তখনও ‘উড’-কালচার শুরু হয়নি। মানে হলিউড, বলিউড, টলিউড–এসব আর কি। তখনও সিডি, ডিভিডি, ক্যাসেট জন্ম নেয় নি। মানুষ সিনেমাকে ‘ফিলিম’ বলতেই অভ্যস্ত। অন্তত আমাদের দেশের সাধারণ মানুষেরা তো বটেই। তারা বলত ‘বোম্বের ফিলিম’ আর ‘আংরেজি ফিলিম’। আর বাংলা কিন্তু হলে ‘বাংলা বই’। এইসব সময়ে হল মানে সিনেমা হল – মানে এক রহস্যময় জগৎ। আর পর্দায় চলা হিরো–হিরোইন সব স্বপ্নের জগতের রহস্যময় নর–নারী। তাদের নিয়ে চর্চার জায়গা শুধু আকাশবাণীর ‘বিবিধ ভারতী’ কিংবা সকালের বসুমতি, যুগান্তর বা আনন্দবাজার পত্রিকা। একজন নায়ক বা নায়িকাকে নিয়ে খবর আসতে আসতেই কত সময় অপেক্ষা করতে হত। বাড়িতে বা পাড়ায় কত দুপুর টাটকা কল্পনার জাল বুনে কাটাতো কুসুম,অমিয়,লাবণীর মত সে যুগের নয়া জমানারা। সেইসব দিনের ‘ভুলে বিসরে গীত’ নিয়েই এই লেখা। সময়টা চল্লিশ–পঞ্চাশের দশক। তখনকার বোম্বে যে আজকের মুম্বই হয় নি। তখনও সেখানে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সিংহভাগ দায়িত্বই বাঙালিদের হাতে। সেইসব ‘গোল্ডেন মেমোরি’র এই স্লাইড–শো তে পাওয়া যাবে বেশ কিছু হারিয়ে যাওয়া গল্প। যে গল্প আজকের জমানা হাঁ করে গিলতে চায় তার জ্যেঠু-কাকুদের পাশে বসেই। আর তারা যাদের চুলে আমার মতন পাক ধরেছে এখনও ‘লুঙ্গি ড্যান্স’ শোনার চেয়ে রেডিও-এফ এম এর হাত ধরে পৌছে যায় পুরনো ফিলমি দুনিয়ায়, তারা আমার সঙ্গেই ঘুরে আসুন না পঞ্চাশের দশকের বম্বে ফিল্মি দুনিয়ার ঘর-কন্যের জগতে।
গল্প শুরু করতে গেলে ট্র্যাজিক কাহিনিই ভাল। কি জানি দেখবেন কাহিনি ট্র্যাজিক হলে কাহিনি শেষ হওয়ার পরও বেশ একটা মন কেমন করা আবেশ থাকে। রাজেশ খান্না মারা যাওয়ার বেশ কয়েকদিনের পরের ঘটনা। ধর্মতলার হিন্দুস্তান বিল্ডিং এর সামনেটায় ঋতুপর্ণদার সঙ্গে (প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ) দেখা। ‘প্রতিদিন’ যাবেন বলে গাড়ি পার্ক করাচ্ছেন। এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ উঠল রাজেশ খান্নার কথা। বললেন ‘দেখিস বাঙালি কয়েকদিন খুব কাঁদবে।’ আসলে বারবার মনে হয় বাঙালি কাঁদতে খুব ভালবাসে, তাই ট্র্যাজিডি বাঙালিকে ছাড়ে না কিছুতেই। কতভাবে দুঃখ করে সে । পুরনো দুঃখের কথা ভাবতে খুব ভাল লাগে আর কি ? আসলে ভাবুক জাতেরই এটা হয় বোধহয়। আজ বলা কথার কথক ছবির ফ্রেমে বন্দি হয়ে হাসছে। আর আমি তার দেখানো সুত্র ধরে চল্লিশের দশকের বোম্বাই ফিল্মি জগতের এক ট্র্যাজিক কাহিনীর শোনাতে বসেছি। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে আবার চোখ আটকে গেল, ঋতুপর্ণদার কথাই মনে পড়ল। সত্যি বোধহয় বোম্বের মাটিতে পা রাখতে গিয়ে ওঁকেই মিডিয়াম করলাম, ওরই এক প্রিয় জুটির কাহিনীর খোঁজে।
