ত্রিলোকনাথ গোস্বামী প্রতিদিনের মতই নিজের সাধনায় বসেছে। দুধওয়ালা শুভ, প্রতিদিনের মত দুধের প্যাকেটটা নিয়ে আসল – ত্রিলোকনাথের ঘরের সামনে। দুটো টোকা মারল দরজার উপর। ভালো করে ত্রিলোকনাথের দিকে তাকিয়ে দেখল, সে পদ্মাসনে বসে রয়েছে। ত্রিলোকনাথ কোনো সারা না দেওয়াতে – শুভ নিজেই ঘরে ঢুকে, টেবিলের উপর রাখা পাত্রে – দুধের প্যাকেটটা রেখে দিল।
শুভ-র বয়স বেশী নয়, বাইশ-তেইশ হ’বে। ছোটো বেলায় শুভর বাবা-মা মারা যায়। মারা যা’বার আগে তারা শুভর কাছে রেখে যায় – তার থেকে বছর চারেকের ছোটো একটি ভাইকে। শুভ তখন ক্লাস এইটে পরে। সংসারে ঠেকনা দেওয়ার আর কেউ ছিল না বলে – তাকে পড়াশুনা ছেড়ে দিতে হয়। কাজে লেগে পড়তে হয় তাকে। তারপর থেকে, সংসারের খরচ এবং ছোটো ভাইয়ের পড়াশুনার খরচ – সমান-তালে চালিয়ে আসছে সে। তার ইচ্ছা ছোটো ভাইকে পড়াশুনা করিয়ে – বিশাল বড় ডাক্তার বানাবে! এখন সে পাড়ারই একটা দুধের দোকানে কাজ করে। প্রায় বছরখানেক হ’ল – সে ত্রিলোকনাথের বাড়িতে এসে দুধ দিয়ে যায়।
আজ সে গুটি-গুটি পায়ে ত্রিলোকনাথের সামনে এগিয়ে এসে – হাত নাড়িয়ে, চোখের উপর-নীচে উঁকি মেরে দেখে তার জ্ঞান রয়েছে কিনা!
কিছুক্ষন উঁকি-ঝুঁকি মারার পর, সে ত্রিলোকনাথের শরীরে খোঁচা মেরে ডাকতে শুরু করল, “দাদা, দাদা…”
হঠাত্ই নিজের পাশে দেখতে পেল একটা পাত্রে রাখা খানিকটা জল উল্টে পড়ে গিয়ে, লেখা হয়ে যাচ্ছে – ‘করিস না’!
শুভ – ভয়ে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে, ঘরের এককোণে গিয়ে ঠক্ঠক্ করে কাঁপতে শুরু করল।
কিছুক্ষন পর, চোখ খুলল ত্রিলোকনাথ। কথা বলল, “কি জন্য ডাকছিলি – বল?”
শুভর মুখ থেকে কোনো আওয়াজই বের হ’ল না। শুধুমাত্র তর্জনীর ঈশারার মাধ্যমে মেঝের লেখাটা সে দেখিয়ে দিল ত্রিলোকনাথকে।
মৃদু হাসল ত্রিলোকনাথ। “এটা তো আমিই লিখেছি। তুই আমাকে স্পর্শ করছিলি! তাই আমি বাধ্য হয়ে এ’কাজ করেছি। তোকে ভয় দেখানো আমার উদ্দেশ্য ছিল না! তবে শুনে রাখ যখন কেউ ধ্যানে বসবে, তখন তাকে স্পর্শ করতে নেই।” –সে বলল।
“ক্…ক্…কিন্তু…!” –কথা বের হ’ল না শুভর মুখ থেকে।
“বুঝলি না? একে বলে সুক্ষ্ম শরীরে বিচরণ করা। ইংরেজিতে বলে- Astral Body Projection. আমি ধ্যানে বসে – নিজের স্থূল শরীর থেকে সুক্ষ্ম শরীর, অর্থাৎ আত্মা-টা বের করে; যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারি। কিন্তু সেই সময় কেউ যদি – স্থূল শরীরটাকে স্পর্শ করে, তাহলে সুক্ষ্ম শরীরটা উপদ্রুত হয়; এবং স্থূল শরীরে ফিরে আসার চেষ্টা করে – কাজ অসমাপ্ত রেখেই। যাইহোক, এ’বার বল – আমাকে ডাকছিলি কেন?”
