স্বরূপ তখন চীৎকার করিয়া বলিল, “বাতাসী এইবার নৌকা গেল, আর রক্ষা নাই। বৈঠা কৈ ?” তখন বৈঠা খুঁজিয়া পাওয়া যায় না ; তাহাদের অজ্ঞাতসারে বৈঠা দুইখানি জলে পড়িয়া গিয়াছিল। তখন স্বরূপ বলিল, “বাতাসী আর রক্ষার উপায় নাই। আমার জন্যে ভাবছি না বাতাসী ! কিন্তু আজ যে তুমি নৌকায় রয়েছ। তোমাকে যে আজ বাঁচাতে পারছি না, এ কষ্ট যে মরলেও যাবে না। বাতাসী, কেন তোমায় এই ঝড়ের মধ্যে নৌকায় তুলেছিলাম, কেন তোমার কথা শুনলাম না। আমিই তোমায় মেরে ফেললাম। বাতাসী, ঐ ঢেউটি আসছে, ঐ ঢেউয়েই আমাদের নৌকা ডুবা যাবে।”
বাতাসী তখন উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে। সে বলিল, “স্বরূপ আমি কি মরতে ভয় পাই। এস দুজনে আজ গলা জড়িয়ে ধরে মরি। আজ আমাদের বিয়ে ! স্বরূপ আজ আমাদের বিয়ে !” এই বলিয়া বাতাসী স্বরূপের গলা জড়াইয়া ধরিল। স্বরূপ আর কথা কহিতে পারিল না ; সে প্রাণপণ শক্তিতে বাতাসীকে বুকে জড়াইয়া ধরিল। বাতাসী তখন চীৎকার করিয়া বলিল, “স্বরূপ, চল আজ আমরা পারে যাই।” প্রকান্ড একটি ঢেউ আসিয়া নৌকাখানি আছড়াইয়া ফেলিল ; স্বরুপ ও বাতাসী দৃড় আলিঙ্গনে বদ্ধ হইয়া ইছামতীর গর্ভে ডুবিয়া গেল।
আজও বদনগঞ্জের লোকেরা স্বরূপ – বাতাসীর গল্প করে। যে ঘাটের সম্মুখে তাহাদের নৌকা ডুবিয়াছিল এখনও সকলে তাহাকে “স্বরূপ মাঝির ঘাট” বলিয়া থাকে।
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।