গ্রহের বাকি সব শহরের মতন এই শহরটা লোকে পরিপূর্ণ ছিল না। এটা কুয়োয় ভর্তি ছিল। জ্যান্ত … তবে শেষমেশ ওগুলো কুয়োই।
কুয়োগুলো প্রত্যেকেই আলাদা রকমের ছিল। কেবল যে সব জায়গায় খোঁড়া হয়েছিল তাদের, তার প্রেক্ষিতে নয় বরং তাদের পাঁচিলের তুলনায়ও ওগুলো আলাদা ছিল ( কুয়োমুখ গুলো দিয়েই তারা বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখত)। মূল্যবান ধাতু ও মর্মরের প্রাচীর দিয়ে বাঁধানো জাঁকাল রত্নখচিত কুয়োও ছিল সেখানে। আবার সামান্য ইঁটকাঠ দিয়ে বাঁধানো কিংবা আরো সাধারণ কিছু ভাবে তৈরি স্রেফ গর্তওয়ালা কুয়োও ছিল।
শহরের বাসিন্দাদের যোগাযোগের সূত্র ছিল এক পাঁচিল থেকে অন্য পাঁচিল, আর খবরেরা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশদে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ত গোটা শহরে। একদিন সে শহরে একটা “ফ্যাশন” এল, যেটা নিশ্চিতভাবে অন্য কোনও মানুষের শহরেই জন্মেছিল। নতুন আইডিয়াতে বলা হল যে জীবিত প্রাণীদের বহির্জগৎ এর চেয়ে অন্তর্জগৎ নিয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে। ওপরচালাকি নয় বরং মূলগত হতে হবে।
এভাবেই কুয়োগুলো জিনিষ দিয়ে ভরাট হতে লাগল। কেউ রত্ন দিয়ে, কেউ বা সোনার মুদ্রা দিয়ে নয়ত মূল্যবান পাথরে ভরতে লাগল সেসব। যারা বেশি বাস্তববাদী তারা আবার সেগুলোকে ঘরে ব্যবহার করার বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম দিয়ে ভরতে লাগল। বাকিরা শিল্পকলার বস্তু যেমন গ্র্যান্ড পিয়ানো, দামি দামি ছবি কিংবা উত্তর আধুনিক ভাস্কর্য দিয়ে একাজ করল। শেষে বুদ্ধিজীবীরা বই, তত্ত্বমূলক প্রচারপত্র কিংবা ম্যাগাজিন পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যা দিয়ে ভর্তি করতে লাগল।
তারপর বহুদিন কেটে গেল। কুয়োগুলো এত ভরে গিয়েছিল যে সেগুলোতে আর কিছু ঢোকানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কুয়োগুলো সবকটা এক মাপের ছিল না। তাই কেউ এতেই সুখী হল, আবার কেউ বা ভাবল আর কীভাবে ভেতরটা ঠেসে আরো কিছু ঢোকানো যায়। কিছু কুয়ো প্রথম দলে ছিল। এতে তৃপ্ত থাকার চাইতে বরং তারা চাইল সেগুলোর জিনিষ নেবার ক্ষমতা বাড়ানো যায় কীভাবে। বেশিদিন যাবার আগেই এই আইডিয়াটা ছড়িয়ে পড়ল। সবকটা কুয়ো একসঙ্গে তাদের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে শুরু করল কী করে ভেতরে আরো কিছু ঢোকানো যায়।
একটা কুয়ো, আকারে ছোট আর শহরের কেন্দ্র থেকে কিছু দূরে অবস্থিত। সে দেখল তার সঙ্গী কুয়োরা তাদের ভেতরকে এবড়োখেবড়ো করে ভর্তি করে ফেলছে। সে ভাবল এভাবে যদি চলে তবে শিগগিরিই পাঁচিলগুলো এক রকমের হয়ে যাবে আর কেউ কারো নিজস্ব সত্তা খুঁজে পাবে না। হয়ত এই ভাবনা থেকেই সে ভাবল যোগ্যতা বাড়ানোর মানে হল বেড়ে ওঠা- তবে তা চওড়ায় নয় , গভীরতায়। জায়গাটাকে চওড়া করার থেকে গভীর করতে হবে বেশি। খুব শিগগিরিই সে আবিষ্কার করল যে ভেতরের যা অবস্থা তাতে বাড়ানোর কথা ভাবাই যায় না। যদি গভীর করতে হয় তাহলে সব বস্তু ভাসিয়ে দিতে হবে…
শূন্যতা দেখে প্রথমটায় খুব ঘাবড়ে গেল, তারপর যখন দেখল এ ছাড়া আর কোনও পথ নেই, সে করল। দখল মুক্ত হওয়ায় কুয়ো আস্তে আস্তে ভরতে লাগল। আর সেই ফাঁকে বাকী কুয়োরা ও যে সব জিনিষ ফেলে দিয়েছিল সেগুলো দিয়ে নিজেদের ভরতে শুরু করে দিল… একদিন যে কুয়োটা গভীরতায় বাড়ছিল একটা আশ্চর্য জিনিষ লক্ষ্য করল। ভেতরে, অনেক ভেতরে সে দেখতে পেল জল।
এর আগে কোন কুয়োই জলের চেহারা দেখে নি… কুয়োটা তার বিস্ময় কাটিয়ে সদ্য পাওয়া জলের সঙ্গে দেওয়াল ভিজিয়ে, প্রাচীরে জল ছিটকিয়ে খেলতে লাগল। আর শেষমেশ জল টেনে উপচে বাইরে নিয়ে এল। বৃষ্টির জলেও এমনি করে সেশহর ভেজে নি কোনদিন। বরং পরিমাণে কমই ছিল । এভাবেই কুয়োর চারপাশের জমিটা জলে নতুন প্রাণশক্তিতে জেগে উঠতে শুরু করল। তার ভেতরের নাড়ির বীজ ত্রিপত্র এবং ফুলে চাষের জন্য অঙ্কুরিত হতে লাগল। ক্রমে সামান্য চারা বড় হয়ে মহীরূহ হয়েছে। দূরের কুয়োগুলোর আশপাশের জীবন রঙিন হয়ে উঠতে শুরু করল আর ওকে ওরা “অর্কিড” বলে ডাকতে শুরু করল। সবাই তাকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করল এ জাদু হলো কী করে!
