[ইসমত চুঘতাই সম্পর্কে সাদাত হাসান মান্টোর এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য অ্যানুয়্যাল অব উর্দু স্টাডিজ’ পত্রিকায়। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মহম্মদ উমর মেনন। লেখাটি উর্দু থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করেছেন মহম্মদ আসাবুদ্দিন। সেটিরই বাংলা অনুবাদ করেছেন দেবাশিস মজুমদার।]
ইসমত সম্পর্কে আমি যা লিখছি তা কোনো লজ্জা থেকে নয়। আসলে তাঁর কাছে একটা ঋণ রয়ে গেছে। আমার ইচ্ছা- তার সামান্য পরিমাণ অংশ সুদে পরিশোধ করি। আমি মনে করতে পারি না তার গল্প গুলোর মধ্যে কোনটা আমি প্রথম পড়েছি। স্মৃতির গভীরে ফিরেও আমি কোনো সাহায্য পাইনি। এটা এমনও হতে পারে সে গুলি লেখার বহু আগেই যেন আমি পড়েছিলাম। সেই কারণে আমার মনে হয়েছিল আমার বোধ হয় সে বিষয়ে যোগ্যতা নেই। যাই হোক, যখন আমি তাঁকে দেখেছিলাম আমি যথেষ্ঠই আশাহত হয়েছিলাম।
সাপ্তাহিক ‘মশাভিব’ পত্রিকার মুম্বাই এর ব্লেয়ার রোডের অফিস ছিল অ্যাডেলকি বাড়ির ১৭ নং ফ্ল্যাটে। সেখানেই শাহীদ তার স্ত্রীকে (ইসমত)কে নিয়ে এসেছিল। সেটা ছিল ’৪২ সালের আগস্ট মাস। মহাত্মা গান্ধী সহ সমস্ত কংগ্রেসের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। শহরের আবহাওয়া ছিল খুব জটিল। শহরের বাতাস রাজনীতির গন্ধে ভারী। আমরা কিছুক্ষণ স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে কথা বলেছিলাম। তারপর ছোটগল্পের বিষয়ে আলোচনা ঘুরেছিল। একমাস আগে ইসমতের ‘লিহাফ’ছোটগল্পটি ‘আদাব-ই-লতিফ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন আমি দিল্লির অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে কাজ করছিলাম। ওটি পড়ার পরে আমি কৃষাণ চন্দরকে বলেছিলাম ‘গল্পটা খুব ভালো-কিন্তু শেষ পংক্তিটি গল্পের নির্মাণশৈলীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে”। আহমেদ নাদিম কোয়াসমি-র বদলে যদি আমি সম্পাদক হতাম আমি অবশ্যই ওটিকে আরও আনন্দদায়ক করে তুলতাম। যখন আমাদের আলোচনা ছোট গল্পের দিকে গিয়েছিল তখন আমি ইসমতকে বলেছিলাম তোমার ছোটগল্প ‘লিহাফ’ আমার ভালো লেগেছিল।তোমার পরিমিত শব্দ ব্যবহারের বিশেষ বৌদ্ধিক ছাপ গল্পটির মধ্যে রয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি আশ্চর্য হয়েছি তুমি অনেক লক্ষ্যহীন পংক্তি ব্যবহার করেছ।বিশেষত সেই পংক্তিটি – ‘এমনকি, কেউ যদি আমাকে এক লক্ষ টাকাও দেয় আমি কাউকেই বলব না যখন লেপটি এক ইঞ্চি উঠে গিয়েছিল তখন আমি কি দেখেছিলাম।’