গৌরীর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার দরুন কিছু ভাল লাগছিল না। মনটা বড় খারাপ,–নীতীশ ভাবতেই পারছে না, দোষটা সত্যিই কার। অহরহ মনে হচ্ছে–আমার কি দোষ? জীবনে অমন মেয়ের সঙ্গে সে কখনই কথা বলবে না।
দক্ষিণ দিককার বারান্দা দিয়ে যতবার যায় ততবারই দেখে, গৌরী পর্দ্দা সরিয়ে এদিক পানে চেয়ে আছে, ওকে দেখলেই পলকে পর্দ্দা ফেলে দেয়। এ চিন্তা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে মনটা সদা চঞ্চল হয়ে রয়েছে; কি করে, কোথায় বা যায়? কোন কাজেই মন টিকছে না! অবশেষে বিকেল বেলা মনে পড়ল–জুতো জোড়া নেহাৎ অসম্মানজনক হয়ে পড়ছে, অনেক অনুনয়-বিনয় করে ঠাকুমার কাছে ব্যাপারটা বলতে–টাকা পাওয়া গেল।
নিজের জিনিস নিজে কেনার মত স্বাধীনতা বোধ হয়। আর কিছুতেই নেই, অথচ মুসকিলও আছে যথেষ্ট। যদিও সরকার মশায়ের গ্রাম্য পছন্দের আওতায় নিজের একটা স্বাধীন পছন্দ গড়ে উঠেছিল, কিন্তু তাকে বিশ্বাস নেই–কি জানি যদি ভুল হয়? যদি দিদিরা বলে, ‘ওমা এই তোর পছন্দ?’ সিদ্ধান্ত যদি হয়–’তা মন্দ কি বাপু বেশ হয়েছে, ঘষে মেজে অনেক দিন পায় দিতে পারবে ’খন!’ এর চাইতে গুরু শ্লেষ আর কি হতে পারে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে নীতীশ রাস্তা দিয়ে চলেছে। ছোট দোকানে যে তার পছন্দসই জুতো পাওয়া যেতে পারে না, এ ধারণা তার বদ্ধমূল, তাই বেছে বেছে একটা বড় দোকানে গিয়ে উঠল। জুতোওয়ালা এমন করে কথা বলে, যে তার উপর কথা বলা চলে না, মনে হয় যেন ওকথাগুলো নীতীশের। যে জুতোজোড়া পছন্দ হল, সেটা সোয়েড আর পেটেন্ট লেদারের কম্বিনেশান। ক্লাসের ছেলেরা হিংসে করে মাড়িয়ে দিতে পারে, গৌরীর মনে হতে পারে, কেন ছেলে হয়ে জন্মালুম না?
দাম ছ-টাকা; ঠিক পাঁচ টাকাই তার কাছে আছে। দর-কষাকষি করতে লজ্জা হয়, পছন্দ হয়নি বলে যে অন্য দোকানে যাবে তারও জো নেই, কারণ শুধু তার জন্যে অতগুলো বাক্স নামিয়ে দেখিয়েছে। আজকাল তো সবকিছুই সস্তা, কিছু কম বললে দেয় না? ইচ্ছে আছে, কিছু পয়সা যদি সম্ভব হয় তো বাঁচিয়ে একখানা মোটা খাতা কিনবে, গৌরীর হাতের লেখা ভাল, ভাব হলে, তার উপর সে মুক্তোর মত অক্ষরে বসিয়ে দেবে–নীতীশ ঘোষ–সেকেণ্ড ক্লাস…অ্যাকাডেমি।
লজ্জা কাটিয়ে বলে ফেললে, সাড়ে চারে হয় না?
জুতোওয়ালা বললে, আপনার পায়ে চমৎকার মানিয়েছে, একবার আয়নায় দেখুন না, দরাদরি আমরা করি না।
নীতীশ পিছন ফিরে আয়নার দিকে যেতে গিয়ে দেখে, নিকটে এক ভদ্রলোক বসে আছেন, যার বয়েস সে আন্দাজ ঠিক করতে পারে না, তবে তার দাদার মত হবে; যাকে আমরা বলব আটাশ হতে তিরিশের মধ্যে; তাঁর হাতে ছোট্ট ছোট্ট দুটি জুতো, কোমল লাল চামড়ার। দেখে ভারী ভাল লাগল–জুতোজোড়া সেই নরম কোমল পায়ের, যে পা দুখানি আদর করে স্নেহভরে বুকে নেওয়া যায়, সে চরণ পবিত্র, সুকোমল, নিষ্কলুষ।
সহসা যেমন দুর্ব্বার দখিন হাওয়া আসে, তেমনি এল অজানা মধুর আনন্দ, ওইকিশোর নীতীশের বুকের মধ্যে। ছোট লালজুতো দেখলে ওর যে বিপুল আনন্দ হতে পারে, এ কথা ওর জানা ছিল না–জানতে পেরে আরও খুসী হল, খুসীতে প্ৰাণ ছেয়ে গেল। ইচ্ছে হল, জুতো জোড়া হাতে করতে, ইচ্ছে হল হাত বুলোতে। কোন রকমে সে লজ্জা ভেঙে বললে, মশাই দেখি, ওই রকম জুতো।
ক-মাসের ছেলের জন্যে চান?
