[ক্যাথরিন ম্যানসফিল্ড-এর জন্ম, ১৮৮৮ সালে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন শহরে। তাঁর শিক্ষাজীবনের বেশ কিছুটা লন্ডনে, এবং সেখান থেকেই তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু। ১০১২ সালে বিখ্যাত সমালোচক এবং সম্পাদক মিডলটন মারির সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং পরে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। ইতিমধ্যে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধে তাঁর ভাই লেসলি মারা যান। এই ঘটনা তাঁর সাহিত্য জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।
‘দ্য ফ্লাই’ বা মাছি গল্পটি ম্যানসফিল্ডের একটি বিখ্যাত ও বহুপঠিত গল্প। এটি The Dove’s Nest নামক সংকলনের অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়াও ম্যানসফিল্ডের উল্লেখযোগ্য কাজগুলির মধ্যে আছে Bliss and other stories (1920), The Garden Party (1922) ইত্যাদি। ম্যানসফিল্ড তাঁর রচনাকে সাধারণ-একাকী-বিষাদগ্রস্ত মানুষের জীবন ও চিন্তাকে প্রকাশ করার মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। ‘দ্য ফ্লাই’কে ইংরাজি সাহিত্যের প্রথম সারির পনেরোটি ছোটো গল্পের মধ্যে একটি বলে গণ্য করা হয়। লেখিকার মৃত্যূ ১৯২৩ সালে, অক্টোবর মাসের একটা দিনে, মাত্র ৩৫ বছর বয়সে।
‘দ্য ফ্লাই’এর মতো ছোটোগল্প অনুবাদ করতে হলে অনুবাদককে কতকগুলি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। প্রথমত, এর বিষয়বস্তুর স্বল্পতা। গল্পটিতে মূল ঘটনা সামান্যই। সেটা এক’দু কথাতেই সেরে নেওয়া যায়। তাই ঘটনা বা বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে অনুবাদ করলে রসসৃষ্টিতে বৈষয়িকতাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সেটা হয়ে যায় ‘ওথেলো’ নাটক না পড়ে ‘স্ত্রীর সম্বন্ধে স্বামীর ঈর্ষা’ শীর্ষক কোনো প্রবন্ধ পড়ার মতো।
দ্বিতীয়ত, ভাষান্তরের অসুবিধা। মুজতবা আলি বর্ণিত ‘চাচা কাহিনী’র প্রখ্যাত মদ্যপ সূর্য রায়ের মন্তব্য এস্থলে স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি যেমন বলেছিলেন – ‘পান্তা ভাতে কাঁচালঙ্কা চটকে এক সানক গিলে এলুম, এ জিনিস জর্মনে বলা যায় না।’ তেমনি প্রত্যেকটি ভাষারই বেশ কিছু ভাব আছে যেটা পুরোপুরি অন্য একটা ভাষায় রূপান্তরিত করা যায় না। ভাবগুলো তার একান্ত নিজস্ব, সে ভাষাভাষী মানুষে পারিপার্শ্বিকতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। যা খুব স্বাভাবিক ভাবেই স্থান ও পাত্র ভেদে ভিন্নতর হতে বাধ্য।
আসলে আমাদের ভাটিয়ালির যেমন রাইন, টেমস, তা হাডসনীয় সংস্করণ হয় না। তেমনি কিটস-এর … and for many time I have been half in love with easeful Death কথাগুলোর আক্ষরিক অনুবাদ করতে হলে সাহিত্য রস চটকে চিটেগুড় হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। তাই, অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো অনুবাদকের প্রাপ্য স্বাধীনতার সীমা লঙ্ঘন করেছি। সেটা মূল গল্পটিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করার সৎ উদ্দেশ্যেই। পত্রিকার পাঠকরা অবুঝ নন এটা জেনেই এই অনুবাদ তাঁদের হাতে নির্ভয়ে তুলে দিচ্ছি। – পীযূষ আশ (অনুবাদক)]
……………………………………………………………………..
