প্রায় দিনই মানুষটিকে একই সময়ে মেট্রো স্টেশনে দেখে চন্দ্রানী। সেই মানুষটিও চন্দ্রানীকে দেখে। একদিন সকালের মেট্রো রেলে অফিসের ব্যাগ্রতা ও ব্যস্ততার সময়ে নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে সেই মানুষটি চন্দ্রানীকে বসতে দেয়। চন্দ্রানীর এক হাতে ব্যাগ অন্য হাতে মস্ত বড় এক প্যাকেট। বসতে পেয়ে সুবিধেই হল। বসে পড়ে কৃতজ্ঞ হাসি হেসে চন্দ্রানী বলে, “ধন্যবাদ ! আজকাল কেউ কাউকে জায়গা ছেড়ে দেয়না। আমার হাত ভর্তি বোঝা, বসতে পেয়ে ভালো হল।”
ভদ্রলোক চন্দ্রানীর কাছাকাছি বয়সের। পরিণত যৌবনের দুটি নারী পুরুষ পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হল চলন্ত মেট্রো ট্রেনে, অফিস যাবার ব্যস্ততার মুহুর্তে।
চন্দ্রানী জানতে পারল পুরুষটির নাম শমীন্দ্র ধর। শমীন্দ্রও চলেছে তার কর্মক্ষেত্রে। প্রথম আলাপে আরও প্রশ্ন করা উচিত কিনা ভাবতে ভাবতে চন্দ্রানীর অফিসের কাছে সেন্ট্রাল স্টেশনে ট্রেন এসে থামল। চন্দ্রানী উঠে এগোতে দিয়ে দেখে শমীন্দ্রও তার সঙ্গে এগিয়ে আসছে নামবে বলে।
ট্রেন ছেড়ে গেলে অসংখ্য যাত্রী চলন্ত সিঁড়ির দিকে এগোতে থাকে। অফিস যাবার দেরি হয়ে যাচ্ছে জেনেও চন্দ্রানী সামান্য সময় সকৌতুক কৌতুহলে শমীন্দ্রকে প্রশ্ন করে, “আপনি তো এই স্টেশনে নামেন না, অন্যদিন তো এরপরেও এগিয়ে চলে যান, তাই না ?”
শমীন্দ্র চন্দ্রানীর চেয়ে কিছুটা লম্বা, দৈর্ঘ্যের কারণেই সামান্য ঝুঁকে তাকায় সে চন্দ্রানীর দিকে। বলে, তাও লক্ষ্য করেছেন ? আজই তো প্রথম পরিচয় হল আপনার সঙ্গে। আপনি জানলেন কী করে আমি এখানে নামি না ?”
চন্দ্রানী মৃদু হেসে বলে “আলাপ হল আজ, কিন্তু আমরা তো পরস্পরকে দেখছি অনেক দিনই !”
শমীন্দ্র বলে, “আমি যাব আরও দূরে, আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য নামলাম, একটি দুটি ট্রেন ছেড়ে দিয়ে পরের ট্রেনে উঠলেই হবে। আপনার অফিস ?”