। ইসমত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিল –“পংক্তিটিতে ভুল কি আছে “? আমি আরও কিছু তাকে বলতে গিয়েছিলাম কিন্তু আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম যে, তার মুখে ঘরোয়া মেয়েদের আচমকা কোনো কিছু শুনে হতবুদ্ধির মধ্যে পড়ে গেলে যে রকম বাক্রুদ্ধ হয়ে যায় সেই রকম একটি ছাপ পড়েছিল। আমি যথেষ্টই আশাহত হয়েছিলাম। কারণ আমি চেয়েছিলাম তার সঙ্গে ‘লিহাফ’ গল্পটির বিষয়ে অনুপুঙ্খ আলোচনা চালিয়ে যেতে। কিন্তু সে যখন ব্যাপারটি ছেড়ে দিয়েছিল আমি নিজেই নিজেকে বলেছিলাম সর্বোপরি এই হতভাগিনী একজন খাঁটি ঘরোয়া মহিলা। আমার এখনও মনে আছে যে তার পরের দিনই দিল্লিতে আমার স্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলাম-ইসমতের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, তুমি শুনলে আশ্চর্য হবে যে সেও তোমার মতন একজন মহিলা। আমি যথেষ্টই আশাহত হয়েছি ,কারণ যখন আমি তাকে তার গল্পের শেষ পংক্তি নিয়ে পরোক্ষভাবে কিছু বলতে গিয়েছিলাম সে যথেষ্টই আহত হয়েছিল।কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই তাকে খুব পছন্দ করবে।
ইসমতের বরফ খাওয়ার অভ্যাস ছিল। সে তাঁর হাতে এক টুকরোরাখতো। আর সেটিকে শব্দ করে কামড়ে ভাঙতো। সে তার বহু গল্প এই ভঙ্গিতেই লিখে গেছে। ইসমত খাটিয়ার উপর কনুইতে ভর রেখে শুয়ে পড়ে তার চোখের সামনে বালিশের উপর রাখা নোটবুকের দিকে তাকিয়ে থাকত। একহাতে ধরে থাকত একটা ফাউন্টেন পেন, আর অন্য হাতে একটুকরো বরফ। রেডিওটা জোরে বেজে যেত কিন্তু ইসমতের কলম কাগজের উপর দিয়ে দৌড়বাজদের মতন দৌড়ত। অন্যদিকে তার দাঁতও সমান গতিতে বরফটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলত। ইসমতের কলম আর মুখ দুটোই দ্রুতগতিতে জোরে দৌড়াত। যখন সে তার লেখা শুরু করত, তার ধারণাগুলি কলমের আগে ছুটত। আর তার ব্যবহৃত শব্দ তাকে ভাবনাতে ধরতে পারত না সবসময়। যখন সে কথা বলত, কথাগুলি একটির ওপর আরেকটি এসে পড়ত। আমার ধারণা সে রান্না ঘরে তার রন্ধনকৌশল দেখাতে ঢুকলেও একইরকম ঘটত। তাঁর এই তাড়াহুড়োর প্রবণতা তার লেখায় বানান ভুল নিয়ে আসতো, সে নিজেও সেটা স্বীকার করেছে কখনও কখনও। কিন্তু এক অদ্ভুত বৈপরীত্য দেখেছি তার শিশুকন্যার পোষাক সেলাই-এর সময়।তার ছুঁচ তাড়াহুড়োতে কখনও কেঁপে উঠত না। প্রতিটি সেলাই এত নির্দিষ্ট পথে চলত যে, কোনো অংশ ভুল করেও সেলাইবিহীন থাকত না। এ প্রসঙ্গে ‘উফ ইয়ে বাচ্চে’ গল্পের কথা বলা যায়-
“বাড়ি বাড়ি নয়, মহল্লা জুড়ে কলেরা আসুক। সারা দুনিয়ার বাচ্চা পটাপট মরতে থাকুক। কিন্তু বই একটাও না। প্রতি বছর মা ‘শাল্লা’হ পুরো বাড়ি হাসপাতাল হয়ে যায় (তবু মরে না)। শুনেছি দুনিয়াতে ছেলেপিলেরা মরে- হয়ত মরে কিছু ।”
