হুমদোমুখো লোকগুলো জেরা করেই চলেছে। কঠিন সব প্রশ্নের জালে ক্রমশ পেরে ফেলছে স্বপ্ননীলকে। স্বপ্ননীল ভাবছে, তাহলে গোপনীয় বলে কিছুই নেই। সে কবে ওলা বা উবরে কোথায় গিয়েছিল, ওহো! ক্যালকাটায় কবে কার সঙ্গে গিলে কত টাকা ডিজিটালে পেমেন্ট করেছে, সবই ওদের জানা। এমনকি পাতি হলুদ ট্যাক্সিতে হাওড়া স্টেশনে গিয়ে বেঙ্গালুরু থেকে আসা কয়েকজনের সঙ্গে সে যে দেখা করেছিল, সেটাও তারা বলে দিচ্ছে।
– মিঃ ভট্টাচারিয়া আপনি গত দশদিন আগে ওদের সঙ্গে কি কারণে দেখা করতে গিয়েছিলেন তা সবই আমাদের জানা। আপনি ওদের নিয়ে কোন কোন অফিসে গিয়েছিলেন, পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরায় কোন মেমের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তাও জানি। আমাদের নজরদারি ক্যামেরায় ধরা আছে। আপনি ওদের দেখে বত্রিশ পাটি দাঁতের মধ্যে ছাব্বিশ পাটি বের করেছিলেন। আপনাদের গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর শুনতে না পাওয়া গেলেও, সেসব যে প্রেমালাপ ছিল না তা আপনার বডি ল্যাঙ্গোয়েজ বলে দিচ্ছে। আমাদের যন্ত্র বলে দিচ্ছে, আপনি ঘাড়টাকে ঠিক থার্টি থ্রি পয়েন্ট থ্রি থ্রি ডিগ্রি বেঁকিয়ে কথা বলছিলেন।
আরেক হোঁদল কুতকুত মার্কা ঘোড়েল মাল বলে উঠল,
-কত ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘাড় বেঁকালে আপনার মন কি বলছে তাও আমরা জানতে পারি। ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় কোনও কিছুই অজানা নয়। গোপন কথাটি রবে না গোপনে।
আরেকজন বলল,
– কয়েক মাস ধরেই আপনার আচরণ অস্বাভাবিক। আমরা যে ছকে দুনিয়ার সব মানুষকে চালাতে চাই, তারসঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। আপনি পনেরোই আগস্ট কাজ করবেন না বলে, জেদ করেছিলেন। সহকর্মীদেরও খেপিয়েছেন। বলেছেন, আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসে ছুটি আর ভারতেরটায় নয় এটা মানা যায় না। অথচ, আপনিই এর আগে গর্বের সঙ্গে বলতেন, আমাদের চাকরিতে এত ব্যস্ততা পনেরো আগস্টেও ছুটি নেই।
এসি রুমেও স্বপ্ননীল দরদর করে ঘামছিল। মনে হচ্ছিল সে মরে গিয়ে বিচারসভায় এসেছে। চিত্রগুপ্ত খাতা খুলে তার নাড়িনক্ষত্র বলে দিচ্ছে। তার কথা বলার কোনও সুযোগই নেই।
যেই না ভাবনা সঙ্গে সঙ্গে বিচারক বলে উঠল,
– দেখুন ভট্টাচারিয়া চিত্রগুপ্তর খাতাকে তবুও ফাঁকি দেওয়া যায়, আমাদের ফাঁকি দিতে পারবেন না।
এতো আজব কারবার। মনের কথাও এরা জেনে ফেলে। ভাবে, স্বপ্ননীল।