চন্দ্রানী বলে, “আমি চন্দ্রানী রায়, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী, একটু এগিয়ে পোদ্দার কোর্টে আমার অফিস। আজ চলি। কাল অফিস যাবার সময় আবার দেখা হবে” – বলে আর অপেক্ষা না করে চন্দ্রানী হাতের প্যাকেট ও কাঁধের ব্যাগ নিয়ে দ্রুত এগোতে থেকে ভীড় ঠেলে।
শমীন্দ্র পিছন থেকে ডাকে “শুনুন” –
“কাল কথা হবে” – বলে চন্দ্রানী এগিয়ে যায়।
চন্দ্রানী রায়। সুশ্রী ও মধ্য যৌবনা, বিবাহিতা, কিন্তু স্বামী থাকে না তার সঙ্গে, চন্দ্রানীর একটি কন্যা আছে, মাত্রই সাত বছর বয়স তার। স্কুলে যায়, আঁকা শেখে, গান শেখে, বাড়িতে ঠিক একা থাকে না, সর্বক্ষণের কাজের মাসী থাকে তাদের সঙ্গে। চন্দ্রানীর স্বামী অসিতেশ যে তাঁর সঙ্গে আজকাল থাকে না, অফিসে বদলির অছিলায় সে যে তার প্রিয় সঙ্গিনী রনিতার সঙ্গে অন্যত্র থাকে, একথা নিজের মাকে এবং ছোট বোন ইন্দ্রানীকেও সে জানায় নি।
অফিসে পৌঁছে কাজের স্তূপের মধ্যে ডুবে যায় চন্দ্রানী। চন্দ্রানী নিজের কাজের ব্যাপারে খুব সতর্ক ও সচেতন। সে জানে এই চাকরি টুকুই তাকে এবং তার কন্যা বৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রেখেছে এবং বাঁচিয়ে রাখবে। বৃষ্টি নাম তার নিজের রাখা, তার মা মনোরমা এবং বোন ইন্দ্রানী, তার বর অসিতেশ কারোরই বৃষ্টি নাম পছন্দ ছিল না। সে জেদ করে এই নাম রেখেছে।চন্দ্রানীর সবচেয়ে প্রিয় ঋতু হল বর্ষাকাল। বৃষ্টি ঝরো ঝরো শব্দ তার খুবই প্রিয়, বর্ষার গান তার প্রাণ, তাই একমাত্র নয়নের মনি মেয়েটির নাম রাখে চন্দ্রানী ‘বৃষ্টি’।
খুবই আশ্চর্য যে বৃষ্টি এবং বৃষ্টির মা চন্দ্রানী কেউই অসিতেশকে বেঁধে রাখতে পারেনি পুরোনো সম্পর্কে। নতুন সম্পর্কের টানে ভেসে গিয়েছে অসিতেশ। দূরে সরে গিয়েছে তাদের জীবন থেকে। মা মনোরমা মাত্র দু বছর আগে স্বামীকে হারাবার শোক পেয়েছেন। এখনও একলা কাঁদেন মনোরমা। মনোরমাকে নিজের দুঃখের কথা বলতে চায়না চন্দ্রানী। শুধু দুঃখের নয়, লজ্জারও কথা বটে এটা। মনোরমা ফোন করলে সে বলে আসিতেশ অফিসের কাজে বাইরে গেছে। অনেকদিন মনোরমা এদিকে আসেন না। মনোরমা সরাসরি এসে পড়লে কী বলবে সে মনোরমাকে, তা ভেবে পায়না চন্দ্রানী। সে জানে যে একদিন সব কথা জানাজানি হয়ে যাবে। গোপনীয়তার কিছুই আর বাকী থাকবে না। তবু যতদিন পারে সে তার এই পরাজয়ের কাহিনী, এই লজ্জা আত্মীয় পরিজনের থেকে আড়াল করে রাখতে চায়।
শমীন্দ্র আর চন্দ্রানী একসঙ্গে পথ হাঁটছে। চন্দ্রানীর অফিসের সামনে ছুটির সময় শমীন্দ্র এসে দাঁড়িয়েছে। দুজনে হেঁটে রেঁস্তরায় গিয়ে বসে। একটি পর্দা ঢাকা কেবিনের অল্প আলো আঁধারির ভিতর বসে পড়ে দুজনে। শমীন্দ্র চা এবং হাল্কা খাবার অর্ডার দেয়।
চন্দ্রানী শমীন্দ্রর দিকে তাকিয়ে হাসে, বলে, “এটা অফিস পাড়া। যে কোনও সময় যে কোনও চেনা লোক এসে যেতে পারে।”
শমীন্দ্র দুই দিকে দু’হাত প্রসারিত করে দেয়। একটু বিষন্ন হাসে, বলে, “আমরা কোনও অন্যায় করছিনা। চেনা লোক দেখলো তো কী হয়েছে ?”
বলতে বলতে রেস্তঁরায় বয় এসে খাবার দিয়ে চলে যায়। দুজনেই অফিস করে মৃদু ক্ষুধার্ত, খাবারের দিকে মন দেয়।
চা এলে, চা খেতে খেতে চন্দ্রানী প্রশ্ন করে – “কী হয়েছিল তোমার স্ত্রীর ? বাচ্চা হতে গিয়ে মারা যায় ? বাচ্চাটা বাঁচে নি ?”