ইসমত লিখত মর্জিমাফিক। এমন অনেক সময় গেছে বা মাসের পর মাস গেছে যখন ইসমত কিছুই লেখে নি। আবার যখন তার মেজাজ এসেছে শয়ে শয়ে পাতা লেখা তার কলমের অঝোর ধারায় বেরিয়ে এসেছে। আর সেই সময় সে তার নাওয়া-খাওয়া আর পিপাসা ভুলেছে। তখন তার খাটিয়ায় শুয়ে মুখ নামিয়ে বরফ চুষতে চুষতে ধারণাগুলিকে কালির অক্ষরে লিপিবদ্ধ করে গেছে। আমি জানি তেরহি লকিবের মত দীর্ঘ উপন্যাস সে শেষ করেছিল সাত-আটটা বৈঠকীতে। এপ্রসঙ্গে কৃষাণ চন্দরের একটি ব্যাখ্যার কথা বলা যায়। কৃষাণ বলেছিল, ‘গল্পগুলি কাউকে ঘোড়দৌড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, তার গতি (আমার মনে হয় কৃষাণ বোঝাতে চেয়েছিল আলোর গতি) তার ভাবনার প্রতিচ্ছবি, তার চরিত্র, তাদের অনুভূতি, তাদের শব্দ সবকিছু যেন একটা ঝড়ের গতি সৃষ্টি করত।
ইসমত ছিল খুব একগুঁয়ে। একগুঁয়েমি হয়ে উঠেছিল ওর দ্বিতীয় সত্ত্বার অংশ। এই ব্যাপারে ও ছিল শিশুর মতন। সে কোন কিছুই এমনকি, প্রাকৃতিক কোন নিয়মকেও প্রতিরোধ না দেখিয়ে মেনে নিতে চাইত না। সে বিয়ে করতে রাজি ছিল না। যখন সে কোন ভাবে রাজি হল, সে মা হতে রাজি হয়নি। তাঁকে বহু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে ও বহু সমস্যা সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু সে কখনই তাঁর একগুঁয়েমি বা জেদকে পরিত্যাগ করেনি। তবে আমার মনে হয় এটাই ছিল তার পন্থা। জীবনের সত্যগুলিকে বুঝতে সেগুলির সে পরীক্ষা নিত। তাদের মুখোমুখি দাঁড়াত। তাদের সাথে লড়াই-এ নামত। এগুলি সমস্তই তার নিজের পন্থা এবং সবসময়ই অন্যগুলির থেকে পৃথক। এব্যাপারে একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। শাহীদ আর ইসমত আমাদেরকে ওদের মালাডের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিল। যখন আমরা রাত্রের খাবার সারছি তখন, ‘দস্ত-দরাজি’ শব্দবন্ধ-টির ব্যবহার নিয়ে তর্ক বেধেছিল। ইসমত বলেছিল ওটির সঠিক ব্যবহার হল ‘দরাজ-দস্তি’। সারা রাত তর্ক চলল। এমনকি ভোরের কাকও ডাকতে শুরু করেছিল। ইসমত ডিকশনারি দেখল সেখানেও ‘দস্ত-দরাজি’। এরপর হয় ইসমত ওর নিজের মত পরিবর্তন করেছিল অথবা আমি নিজেকে লড়াই থেকে সরিয়ে নিরাপদ বলয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। ইসমতের সঙ্গে ৫-৬ বছরের পরিচয়। নানা সময়ে লড়াই হয়েছে। কিন্তু কখনই এরকম ভয়াবহ অবস্থায় যায়নি।
এই একগুঁয়েমি আমি দেখেছি বম্বেতে তার মেয়ে সীমা যখন হুপিং কাশিতে কষ্ট পাচ্ছে, তখন সারারাত জাগতে। সেই সময়ে সে ভীষণ ভেঙে পড়েছিল। তাকে দেখলে মনে হত সে যেন বিপন্ন। আমার মনে হয়, কেউ সত্যিকারের ভালবাসার প্রকৃতিকে বুঝতে পারবে যখন সে একজন মা হয়ে উঠবে।