দারুণ সাজিয়েছেন কিন্তু ঘরটা, বেশ আরামেই রয়েছেন দেখছি…
একটা বাচ্চা যেমন চারপাশের পরিবেশটা সমঝে নেবার জন্য তার দোলনা থেকে মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে বিলক্ষণ সন্তুষ্টি প্রকাশ করে, ঠিক তেমনই বড় আর্মচেয়ারটা থেকে আর একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে তারিফ করলেন মিস্টার উডিফিল্ড।
যদিও নতুন করে কিছু বলার নেই তবুও উডিফিল্ডের একটুও বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। সপ্তাহে তো মাত্র এই একটা দিন। তাছাড়া বস ঘরটা সাজিয়েছেন খুব সুন্দর…সুতরাং চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিয়ে মিস্টার উডিফিল্ড নতুন প্রসঙ্গ খুঁজতে লাগলেন, যা নিয়ে বসের সঙ্গে আরেকটু গল্প করা যায়।
আসলে অবসর গ্রহণের পর আর পাঁচটা লোকের মতো উডিফিল্ডও একটু বুড়িয়ে গেছেন। সেইজন্য আর পাঁচটা পরিবারের মতো তাঁর পরিবারও সারা সপ্তাহ অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে তাঁকে ঘরবন্দি করে রাখে। কেবলমাত্র এই মঙ্গলবারটা ছাড়া। শুধু এই দিনটাতে তাঁর বাইরে বেরুনোর ছাড় আছে। অবশ্য তাঁর বাড়ির লোক মনে করে বাইরে গিয়ে বন্ধুদের বিরক্তি উৎপাদন ছাড়া আর কিছুই করেন না। তাই ছাড়া পেলেই তিনি অফিসে চলে আসেন। বসের সঙ্গে গল্প-গুজব করেন…পাতা ঝরার দিনগুলোতে গাছ যেমন তার শেষ পাতাটিকেও আঁকড়ে ধরে নিজের সবুজ যৌবনের স্মৃতিচারণ করে, তেমন কর্মব্যস্ত অফিসের যোগসূত্র ধরে বুড়িয়ে যাওয়া উডিফিল্ডও তাঁর ফেলে আসে কর্মময় জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করেন…
তাছাড়া বসের ঘরটা এত সুন্দর সাজানো। পুনর্বার তারিফ করলেন টেবিলের অন্যপ্রান্তে উপবিষ্ট বসকে।
যাকে উদ্দেশ্য করে এই তারিফ, তিনি এতক্ষণ ‘ফিনান্সিয়াল টাইমের’ পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। যদিও কাগজের দিকে তাঁর মন ছিল না। উডিফিল্ডের এই প্রশংসা বাক্য তিনি তাঁর সমস্ত সত্তা দিতে উপভোগ করেছিলেন। এ লোকটিকে তাঁর ভালোলাগে। না, কথাটা বোধহয় ঠিক হল না।
আসলে এই পরিবেশে লোকটির উপস্থিতি তাঁকে খুশি করে। তাঁর চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট কিন্তু দুর্বল, বাড়ির মেয়েদের শাসনাধীন মাফলার পরিহিত জবুথুবু এক প্রায় বৃদ্ধ, আর অন্যদিকে তিনি, একটা লাভজনক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিক, সুস্থ-সবল, এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ কর্মক্ষম, চারপাশে তাঁরই শাসনাধীন কর্মচারীবৃন্দ – এ তুলনামূলক তথ্যগুলো তাঁকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়।