দুই হাত দিয়ে নিজের চুলের গোছ চেপে ধরে শমীন্দ্র, সামান্য বড় চুল রাখে সে। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, “না, মা এবং বাচ্চা কাউকেই বাঁচাতে পারেনি তোমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা। আমাকে সর্বশ্রান্ত করে দিয়ে গেছে ওই মৃত্যু।” রেঁস্তরার মধ্যে চন্দ্রানী তার ডান হাত দিয়ে শমীন্দ্রর ডান হাত খানি ধরে। মুখে বলে, “সরি ! আমি বুঝতে পারিনি ! এতখানি ব্যথার জায়গা, আমার হাত দেওয়া উচিত হয়নি।”
চন্দ্রানীর ধরা হাতখানি নিজের হাত দিয়ে ধরে নেয় শমীন্দ্র, মুখে বলে, “না ; যদি বন্ধু হই, যদি পরস্পরকে ভালো লেগে থাকে আমাদের, তবে পরস্পরের সব দুঃখ সুখের কথা তো জানতেই হবে। এই নিয়ে চতুর্থ দিন আমাদের কথা হল। বলো, কতখানি টান থাকলে চতুর্থ দেখা হওয়ার দিনে আমরা নিরালা রেঁস্তরায় এসে বসতে পারি ? পরস্পরকে ভালো লাগে, এই সত্যটি স্বীকার করা দরকার পরস্পরের কাছে, তাই না ?”
চন্দ্রানী হেসে মাথা সামান্য হেলিয়ে দেয় শমীন্দ্রের কাঁধে। শমীন্দ্র নিজের ব্যগ্র ও তৃষিত ঠোঁট নামিয়ে আনে চন্দ্রানীর দুটি ঠোঁটের উপর। প্রথম ও দীর্ঘ চুম্বনে পরস্পরকে অনুভব করে তারা। শমীন্দ্র বুঝতে পারে দীর্ঘ উপবাসে তৃষিত রয়েছে তার পুরষ প্রেমিক সত্তাটি। উপবাসী ও ক্ষুধিত ব্যগ্রতা নিয়ে যে চন্দ্রানীকে আরও একবার চুম্বন করে। সন্ধ্যা ঘন হয়ে এসেছে, রাত্রি আটটা বাজে প্রায়। দুজনে বিল মিটিয়ে রেঁস্তোরা থেকে বাইরে এসে দাঁড়ায়।
মনোরমা শিক্ষকতার থেকে এখনও অবসর নেননি। তাঁর সংসারে তিনি এবং তাঁর ছোট কন্যা ইন্দ্রানী। মনোরমার বয়স এখন আটান্ন, তাঁর প্রথম সন্তান চন্দ্রানী হয় তাঁর তেইশ বছর বয়সে। কুড়ি বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মনোরমার। তখনকার দিনে বি, এ পাশ করা মেয়ে, দেখতেও সুশ্রী ছিলেন, পাত্রের অভাব হয়নি। বিয়ের পর শিক্ষকতার কাজে যোগ দিয়েছিলেন মনোরমা। শ্বশুরবাড়ির থেকে যে কিছু আপত্তি অভিযোগ ওঠে নি তা নয়, ছোট বাচ্চা রেখে বৌমার শিক্ষায়িত্রী হওয়াটাকে শ্বশুরমশাই প্রসন্ন মনে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর পার্শ্বিকতার ধারণায় এই সব ঘটনা কল্যাণকর বলে মনেই হয়নি। ছোট শিশু বাচ্চা রেখে মা যাবে চাকরি করতে, এটা মোটেই পছন্দ ছিল না শ্বশুরমশাই রুদ্রদেববাবুর। কিন্তু আশ্চর্য সহযোগ পেয়েছেন মনোরমা তার শাশুড়ি মা সুপ্রভাদেবীর কাছে। তিনিই বলেছিলেন, “হ্যাঁ যাবে বৌমা মাষ্টারি করতে ! আমরা চাকরি করার সুযোগ পাইনি। ওরা পাচ্ছে, এটাকে অবহেলা করা উচিত নয়। চন্দ্রানী আমার নাতনি সে আমার আদরের জিনিস, আমার কাছে থাকবে, কাজের মাসী আছে সে দেখভাল করবে। হ্যাঁ, যাবে বৌমা চাকরি করতে।”