ভীষণ সমস্যা, কী–মাসের ছেলের জন্যে চাইবে? বললে, ছ-সাত, নানা, আট-দশ মাসের আন্দাজ।
একটি ছোট বাক্স, তার মধ্যে ঘুমন্ত দুটি জুতো, কি মধুর। নীতীশের চোখের সামনে সুন্দর দুটি মঙ্গলাচরণ ভেসে উঠল। মনে হল, ও পা দুটি তার অনেক দিনের চেনা, অনেক স্বপ্নমাখা আনন্দ দিয়ে গড়া। হাসি চাপিতে পারলে না, হাসি যেন ছুটে আসছে, না হোসে থাকতে পারল না।
মনে করতে লাগল, কার পায়ের মত? কার পা? কিছুতেই মনে আসছে না, টুটুল? না–টুটুল তো বেশ বড়। ইচ্ছে হল জুতোজোড়া কিনে ফেলে। জিগগেস করল, ওর দাম?
এক টাকা। নিজের টাকা দিয়ে কিনতে ইচ্ছে হল, কিন্তু সাহস হল না। কিন্তু উদ্বৃত্ত টাকাও যে তার কাছে এখন নেই, হয়তো কিছু সস্তায় হতে পারে। কি করা যায়, ‘কি হবে কিনে?’ বলে বিদায় দেওয়া যায় না? যাক টাকা পেলে কেনা যাবে। নিজের জুতো কেনাও হল না, দরে পোষাল না বলে। যখন সে উঠতে যাচ্ছে, তখন তার মনে হল, পিছন থেকে জুতো জোড়া তাকে টানছে, বিপুল তার টান! যেন ডাকছে, কি মোহিনী শক্তি ৷ একবার মনে হল কিনে ফেলে, কি আর বলবে, বড়জোড় বকবে, তবুও সাহস হল না।
চিরকাল সে ছোট ছেলে দেখতে পারে না, ছোট ছেলে তার দু-চক্ষের বিষ, ভেবেই পেত না টুলকে কি করে বাড়ির লোকে সহ্য করে…কি করে লোকে ছোট ছেলেকে কোলে নেয়? নিজের ওই স্বভাবের কথা ভেবে লজ্জা হল, তবু–তবু ভাল লাগছিল, যতবার ভুলবার চেষ্টা করে ততবার ভেসে আসে সেই লাল জুতো–মধুর কল্পনা পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে সেই লাল জুতোর পানে দেখে সে আন্তে আস্তে দোকান থেকে বার হয়ে এল।
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কত অসম্ভব কল্পনাই না তার মনে জাগছিল। তার মনে তখন, পিতা হবার দুৰ্ব্বার বাসনা। গৌরীর সঙ্গে যদি বিয়ে হয়, তাহলে? বেশি ছেলে মেয়ে সে পছন্দ করে না, একটি মেয়ে সুন্দর ফুটফুটে দেখতে, কচি–কচি হাত পা, মনের মধ্যে অনুভব করল, যেন একটা কচি—কচি গন্ধও পেল।
গৌরী সন্ধেবেলায়, প্রায় অন্ধকার বারান্দায় বসে, রূপোর ঝিনুকে করে তাকে দুধ খাওয়াবে; ঝিনুকটা রূপোর বাটিতে বাজিয়ে বাজিয়ে বলবে, আয় চাঁদ আয় চাঁদ–কি মধুর। আকাশে তখন দেখা দেবে একটি তারা।…আমায় বাবা বলে ডাকবে, শুনতে পেল–ছোট দুটি বাহু মেলে আধো–আধো গদগদভাবে ডাকছে, বাবা–হাতে দুটি সোনার বালা। দেখতে যেন পেল, গৌরী তাঁকে পিছন থেকে ধরে দাঁড় করিয়েছে, মাঝে-মাঝে শিশু টাল সামলাতে পারছে না, উল্লাসে হাতে হাত ঠেকছে, হাসি উচ্ছল মুখ। আমি হাত দুটো
ধরে বলব, ‘চলি-চলি পা-পা টালি-টালি যায়, গরবিনী আড়ে আড়ে হেসে হেসে চায়. কি নাম হবে? গৌরী নামটা পৃথিবীর মধ্যে নীতীশের কাছে মিষ্টি, কিন্তু ও নামটা রাখবার উপায় নেই,লক্ষ লক্ষ নাম মনে করতে করতে সহসা নিজের লজ্জা করতে লাগল, ছিছি। সে কি যা–তা ভাবছে! কিন্তু আবার সেই বাহু মেলে কে যেন ডাকল–’বাবা।’
না, ছেলেমেয়ে বিশ্ৰী, ‘বিশ্ৰী’ শুধু এই ওজর দিয়ে প্রমাণ করতে হল যে—যদি টুটুলের মত মধ্যরাতে চীৎকার করে কেঁদে উঠে–উঃ কি জ্বালাতন!