-ইয়ে, ঠিকই বলেছেন আপনি…
বস এতক্ষণে মুখ খুললেন। তারপর ঘর সাজাতে আর নতুন কী কী কিনেছেন তার দিকে এক এক করে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে লাগলেন…নকশা করা মূল্যবান কার্পেট, সুদৃশ্য বুককেস, ব্যয়বহুল কিন্তু আরামপ্রদ হিটিং সিস্টেম…
এইভাবে ঘরের সব কিছুই প্রায় দেখিয়ে দিলেন। শুধু টেবিলের ওপর পড়ে থাকা একটা ছবি নিয়ে কোনো কথাবার্তা হল না। সামরিক পোষাক পরা দুঃখী দুঃখী মুখের এক কিশোরের ছবি। ওটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। গত ছ’বছর ধরে টেবিলের এক কোণে একইভাবে পড়ে আছে…
ওদিকে মিস্টার উডিফিল্ড মনে হয় কথা বলার জন্য নতুন কিছু খুঁজে পেয়েছেন।
– ওহো, আপনাকে তো বলতে ভুলেই দিয়েছিলাম। হয়েছে কি…আমি বাড়ি থেকে বেরুবার সময়ই ঠিক করে রেখেছিলাম ব্যাপারটা আপনাকে বলব।
একটু থামলেন উডিফিল্ড। মুখে বিরক্তির ছাপ। কারণ, বাড়ি থেকে বেরুবার সময় যা ভাবে রেখেছিলেন সেটা এখন বেমালুম ভুলে গেছেন।
অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। উডিফিল্ড চোখ বুজে কিছুক্ষণ ভাবার চেষ্টা করলেন-না, কোনো লাভ হল না।
‘বেচারা’-মনে মনে উডিফিল্ডকে করুণা না করে পারলেন না বস।
-আমি বলছি আপনার ব্যাপারটা কি…আপনার ব্রেনটা একেবারে ঠাণ্ডা মেরে গেছে। ওটাকে একটু চাঙ্গা করা দরকার। এই বলে আলমারি খুলে একটা মদের বোতল বার করলেন।
-কিন্তু এ…এটাতো হুইস্কি!!!
শঙ্কিত এবং ততোধিক উত্তেজিত হয়ে উঠলেন মিঃ উডিফিল্ড।
-অফকোর্স, এসব কেসে সবথেকে বহাল দাওয়াই।
-কি বলছেন আপনি! জানেন স্ট্রোক হবার পর থেকে আমার বাড়ির লোকেরা আমাকে ও জিনিস ছুঁতেও পর্যন্ত দেয় না।
-আরে রাখুন বউ বাচ্চার কথা। অন্তত এই ব্যাপারটা আমরা ওদের থেকে ভালো বুঝি। আর শরীর খারাপের কথা বলছেন, আপনার তো দূর, কোনো বাচ্চারও ক্ষতি করবে না এ জিনিস। এ একেবারে খাস উইণ্ডসর কাসল এর মাল। ঠিক আছে, নিন এবার ধরুন।
একে দীর্ঘ বিচ্ছেদ, তার ওপর উৎকৃষ্ট হুইস্কির রমনীয় হাতছানি। সামলাতে পারলেন না উডিফিল্ড…
বসের দাওয়াইতে কিন্তু সত্যিই কাজ দিল। একই সাথে মগজ আর মুখ খুলে গেল উডিফিল্ডের-
‘ব্যাপারটা কিছুই না, আমার মেয়েরা, মানে গাট্রুড আর তার বোনেরা কিছুদিন আগে বেলজিয়াম গেছিল…ঐ ওদের ভাই রোগির সমাধি দেখতে। তা ওরা ফিরে এসে যা বলল তাতে ভাবলাম জায়গাটা মোটের ওপর খারাপ না। প্রায় মাইল খানেকের মতো বড়ো সমাধি। কিন্তু বেশ পরিষ্কার, বুঝেছেন-মানে কর্তারা মাঝে মাঝে দেখভাল করেন আর কি, হেঁ হেঁ…রাস্তা-টাস্তাগুলো বেশ চওড়া আর প্রচুর ফুল আছে…আর, ইয়ে…ওরা আপনার ছেলের সমাধিটাও দেখে এসেছে…ফুল-টুল দিয়ে এসেছে…মানে সব ঠিকঠাক আছে আর কি…আর রোগির থেকে বেশি দূরেও নেই। ভগবান ওদের শান্তিতে রাখুন…