সেই শুরু। মনোরমার চাকরি জীবন আরম্ভ। তারপরও একটি সন্তান হয়েছে মনোরমার, ছোট মেয়ে ইন্দ্রানী, সব ঝামেলা ঝক্কি সামলেছেন তাঁর শাশুড়ি মা সুপ্রভা দেবী। এই জীবনে যতখানি কৃতজ্ঞতা তার জমা আছে এই নারীটির কাছে, তেমন আর কোথাও নেই। আজ দশবছর হল এই মায়াটান ছেড়ে, পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন তিনি। মনোরমা বোঝেন বৃহৎ পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয়ের কারণে, নিজে সক্রিয় সমাজসেবার কাজ করার জন্য, রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে কম বয়সে যুক্ত থাকার কারণে সুপ্রভাদেবীর একটি বড়, প্রসারিত মন তৈরি হয়েছিল। তারই পরিণাম, মনোরমার প্রতি তাঁর মানবিক বিবেক সহিষ্ণু ব্যবহার। কাজের লোক রাখা সত্ত্বেও মনোরমা জানেন সুপ্রভাদেবী ছিলেন বলেই তাঁর দুই মেয়ে সুন্দর ভাবে মানুষ হয়েছে। নিজের শোবার ঘরে সদ্য প্রয়াত স্বামী এবং শাশুড়ি মা, – দুজনের ছবিই টাঙিয়ে রেখেছেন মনোরমা। মালাও দেন তাতে মাঝে মধ্যে। ধূপ জ্বেলে দেন নিত্য দিন সেই ছবি দুখানির তলায়।
ইন্দ্রানী স্কুল সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছে এই সাংঘাতিক বেকারত্বের যুগে, – এটি একটি সুসংবাদ বৈকি ! মা ও মেয়ে দুজনেই চাকরিতে বেরিয়ে যায় বলে সর্বক্ষণের একজন মহিলাকে কাজে রাখার কথা ভাবছেন মনোরমা। বলেছেন অনেককে, পাচ্ছেন না ঠিকঠাক।
সেদিন রবিবার সকাল আটটা, ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল ল্যান্ডফোন। মনোরমা এগিয়ে গিয়ে ফোন ধরলেন, ওপারে মনোরমার ছোট বোন সুরমা। সুরমা বলে, “হ্যালো, দিদি, তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে।”
ব্যস্ত ও উদ্বিগ্ন মনোরমা বলেন, “হ্যাঁ বল্, কী হয়েছে ? তোরা সব ভালো আছিস তো ?”
সুরমা বলে “আমরা সবাই আছি একরকম। কিন্তু একটা সাংঘাতিক খবর শুনলাম, দিদি।”
মনোরমা অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করেন, “কী খবর বলবি তো ! কার, খবর, কোন বিষয়ের খবর সব ঠিকঠাক বল্ ”
সুরমা বলে, “আমি শুনলাম অসিতেশ, চন্দ্রানীর বর, আর চন্দ্রানীর সঙ্গে থাকে না। বদলির অছিলায় অন্য মহিলাকে নিয়ে বাইরে থাকছে আজকাল। খবরটা বোধহয় মিথ্যে নয়। কেননা খবরটা যিনি দিয়েছেন তিনি বাজে কথা বলার লোক নন। তুই দিদি, ঠিকঠাক খবর নে ; আমি তো চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি মেয়েটার কথা ভেবে।”
এপার থেকে মনোরমা বলেন, “এসব কথা কী করে সত্যি হয় ? এতবড় একটা ঘটনা আর মেয়েটা আমায় কিছুই জানাল না, – তাই হয় নাকি ? অসিতেশ এই রকম করবেই বা কেন ?”