যে জুতো দেখে ওর মন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল, ইচ্ছে হচ্ছিল সেই লাল জুতো–জোড়ার কথা সকলকে বলে, কিন্তু সঙ্কোচও আছে যথেষ্ট, পাছে গৌরীকে নিয়ে যা কল্পনা করেছে তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। যদিও প্রকাশ হবারকোনও সম্ভাবনাছিল না, তবুও মনে হচ্ছিল, হয়ত প্ৰকাশ হয়ে যেতে পারে। একেই তো গৌরী এলে, ঠাকমা থেকে আরম্ভ করে বাড়ির সকলে ঠাট্টা করে। ঠাট্টা করার কারণও আছে; একদা স্নানের পর তাড়াতাড়ি করে নীতীশ ভাত খেতে গেছে, ঠাকুমা বললেন–নীতীশ তোর পিঠময় যে জল, ভাল করে গাটাও মুছিস নি? পাশেই গৌরী দাঁড়িয়েছিল, সে অমনি আঁচল দিয়ে গাটা মুছিয়ে দিলে পরম স্নেহে–অবশ্য নীতীশ তখন ভীষণ চটেছিল। এই রকম আরও অনেক ব্যাপার ঘটেছিল যাতে করে বাড়ির মেয়েদের ধারণা, নীতীশের পাশে গৌরীকে বেশ মানায়–বিয়ে হলে ওরা সুখী হবে এবং তাই নিয়ে ওঁরা ঠাট্টাও করেন।
কি করে, আর কাউকে না পেয়ে নীতীশ তার বড়বোঁদিকে বললে, জানো বড়বেদি, আজ যা একজোড়া জুতো দেখে এলুম, ছোট্ট জুতো, টুটুলের পায়ে বোধহয় হবে।–কি নরম, তোমায় কি বলব! দাম মাত্র একটাকা! অবশ্য নীতীশের ভীষণ আপত্তি ছিল টুটুলের নাম করে আমন সুমধুর ভাবনাটাকে মুক্তি দেওয়ায়, কিন্তু বাধ্য হয়ে দিতে হল।
বৌদি বললেন, বেশ, কাল আমি টাকা দেব’খন–তুমি এনে দিও।
মনটা ভয়ানক ক্ষুন্ন হল, কি জানি সত্যি যদি আনতে হয়–শেষে কিনা টুটুলের পায় ওই জুতোজোড়া দেখতে হবে! তবে আশা ছিল এইটুকু যে, বৌদি বলার পরই সব কথা ভুলে যান।
নীতীশ পড়ার ঘরে গিয়ে বসল। পড়ায় আজ তার কিছুতেই মন বসছিল না, সর্বদা ওই চিন্তা। তার কল্পনা অনুযায়ী একটি শিশুর মুখ দেখতে ভয়ানক ইচ্ছে হল–এ বই সে বই ঘাঁটে, কোথাও পায় না, যে শিশুকে সে ভেবেছে তার ছবি নেই।–কোথায়? কোথায়?
