দুপুরে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছিল না শোভনের । পাশ ফিরতেই চোখ পরে একটু দুরে রাখা ড্রেসিং টেবিলের আয়নাতে । বনলতা একমনে বসে বই পড়ছে, বিছানার পাশে রাখা টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে । শোভন জানে খানিকটা পড়ে তবে ও শুতে আসবে । নীল আলোতে লতার মুখের ওপর একটা আভা ফুটে উঠেছে । তবু বয়সের আঁকাজোকা যেন চাপা দেওয়া যাচ্ছে না । তাদের দুজনের জীবন একে অপরকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে । তবু বনলতা যেন সত্যিই লতা । নিজের পায়ে দাঁড়াবার, স্বাবলম্বী হবার কোনো ক্ষমতাই যেন নেই । ‘ ক্ষমতা ’ না ‘ ইচ্ছে ’ এটা নিয়ে শোভন মাঝে মাঝে ধন্দে পরে যায় । একটা প্রাইভেট প্রাইমারি স্কুলে পড়ায় লতা, রোজ সন্ধ্যায় বাড়িতে আসে গুঁড়িগুঁড়ি বাচ্চারা । তারা লতার গায়ে পিঠে উঠে দামালপনা করতে করতে প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে চলে যায় বড় ইংলিশ মিডিয়ামে, রামকৃষ্ণ আশ্রমে বা অন্য কোথাও । প্রতি সন্ধ্যাতে লতার মধ্যে ফুটে ওঠে এক স্বস্তির ছবি, মাতৃত্বের ছবি । সারা গায়ে মা মা গন্ধ মেখে রাতে শুতে আসে যখন, শোভন সেই ঘ্রাণ টুকু শুষে নেয় নিঃশব্দে । আর লতা মায়ের খোলস ছেড়ে জংলি লতা হয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে সেই গাছ টাকে ।
মাথার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে শোভন বলে – এবার একটু বাইরের কাজগুলো শেখো । ব্যাঙ্ক, পোষ্টাপিস, তারপর ধরো আমার কোথায় কি সেভিংস আছে একটু বুঝে শুনে নাও। মানুষের শরীরের কথা বলা যায় কি ? তাছাড়া আমি তোমার থেকে তেরো বছরের বড়ো । আমার শরীরও ভালো নয়, যদি আমি তোমার আগে …..
কথা শেষ করতে দেয় না লতা । দু হাতে চেপে ধরে শোভনের মুখ । না তুমি যাবে না । আমি থাকতে পারবো না তোমাকে ছেড়ে । ঠিক আছে । তবু একটু জানা দরকার তো তোমার, কোথায় কি আছে । আমি হঠাৎ অসুস্থ হলে তুমি কি করবে ? বহুবার বলা এবং শোনা এই সব কথা বনলতার স্বভাবে কোনো আগ্রহ আনতে পারে না । শোভন রাগ করে, অসন্তুষ্ট হয় । প্রিয় বন্ধু রায়দা কে বলে – ভারি বিপদেই পড়লুম মশায় একে নিয়ে । আমি চলে গেলে লতা যে ভারি আতান্তরে পড়ে
সেদিন সকালে রায় বাবু এক বুদ্ধি দিয়েছেন । বলেছেন, জোর করে লতা কে দিয়ে সাদা কাগজে লেখাবেন । আপনি একে একে বলে যাবেন আর উনি লিখবেন । তাহলে কিছুটা হলেও তো জানতে পারবেন । প্রস্তাবটা মনে ধরেছিল শোভনের । কিন্তু গড়িমসি করে আর করা হয়ে ওঠেনি । আজ করে ফেলতেই হবে । আয়নার প্রতিবিম্বে খুব স্পষ্ট তার বয়েসের ছাপ, ক্লান্তি । আচ্ছা মুখের রেখা গুলো কি মৃত্যুর ?
অনেক রাত পর্যন্ত শোভন বসে বসে লতাকে দিয়ে সব লিখিয়েছে । সহজে কি আর রাজি হয় লতা ? বকে, ধমকে তবে রাজি হয়েছে । যে এলআইসি গুলোতে লাইফ রিস্ক কভার করা আছে সেগুলো লিখতে লিখতে চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছিল লতার । শোভন একটুও প্রশ্রয় দেয়নি সেই ইমোশন কে । বাস্তব বড়ো কঠিন জায়গা । লতা তো টেরই পেলো না । রাতে শোবার সময় লতাকে জড়িয়ে বলে শোভন – বড় শান্তি পেলাম গো । বিবাহিত জীবনের আঠাশটা বছরের মধ্যে এই প্রথম লতা গাছটাকে আঁকড়ে ধরলো না । শোভন বুঝতে পারলো নিঃশব্দ কান্নায় ভিজে যাচ্ছে বালিশ ।
চড়া রোদ্দুরে ঘুম ভেঙে গেল শোভনের । একি ! এতো রোদ ঘরে । লতা আমাকে ডাকেনি কেন ? তবে কি কাল রাতের অভিমান পরক্ষণেই দেখে বিছানায় অঘোরে ঘুমিয়ে লতা । চোখের কোণে শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ মরা নদীর মতো । সকালের প্রথম চা টা এতো বছর ধরে লতাই করে আসছে । আজ সে চা করে চমকে দেবে লতাকে – এই ভেবে ডাকতে গিয়েও ডাকলো না ।
চা নিয়ে বিছানায় যেতে না যেতে কলিং বেল।শোভন চাবি খুলতে গিয়ে থমকে যায়। লতা চাবিটা কোথায় রাখে ! সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে না পেয়ে বড় বিরক্ত লাগে । এমন মেয়ে নিয়ে সে সংসার করলো এতোগুলো বছর । এদিকে চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, ওদিকে একটুক্ষন পর পর বেজেই যাচ্ছে কলিং বেল । বেলাদি রান্না করতে এসেছে ।
চা টা সরিয়ে লতা লতা করে কয়েক বার ডেকে সাড়া না পেয়ে গায়ে হাত দিতেই যেন ইলেকট্রিক শক লাগলো । ঠাণ্ডা শরীরটা ধরে নাড়তেই মনে হলো কাঠের পুতুলের মতো শরীরটা। সারা রাত ধরে একটু একটু করে বাঁধন ছিঁড়ে গাছকে ছেড়ে মাটিতে পড়ে গেছে লতাটা, সে জানতেও পারেনি । ওদিকে বেল বাজছে মুহুর্মুহু । কি করবে শোভন এখন ? সারা বাড়ি হাঁতড়ে বেড়াচ্ছে চাবির গোছার জন্য । রাতে অতিরিক্ত সাবধানতার জন্যে সব চাবি লতা সরিয়ে রাখতো সে জানে । কিন্তু কোথায় তা জেনে নেওয়া হয়নি আঠাশ বছরে – পাগলের মতো সারা বাড়ি ছুটছে শোভন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে । ওদিকে সদর দরজাতে ধাক্কা পড়ছে এবার জোরে জোরে ….।
Tags: ধাক্কা, নন্দিতা সিনহা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।