“ম্…মাসের… টাকাটা… যদি দিতে… ভালো হ’ত!” শুভ ঢোক্ গিলে গিলে বলল।
ত্রিলোকনাথ উঠে – তার ব্যাগ থেকে ৫৪০ টাকা বের করে, শুভর হাতে দিল।
শুভ টাকাটা নিয়েই দৌড়ে বেড়িয়ে গেল ত্রিলোকনাথের ঘর থেকে।
***
পরের দিন শুভ ভয়ে ভয়ে ত্রিলোকনাথের ঘরে ঢুকে – দুধ রাখার জায়গায় প্যাকেটটা রেখে, কোনো কথা না বলে –ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।
***
একসপ্তাহ পর নির্দিষ্ট জায়গা-মতো দুধের প্যাকেটটা রাখল শুভ। তার ভয় অনেকটাই কেটে গিয়েছে এতদিনে। ত্রিলোকনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে – সে কিছুদূরে মেঝেতে গিয়ে বসল।
কিছুক্ষন পর চোখ খুলল ত্রিলোকনাথ। “কেমন আছিস শুভ? কিছু বলবি আমাকে?” –সে জিজ্ঞেস করল।
“ত্রিলোক-দা, আমাকে শিখিয়ে দেবে – তোমার মতো ‘সুক্ষ্ম শরীরে বিচরণ করা’?”
কিছুক্ষন কোনো কথা না বলে – বসে রইল ত্রিলোকনাথ। তারপর, নিজের আসন ছেড়ে উঠে গেল – ঘরে রাখা একটি জলের বোতলের কাছে। একটু জল খেল সে বোতল থেকে। তারপর বলল, “এ’কাজ করার সাধ্য সবার নেই রে শুভ। অনেক ধৈর্যের প্রয়োজন। আমি বছরের পর বছর সাধনা করে ফল পেয়েছি।”
হঠাৎ করে, শুভ এসে ত্রিলোকনাথের পা জড়িয়ে ধরে। কাকুতির সুরে সে বলে, “দয়া করে আমাকে শিখিয়ে দাও ত্রিলোকদা। আমাকে তোমার শিষ্য বানিয়ে নাও। আমি সব কিছু করতে রাজি আছি।”
শুভকে পায়ের কাছ থেকে টেনে তুলল ত্রিলোকনাথ। কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল তার চোখের দিকে। তারপর, কি একটা ভেবে – রাজী হয়ে গেল সে। বলল, “ঠিক আছে। কাল থেকে তুই আয়। সকাল ছ’টা থেকে আটটা, প্রতিদিন। এই সময়ে অন্য কাজ রাখবি না কিন্তু। আর… আমার কাছে কামাই করা চলবে না। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে, দাদা।”
“আজ যা তবে।”
***
পরদিন, সকাল ছ’টাতেই পৌঁছে শুভ বলল, “এসে গিয়েছি দাদা।”
“আয় শুভ, তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।” –ত্রিলোক বলল।
হাতে একটা ডায়েরি তুলে, এগিয়ে এল ত্রিলোক শুভর দিকে। সে জিজ্ঞেস করল, “পড়াশুনা কদ্দূর করেছিস?”