আমি ইসমতকে পছন্দ করতাম। সেও আমাকে পছন্দ করত। কিন্তু কেউ যদি হঠাৎ করে জিজ্ঞাসা করে এই রসায়নটা সঠিকভাবে কি রকম? তোমরা কি একে অন্যকে পছন্দ কর? তাহলে আমি নিশ্চিত আমাদের দুজনের মাথাই কিছুক্ষণের জন্য ফাঁকা হয়ে যাবে। আমি কখনই তার ভালবাসায় পড়িনি। যতটা আমার স্ত্রী তার সঙ্গে ভালবাসায় আবদ্ধ হয়েছিল। যাইহোক, আমার স্ত্রী সাফিয়া তার প্রতি ওর ভালবাসা প্রকাশ করেছে সাহসের সাথে। ইসমত থাকলে নিশ্চয় বলত- “তোমার বাবার বয়সী লোকেরা আমার দিকে ঝুঁকেছিল”। আমি একজন বয়স্ক বিখ্যাত লোককে জানতাম যে ইসমতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। সে তাঁকে ভালবাসা চিঠিতে জানিয়েছিল। ইসমত প্রথম দিকে তাঁকে বেশ উৎসাহ জুগিয়েছিল। কিন্তু ক্রমে ক্রমে তাঁকে এমন শিক্ষা দিয়েছিল যে, বেচারা লোকটা আকাশের তারা দেখতে শুরু করেছিল। সেই ভদ্রলোক কখনই এই সত্যি গল্পটার কথা লিখতে পারবে না।এই গল্পের সঙ্গে আরেকটি গল্প জুড়ছি – হায়দ্রাবাদে প্রগতিশীল লেখকদের একটি সম্মেলন হয়েছিল। যদিও আমি সেই সম্মেলনে যোগদান করিনি, কিন্তু হায়দ্রাবাদ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকা মারফৎ জানতে পেরেছিলাম বহু মেয়েরা ইসমত চুঘতাইকে সেখানে প্রশ্ন করে অনুরোধ করেছিল, সে কেন মান্টোকে বিয়ে করছে না? আমি জানিনা রিপোর্টটি ঠিক কি ভুল ছিল, কিন্তু ইসমত বম্বে ফিরে এসে আমার স্ত্রীকে বলেছিল যে, হায়দ্রাবাদে একজন মহিলা যখন তাকে জিঞ্জাসা করেছিল মান্টো অকৃতদার কিনা, সে ততক্ষণাৎ জবাব দিয়েছিল আদৌ নয়। এই কথা শুনে প্রশ্নকর্তা মহিলাটি ভেঙে পড়ে ও সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যান। সত্য যাই হোক, সারা ভারতবর্ষের মধ্যে হায়দ্রাবাদের নারী পুরুষরাই আমার আর ইসমতের বিয়ে নিয়ে বোধহয় বেশি চিন্তিত হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হয়, আমরা যদি বিয়ের পরিকল্পনা নিতাম তখন অন্যদের বিস্ময় ও প্রতিবাদের মধ্যে ডোবানোর থেকে আমরা নিজেরাই বোধহয় তার মধ্যে ডুবে যেতাম। আর আমরা যখন ধাক্কা কাটিয়ে আমাদের স্বাভাবিক অনুভূতিতে ফিরতাম, তখন আমাদের বিস্ময় আর প্রতিবাদ বদলে যেত আনন্দ আর দুঃখে। তাই ইসমত আর মান্টোর নিকাহ বা বিবাহ – ওফ কি হাস্যকর ধারণা। এজন্য সাহিত্যিক কৃষাণ চন্দরের ভূমিকায় একটা অংশ তুলে দিচ্ছি –
“বিষয়টি প্রচ্ছন্ন রেখে, পাঠককূলকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে, শেষে হঠাৎ নাটকীয়ভাবে আসল কথাটা বলে ফেলার মতো করে চমৎকারিত্বের ব্যাপারে ইসমত ও মান্টো কারো চাইতে কেউ কম যায় না। এব্যাপারে উর্দু গল্প লিখিয়েদের মধ্যে খুব কম লোকই এধরণের গুণের অধিকারী।“
