ওরে!কি হোলো কি তোর আজ? মনের খিদেটা যে তোর মিটছে না কিছুতেই।
কি করে মিটবে এমন সুন্দর বসন্তের ভোর — মিহি আলোয় পরিপূর্ন আমেজ। – ফাঁকা পথে আমার দুইচাকার পক্ষীরাজে আমি একা সওয়ারী আবার আমিই তার সারথী। কাজেই সওয়ারীর মরজিমাফিকই প্যাডেল ঘুরছে পায়ের চাপে — কখনও ধীরে বা কখনও উদ্দাম গতিতে। – যেন খেলা চলেছে মৃদু সমীরণ বা মাতাল হাওয়ার সঙ্গে।
সবে বসন্তের সুরু। শীত বুঝি এখনও তার ঝরা পাতার ঝুলি সবটা ভরে নিতে পারেনি, তাই বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমার এই খেলায় সংগত করছে শুকনো পাতা ঝরে পড়ার সড়্সড়্ খস্খস্ বাদন। তবে এই তরঙ্গ খুশীর না বেদনার তা যেন ঠিক বুঝতে পারিনা। – তবে যাই হোক এর একটা মাদকতা আছে। ঠিক যেন আমার মনের মতো। – প্রবল উচ্ছাস মুক্তির আনন্দে, কিন্তু ফেলে আসা ব্যাথা যেন পিছু ছাড়ে না।
চওড়া মোড়ামের রাস্তায় শিমুল পলাশ বিছিয়ে আছে। – আকন্দের ঝাড়ে হালকা বেগুনী ফুলের থোকায় হলুদ-কালো মৌমাছিগুলিও যেন আমার মতোই আমোদিত।
সাদা,লাল,গোলাপী,হলুদ ফুলে ফুলে ছাওয়া পথের দুধারের সৌন্দর্য্য গিলতে গিলতে মন্নু চলছে তো চলছেই।
ঘন গাছের ফাঁক দিয়ে ভোরের ঝলমলে রোদ মন্নুকে উষ্ণতা দিচ্ছে।এইবার মন্নু গতি বাড়ালো।– সে যাবে বেশ খানিক দূরে সুড়ুল নদীর তটে। বাঁশঝাড়ের ছায়ায় সাইকেল রেখে বালির চড়া পেরিয়ে চলে যাবে নদীর জলের কাছে।
বালি নদীর ঝক্ঝকে জলে নিজের ছবি দেখে মাথার চুলটা একবার ঠিক করে নিল মন্নু।এইখানেই তো দেখা হবে তার হারিয়ে গিয়েও ফিরে পাওয়া সেই শৈশবটার সঙ্গে — কুতু, বুড়ি, সুমন, আব্দুল্লাদের নিয়ে নদীর জল বালিতে সারাদিনের হুটোপুটি — পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে ঢিল ছোড়া — আর একটু বড়ো হয়ে চায়ের দোকানের উনুনে আঁচ দেওয়া — পর্যটকদের হাতে হাতে গরম চায়ের ভাঁড় পৌঁছে দেওয়া — মালিকের ফাইফরমাস খাটা — ; – ঝপ্ করে নিভে গেল মন্নু; ভেতর থেকে যেন কান্না ঠেলে আসছে। – কিছু নেই!? একটুও নেই? কোথাও নেই? চিহ্নমাত্র নেই!!
মন্নু যে অনেক আসা নিয়ে এসেছিল। – যেন নিশ্চিন্ত ছিলো। ভেবেছিল বুঝি দেখতে পাবে সেই সোনালী দিনগুলিকে, ঠিক যার পরেই এক রাতের বেলায় আগ্রাসী জলোচ্ছ্বাস বিলকুল ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ওদের গোটা গ্রামটাকে। – বাদ পড়েনি গজিয়ে ওঠা পর্যটক আবাস বা তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা তার মালিকের চা-বিস্কুট, পাউরুটির দোকান।
যদুকাকার ভাত, রুটি, দেশিমুরগির ঝোলের পাঁচতারা বেড়ার হোটেল। যদুকাকা বলতেন পাঁচতারা নয় রে অজস্র তারা। রাতে হোটেলের ভিতরের বাঁশের বেঞ্চিতে বসে- উপরে তাকালে ফুটো চালের ভিতর দিয়ে তারাদের দেখা যেত যে।
বালির উপর বসে পড়ে মন্নু। – পায়ের পাতার উপর দিয়ে নদীর ঠান্ডাজল বয়ে যাচ্ছে। – দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠল মন্নু।
নদীর জলের একঘেয়ে বয়ে চলার শব্দ আর আদিগন্ত নিল আকাশে চিলেদের গোল গোল হয়ে ঘোরা এই চেনা ছবিটা ভূমিপটে মেলানোর জন্য জলে পা ডুবিয়ে চুপ করে বসে বসে মন্নু যেন গোটা বালুকাবেলায় ক্ষীপ্র গতিতে ছোটাছুটি করতে লাগল।–
মিলছে না —-আ, মিলছে না!!
এই নীল আকাশ গাছের সারির পিছন দিয়ে গিয়ে গ্রামের শেষ সীমানায় থাকা কুটিরগুলিকে আলিঙ্গন করে নেই কেন?
ভেতরটা মুচড়ে ওঠে মন্নুর।
কি দরকার ছিল তার বেঁচে থাকার — পরিবারের আর সকলের মতো তারও সলিলসমাধি হতো।– তবে তো বারে বারে আহত হতো না আশাবাদী মন।
জনমানবহীন ধূ ধূ প্রান্তর মন্নুকে যেন আছড়ে ফেলে বালির চড়ায়।
ফিকে হয় না তার সেই স্মৃতি।।
Tags: ঠিকানা, শর্মিষ্ঠা সেনগুপ্ত
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।