১
সারাদিন অখণ্ড অবসর।
জীবন বড়ো নিস্তরঙ্গ।
কাছেই কোথাও কোকিল ডাকছে। আর তার সাথে আসছে ছাতারে পাখিদের হিসেব না মেলা ঝগড়া। বড় খেয়ালী এ সকাল। আর খুব আলতো। মুঠো করে না ধরলে যেন ঝরে যাবে। শব্দ বলতে একটা হচ্ছে বটে। গুনগুন,গুঞ্জন।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন দীপান্তবাবু।
ফেলে রাখা.. পড়ে থাকা তানপুরা থেকে একটা ভ্রমর বেরিয়ে আসছে। রসিক কবি।তার আবাস নির্বাচন অভ্রান্ত।
…. খুব ব্যঞ্জনাময় গানের গলা ছিল সুরঙ্গমার।
তানপুরা বাজিয়ে গান করত মাঝেমাঝে। সব গান যেন পরবাস নিয়ে। পরবাসী চলে এসো ঘরে….অথচ নিজেই আগে খুঁজতে চলে গেল সেই ঠিকানা। কি অমিল,কি অমিল।
সেই থেকেই খুজে নিয়েছে মন মিল পাবার খেলা। মিল খোঁজে এখন দীপান্তবাবুর মন। না। অন্তমিল দেওয়া কবিতা টবিতা নয়।সামান্য আয়োজন এ অবসর যাপনের। শব্দছক।
খবরের কাগজ,পত্রিকা যেটাই আসে তারি শূণ্যস্থান ভরে যায় কালিতে। অমিল যে বড় অসহ্য।
তবুও তো গরমিল না হয়ে যায়না। সুরঙ্গমা চলে গেলো দূরে,ছেলে রূপান্ত আজ সত্যি সত্যি পরবাসে..ভেসে আসে শব্দ। টেলিফোনে পিতৃঋণ শোধ করে ছেলে। কথা এসেছে কমে। দুতরফেই। তবু থামেনা শব্দের প্রয়োজন,প্রবাহপথ তাই এখন মুখ থেকে হাত,কালি কলমে।এ বাড়িতে এখন চরিত্র বলতে ওরাই।
খানিকটা এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে এল ভ্রমর।
অনেকটা সময় আনমনা হয়ে গেছিলেন দীপান্তবাবু।
ফিরে এলেন নিজের ছকে।
“আর কত মিল খুজবে? সবই যে অমিল। দেখতে পাওনা? সাদা’র পরে কালো কালো ছক।”
কে?তুমি কতক্ষণ এলে?
ভুল তো নয়। সুরঙ্গমা। ঠিক।একদম সে।
আওয়াজ আসছে বাঁ দিক থেকে।সে দিকটা তো অচল। ডানদিকে প্রাণ। ডানদিক সচল। তাই বুঝছেন ডান দিকের কোন শব্দ এটা নয়।প্যারালিসিস হওয়া বাঁ দিক থেকে এ আওয়াজ। চলতে থাকে এ অস্বস্তি। অথচ কি নিরুপায় তিনি।
খুব ঘাম হচ্ছে এবার।একা বাড়িতে থাকতে হয়। শেষে এবার দিনের বেলা নিশি ডাকবে নাকি? “দিনের বেলা নিশি কিগো,কি যা তা বলছ। বলি সকাল থেকে একটা কিছু লিখেছ?”
এবার? অবিশাস্য। দীপান্তবাবুকে কিছু না করতে পেরে দুচোখের মনিকে যতটা হয় বামদিকে সরাতে হল।
কেউ নেই। খোলা জানালা দিয়ে দুরের মাঠ দেখা যায় ওদিকে।শরীরটা আবার আগের মতো হাল্কা লাগছে।
মীনাও আজ সকালবেলা আসতে দেরী হবে বলে গেছে। অন্ততপক্ষে এগারোটা বাজবে।শুকনো মুড়ি আর ছোলা বাটিতে চাপা দেওয়া। ঠিক তার পিছন থেকে উকি দিয়ে দেখছে হোমিওপ্যাথের কটা শিশি।
শরীরটা হাল্কা। কাল রাতে সুরঙ্গমা এসেছিল। সাদা পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দিয়ে গেল। যাবার সময় যত ক্লেদ জমা ছিল সব আঁচলে বেধে নিয়ে গেছে সে। অস্থি,মজ্জা,রক্ত সব খুলে দিয়েছিল। নাকে চাপা দিয়েছিলেন দীপান্তবাবু।
তবে? না না ঘাম তো হচ্ছেনা আর। নবকলেবরের পর এমন নাকি হয়। কিছু একটা রয়ে গেছে।যার জন্য এখনও এ অনূভূতি আছে। অবশ্য সুরঙ্গমা বলেছিল একথা।
অজানা যেন কিছুই নেই আর। কোনো যন্ত্রনাও নেই কোথাও। অথচ কি আশ্চর্যজনক ব্যাপার যে কিছুতেই তিনি আর লিখতে পারছেন না। কালো ,মোটা ওয়াটারম্যান পেনটাও বিশ্রাম নিচ্ছে। প্রতিদিন তাকে সাদা,কালো মেঝের মত কাগজে কালিও গরাতে হয়।বিক্ষিপ্ত দীপান্তবাবু আজ হাল্কা।শান্ত।
টেবিলের ওপর রয়েছে বাসি একবাটি মুড়ি,বাটির কোনা বেয়ে উঠতে চাইছে দু-তিনটে পিপড়ে। দুপুরের খাবারের সন্ধানে। ঘড়ির কাটা এগারোটার দিকে চলেছে।
একটা শব্দ নিয়েও ভাবা হলনা আজ সকাল থেকে। বারবার একটা অন্য অস্তিত্ব টের পাচ্ছেন। তানপুরার ভ্রমর এগিয়ে আসছে সামনে, কোনো আওয়াজ না করে।এগিয়ে আসতে আসতে ভ্রুর মাঝখানে থামতে চাইছে, ক্রমশ যত কাছে এল তত অবশ হয়ে এল সমস্ত ভাবনা শক্তি। একেএকে তিনি পেলেন অচেনা কত রেণুর গন্ধ।
২
মোড়ের মাথায় জ্যাম পেরিয়ে আসতে একটু দেরী হয়ে গেলো মীনার। অভ্যাসমতো চাবি খুলে ওপরে উঠে এল। হ্যান্ডলক খুলে দরজা খুলতেই পা-দুটো নিজের অজান্তেই কেপে উঠলো। কিছু কালো পোকা ওড়াউড়ি করছে। কাছে সরে গিয়ে চিৎকার করার আগে ভালোভাবে মীনা দেখলো সারে সারে,ধীরে ধীরে অনেকগুলো ভ্রমরের মতো পোকা বেরিয়ে যাচ্ছে তানপুরার ভেতর থেকে।দাদাবাবু চেয়ে আছে একভাবে।ঘুমিয়ে নেই।একজন শীতল, জীবন্ত মানুষকেই বারবার ঠেলে ঠেলে জাগাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে মীনা।
Tags: কী্ট, শুভম ব্যানার্জি
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।