[যশপাল হিন্দি সাহিত্যের প্রখ্যাত প্রগতিশীল কথা সাহিত্যিক। সামাজিক বৈষম্য দূর করে সমাজে সকলের সমান অধিকারের দাবিতে সাহিত্যকে তিনি একটি হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর লেখা উপন্যাস – দিব্যা, দাদা কমরেড, অমিতা, ঝুঠাসচ, মনুষ্য কে রূপ। অন্যান্য রচনা – ন্যায় কা সংঘর্ষ, গান্ধীবাদী কি শবপরীক্ষা ইত্যাদি। – অনুবাদক ননী শূর]
পোশাক মানুষকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করার একটা সীমারেখা। এই পোশাকই সমাজে মানুষের অধিকার আর তার শ্রেণী নির্ধারণ করে। এই পোশাক আমাদের সামনে অনেক বন্ধ দরজা যেমন খুলে দেয় তেমনি মাঝে মাঝে এমন অবস্থাও আসে যখন আমরা নিচু হয়ে নিচুতলার মানুষজনদের সুখ দুঃখ বোধকে উপলব্ধি করতে চাই তখন কিন্তু এই পোশাকটাই বাধা আর পায়ের বেড়ি হয়ে দাঁড়ায়। বাতাসের তরঙ্গ যেমন একটা কাটা ঘুড়িকে হঠাৎ করে মাটিতে নেমে আসতে দেয় না, ঠিক তেমনি বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে আমাদের পোশাক আমাদের নিচুতে নেমে আসতে বাধা দিয়ে থাকে।
বাজারে ফুটপাতে কিছু খরমুজ ডালায় আর কিছু মাটিতে ছড়িয়ে একটি মাঝবয়সী মেয়েছেলে বসে বসে কাঁদছে। খরমুজগুলো বিক্রির। কিন্তু খরমুজ কিনতে লোকে ওর কাছে ঘেষঁবে কেমন করে। কারণ যে বিক্রি করবে সে যে মুখে কাপড় চেপে হাঁটুতে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে এক নাগাড়ে কেঁদেই চলেছে। আশেপাশের দোকানের আর বাজারের মানুষজন মেয়েছেলেটি সম্বন্ধে ঘৃণাভরে নানা কথা বলছিল। মেয়েছেলেটির কান্না দেখে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। কিন্তু কেন কাঁদছে ও জানব কী করে? আমার এই পোশাকটাই যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঘেন্নায় থুঃ করে থুতু ফেলে একজন বলল – ‘কী দিনকাল পড়েছে। জলজ্যান্ত জোয়ান ছেলেটা মরে গেল একটা দিনও কাটেনি, আর এই বেহায়া মাগি কিনা এসে দোকান পেতে বসেছে!’ এক মিঞাসাহেব দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল, – ‘ আরে যার যেমন মতি, আল্লাও তারে তেমনই বরাত দেন’। একপাশে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে দেশলাই কাঠি দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে একজন বলল – ‘আরে ওদের আর কি? এই ছোটলোকগুলান এক কণা খাবারের জন্য পরাণ পর্যন্ত দেয়। ওদের কাছে ছেলেই বলুন, মেয়েই বলুন, স্বামী-স্ত্রী, ধম্মকম্ম সবই খাবারের টুকরো’। পাশের মুদি দোকানে বসে থাকা এক বাবু বলে পাঁচজনের ধর্মকর্মের কথাটা তো খেয়াল রাখা উচিত। জোয়ান ছেলে মরলে তেরো দিনের মরণাশৌচ হয়, আর এই বেটি কিনা এখানে এই বাজারের ভেতর এসে খরমুজ বেচতে বসেছে। হাজারো মানুষ আসছে যাচ্ছে। কেউ কি আর জেনে বসে আছে যে ওর অশৌচ? কেউ যদি ওর খরমুজ খেয়ে বসে তাহলে সে লোকটার ধর্ম বাঁচবে কেমন করে? এ কী মগের মুলুক।’
এখানে ওখানে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম মেয়েছেলেটির তেইশ বছরের একটা জোয়ান ছেলে ছিল। বাড়িতে ছেলের বৌ আর নাতি নাতনি। শহরের কাছেই দেড় বিঘার মতো জমিতে চাষবাষ করে ছেলে কোনো মতে পেট চালাত। বাজারে খরমুজের ডালা নিয়ে কোনোদিন ছেলে বসত, কোনোদিন মা। গত পরশু ছেলে কাকভোরে অন্ধকার থাকতে থাকতে খেত থেকে পাকা পাকা খরমুজ বেছে তুলছিল। সে সময় স্যাঁতস্যাঁতে আলের উপর শুয়ে থাকা একটা সাপের গায়ে পা পড়তে সাপটা ছেলেকে ছোবল মারল।