ওপার থেকে সুরমা বলে, “মতিভ্রম রে দিদি, মতিভ্রম। ‘যার সঙ্গে যার মজে মন কিবা হাঁড়ি কিবা ডোম’ – বলে না কথায় ? অফিসের ওই মেয়েটা শুনেছি একদম গন্ডোগোলের মেয়ে। অসিতেশ জড়িয়েছে কোনও উল্টোপাল্টা বাঁধনে। মানুষের মন না মতিভ্রম।
মনোরমা বলেন, – “এসব রটনা ! মিথ্যেকথা। আমি বিশ্বাস করিনা। আমি নিজে গিয়ে মেয়ের সংসারে কী ভাঙন ধরেছে, আদৌ ধরেছে কিনা দেখে আসব। ছাড় ওসব কথা। নিজে গিয়ে সব বুঝে আসব আমি। তোরা সব ভাল আছিস তো ?
“ভালো আর কী করে থাকি দিদি বল্। চন্দ্রানী আমাদের এত আদরের মেয়ে, তার এই অবস্থার কথা শুনে, আমি, আমরা ভালো নেই, রে।” উত্তর দেয় সুরমা।
“আচ্ছা এখন রাখ্ছি,” – বলে ফোন রেখে দেন মনোরমা। মনোরমা জীবনের হাতে পোড়খাওয়া, ঘা সহা মানুষ, তিনি অনেক আপাত ঘটনার মধ্যে নিহিত গূঢ় তাৎপর্য ধরতে পারেন। তাঁর এই ছোট বোনটি খুবই পরচর্চাপ্রবন। আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু- বান্ধব সকলের হাঁড়ির খবর রাখাই তার কাজ। এই টেলিফোনের পিছনে চন্দ্রানী সম্পর্কে তার উদ্বেগ যতখানি ঠিক ততখানিই কৌতূহল কাজ করছে, টের পায় মনোরমা।
রাত্রে খেতে বসে কন্যা ইন্দ্রানীর সঙ্গে কথা বলেন মনোরমা। নিজেই তোলেন চন্দ্রানীর প্রসঙ্গ, বলেন, “ইন্দা আজ তোর ছোটমাসী ফোন করেছিল একটা বড় অদ্ভূত খবর শোনাল, আমি তোর সঙ্গে কথা বলে তবে চন্দ্রাকে ফোন করব, দরকার হলে চন্দ্রার বাড়িতে যাব, ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে দুদিন থাকলেই সব সত্য জানতে পারব।”
ইন্দ্রানী কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গে তার মায়ের মুখের দিকে তাকায়, বলে, “কী হয়েছে ? দিদির কী হয়েছে মা ? গত কালই তো দিদির সঙ্গে আমার ফোনে কথা হল, কই, কিছু হয়েছে বলে তো মনে হল না।”
মনোরমা দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে বলেন, চন্দ্রা বরাবরই অত্যন্ত চাপা স্বভাবের মেয়ে। “সুমি, তোর ছোট মাসী জানাল জামাই অর্থাৎ অসিতেশ নাকি বদলির অছিলায় অন্য মহিলাকে নিয়ে বাইরে অন্য কোথাও থাকছে। চন্দ্রার সঙ্গে আর থাকে না অসিতেশ। আমি তো শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছি। এত বড় একটা ঘটনা। মেয়েটা আমাকে কিছু বলেনি ! আমি তখনই একবার ফোন করতে যাচ্ছিলাম ; পরে ভাবলাম যে মেয়ে নিজের থেকে এত বড় ঘটনা চেপে যায় – সে মেয়ে ফোনে আমাকে কিছুই জানাবে না। তুই কী বলিস্। সোজাসুজি চলে যাবো ওর বাড়িতে ? তুই যাবি আমার সঙ্গে ?”