মাথা নীচু করে শুভ বলল, “এইট… মানে…সেভেন। এইটে উঠে ছেড়ে দিয়েছি।”
“ঠিক আছে, এটা ধর। এতে আমার বহু বছরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লেখা আছে। পড়বি এটা।” –ডায়েরিটা শুভর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে, বলল ত্রিলোকনাথ। “এখন বস এখানে।” –আগে থেকেই পেতে রাখা একটা আসন দেখিয়ে বলল সে।
শুভকে পদ্মাসনে বসার ভঙ্গি শিখিয়ে দিয়ে, নিজেও আরেকটি জায়গায় গিয়ে পদ্মাসনে বসল ত্রিলোকনাথ।
“চোখ বন্ধ করার পর যখন চারিদিক অন্ধকার হয়ে যাবে, তখন একটা উজ্জ্বল বিন্দু খোঁজার চেষ্টা করবি। যখন খুঁজে পেয়ে যাবি, তখন মনের চক্ষু দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকবি সে’টার দিকে। ভুলে যাবি বাকি পৃথিবীর কথা। বিন্দুটিকে খুঁজে পেলে, তার মধ্যে খোঁজার চেষ্টা করবি – যাকে তুই মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসিস। হ’তে পারে সে তোর মা, অথবা বাবা, তোর ভাই, বোন, প্রেমিকা, অথবা তোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেউ! আমি যেমন ঐ বিন্দুতে আমার মা কালীর মুখ খুঁজে পাই।” –কথাগুলো বলে একটু বিশ্রাম নিল ত্রিলোকনাথ। তারপর বলল, “…নে, এ’বার চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বস, আর ওই বিন্দুটা খোঁজার চেষ্টা কর।”
চোখ বন্ধ করল শুভ। ত্রিলোকনাথও চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসল।
কিছুক্ষন পর, ত্রিলোকনাথের শরীর থেকে বেড়িয়ে আসল আত্মা। তারপর, ঘরের বন্ধ দরজার এ’পার থেকে ও’পারে চলে গেল সে।
কিন্তু, শুভর শরীর থেকে বের হ’ল না আত্মা। আরও কিছুক্ষন পরও তার কোনোরকম উন্নতি দেখা গেল না। একটা মশা বড্ড জ্বালাচ্ছিল তাকে। এতক্ষন দাঁতে দাঁত চেপে সে মশার কামড় খাচ্ছিল। এখন আর সহ্য করতে পারল না। হাত তুলে – চটাশ্ করে এক চাপড় চালিয়ে দিল থাই-এ বসে থাকা মশার উপর।
তারপর আর কিছুতেই ধ্যানে মনযোগ বসাতে পারল না শুভ।
কিছুক্ষন পর, চোখ খুল ত্রিলোকনাথ। শুভর অবস্থা দেখে – সে মৃদু হাসল। শুভ কিছু বলতেই যাচ্ছিল…। কিন্তু তার আগেই ত্রিলোকনাথ বলল, “হ’বে হ’বে। আমি ছয় বছর অভ্যাসের পর সফলতা পেয়েছি; আর তোর তো আজ প্রথম দিন। যা, বাড়ি গিয়ে ভালো করে পড়িস ডায়েরিটা।”
***
পরের দিন ত্রিলোকনাথ ও শুভ, নিজের নিজের আসনে বসেছে।
“আচ্ছা ত্রিলোকদা, তুমি তোমার ডায়েরিতে লিখেছ ‘সুক্ষ্ম শরীরে বিচরণ করার সময় – শুধুমাত্র পঞ্চভুতের অনুভুতি পাওয়া যায়।’ –এই ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবে?” –শুভ জিজ্ঞেস করল।
“পঞ্চভূত হ’ল- পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু এবং আকাশ। শুধুমাত্র এই পাঁচটা ভূতেরই অনুভুতি পাওয়া যাবে – সুক্ষ্ম শরীরে বিচরণের সময়, বাকি কোনো জিনিসের নয়। পৃথিবী অর্থাৎ মাটি, এর অনুভুতি পাওয়া যাবে বলেই তুই মাটির উপর দিয়ে হেঁটে চলতে পারবি। আগুন এবং জল-কে ছুঁয়ে দেখতে পারবি। কোনো জায়গায় প্রবল হাওয়া বইতে থাকলে – সেটা অনুভব করতে পারবি। আর আকাশ-কেও তুই অনুভব করতে পারবি, তার ফলে তুই উড়ে বেড়াতেও পারবি। এছাড়া বাকি সব জিনিস, যেমন – কাঁচ, কাঠ, লোহা, ইত্যাদি ইত্যাদি বহু জিনিস তোর অনুভুতির বাইরে চলে যাবে সুক্ষ্ম শরীরে বিচরণ করার সময়। যার ফলে, একটা কাঁচ বা কাঠের দরজা না খুলেও – তুই এপার থেকে অপার চলে যেতে পারবি। এইরকম আরও বহু জিনিস তুই বুঝতে পারবি – যখন নিজে সুক্ষ্ম শরীরের বিচরন করবি। তবে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথাঃ যদি তুই কখনও কোনো মানুষের সামনে সুক্ষ্ম শরীরে এসে – পাপ কাজ করিস, তাহলে কালী মায়ের প্রকোপে তুই তোর শক্তি হারাবি। এমনও হ’তে পারে – তুই আর কোনোদিন নিজের শরীরে প্রবেশ করতে পারলি না! তাই… সাবধান! অসৎ উদ্দেশ্য ত্যাগ করে সবসময় সত্যের পথে চলবি।”
“ঠিক আছে ত্রিলোক দা।”
“নে, ধ্যানে বস এইবার…”
কিছুক্ষন পর শুভ কাঁদো কাঁদো মুখে বলল- “আমার দ্বারা হ’বে না মনে হচ্ছে!”