আসলে আপনি একদিন বলেছিলেন না…মেয়েরা বেলজিয়াম গেছে জেনে যদি জানতে চান তাই বললুম আর কি…
উডিফিল্ড একটু থামালেন, উৎসুকভাবে তাকালেন বসের দিকে। একটা অস্ফুট শব্দ ছাড়া বস কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। শুধু মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলেন তিনি শুনছেন।
বোধহয় হুইস্কির গুণে উডিফিল্ড এতেই উৎসাহ পেলেন।
…তবে কি জানেন, সব তো আর মনের মতো হয় না।
ওখানকার হোটেলওলাগুলো একেবারে চোর বুঝেছেন। একে তো গলাকাটা দাম তার ওপর…গাট্রুড মনে হয় খাবার সময় কি একটা বাড়তি তরকারি চেয়েছিল, তো সে ব্যাটারা দশ ফ্রাঁ এক্সট্রা চেয়ে বসলো…একেবারে দশ ফ্রাঁ, ভাবতে পারেন। তো আমার মেয়েও সে রকম, আসার সময় হোটেলের দুটো তোয়ালে সরিয়ে এনেছে…টিট ফর ট্যাট, কী বলেন…। কিন্তু এই যে এদের এত বড় বাড়…সেটা কীজন্য হয়েছে জানেন…আমাদেরই জন্য। জায়গাটা যেহেতু ইয়ে…তাই ওরা ভেবে বসেছে ওরা যা চাইবে তাই-ই আমরা ইয়ে করব…ওরা আসলে আমাদের সিমপ্যাথির জায়গাগুলোকে এক্সপ্লয়েট করছে। ওদের সাথে গাট্রুটের মতো ব্যবহার করা উচিত…একেবারে টিট ফর ট্যাট…ওরে বাবা, এতো দেখছি অনেক বেজে গেল…আচ্ছা তাহলে…।
মিস্টার উডিফিল্ড বিদায় নিলেন।
বস অনেকক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন উডিফিল্ডের গমন পথের দিকে। অবশ্য তার আগে ‘ঠিকই তো, ঠিকই তো’ গোছের সায় দেবার চেষ্টা করেছিলেন উডিফিল্ডের কথায়। কিন্তু ওটা প্রলাপ ছাড়া কিছু নয়। ধীরে ধীরে এই অসংযত অর্দ্ধ প্রলাপের রেশ বসের সমস্ত চিন্তার ভরকেন্দ্র হয়ে যেন এক সর্বগ্রাসী মহাভারের রূপ নিতে লাগলো। তাঁর একমাত্র ছেলে…একটাই ছেলে আজ ৬ বছর হল…উডিফিল্ড নিজেও জানে না কী দুঃখ তিনি বসকে দিয়ে গেলেন। ছেলের কথা যখনই মনে পড়ে তখন তিনি আর নিজেকে বেঁধে রাখতে পারেন না। ওহ! তাঁর একমাত্র সন্তান। কী সুন্দর ছিল তখনকার জীবন। বস কত সুষ্টুভাবে, কত পরিকল্পিতভাবে তাঁর ছেলেকে তৈরি করে তুলছিলেন…তাঁর ব্যবসার জন্য…তাঁর অগাধ সম্পত্তির জন্য…প্রাচুর্যের জন্য, কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল যেদিন মেসি তাঁকে ঐ কালো বর্ডার দেওয়া টেলিগ্রামটা দেখাল। সেই ছেলে আজ যুদ্ধে নিহতদের কবরে শুয়ে আছে।
বস কান্নায় ভেঙে পড়তে উদ্যত হলেন। না, সময়ের কোনো প্রলেপই তাঁর ওপর পড়েনি। ছ’ছটা বছর কেটে গেছে অথচ তাঁর এ শোক যেন সদ্য ক্ষতের মতোই যন্ত্রণাময়। বস যেন কাতরে উঠলেন যন্ত্রণাতে। এ নিদারুন শোকের একমাত্র উপশম কান্না। আগেও যতবার ছেলের কথা মনে পড়েছে তিনি নিদারুন কান্নায় ভেঙে পড়েছেন, তাতে কিছুটা শান্তি পেয়েছেন। আজও তাঁর দরকার কিছুটা কান্না…
