-‘আচ্ছা দাদান, এই তারাগুলোর মধ্যে ঠাম্মা কোনটা?’
-‘ওইযে দাদুভাই সবচেয়ে বড়ো তারাটা দেখো, কী উজ্জ্বল, ওটাই তোমার ঠাম্মা’।
-‘দাদান, সব মানুষই কি মরে গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়?’
-‘না দাদুভাই, যারা ভালো কাজ করে, কক্ষনো মিথ্যেকথা বলে না শুধু তারাই তারা হয়ে আকাশের কালো বুকটাতে ঝিলমিল্ করতে থাকে’।
-‘আচ্ছা দাদান, তারাদের কি কখনও ধরা যায়?’
-‘না দাদুভাই, তারারা তো পৃথিবী থেকে অনেক দূরে তাই তাদের ধরা কখনই সম্ভব নয়’।
-‘কত দূরে?’
-‘কোটি কোটি আলোকবর্ষ’।
-‘আলোকবর্ষ! সেটা আবার কি দাদান?’
কথাগুলো মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে সম্বিত ফিরল নবারুণবাবুর।ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখলেন অন্ধকার আকাশ।তারাগুলো মিটমিট্ করে জ্বলছে। আর অনুভব করলেন তীব্র শীতল হাওয়া তার শরীরটাকে প্রায় অবশ্ করে ফেলেছে। তিনি ছাদের উপর পড়ে আছেন। আলগা শরীর। তার চোখ থেকে দু-তিন ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
নবারুণ বাবু রিটায়ার্ মানুষ। বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। চুল,দাঁড়ি,গোঁফ সব সাদা। তবে চোখের জ্যোতি এখনও প্রবল। চশমা নেন নি। বদ্ স্বভাব একটাই, দাঁতে নখ্ কাটেন। নাতিও শিখে নিয়েছে। জলের
থেকেও ঠান্ডা তার মাথা তবে গলার স্বর বেশ ভারী।তার একমাত্র আদরের নাতি সুনীল। তিনি আদর করে দাদুভাই বলে ডাকেন। তিনি কারো সাথে খুব একটা মিশতেন না। নিজের পরিবার আর কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন সারাদিন। তাই তার বন্ধু-বান্ধব প্রায় ছিল না বললেই চলে। আর বদলি চাকরীর কারনে আত্মীয় স্বজনের সাথেও তার বেশ দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল। তাই এই শেষ বয়সে তার প্রানের বন্ধু ও একমাত্র কথা বলার সঙ্গী ছিল দাদুভাই।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও নবারুণ বাবু স্কুল ছুটির পর দাদুভাইকে নিয়ে আসতে গেছিলেন।স্কুলের সামনে যে রাস্তা দিয়ে সারাদিন হুস্ হুস্ করে গাড়ি যায় সেই রাস্তা আজ পুরো স্তব্ধ। বেশ অবাক হয়েই নবারুণ বাবু এগিয়ে যান। দেখেন স্কুলের গেট থেকে ফুট বিশ দূরে মানুষের জটলা। দূর
থেকে তিনি চিনতে পারেন। ওইতো রোহনের মা,তিতলির মা। আজ কি তবে ওদের তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল? ভাবতে ভাবতে ধীর গতিতে স্কুলের গেটের দিকে এগিয়ে যান নবারুণ বাবু। গার্ডকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি বুঝতে পারেন পিছন থেকে একটা কান্নার রোল তার দিকেই ধেয়ে আসছে। তিনি পিছনে ফেরার আগেই নবনীতার মা তার পায়ে আছড়ে পড়েন। নবারুণ বাবু দেখেন নবনীতার মায়ের হাত রক্ত মাখা। কাপড় রক্তে ভেজা। সে কাঁদছে আর বলছে ‘পারলাম না, আমি বাঁচাতে পারলাম না…..’। নবারুণ বাবু বেশ ভীত হয়ে এগিয়ে গেলেন ভীড়টার দিকে। ভীড়ঠেলে ভিতরে ঢুকে যা দেখলেন তাতে তার চক্ষুস্থির হয়ে গেল। তার দাদুভাই আর নেই। তার মাথাটা বিভৎস ভাবে থেতলে গেছে। নবারুণ বাবু কলের পুতুলের মতো মাটিতে বসে পড়লেন।
ছেলে,বউমা কেউই নবারুণ বাবুকে বিন্দুমাত্র দোষারোপ করেননি। কিছুদিন পর তারা বিদেশে চাকরীর অজুহাতে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিয়েছিলেন। নবারুণ বাবু আটকান নি। তিনি অনুভব করেছিলেন তাদের বুকের যন্ত্রনা। যে বাড়িটা একসময় দাদু-নাতিতে মেতে থাকতো তা আজ পুরো খাঁ খাঁ করছে। বাড়িময় যেন নিস্তব্ধ কান্নারা ভীড় জমিয়েছে। আর সেই নিস্তব্ধতায় নবারুণ বাবুর দম বন্ধ হয়ে আসতো। তিনি নিজের কাছে নিজে অনেক ছোট হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নিজেকে নিজে দোষারোপ করা শুরু করেছিলেন। তিনি ভাবতে শুরু করেন শুধুমাত্র তার জন্যই আজ দুটো কোল ফাঁকা হয়ে গেছে। তার আত্মঅনুশোচনা তীব্র হয়ে উঠেছিলো। ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। আর এসময় একাকীত্ব তার হাতধরে জীবনে বেঁচে থাকার সামান্য রসদটুকুও গ্রীষ্মের তপ্ত মাটির মতো শুষে নেয়। তার মনে আত্মহত্যার এক প্রগাঢ় অভিলিপ্সা জেগে ওঠে। জেগেওঠে মুক্তির আকুল বাসনা।
প্রতিদিনের মতো আজও নবারুণ বাবু হুইস্কিতে গলা ভেজাতে ভেজাতে সিলিং ফ্যানের সাথে বাঁধা ঝুলন্ত ফাঁসটার দিকে অপলক্ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। তার চোখে মুখে আনন্দের বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। মুক্তি যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। শেষ প্যাকটা দুই ঢোকে গিলে বিষধর সাপের মতো দুলায়মান শরীরটাকে দাঁড় করালেন। তারপর একটা চেয়ার নিয়ে ধীরে ধীরে খাটে উঠলেন। চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধকরে গভীর শ্বাস নিলেন। এই পৈশাচিক জীবনের থেকে মুক্তির স্বাদ তার জিহ্বায় জিহ্বায় খেলে গেল। হঠাৎ সে শুনতে পেল তার দাদুভাইয়ের কন্ঠস্বর ‘দাদান ও দাদান, তুমি কোথায়?’ তার বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠলো। নবারুণ বাবু কানপেতে রইলেন কিছুক্ষন। আবারও সেই একই ডাক্। ডাকটা সিড়িঘর থেকে আসছে। অনুমান করলেন তিনি। তারপর সেই মায়াময় ডাকের টানে তিনি সিড়িঘর ফেলে ছাদে ছুটে গেলেন। আর প্রতিদিনের মতো তার দাদুভাই তার কানের কাছে প্রশ্ন করলো ‘আচ্ছা দাদান,এই তারাগুলোর মধ্যে ঠাম্মা কোনটা?’
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।