বিচারকের মুখটা চেনা চেনা লাগছে। কোন দুনিয়া কাঁপানো কর্পোরেটের কর্তা। নামটা কিছুতেই মনে আসছে না। অথচ নেটে প্রায় প্রতিদিন সে এর ছবি দেখেছে, বাণী পড়েছে। মনে হয়েছে এদের মতো সর্বজ্ঞ কেউ নেই। সব জানে। তামাম দুনিয়া এদের ইশারায় চলে। দেখলেই কিরম গদ্গদ ভাব হত। অথচ, আজ চোখের সামনে দেখে মনে হচ্ছে সাক্ষাৎ যম।
স্বপ্ননীলের চোখের সামনে দুজোড়া চোখ। ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ভাবলেশহীন যান্ত্রিক দুজোড়া চোখ। তাকে আপাদমস্তক মেপে নিচ্ছে।
ধড়মড় করে উঠে বসতে গিয়েই সারা গায়ে ব্যথা টের পেল সে। ওঠার ক্ষমতা নেই। একটা পাগলা খ্যাচা টাইপের লোক তারদিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে। দৃষ্টিতে সারল্য আর ছেলেমানুষি খেলা করছে। নোংরা চুল, দাঁড়ি, ততোধিক নোংরা ছেঁড়া জামা প্যান্ট বলে দিচ্ছে, মালটা ভবঘুরে। এদের ভয় পাওয়ার মতো বোকা স্বপ্ননীল নয়। এদের মাপতে এতটুকুও অসুবিধা হয় না।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পাশের চওড়া রাস্তা দিয়ে হুশহুশ করে গাড়ি ছুটছে। তার বাঁদিকে একটা ঘেয়ো নেড়ি আন্ডাবাচ্চা নিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে রয়েছে। এটাই তার দিকে তেড়ে এসেছিল। কিন্তু পায়ের কাছে এসেই চেল্লানি থামিয়ে ল্যাজ নাড়তে শুরু করে। আসলে লাকির গায়ের গন্ধ পেয়েই কুকুরটা বুঝেছিল স্বপ্ননীল সন্দেহজনক নয়। লাকি। তার বাড়ির পোষা বিদেশি কুকুর। আস্তে আস্তে তার সব মনে পড়ে যাচ্ছিল। যত স্মৃতিশক্তি ফিরছিল, তত আতঙ্ক গ্রাস করছিল তাকে। যতক্ষণ কিছু মনে পড়ছিল না, ততক্ষণই বোধয় সে ভালো ছিল। একে কি বলবে? অনিশ্চয়তার নিশ্চয়তা? আজকাল এসব অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন মাথাচাড়া দেয়।
মাসতিনেক ধরে তার জীবনের সবই চলছে উলটো পথে। উলটো পথে, নাকি স্বাভাবিক ছন্দেই ফিরে এসেছে সে। কলেজ ও ইউনিভার্সিটি জীবনে দেখা স্বপ্নগুলো ক্রমেই ভুলে গেছে স্বপ্ননীল। এমনটাই অভিযোগ সুচরিতার। কলেজে শাসক দলের অনুগত রাজনীতি, বিপ্লবের বুলি কপচানো, স্বপ্ন দেখা আর দেখানো। আর পাঁচটা গড়পড়তা বাঙালির মতোই জীবন। অথচ সেসবকেই মনে হত অফবিট। এখনও তো তেমনই চলছে। শাসকের রঙ বদলেছে, নতুন রঙের দলে ভিড় জমছে। অন্য কোনও কথাই ক্যাম্পাসে বলা যাবে না। স্রোতে গা ভাসিয়ে দাও।
‘ মহাকাশ হতে গু-খেকো শকুন হাগিতেছে তব গায়,
বাঙালি শুধুই খচ্চর নয়, তদুপরি অসহায়’।