কোন জাদু না- “অর্কিড” বলল। ভেতরটা দেখা দরকার, গভীরে যাওয়া প্রয়োজন।
সবাই “অর্কিড” কে অনুসরণ করতে শুরু করল। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তারা সেই আইডিয়াটাকে অনুসরণ করল না যে গভীরে যেতে গেলে জায়গাকে খালি করে ফেলতে হয়। প্রতিবার আরো আরো জিনিষ দিয়ে ভর্তি করতে গিয়ে আরো ছড়িয়ে যেতে লাগল… শহরের অন্য প্রান্তে আর একটা কুয়ো এভাবে গভীরে যাবার ঝুঁকি নেবে ঠিক করল… সেখানেও জল এল।। সেখানেও জল উপচে পড়ে সে জনপদকে একটুকরো সবুজ মরুদ্যান করে তুলল।
জল ফুরিয়ে গেলে তুমি কি করবে? তাকে সবাই জিজ্ঞেস করল।
জানি না কি হবে- উত্তর এল।
তবে এখন যত জল টানব তত জল আসবে।
একটা বড় আবিষ্কারের আগে কয়েক মাস কেটে গেল। একদিন প্রায় অকস্মাৎই কুয়োদুটো দেখল তারা যে জল আবিষ্কার করেছিল সেই দুই জলই এক… এক নদীর জলই ভেতরে ভেতরে বয়ে একটা কুয়ো র সঙ্গে অন্য কুয়োকেও ভরিয়ে তুলেছে। তারা খেয়াল করল যে বিষয়টা তাদের একটা নতুন জীবন দিয়েছে। শুধু যে বাকীদের মতই তারা এক পাঁচিল থেকে অন্য পাঁচিলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে। হয়ত বাহ্যিকভাবে তা নয়। কিন্তু এই খোঁজ তাদের মধ্যে যোগাযোগের এক নতুন ও গোপন দিক খুলে দিয়েছে।
গভীর যোগাযোগ তাদের মধ্যেই হয় যারা সাহস করে বিষয় শূন্য হয় এবং নতুন কী দিতে পারে তার জন্য গভীরে যায়।
খোরখে বুকাই/লেখক পরিচিতি
১৯৪৯ সালে আর্জেন্টিনায় জন্ম হয় প্রথিতযশা লেখক খোরখে বুকাই-এর। একজন সাইকো থেরাপিস্ট হিসাবে মানুষের মনের অন্ধিসন্ধি ছিল তাঁর নখদর্পণে। সম্ভবত তাই তাঁর সৃষ্টির ভেতরেও এত অসাধারণ ভাবে মিশে থাকে সরলতা ও প্রজ্ঞা। তাঁর লেখা সম্পর্কে সমালোচকেরা দ্বিধাবিভক্ত। ওসভালদো কিরোগা বলেন, তিনি একজন প্রাথমিক শ্রেণীর ও মাঝারি মাপের লেখক। বিপরীতে অন্যরা বলেন, এই কথাসাহিত্যিক মানুষের মুখের ভাষাকে ঝরঝরে ভাবে তাঁর কলমের ডগায় আনেন। জীবনকে বোঝার জন্য, শান্তিতে বেঁচে থাকার জন্য, তাঁদের চিন্তার আকাশ বাড়ানোর জন্যই তাঁর লেখা। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই লেখক বর্তমানে আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেস শহরে থাকেন।
অনুবাদ – জয়া চৌধুরী
জয়া চৌধুরী মূলত অনুবাদক। মূল স্প্যানিশ ভাষা থেকে বাংলায় এযাবৎ প্রকাশিত হয়েছে পাঁচটি অনূদিত বই ও বাংলায় যৌথভাবে একটি মৌলিক কবিতার বই। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিত অনুবাদ করে থাকেন। অবসরে প্রবন্ধ ও কবিতা লেখেন বাংলায়। সেগুলিও নিয়মিত প্রকাশিত হয় বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও ব্লগে। প্রিয় শখ নাটক করা। স্প্যানিশ ভাষা শেখান রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল অফ ল্যাঙ্গুয়েজ এবং শিবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
Tags: কুয়োর শহর, খোরখে বুকাই
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।