এ প্রসঙ্গে “ছোটে আপা’-তে ইসমতের লেখা উল্লেখ করা যায় – “শুধু এই সামান্য ভালবাসার জগতে কত শওকত, কত মাহমুদ,কত আব্বাস,কত আসকারি,কত ইউনুস,আরও কত নাম না জানা প্রেমিক তাসের ঘরের মতন হারিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ কি বলতে পারে এর মধ্যে সত্যিকারের প্রেমসুধা প্রাপ্ত লোকটি কে? শওকতের সেই কাহিনীর অতৃপ্ত আত্মার চাহনিগুলি মাহমুদের সাপের মত কিলবিল করা অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি, আসকারির নির্দয় হস্ত যুগল, ইউনুসের কালো ঠোঁটের আবেগ, আব্বাসের উদাস স্মিত হাসি আর হাজার হাজার আবেগবিদ্ধ চওড়া বুক, প্রশস্ত কপাল, কোকিল-কালো কেশদাম, মসৃন সুডৌল নিতম্ব, পেশলবাহু – সবকিছু একসঙ্গে মিলে পাকা সুতোর ডোরে বাঁধা অবস্থায় ঝুলে আছে নিঃসীম শূন্যে অনন্তকাল। অস্থির চাতকের মতো তলিয়ে দেখি এদের দিকে। ভেবে পাই না কাকে রেখে কাকে ধরব। কোন ডোরটি ধরে টানতে থাকব আর টানতে টানতে আমিও ঘুড়ির মত উড়তে থাকব নিঃসীম শূন্যে, দূরে আরও দূরে”।
অন্যদিকে মান্টো তার ‘তকলিফে’ লিখেছেন, “আমি শুধু এতটুকু বুঝি, মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করা আর জমি খরিদ করা একই কথা। তুমি ভালবাসার চেয়ে বরং দুবিঘা জমি কিনে সারা জীবন দখলে রাখো। জীবনে শুধু একটি মেয়ে আর সারা দুনিয়াজুড়ে এত? কেন এত তামাশা জমা হয়ে আছে? শুধু গন্ধ সৃষ্টি করেই আল্লামিয়াঁ তাঁর কর্মের পরিসমাপ্তি করলেন না? আমার কথা শোনো, এই যে জীবন তোমাকে দান করা হয়েছে বেশ করে উপভোগ কর। তুমি এমন একজন খদ্দের, যে একটি মেয়েকে লাভ করার জন্যই সারা জীবন রসদ জুগিয়েও যা পাবে তা যৎসামান্য মনে করবে। আমি এমন একজন খদ্দের যে জীবনে অনেক মেয়েকেই লাভ করব। তুমি এমন একটা প্রেম করতে চাও, যে প্রেমের ব্যর্থ উপাখ্যান দিয়ে একজন বটতলার লেখক উপন্যাস লিখবে, নারায়ণ দত্ত সায়গল সেটা ময়লা কাগজে ছাপবে আর দিব্যি বাজারে রদ্দি মাল হিসাবে সের দরে বিক্রি হবে। আমার জীবন খাতায় সকল উইপোকার মতো নিঃশেষ করে দিতে চাই, যেন আর কিছুই বাকি না থাকে। তুমি প্রেমের মাঝে জীবন লাভ করতে চাও, আমি আকন্ঠ প্রেমসুধা পান করতে চাই”।
নানা বিষয়ে তর্কাতর্কি এড়াতে ইসমত আর আমি খুব কম কথা বলতাম। যখনই আমার কোন গল্প প্রকাশিত হয়েছে সে তার প্রশংসা করেছে। ‘নীলম’ প্রকাশিত হবার পর সে নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে প্রশংসা শুরু করেছিল। সে বলেছিল, তুমি ঠিক বলেছ, একজন পুরুষ যখন একজন মহিলাকে বোন হিসাবে, পরিচিত করায় তখন তা মেয়েটির কাছে একটু লজ্জার। এই কথাটা যথেষ্ট বিস্মিত করেছিল। যদিও সে আমাকে মান্টোভাই বলে ডাকত আর আমিও তাকে ইসমত-বহিন বলেই ডাকতাম।