কলেজ জীবনেই নবারুণ পড়তে শিখিয়েছিল সুচরিতা। ঠাট্টা করে বলত, এই যে ভচ্চায বামুন আরেক ভচ্চাযের লেখা পড়ো। আসলে বাঙালির আঁতলামো খচরামো সবই অসহায়ত্ব ঢাকবার মরিয়া চেষ্টা। এমনটাই মনে করে সুচরিতা। রাজনীতি করবে, দেখাবে কত জানে, বোঝে, আসলে ভেতরটাই ফাঁপা। এই .ভণ্ডামি কিছুতেই সে মেনে নিতে পারে না। সুচরিতার এই একরোখামিকেই ভালোবেসে ফেলেছিল স্বপ্ননীল। সুচরিতা, স্বপ্ননীলের কাছে শুধুই সু। আর স্বপ্ননীল, সুচরিতার কাছে শুধু নীল।
ইউনিয়ন করলেও সু প্রথম থেকেই ত্যাড়াব্যাকা কথা বলত। নেতাদের প্রশ্ন করতে ছাড়ত না। বিতর্ক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয় গুজরাট দাঙ্গার সময়ে। সু বলেছিল, এখানে সেফজোনে বসে লম্ফঝম্প না করে, আমাদের গুজরাটে যাওয়া উচিৎ। তবেই না বুঝবো আমাদের হিম্মত রয়েছে। কোণঠাসা করার চেষ্টা তো বহুকালই শুরু হয়েছিল । এবার এক্কেবারে বিচ্ছিন্ন করে দিতে উঠেপড়ে লাগল কয়েকজন। ধীরে ধীরে এসব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল সু। যদিও নীলের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয় নি। আসলে সার্কুলার মেনে যন্ত্রের মতো কর্মসূচি করাতে নীলও হাঁপিয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পাঁজি-পুঁথি মেনে ব্রত পালনের মতোই এসব আচার সর্বস্ব। চে গেভারা পড়ে তখন সে উত্তেজনায় ফুটছিল। অবশ্য সু এর মতো মুখের ওপর এসব বলার সাহস তার কোনওদিনই ছিল না।
সুচরিতার থেকে সাবধানে থাকিস। বলেছিল বিপত্তারণ দা। নীল কিছু বলতে গিয়েও, বিপত্তারণদার মুখের দিকে চেয়ে থেমে যায়। নীলের মনে হয়েছিল, বিপত্তারণ দা মুখে যে কথা বলছে, তা তার মনের কথা নয়। হতে পারে না। বিপত্তারণদাকে আলাদা চোখেই দেখে স্বপ্ননীল। সুচরিতাও তাই। আসলে নাম অতনু। ছাত্র-ছাত্রীদের আপদে-বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ত। তা দেখেই সুচরিতা নাম দিয়েছিল আপদকালীন বিপত্তারণ। তার থেকেই বিপত্তারণ নামটার প্রচলন। এরম নাম দেওয়ার অভ্যেস আছে সুচরিতার। তাদের বাড়ির কাছে একজন বয়স্ক লোক থাকতেন। রোজ সন্ধেবেলায় মারফি কোম্পানির একটা রেডিও নিয়ে রকে বসতেন। পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি। হাড় জিরজিরে চেহারা হলেও, গলার জোর ছিল বেশ। একেবারে অমাইক। সুচরিতা তাঁর নাম দিয়েছিল মারফি দাদু। ঠাট্টা করে নয়, আপন মনে করেই। সুযোগ পেলেই সে মারফি দাদুর কাছে গল্প শুনত। সাম্প্রতিক অতীতের গল্প। কীভাবে কলোনি গড়ে উঠেছিল, কারখানাগুলোতে উদ্বাস্তুরা চাকরি জুটিয়েছিল, সেসব কারখানার শ্রমিকদের লড়াইয়ের কাহিনি। এখন মারফি দাদুও নেই আর সেসব কারখানাও নেই।