হঠাৎ পাশের ঘর থেকে গৌরীর গলা পাওয়া গেল, অস্বাভাবিক কঠে। সে কথা বলছে। প্রতিবার ঝগড়ার পর নীতীশ এ ব্যাপারটাকে লক্ষ্য করেছে, গৌরীকে সে বুঝতে পারে না। হয়ত গৌরী আসতে পারে, এই ভেবে সে বইয়ের দিকে চেয়ে বসে রইল।
উদ্দাম দুর্ব্বার বাতাসে ত্রাসে কেঁপে ওঠে যেমন দরজা জানলা, গৌরী প্রবেশ করতেই পড়ার ঘরখানা তেমনি কেঁপে উঠল। হাসতে হাসতে ওর কাঁধের উপর হাত দিয়ে বললে, লক্ষ্মীটি আমার উপর রাগ করেছ?
কথাটা কানে পৌঁছতেই রাগ কোথায় চলে গেল!
রাগের কারণ আছে। গৌরী ফোর্থ ক্লাসে উঠে ভেবেছে যে সে একটা মস্ত কিছু হয়ে পড়েছে–অঙ্ক কি মানুষের ভুল হয় না? হলেই বা তাতে কি? প্রথমবার নয় পারে নি, দ্বিতীয়বার সে তো রাইট করেছে। না পারার দরুন গৌরী এমনভাবে হাসতে লাগল এবং এমন মন্ত্র উচ্চারণ করলে যে অতি বড় শান্ত ভদ্রলোকেরাও ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটে, নীতীশের কথাতো বাদই দেওয়া যাক।
নীতীশের রাগ পড়েছিল, কিন্তু সে মুখ তুলে চাইতে পারছিল না; সেই কল্পনা তার মনের মধ্যে ঘুরছিল।
রাগ করেছ? আচ্ছা আর বলব না, কক্ষনো বলব না–বাবা বলিহারি রাগ তোমার। কই আমি তো তোমার উপর রাগ করি নি?
মানে? আমি কি তোমায় কিছু বলেছি যে রাগ করবে?
গৌরীর এই সব কথাগুলো শুনলে ভারী রাগ ধরে, কিছু বলাও যায় না।
চুপ করে আছ যে? এই অঙ্কটা বুঝিয়ে দাও না ভাই…
অঙ্ক-টঙ্ক হবে না—
লক্ষ্মীটি তোমার দুটি পায়ে পড়ি।
এতক্ষণ বাদে ওর দিকে নীতীশ চাইল। ওকে দেখে বিস্ময়ের অবধি রইল না, সেই শিশুর মুখ; যাকে সে দেখেছিল নিজের ভিতরে, অবিকল গৌরীর মতই ফর্সা–ওই রকম সুন্দর চঞ্চল, কাল চোখ!
কি দেখছি?
লজ্জা পেয়ে ওর অঙ্কটা করে দিলে। তারপর নানান গল্পের পর, লাল জুতো–জোড়ার কথা ওকে ব’লে বললে, কি চমৎকার! মনে হবে তোমার সত্যি যেন ছোট্ট ছোট্ট দুটো পা।
ছোট্ট দুটি চরণ কল্পনা করে গৌরীর বুকও অজানা আনন্দে দুলে উঠল—যে আনন্দ দেখা দিয়েছিল নীতীশের মনে। গৌরী বললে, আচ্ছা কাল তোমায় আমি পয়সা দেব, আমার টিফিনের পয়সা জমানো আছে–কেমন?
নীতীশ ভদ্রতার খাতিরে বললে, তোমার পয়সা আমি নেব কেন?
কথাটা গৌরীর প্রাণে বাজল, সে অঙ্কের খাতাটা নিয়ে, বিলন্বিত গতিতে চলে গেল। নীতীশ অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল।
দিন-দুয়েক গেল পয়সা সংগ্রহে। এই দুদিনের মধ্যে গৌরী এ বাড়ি আর আসেনি। ঠাকুমা জিগগেস করলেন, নীতীশ, গৌরী আসে না কেন রে?
আমি কি জানি?
কথাটা ঘরে থেকে শুনেই গৌরী তৎক্ষণাৎ গিয়ে জানালার পর্দ্দা সরিয়ে দাঁড়াল।
ঠাকুমা বললেন, আসে না কেন?
জ্বর।
জ্বর কথাটা নীতীশকে মোটেই বিচলিত করল না, ও জানে, ওটা একটা ফাঁকি ছাড়া আর কিছু নয়।
টাকাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল জুতোজোড়া আনতে, রাস্তা থেকে টাকাটা ভাঙিয়ে নিলে, কারণ হারিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়, প্রতি মোড়ে মোড়ে গুণে দেখতে লাগল পয়সা ঠিক আছে কিনা।
জুতোর দোকানে ঢুকেই বললে, দিন তো মশাই সেই লাল জুতো; সেই যে সেদিন দেখে গিয়েছিলুম?