ইসমতের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের একটি অসাধারণ ঘটনা মনে পড়ছে। আমরা দুজনেই একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলাম। আমাদের অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। যদিও সেরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। এর আগেও আরও দুবার আমাকে এই মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ইসমতের ক্ষেত্রে এটা ছিল নতুন অভিযোগ। এবং ও খুব ভেঙেও পড়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বে-আইনি ঘোষিত হয়েছিল কারণ, পঞ্জাব পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়া আমাদের গ্রেপ্তার করেছিল। ইসমত এতে খুশি হয়। পরবর্তীকালে তাকে লাহোর কোর্টে নিজেকে উপস্থিত করতে হয়েছিল। বোম্বে থেকে লাহোর আমরা দুটি পরিবারের সব সদস্য একসাথে যাই। ইসমতের স্বামী শাহীদ ও আমার স্ত্রী সাফিয়া খুব মজা করছিল আমাদের বিরুদ্ধে আনা অশ্লীলতার অভিযোগ নিয়ে। তারা আমাদের গ্রেপ্তার পরবর্তী জেল-জীবন নিয়েও মজা করছিল। শেষবেলায় ইসমত বলে উঠেছিল, “ওদেরকে ফাঁসিকাঠ অবধি যেতে দাও, আমরা আমাদের সত্যতেই দাঁড়িয়ে থাকব”। আমাদের দুবার লাহোর যেতে হয়েছিল এই মামলা সংক্রান্ত ব্যাপারে। স্থানীয় কলেজের ছাত্ররা কোর্টে এসেছিল, আমাদের দেখবে বলে। ইসমত মজা করে বলেছিল, “মান্টোভাই চৌধুরী নাজিরকে কিছু টাকা ফি বাবদ তুলতে বলো এই দর্শনার্থীদের কাছ থেকে। অন্তত আমাদের যাতায়াত ভাড়াটা তাই থেকে আমরা দিতে পারবো। আমরা দুইবার লাহোর গিয়েছিলাম আর দুইবার ‘কারনাল বুটশপ’ থেকে দশ-বারো জোড়া চটি ও জুতো কিনেছিলাম। পরে বম্বেতে ইসমতকে একজন জিজ্ঞাসা করেছিল তোমরা কি লাহোরে আইনসংক্রান্ত ব্যাপারে গিয়েছিলে? সে অকপটে জবাব দিয়েছিল – না, আমরা জুতো কিনতে গিয়েছিলাম।
আরেকটা ঘটনার কথা মনে পড়ে, ইসমত আর আমি বোম্বে টকিজ থেকে ইলেকট্রিক ট্রেনে ফিরছিলাম। হঠাৎ আমি বলেছিলাম কৃষাণ চন্দরের লেখায় আমি প্রায়ই দুটি জিনিস পাই – ‘রেপ’ আর ‘রেনবো’। ইসমত সমর্থন করল এবং আমি জানালাম যে একটা প্রবন্ধ লিখব, কৃষাণ চন্দর দ্য রেনবো এন্ড ভায়োলেন্ট রেপ। ও প্রায় বিস্মিত হয়েছিল রেপ আর রেনবোর মধ্যে ‘অন্তর্লীন’ সম্পর্ক কি হতে পারে। ইসমত বলল, নান্দনিক দৃষ্টিতে বিভিন্ন রং-এর সমন্বয়ে রেনবো বা রামধনু খুবই আকর্ষনীয় ও সুন্দর। কিন্তু তুমি এটাকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছো। আমি বললাম হ্যাঁ। দেখো লাল হল আগুন আর রক্তের রং। মিথ অনুযায়ী এটি মঙ্গলের