অতনু দাও এখন বদলে গেছেন। সাব-অল্টার্নদের নিয়ে কাজ করেন। মার্ক্সের ক্লাস স্ট্র্যাগল নাকি এখন অচল। শ্রীরামপুরে থাকেন আর সুন্দরবনের মানুষের জীবন নিয়ে ইউরোপে পেপার পড়েন। বস্তি জীবনের খিস্তি : প্রান্তবাসির অন্তরের কথা নামক গবেষণার জন্য প্রান্তিক পুরস্কার পেয়েছেন। বিভিন্ন চ্যানেলে টক শোর নিয়মিত গেস্ট। রীতিমতো সেলিব্রিটি। সুয়ের মতে সফল হাওয়া মোরগ।
দ্রুত বদলাচ্ছে স-ব। ডেভেলপমেন্ট। স্বপ্ননীলদের আড্ডা মারার চায়ের দোকান তো কবেই উঠে গেছে। এখন শহরে ঝা চকচকে চায়ের দোকান। নো স্মোকিং জোন। ঘন্টার পর ঘন্টা এক ভাঁড় চা আর বান্ডিল কে বান্ডিল বিড়ি ফুঁকে রাজা উজির মারার আলসেমি এখন অচল। রাতারাতি বন্ধ কারখানার জমিতে আধুনিক ফ্ল্যাট, ব্র্যান্ডেড দোকান, মল – সবকিছু বদলে গেল। লোকে সকালে হাগা-মোতা সেরেই মলে ভিড় জমাচ্ছে। মলের গ্র্যান্ড অফারের খবর না রাখলে আজকাল প্রেমে অফার করা যায় না। ডেভেলপমেন্ট নয় তো কি?
-না ডেভেলপমেন্ট একে বলে না। পেট ভরা খাবার খেতে পারি না বলে, বিষ খাওয়াকে কখনই ডেভেলপমেন্ট বলে না নীল।
-ওঃ সু। রোববারের সকালে এসব কি শুরু করলে। চারিদিকে এত ব্র্যান্ডেড রেস্টুরেন্ট আর তুমি আধপেটা খাওয়ার দুনিয়ায় এখনও ? যত্তসব বস্তাপচা সেকেলে ধারণা।
– নীল এসব সেকেলে নয়। ঐ পিৎজার দোকানের পাশের বস্তিতেই যারা থাকে, তাদের খবর রাখো? তোমাদের ডেভেলপমেন্ট। এসি দোকানের পাশে শনি মন্দির! তাগা তাবিজ পরে সেক্টর ফাইভে চাকরি!
আজকাল কথায় কথায় সুয়ের সাথে খটাখটি লাগে। সবকিছুতে মানিয়ে চলা স্বপ্ননীলের ছাত্র জীবন থেকেই মজ্জাগত। আর সুচরিতার ধারাটা ঠিক উলটো। যত বয়স বাড়ছে, তত একরোখামি বাড়ছে। তবে দুজনের সম্পর্কটা কিন্তু ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল বা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো গরমাগরম নয়। সু স্বভাবসুলভ ঠাট্টায় বলে থিসিস-অ্যান্টিথিসিস না হলে সৃষ্টি হবে কি করে মশায়।
তাদের সৃষ্টি সুনীল। সু আর নীল মিলিয়ে একমাত্র পুত্রের এমন নামকরণ। সুনীলের স্কুলে ভর্তি নিয়েও চাপানউতোর । স্বপ্ননীল ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবে। নাহলে স্টেটাস থাকে না। সেক্টর ফাইভে উচ্চপদে কাজ করা লোকের ছেলে পড়বে কিনা মফঃস্বলের বাংলা স্কুলে! শেষে সুচরিতার জেদই বজায় রইল। ছেলে বাংলা মিডিয়ামের সরকারি স্কুলেই ভর্তি হল। শুনে অফিসের পাকড়াশি দা বলেছিল,
-তোমাদের সবই উলটো পুরাণ ভচ্চায। সব শালা বউয়ের দোহাই দিয়ে ছেলে-মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করে। আর তোমার মিসেসই কিনা…