গীতা দত্ত, গুরু দত্ত। উল্টোও বলা যায়। কিন্তু আজকের বাঙালি প্রথমকে দিয়ে দ্বিতীয়জনকে চেনে। এই দত্তদের জীবনে ‘অমর প্রেম’ শব্দটা ছবি হওয়ার আগেই বাস্তবে ঘটে গিয়েছিল। সালটা ১৯৬৪। তারিখ ১০ই অক্টোবর। পরদিনের ইংরাজি কাগজ লিখেছিল Dutt was found dead in his bed. The cause of death was deemed a combination of alcohol and sleeping pills although a debate still lingers order whether his death was by accident or a successful suicide. এরপর কাহিনী খুব সোজা – গীতা দত্তর নার্ভাস ব্রেকডাউন। যন্ত্রণা ভুলতে অতিরিক্ত মদ্যপান শুরু। আর ১৯৭০ সালের ২০শে জুলাই মৃত্যু। কারণ সিরোসিস অফ লিভার। অর্থাৎ দুজনের মৃত্যুর ব্যবধান মাত্র ৮ বছর। বয়স? একজন গেলেন মাত্র ৩৯ বছরে। আর একজন মাত্র ৪১ বছর বয়সে। দুজন অনন্য প্রতিভাবানের অকাল মৃত্যু। আর দাম্পত্যজীবন মাত্র ১১ বছরের। (২৬মে ১৯৫৩ – ১০ই অক্টোবর ১৯৬৪) গুরু দত্ত – গীতা দত্তর জীবনের ট্র্যাজিক কাহিনী লিখতে বসে দুজনের স্মৃতি চারণাকে খুব গুরুত্ব দিতেই হবে। একজন – ভি.কে. মূর্তি, যিনি সিনেমাটোগ্রাফার হিসাবে কাজ করেছিলেন গুরু দত্তের প্রায় সব ছবিতে। তাঁর স্মৃতিচারণা খুব স্পষ্ট করে দেয় শেষ দিকের নিঃসঙ্গ মানুষটিকে। আর একজন হলেন আবর আলভি। যিনি একটি বিখ্যাত বইতে স্মৃতিচারনা করে গিয়েছেন তার দত্ত সাহাবকে নিয়ে। বইটির নাম ‘টেন ইয়ারস্ উইদ গুরু দত্ত’। পেঙ্গুইন বুক্স,ইন্ডিয়া বইটি একসময় প্রকাশ করেছিল। এই আবর আলভি মৃত্যুর কয়েক মূহুর্ত আগেও সঙ্গে ছিলেন। বইটিতে গুরুদত্তের মৃত্যুর আগের রাতের একটি সুন্দর বর্ণনা আছে। যদিও ভি. কে মূর্তি তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন গুরুদত্ত এর আগেও দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। আর এক জায়গায় তিনি লিখেছেন – Whenever there was a call from his home, some production people and I would run to his house and rush his to the hospital. The third time he died.
সত্যিই বড় বিচিত্র মানুষের মন। শিল্পীর জীবন, শিল্পের শর্ত সবই রং বদলায় আপন খেয়ালে। আর খেয়ালি মানুষও হঠাৎ চুপ করে ভাবেন কেন গুরুদত্ত – ১৯৬২ সালে করতে গেলেন ‘সাহবে বিবি অউর গুলাম’ ছবিটা? ওর সঙ্গীর স্মৃতিচারণাও যে সিনেমাটিকে বর্ণনা করে একটি ‘Ghost directed film’ বলে। যেখানে কোন মন্ত্রবলে গীতা- গুরুর জীবনে এল ওয়াদিহা রহমান ? ভৌতিক ছোঁয়ায় কি বদলে গেল এক রোমান্টিক জুটির জীবন ?
লেখকের জন্ম, বেড়ে ওঠা শ্রীরামপুরে। সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশা শিক্ষকতা, লেখালিখি। নেশা ভ্রমণ ও নিবিড় সাহিত্যপাঠ। অন্য পরিচয় কবি ও ছোটোগল্পকার।
Tags: গীতা দত্ত, গুরু দত্ত, থ্রু – লেন্স, দেবাশিস মজুমদার
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।