কিন্তু…কিন্তু আজ তাঁর চোখে জল আসছে না।
এক ফোঁটা না। অথচ কান্নাটার ভীষণ দরকার ছিল।
শেষ উপায় হিসেবে ছেলেটার ফটোটা হাতে নিলেন।
কিন্তু না, আজ যেন সবই ওলট-পালট। ছেলেটাকে আগে তো কোনোদিন এরকম দেখায়নি … হতাশ হয়ে ফটো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন বস। পরিশ্রান্ত দৃষ্টি ফটো থেকে সরে আসতে লাগলো… আরে ওটা কি! দোয়াতের ভেতর কিছু একটা পড়েছে।
হ্যাঁ, পড়েছে। একটা মাছি!!
না জানি কী করে দোয়াতের ভেতর পড়েছে। মসৃণ কাঁচের দেওয়ালের পিচ্ছিল অভ্যন্তর থেকে মাছিটার বাইরে বেরিয়ে আসার সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। ঘন কালি তার পাগুলোকে গায়ের সঙ্গে সেঁটে দিচ্ছে। সাঁতার কাটার আপ্রাণ চেষ্টা করছে খুদে প্রাণীটা, তবে আর বেশীক্ষণ নয়।
বস খুব সন্তর্পণে মাছিটাকে পেন দিয়ে তুলে রাখলেন একটা ব্লটিং পেপারে। মাছিটার সামনের পা দুটো এবার নড়ে উঠল। তারপর ডানা দুটো থেকে কালি পরিষ্কার করে ছাড়িয়ে দিল সামনের দিকে। বিপদ কেটে গেছে…
এ বিশ্বে এমন অনেক কিছু ঘটে যার দিকে ‘কেন?’ ছুঁড়ে মারলে উত্তর ঠিকরে বেরিয়ে আসে না। হয়ত-মনে হয়-বোধকরি ইত্যাদি শব্দের গোঁজামিল দিয়ে তখন কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হতে হয়। বস এবার যেটা করলেন সেটাও ঠিক একই ধরণের ঘটনা। ড্রপারে কালি নিয়ে মাছিটা যখন উড়তে যাবে ঠিক তখন তার ওপর এক ফোঁটা কালি ফেলে দিলেন। মাছিটা ভয় পেয়ে গেল। নড়তেও সাহস পেল না, আবার যদি কিছু পড়ে।
মাছিটা কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে পড়ে রইল। পোকাটা কী করে না করে দেখার জন্য বস উত্তেজনায় অধীর হয়ে উঠলেন।
নাঃ, ব্লটিং পেপার আস্তে আস্তে শুষে নিচ্ছে কালিটা। তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে স্পন্দন। আবার সেই ভীত সন্ত্রস্ত পা নাড়া ডানা দুটোর কালিমা মুক্ত হবার প্রচেষ্টা…তারপর দেহ থেকে মাথা নীচু করে একমনে একই শ্রমসাধ্য প্রচেষ্টা…সুস্থ হবার, হালকা হবার, জীবনের উপযুক্ত হবার। ‘ব্রাভো’, ক্ষুদে শয়তান ‘ব্রাভো’। নিজের অজান্তেই খুশিয়াল হয়ে ওঠেন বস। মাছিটার সাফল্য যেন তাঁর সাফল্য। মৃত্যু যেন ছাপ ফেলতে না পারে। দ্যাটস দ্য স্পিরিট।