মা পাগলের মতো ছুটে গিয়ে ওঝা ডেকে আনলো। ঝাড়ফুঁক হল। নাগদেবতার পুজো হল। পুজোতে দান দক্ষিণা চাই। ঘরে যেটুকুন চাল, ডাল আর আনাজপাতি ছিল সবই দান দক্ষিণাতে চলে গেল। মা, বৌ আর ছেলেমেয়েরা ভগবানাকে আঁকড়ে ধরে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। কিন্তু ভগবানা সেই যে চুপ করে গিয়েছিল আর একটি কথাও বলেনি। সাপের বিষে তার শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল। জ্যান্ত মানুষ ন্যাংটো থাকতে পারে, কিন্তু মরা মানুষকে ন্যাংটো বিদায় দেয় কী করে? তার জন্য তো দোকান থেকে নতুন কাপড় আনতেই হবে। তা কাপড় আনতে গিয়ে মায়ের হাতের চুড়িই বিক্রি হয়ে যায় তো যাক না। ভগবানা তো চলে গেল। ঘরে যেটুকু খুদকুঁড়ো ছিল তা ওকে বিদেয় দিতেই ফুরিয়ে গেল। বাপ নেই তো কী? সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছেলেমেয়েগুলি খিদের জ্বালায় ছটফট করতে লাগল। ঠাকুরমা ওদের খরমুজ দিল খেতে, কিন্তু বউকে কী খেতে দেয়? বউয়ের শরীর যে জ্বরে তপ্ত তাওয়ার মতো পুড়ছে। আজ ছেলে বেঁচে নেই, বুড়িকে দু-আনা চার-আনা বা কে ধার দেবে? কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল মুছতে মুছতে বুড়ি ভগবানার তুলে আনা খরমুজগুলিকেই ডালায় তুলে নিয়ে বাজারের দিকে চলল। এছাড়া আর উপায়ই বা কী? বুড়ি বুক বেঁধে এসেছিল খরমুজ বিক্রি করবে বলে। কিন্তু বাজারে এসে চাদর মাথায় জড়িয়ে, হাঁটুতে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। কাল যে মায়ের জোয়ান ছেলে মারা গেছে, আজ সে বাজারে সওদা নিয়ে বসেছে – হায় রে পাষাণি! ওর শোক যে কতখানি তা আন্দাজ করতে গিয়ে গত বছর আমার পাড়ারই পুত্রশোকে শোকাতুরা এক মায়ের কথা মনে পড়ে গেল … ওই মা ছেলের মৃত্যূর পরে আড়াই মাস বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি। পনেরো মিনিট পর পরই মূর্ছা যাচ্ছিল। যতক্ষণ জ্ঞান থাকত দু চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতে থাকত। দু-দুজন ডাক্তার শিয়রে বসে। মাথায় বরফ চাপানো। … সারা শহরের মানুষের মন ওই ভদ্রমহিলার পুত্রশোক দেখে বেদনাতুর হয়ে উঠেছিল।
মন যখন কোনো সমাধান খুঁজে পায় না, তখন অস্থিরতায় পথচলা দ্রুত হয়ে পড়ে। সেই অবস্থায় ঊর্ধ্বমুখ হয়ে পথচলা মানুষজনদের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে আমি হাঁটছিলাম। একথা ভাবতে ভাবতে যাচ্ছিলাম – কাঁদবার জন্য, শোক করার জন্যও একটা অনুকূল পরিবেশ চাই, চাই শোক করারও একটা অধিকার …।
………………………………………
ননী শূর – হিন্দি সাহিত্যের বিশিষ্ট অনুবাদক ও সাহিত্যিক
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘লোকায়ত’ নবম (১৯৯৯) সংকলনে। সম্পাদকমণ্ডলীর অনুমতিতে এখানে পুনরায় প্রকাশিত হল।
Tags: ননী শূর, যশপাল, শোকের অধিকার
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।