দোকানদার একজোড়া দেখালে। ও বললে, না–না, এটা নয়, দেখুন তো ওই শেলফে?
পাওয়া গেল সেই স্বপ্নময় জুতো! কি জানি কেন আরো ভাল লাগল–ওর মধ্যে কি যেন লুকিয়ে আছে। চিত্তের মধ্যে একটি হিংস্র আনন্দ দেখা দিল–দর নিয়ে গোল বাধল না, একটি টাকা দিয়ে জুতোজোড়া নিলে জুতোওয়ালা বললে, আবার আসবেন। মনে হল বোধহয় ঠকিয়েছে।
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে অনেক বার ইচ্ছে হল বাক্সটা খুলে দেখে–কিন্তু পারল না। একবার মনে হল, এ দিয়ে কি হবে? কার জন্যেই বা কিনল? সে কি পাগল! মিথ্যে মিথ্যে টাকা তো নষ্ট হল?
ভিতর হতে কে যেন উত্তর দিল, ‘কেন, টুটুলের পায় যদি হয়?’ টুটুলের কথা মনে হতেই একটু ভয় হল, যদি তার পায় সত্যিই হয়, তাহলেই তো হয়েছে। আবার প্রশ্ন, কিন্তু কার জন্যে সে কিনেছে? বেশ ভাল লাগল বলে কিনেছি! ভাল লাগে বলে তো মানুষ অনেক কিছু করে, বাজী পোড়ায়, গঙ্গায় গয়না ফেলে–এ তবু, একজোড়া জুতো পাওয়া গেল। তো! বাজে খরচ হয় নি, বেশ করেছে, একশো বার কিনবে। সহসা জিহ্বায় দাঁতের চাপ লাগতেই মনে পড়ল, কেউ যদি মনে করে তাহলে জিব কাটে, কে মনে করতে পারে? গৌরী? আজি গৌরীকে ডেকে দেখতে হবে।
বাড়িতে পৌঁছে, সকলকে মূল্যবান জিনিসটা দেখাতে ইচ্ছে করছিল,কিন্তু সাহস হল না, মুক্ত করে? প্রথমত সে নিজেই ঠিক করতে পারছে না–কার জন্যে কিনল, কেন কিনল?
টুটুল বারান্দায় তখন খেলা করছিল, তার পায়ের মাপটা নিয়ে জুতোটা মেপে দেখল, টুটুলের পা কিঞ্চিৎ বড়–কিন্তু ওর মনে হল অসম্ভব বড়! শঙ্কিত চিত্তে ঠাকুমার কাছে গিয়ে বললে, তোমাদের সেই লাল জুতোর কথা বলেছিলুম, এই দেখ।
ভাঁড়ার ঘর হাসি উচ্ছলিত। ঠাকুমা বললেন, ওমা—কোথা যাব, ছেলে না হতেই জুতো! হৈ হৈ পড়ে গেল। নীতীশের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, বললে আমি টুটুলের জন্যে এনেছিলুম…
কে শোনে তার কথা! বুঝতে না পেরে, পড়ার ঘরে গিয়ে আলোটা জেলে বাসল, সামনে জুতো জোড়া, প্রাণভরে দেখতে লাগল। এ দেখা, যেন নিজেকে দেখা। ভাবলে, গৌরীকে কি করে ডাকা যায়?
গৌরী গোলমাল শুনে, জানলায় এসে দাঁড়িয়ে দেখছিল–ব্যাপারটা কি সে বুঝতে পারে নি। মনে হচ্ছিল, নীতীশ একবার ডাকে না?
সহসা চিরপরিচিত ইশারায়–না থাকতে পেরে নেমে এল, আসতেই নীতীশ বললে, তোমায় একটা জিনিস দেখাব, দাঁড়াও।
গৌরী উদগ্ৰীব হয়ে ওর দিকে চাইল। নীতীশের শার্ট বোতাম–হীন দেখে বললে, তোমার গলায় বোতাম নেই, দেব?