ক্রমশ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন বস। মাছিটার জীবনশক্তি তাঁকে প্ররোচিত করছে আরও প্রাণবন্ত হবার জন্য। আরও প্রাণবন্ত আরও খামখেয়ালি হবার জন্য। …আরও…আরও…যেন চপলমতি বালকের দুষ্টবুদ্ধি তাঁকে পরিচালিত করছে। আবার একফোঁটা কালি ফেললেন মাছিটার ওপর। ঘন একফোঁটা কালি। অন্ধকারময় শীতল একফোঁটা কালি।
একফোঁটা কালির শীতলতা ঘনিয়ে এল সারা ঘরে…এক অনপনেয় শীতলতা হয়ে। এতক্ষণের সমস্ত উত্তেজনা যেন ফিরে গেল তার বিদেহী উৎসে, সমস্ত ঘরের সমস্ত অনুভূতি বসের দৃষ্টির পথ ধরে চোখ রাখল মহার্ঘ টেবিলের পরিশ্রান্ত চোষ কাগজটার ওপর। প্রতিক্ষণের নিস্তব্ধতা…প্রতিক্ষণের নিশ্চলতা জন্ম দিতে লাগল এক অশরীরী যন্ত্রণার…যার যোনি নিঃসৃত কায়িক রূপ বসের সমস্ত সত্ত্বার ওপর পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের অযৌক্তিক অধিকারের মতো বিনির্মিত হতে থাকল উত্তরোত্তর কেন্দ্রীভূত হবার বিষময় সুষুপ্তি নিয়ে।
আরে দাঁড়াও! ওদিকে দেখ – বসের দৃষ্টি আবার চেতনা ফিরে পেল। সত্যিই তো পোকাটার জীবনদীপ একেবারে নিভে যায়নি, হ্যাঁ ইতিমধ্যে কালিও শুকিয়ে গেছে অনেকটা। বারবার শোষণ করতে করতে পরিশ্রান্ত শোষক কাগজটা তার ক্ষমতার তলানি দিয়ে ধীরে ধীরে শুষে নিচ্ছে এবারকার একফোঁটা কালি। সেই সঙ্গে শতাংশের পাল্লায় জীবনের ঘরেই মাছিটার ভাগ্য অনুপ্রবেশ করছে আস্তে আস্তে। আবার সেই সামনের পা দুটো আন্দোলিত হচ্ছে। তবে এবার খুব সতর্কতার সাথে। বেশি নড়াচড়া করতেও সাহস পাচ্ছে না। পাছে নতুন বিপদ এসে পড়ে। না, কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশ্চিন্ত হল মাছিটা। চারপাশে ভয়ের কিছু নেই। তারপর পুনর্বার শুরু করল তার কাজ। অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকে শুকনো করার, ডানা দুটোকে বাতাসে মেলে দেবার, জীবন সম্পর্কে আশাবাদী হবার।
সেই একই শ্রমসাধ্য প্রস্তুতি। তবে এবার অনেক ধীরে ধীরে। তবু জীবন মৃত্যুর তুল্যমূল্য কাজিয়ায় জীবনের বারবার ঔদ্ধত্য দেখে বসের সব সংশয় কেটে যেতে লাগল। মাছিটার প্রতিটি অণুতে জীবনের সঞ্চার বসের সত্তায় জীবনীশক্তি ফিরিয়ে আনছিল দ্বিগুণ হারে। মাছিটার ডানা মেলার প্রতিটি প্রচেষ্টা বসের চেতনাকে এক বেহিসেবি আনন্দের মাদকতায় ভরিয়ে তুলছিল।
বস ঠিক করে ফেললেন। ব্যস, অনেক হয়েছে। আর এক ফোঁটা। তারপর মাছিটার ছুটি।
সুতরাং শেষ একটা ফোঁটা।
ড্রপার থেকে নির্গত হয়ে সরল রেখা বরাবর বিশেষণ বর্জিত অনিবার্যতার মতো এসে পড়ল মাছিটার ওপর। বস উন্মুখ। পুনরায় জীবনের জয়যাত্রায় সাক্ষী হবেন। কাম অন, খুদে শয়তান। হাত পা গুটিয়ে বসে থেক না – বস প্ররোচিত করতে থাকেন মাছিটাকে।