“আমি তো তোকে আগেই বলেছিলাম এ’কাজ করার সাধ্য সবার নেই। মনের দৃঢ়তা আনতে হ’বে, আর প্রচুর অভ্যাস করতে হ’বে। তবেই পাওয়া যাবে এ’কাজে সফলতা। আজকের মত বাড়ি যা।”
***
দুপুর বেলা শুভ কোনো রকমে রান্না-বান্না করে, ভাইকে খেতে দিয়ে, নিজেও অল্প খেয়ে – ত্রিলোকনাথের ডায়েরি নিয়ে বসে পড়ল।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হ’ল।
শুভর ভাই – জয়-এর এক সহপাঠিনী প্রায় প্রতিদিনই আসে তাদের বাড়িতে। জয় এবং তার সহপাঠিনী সোহিনী – একসাথেই পড়াশুনা করে শুভর ঘরে বসে। মাঝে মধ্যে সোহিনী এসে শুধু নোট্স নিয়েই চলে যায়। তাছাড়া জয় এবং সোহিনীর মধ্যে একটা ভালোবাসার সম্পর্কও রয়েছে; যেটা শুভরও অজানা নয়।
আজও ঠিক সময়মতোই সোহিনী এল। সে এবং জয় একসাথে পড়াশুনা করতে বসল। শুভ, তাদের জন্য জায়গা ফাঁকা করে – খাটের এককোণে গিয়ে বসে পড়ল। ত্রিলোকনাথের ডায়েরির লেখাগুলো যাতে কারোর নজরবন্দী না হয় – তার জন্য সে ডায়েরীটাকে মুখের সামনে তুলে ধরে পড়তে শুরু করেছে।
কিছুক্ষন পর, কি একটা মনে হওয়াতে – সে মুখের সামনের ডায়েরিটা স্বল্প নামিয়ে দেখে সোহিনী এবং জয় – একে-অপরের হাতে হাত রেখে পড়াশুনা করছে।
শুভ কোনো কথা না বলে – ঘর থেকে বেড়িয়ে চলে যায়। একে-অপরের থেকে হাত সরিয়ে নেয় – জয় ও সোহিনী।
***
পরের দিন, বাড়িতে যেতেই শুভকে বসতে বলল ত্রিলোকনাথ।
ত্রিলোকনাথ এবং শুভ – দু’জনেই পদ্মাসনে বসে চোখ বন্ধ করল।
আজ ঘুটঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে শুভ খুজে পেল ছোট্ট একটা আলোর বিন্দু। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর – বিন্দুটি ক্রমশ বড় হ’তে থাকল। শুভ সেই বিন্দুর মধ্যে দেখতে পেল সোহিনীর মুখ।
তার সুক্ষ্ম শরীর বেড়িয়ে আসল স্থূল শরীর থেকে। ঘুরে তাকিয়ে নিল সে নিজের স্থূল শরীরের দিকে। অনড় অবস্থায় বসে রয়েছে সেটি একটি আসনের উপর। আরও কিছুটা এগিয়ে আসল সে। তার ঠোঁটের কোণায় ফুটে উঠল এক শয়তানি হাসি!
Tags: সুক্ষ্ম শরীরে, সুমন সেন
email:galpersamay@gmail.com
Subham Paul on September 26, 2017
অসাধারন
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।