ইন্দ্রানী একই সঙ্গে বিস্মিত এবং ব্যাথিত হয়েছে এই সংবাদ শুনে। সে তার দিদিকে ভালোবাসে। আর চায় তার চাপা স্বভাবের দিদিটির ভালো হোক্। দিদি ভালো থাকুক এটাও সে চায়। সে বলে, “হ্যাঁ, চলো, সামনের শনিবার পরশু স্কুল ছুটির পর ওকে কিছু না জানিয়ে চলে যাই। হঠাৎ গিয়ে পড়লে সত্যি খবরটা জানা যেতে পরে।”
মনোরমাও তাই ভাবেন, আগে থেকে কিছু না বলে যাওয়াটাই বুদ্ধির কাজ হবে। রাত্রে শুয়ে পড়েছেন মনোরমা। মা ও ছোট মেয়ে ইন্দ্রানী এক খাটে শোয়। বড় খাট, দুজনের পক্ষে পর্যাপ্ত বড়। এই খাটে মনোরমা তাঁর দুই কন্যাকে নিয়ে শুয়েছেন এক সময়, পাশে থেকেছেন তাঁর স্বামীও।
রাত্রে শুয়ে শুয়ে ঘুম আসছিল না মনোরমার। এ পাশ ও পাশ করছিলেন। বুঝছেন তাঁর মেয়ে ইন্দ্রানীও ঘুমোয়নি। আধো অন্ধকার ঘরে ম্লান আলো জ্বালছে। ইন্দ্রানী উঠে বসে বিছানায়। বলে, “মা তোমাকে একটা কথা বলছি, শোনো রাগ করবে না, আমি মন ঠিক করে ফেলেছি আমি অনির্বাণকে ভালোবাসি ওকেই আমি বিয়ে করব, এখনি নয়, তবে বিয়ে করলে অনির্বাণকেই করব।”
এতরাতে এই খবর শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না মনোরমা। অনির্বাণ তাঁর মেয়ের ছোট বেলার বন্ধু, একসঙ্গে কোচিং – এ পড়তে যেত।অনির্বাণ একেবারে বেকার ছেলে, এখনও পর্যন্ত চাকরি পায়নি। ব্যবসা- পত্র করার দিকেও মনোযোগ নেই। পাড়ার ক্লাবে আড্ডা মারে আর গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করে। কী একটা লিটিল ম্যাগাজিনও করে ওরা কয়েকজন বন্ধু মিলে। তাঁর মেয়ে অমন ছেলের গলায় মালা দেবে, যে নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি আজও ?
মনোরমা খাট থেকে বেরিয়ে এসে ঘরের আলো জ্বেলে দেন। রাত্রি বারোটা বাজে। পাড়ার প্রায় সবাই শুয়ে পড়েছে। এই মফঃস্বল পাড়ার দু– একটি বাড়িতে এখনও আলো জ্বলছে।
মনোরমা আলো জ্বেলে দিয়ে বিছানায় এসে আবার বসেন। মেয়ের মুখের দিকে তাকান। দু– মুহূর্ত তাকিয়েই থাকেন। এত রাতে এ কী সংবাদ শোনাল তাঁর মেয়ে তাঁকে ? একেবারে কাঠ–বেকার একটি ছেলে, তাকে জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নিচ্ছে তাঁর শিক্ষিত বুদ্ধিমতী আধুনিকা কন্যা ?
দুই কন্যা দুই রকম ভাবে তাকে বিব্রত, বিপর্যস্ত করে দেবে নাকি ?
তিনি শুধু শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করেন, “যা করছ ভেবে করছ তো ? এই বিয়ের, এই সব বিয়ের পরিনাম ভালো হয় না, ইন্দ্রা।
ইন্দ্রানী বিছানায় বসে দুদিকে মাথা ঝাঁকায় বলে, “কোন্ বিয়ের কী পরিণাম তা কি আমরা কেউ জানি ? আমরা পরস্পরকে ভালোবেসেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মা। অনির্বাণ মানুষ ভালো, আর চিরদিন কেউ বেকার থাকে না। এখন শুয়ে পড়ো, কালকে দুজনেরই স্কুল রয়েছে। রাত অনেক হল মা, শোও, শুয়ে পড়ো।
পাশ ফিরে চোখে হাত চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ে ইন্দ্রানী। আলো নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় ফিরে আসেন মনোরমা। উদ্বেগ উৎকন্ঠার ভিতর ঘুমিয়েও পড়েন একসময়।
Tags: কৃষ্ণা বসু, জীবন নামের মহাগ্রন্থ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।