কিন্তু মাছিটাকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। পাগুলো সেঁটে গেছে গায়ের সঙ্গে। ডানা দুটো বিপর্যস্ত। ঘন কালো তরল, কৃষ্ণবর্ণ প্রাণীটার সঙ্গে মিলে মিশে আপন কার্যে ইস্তফা দেওয়া স্থবির ব্লটিংটার ওপর পড়ে রয়েছে।
ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন বস। জীবন মৃত্যূর খেলায় নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। মাছিটাকে সাহায্য করার জন্য কালিটা চেঁছে নেন তিনি। কিন্তু তাতেও লাভ হয় না।
অনিশ্চিত উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে আকাশবিসারী আয়তনের অদমনীয় স্থৈর্য্য যেন সঞ্চারিত হয়েছে ওই দেহটার মধ্যে…জীবনের বিদ্যমান হাস্যকর খামখেয়ালি বা গর্হনীয় দুর্বলতার দিকগুলো আচমকা অগ্রাহ্য করে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর প্রতিটি ক্ষণে স্থিরত্বের রহস্যময় মাধ্যাকর্ষগুণ সজীবতার প্রতিটি প্রবৃত্তি ও প্রবণতাকে কর্মদক্ষ ব্লটিং পেপারের মতো নিতান্ত উদাসীনভাবে শোষণ করছে, জীবন মৃত্যুর দ্বৈরথ দৃশ্যে প্রতারিত নায়কের মতো নেতিবাচক অর্থেই নীরব কোলাজের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠা মৃত্যুর বহুপ্রসারী তথাপি ক্ষণিক বিদ্যমান রূপগুলি সুসংবদ্ধ হয়ে পরম ব্রহ্মের নাভিমণ্ডল হতে ঊদ্গত শক্তি লহরীর আরাধ্য শর্ত হয়ে সমগ্র প্রাণীজগতের সম্মুখে মৃত্যু নিজেই নিজের ‘চরম সত্য’ নামক প্রণিধানযোগ্য সমার্থক শব্দ চয়ন করেছে।
মাছিটা শেষ পর্যন্ত মরে গেল।
বস আবর্জনাটাকে স্থানান্তরিত করলেন বাজে কাগজের ঝুড়িতে। তারপর বেল বাজিয়ে মেসিকে ডাকলেন। আদেশ করলেন ভালোজাতের কিছু ব্লটিং পেপার আনতে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে লাগলেন। কী যেন এক অস্বস্তি তাঁকে ঘিরে ধরছে। কিসের অস্বস্তি… আরে তাইতো, বিরক্তিকর এই ব্যাপারটার আগে তিনি কিছু ভাবছিলেন, ভাবতে ভাবতে হঠাৎ এই সব যত্ত ঝামেলা…
হ্যাঁ, তিনি যেন কী নিয়ে ভাবছিলেন…কী যেন একটা চিন্তা করছিলেন…কিন্তু কী সেটা? কী ভাবছিলেন একটু আগে – বিস্মৃতির অপার শূন্যতার মধ্যে তলিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। মাঝে মাঝে বুদ্ধুদের মতো ভেসে উঠতে লাগল দু-একটা টুকরো ভাবনা।
কী যেন ভাবছিলেন…
কী যেন ভাবছিলেন…
………………………………………..
পীযূষ আশ – লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক,প্রবন্ধকার ও সুলেখক ।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘লোকায়ত’ অষ্টম (১৯৯৯) সংকলনে। সম্পাদকমণ্ডলীর অনুমতিতে এখানে পুনরায় প্রকাশিত হল।
Tags: ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ড, পীযূষ আশ, মাছি
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।