এই এক অদ্ভুত চরিত্র পাকড়াশি দা। মন দিয়ে কাজ করবে, রসে বশে থাকবে আবার মাঝে মাঝে র্যাডিকাল বুলি কপচাবে। পাকড়াশিদার থেকেই স্বপ্ননীল অনেক তথ্য পায়।
আধার কার্ড করা নিয়ে বাড়িতে অশান্তি। সুচরিতা কিছুতেই আধার করাবে না। সব তথ্য কর্পোরেটদের হাতের মুঠোয় চলে যাবে। স্বপ্ননীল অতশত ভাবে না। সরকারের ডিজিটাল ইন্ডিয়ার প্রজেক্টকে সমর্থনই করে। স্বপ্ননীল মনের আনন্দে আধার কার্ড করালেও, সুচরিতা এখনও করায় নি।
পাকড়াশিদা শুনে বলেছিল,
-নজরদারি। চারিদিকে টিকটিকি। যন্ত্রগুলোই এখন খোঁচর বুঝলে ভচ্চায। এই যে সরকার নিয়ে এত কথা তারই বা আসলে ক্ষমতা কতটুকু! বিল গেটসের সম্পত্তির পরিমাণ বিশ্বের ১২২টি দেশের সম্পদের থেকে বেশি। মাইক্রোসফট না থাকলে কি আর করেকম্মে খেতে পারতে? ওরাই দুনিয়া চালাচ্ছে। ভোট – সরকার – গণতন্ত্র এসবই মায়া।
এরমভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই কেমন যেন ওলটপালট হতে শুরু করল। আই টি সেক্টরে ছাঁটাই। প্রবল অনিশ্চয়তা। এরমধ্যে শুনল বেঙ্গালুরুতে কর্মীরা দল বাঁধছে। তাদের অফিসেও আতঙ্ক দেখা দিল। তখনই প্ল্যানটা মাথায় খেলে যায় স্বপ্ননীলের। আচ্ছা ওরা তথ্য প্রযুক্তির জালে দুনিয়াটাকে বাঁধতে চায়। আমরা এর সমান্তরাল কিছু করতে পারি না। খোঁজ খবর নিয়ে দেখল সারা বিশ্বেই এমন চিন্তা ভাবনা চলছে। সিস্টেমটাকে ভেতর থেকে গুলিয়ে দাও। সব ঘেঁটে গেলেই ওরা শেষ হয়ে যাবে। কর্পোরেট দুনিয়াকে অচল কর।
স্বপ্ননীল অফিসের কয়েকজনকে তার ভাবনা বলে। কেউ রাজি, কেউ নয়। সবচেয়ে মজার অবস্থান নিল পাকড়াশি দা। স্বপ্ননীলদের নানা তথ্য দিলেও সরাসরি এই অনাচারে যুক্ত হল না। সাত্যকি বলেছিল, ও শালা চিরকালের হারামি। বুলি কপচাবে, কাজে লবডঙ্কা। সাত্যকির কদিনের ভূমিকায় স্বপ্ননীল একটু অবাকই হয়েছে। খাও দাও মস্তি কর এই তার জীবন দর্শন। কাঠিও দেবে না, কারোর পাশেও দাঁড়াবে না। সেই সাত্যকি এখন সবচেয়ে র্যাডিকাল। কাজ গেলে যাবে। শেষ দেখে ছাড়ব – এমনই হাবভাব।
এদেশেরই নয়, অন্যান্য দেশের অনেকের সঙ্গেও যোগাযোগ হল। আজকের দুনিয়ায় তা খুবই সহজ। স্বপ্ননীলরা বুঝল না কীভাবে তাদের ওপর নজরদারি চলছে। সরকার নয়, প্রতিদিন মেপে নিচ্ছে কর্পোরেট দুনিয়া। স্বপ্ননীলরা যেগুলোকে অস্ত্র মনে করে, সেগুলো আসলে তাদেরই মারণাস্ত্র। একের সঙ্গে অপরের যোগাযোগ। সরকারি ব্যাঙ্কে অর্থের লেনদেন, ডিজিটাল লেনদেন সবই এক কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডারে জমা হচ্ছে। কোথায়, কখন যাচ্ছে, কার সঙ্গে দেখা করছে সবই ধরা পড়ছে। কর্পোরেটের বেধে দেওয়া ছন্দে না চললেই সন্দেহজনক। তাদের ওপর বিশেষ নজরদারি। আর সন্দেহভাজনদের বিপজ্জনক বলে রাষ্ট্র ও পাব্লিককে খেপানো তো হাতের মোয়া।