দাও।
গৌরীর চুড়িতে সেফটিপিন ছিল না, শুধু একটি ছিল ব্লাউজে, বোতামের পরিবৰ্ত্তে—না ভেবেই সেটা দিয়ে বুঝল ব্লাউজ খোলা, বললে,–দাও। ওটা, তোমায় একটা এনে দিচ্ছি।
থাক।
থাক কেন, এনে দিই না? কাতর কণ্ঠে বললে।
থাক, বলে হাসিমুখে সে জুতোর বাক্সটা খুলে গৌরীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলে, তার মুখ আনন্দে উৎফুল্প।
সুনিবিড় প্রেমে কালো চোখ দুটো স্বপ্নময় হয়ে এল। গৌরী জুতোজোড়া দেখে, কেঁপে উঠল! তার দেহে বসন্ত মধুর শিহরন খেলে গেল। মনে হল, এ যেন তারই শিশুর জুতো! অস্পষ্টভাবে বললে, আঃ–! তার দেহ আনন্দে শিথিল হয়ে আসছিল। যেন কোন রমণীয় সুখ অনুভব করে, আবার বললে, আঃ।…সব কিছু যেন আজ পূর্ণ হল। নিজেদের কল্পনায় যে সুন্দর ছিল, যেন তাকেই রূপ দেবার জন্যে আজ। দুজনে আবদ্ধ হল।
নীতীশ বিস্ময় ভরে দেখে ভাবছিল একি! পাশের বাড়িতে তখন সেতারে চলছিল তিলক-কামোদের জোড়–তারই ঘন ঝঙ্কার ভেসে আসছিল। ওই সমীত এবং এই জীবনের মহাসঙ্গীত তাদের দুজনকে আড়াল করে রাখলে, হিংস্র বাস্তবের রাজ্য থেকে। যে কথা অগোচরে অন্তরের মধ্যে ছিল, সে আজ দুলে।-দুলে উথলে উঠল। বহু জনমের সঞ্চিত মাতৃস্নেহ-মাতৃত্ব।
দেখতে পেলো, সুন্দর অনাগত শিশু, যে ছিল তার কল্পনায়; অঙ্গটি তার মাতৃস্নেহের মাধুৰ্য্য দিয়ে গড়া, যাকে দেখতে অবিকল নীতীশের মত; তার আত্মা যেন শিশুর তনুতে তনু নিল। ইচ্ছে করল। বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে–বুকে জড়িয়ে ধরে বেদনা-।মাখা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়তে। জুতো দুটোয় আস্তে আস্তে হাত বুলোতে বুলোতে সহসা গভীর ভাবে চেপে ধরল, তারপর বুকের মধ্যে নিয়ে যত জোরে পারে তত জোরে চেপে, সুগভীর নিশ্বাস নিলে, মনে হল যেন তার সাধ মিটেছে। ভগ্নস্বরে কণ্ঠ হতে বেরিয়ে এল, আঃ…
আনন্দে বিস্ফারিত আঁখিযুগল। নিজেকে যেন অনুভব করলে। আজ শান্ত হল তার লক্ষ বাসনা লক্ষ বেদনা–লক্ষ স্বল্প মূৰ্ত্তি পেল।
বিশ্বাগত অপূর্ণতা তারা এই তরুণ বয়সেই উপলব্ধি করলে; পূর্ণতার সম্ভাবনায় দুজনেই মহ-আনন্দ-মদে মত্ত হয়ে উঠল।
গৌরীর হৃদয়ের ভিতর দিয়ে, ওই লাল জুতো পরে, নীতীশ টলমল করে চলল, আর–গৌরী চলতে শুরু করলে, নীতীশের হৃদয়ের মধ্যে দিয়ে পথ করে। আচন্বিতে সশব্দে জুতোজোড়াকে চুম্বন করলে। তারপর নীতীশের দিকে চেয়ে, ঈষৎ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠে। জিগগেস করলে, কার জন্যে গো?
মৃদু হেসে বললে, তোমার জন্যে! বারে তুমি যেন কি! অতটুকু জুতো, আমার পায় কখনও হয়? কার লক্ষ্মীটি বল না? তোমার বুঝি?
ধেত! আমার হতে যাবে কেন?
ভুরু কুঁচকে বললে, তবে কার? চোখের তারা নেচে উঠল।
তোমার পুতুলের?
ওমা–তা হতে যাবে কেন? তুমি এনেছ, নিশ্চয় তোমার ছেলের?
আচ্ছা, বেশ দুজনের—
হ্যা–অসভ্য, বলে গ্ৰীবাটাকে পাশের দিকে ফিরিয়ে নিজের মধুর লজ্জাটা অনুভব কর। লাল জুতোজোড়া তখনও তার কোলে, যেন মাতৃমূর্তি।
Tags: কমলকুমার মজুমদার, লাল জুতো
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।