রং। হতে পারে এই রংটি রেপ আর রেনবোর কমন লিঙ্ক। সে বলল, হতে পারে, তুমি তোমার লেখাটা চালিয়ে যাও। আমি বলেছিলাম, খ্রিস্টান ছবিতে লাল রং ঐশ্বরিক ভালবাসার রং। হঠাৎ আমার মাথায় ধারণা এল- এই রংটিকে যীশুর ক্রশিফিকেশনের রং হিসাবেও দেখানো যায়। যুবতী মেরিকেও লাল কাপড়ে আঁকা হয় কুমারীত্বের ইঙ্গিত বোঝাতে। হঠাৎ করে আমার চোখ গেল ইসমতের সাদা কাপড়ের দিকে। ও হাসছিল, মান্টোভাই তুমি অবশ্যই তোমার প্রবন্ধটা লিখো। এটা খুব আকর্ষনীয় হবে। কিন্তু তোমার নামকরণে ভায়োলেন্ট শব্দটা থেকে দূরে থেকো। আমি বললাম, কৃষাণ ‘আপত্তি’ করবে। সে বলল, তার আপত্তি অর্থহীন। কারণ তার নায়িকারাই এই জাতীয় ভায়োলেন্স খুব উপভোগ করে।
ইসমতের নাটক সম্পর্কে তার সমালোচকরা বলেন, তার নাটকগুলি খুব দুর্বল। নানা জায়গায় তার বাঁধন আলগা। তার প্লটগুলির বুনট ঠিক নয়। অনেক জিনিসকে এমনভাবে জোড়া হয়েছে তা যেন ছুতোরের তক্তা মারার মতন করে। আমার মনে হয় সে যৌনতার অনেক বিষয় নিয়ে বেশি আচ্ছন্ন থেকেছে। যাতে মনে হয় এটা তার কাছে একটা রোগ। ইসমতের শৈশব তার মানসিক বৃদ্ধির পক্ষে গঠনমূলক ছিল না। সে তাই পর্দার আড়ালে থাকা বিষয়গুলির বেশি বর্ণনা করেছে। সেইজন্যই ইসমত সমাজ নিয়ে ততটা আগ্রহী ছিল না যতটা ছিল মানুষ নিয়ে। ব্যক্তির প্রতি ঝোঁক সমষ্টির থেকে বেশি ছিল। ইসমত ঠিক যেন দেহ আর দৈহিক কাউকেই একমুখীন করেছিল। সেই অর্থে তার গল্পে কোন লক্ষ্য নেই। কিন্তু লক্ষ্য করার অসাধারণ দক্ষতা ছিল। সে ছিল ‘জিনিয়াল হিউমারিস্ট ও স্যাটারিস্ট’। সে তাই অনেক ক্ষেত্রেই অশ্লীল লেখকের তকমা পেয়েছে। সে তাঁর নিজের ধারায় এমন বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছে যাতে মনে হয় ইসমত তরবারির ধার ধরে হেঁটেছে।
ইসমত সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে। এখনও বলা হচ্ছে। কেউ তাঁকে ভালবাসবে, কেউ তাঁকে বাসবে না। কিন্তু তার সৃজনশীলতা লোকের ভালো লাগা বা না লাগার অনেক ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। ভালো কি মন্দ, খোলামেলা কি ঢাকা, যাই হোক না কেন এটাকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে। সাহিত্যের কোনো ভৌগোলিক সীমা নেই, যতটা সম্ভব এই তত্ত্বকে রক্ষা রক্ষা উচিত, অন্তত পৌনঃপুনিকতা আর ছাপ মারা পদ্ধতির বিস্ময়কর জগৎ থেকে আলাদা করতে।
অনুবাদঃ দেবাশিস মজুমদার – জন্ম, বেড়ে ওঠা শ্রীরামপুরে। সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশা শিক্ষকতা, লেখালিখি। নেশা ভ্রমণ ও নিবিড় সাহিত্যপাঠ। অন্য পরিচয় কবি ও ছোটোগল্পকার।
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।