স্বপ্ননীলদের বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেল। যখন বুঝল তখন তারা জালে বন্দি। অসহায়। প্রযুক্তির চোরাবালিতে ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে তারা। সাত্যকি গণপিটুনিতে খুন হয়ে গেল। রাস্তার নজরদারি ক্যামেরা ‘প্রমাণ’ করে দিল সে নাকি মোবাইল চুরি করতে গিয়ে পাব্লিকের হাতে ধরা পড়ে। বিপাশা বেমালুম হারিয়ে গেল। রেডিও ট্যাক্সিতে সে নাকি ডায়মন্ডহারবারের দিকে রওনা দিয়েছিল। ম্যানেজমেন্টের কাছে সাতে-পাঁচে না থাকার ভাব নিয়ে ঘুরলেও পাকড়াশি দাকেও পাকড়াও করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সেই স্বপ্ননীলকে পালিয়ে যেতে বলল। সঙ্গে যেন কোনও কার্ড, মোবাইল না থাকে। অ্যাপে যেন ট্যাক্সি বুক না করে।
বাড়ি ফেরার জন্য হলুদ ট্যাক্সি নিয়েছিল স্বপ্ননীল। তার আগে মোবাইলটা ফেলে দিয়েছিল। গতিবিধির ওপর যাতে কেউ নজর রাখতে না পারে সে বিষয়ে সজাগ ছিল। ট্যাক্সিকে ইচ্ছে করেই ডানকুনি দিয়ে ঘুরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, চারিদিকে যন্ত্র তার ওপর নজর রাখছে। জামা-প্যান্টটাও খুলে ফেলতে পারলে স্বস্তি পেত।
ডানকুনি অবধি সবই ঠিক চলছিল। তারপরেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দিল্লি রোড না ধরে ট্যাক্সি তীব্রগতিতে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ছুটতে লাগল। ড্রাইভারকে দেখে মনে হল, মানুষ নয় একটা যন্ত্র। কারোর নির্দেশে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে। ঘোরের মধ্যে এক তীব্র ঝাঁকুনি। এরপর আর কিছুই স্বপ্ননীলের মনে পরছে না।
স্বপ্ননীল দেখল তার কাছে এখন কিছুই নেই। স্বস্তি পেল। আর কেউ নজরদারি করতে পারবে না। সময় এগিয়ে চলেছে ভোরের দিকে। ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। শিশিরে ভিজছিল সে। দেখল কাছেই কাশফুল ফুটে রয়েছে। ঘুমটি ঘরের দোকানটা খুলে গেছে। কিছু লোক হাঁড়ি নিয়ে চলেছে। চায়ের দোকানের রেডিওতে ভেসে আসছে গানঃ ‘তোমরা নাকি এখনও স্বপ্ন দেখো এখনও গল্প লেখো গান গাও প্রাণ ভরে মানুষের বাঁচা মরা এখনও ভাবিয়ে তোলে…’
ঠিক সেই মুহূর্তেই স্বপ্ননীলের কাছে এক সঙ্কেত এল । স্বপ্নের সমান্তরাল ওয়েব। কোনও কর্পোরেট বা তার চামচা, টিকটিকি, গিরগিটির চোদ্দ পুরুষের ক্ষমতা নেই তার ওপরে নজরদারি করার।
Tags: নজরদারি, মৃন্ময় সেনগুপ্ত
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।