জন্মের প্রথম পদক্ষেপ থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এক দীর্ঘ পথ পরিক্রমার বিচিত্র ইতিহাস। উপন্যাস-গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-জীবনী-আত্মজীবনী কত বিচিত্র অভিনবত্বে কত বিচিত্র আবহে আমাদের অস্তিত – বোধ-মেধা ও অনুভূতিকে জাগরিত করেছে তার সীমা-পরিসীমা নেই।
এই সব বহু বিচিত্র লেখালিখি গ্রন্থবদ্ধ হয়ে যখন আমাদের হাতে আসে, তখন আমরা মূল লেখার সাথে পেয়ে যাই আরো এক অতিরিক্ত লেখা, যে লেখায় লেখক বা কবির এক নিজস্ব ব্যক্তিগত উচ্চারণ থেকে যায়। আখ্যাপত্রের পরবর্তী পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ এই উচ্চারণ-ই হল উৎসর্গ। তার ভাষা কখনও সৌজন্যমূলক আবার কখনও বা আস্তিত্বিক-আত্ম জৈবনিক। এই উৎসর্গের ভাষাশরীর দিয়ে-ই পাঠক গ্রন্থ পাঠে প্রবেশ করে এবং কবি বা লেখককে সনাক্তকরণের চেষ্টা করে যায়।
আমাদের বাংলা সাহিত্যের বিশাল গ্রন্থ ভাণ্ডারে ছড়ানো রয়েছে বহু বিচিত্র রকমের উৎসর্গ ও তার ভাষা। তা নিয়ে বিশাল ও ব্যাপক গবেষণা করা যায়। সম্ভবত সে কাজ এখনও অসম্পূর্ণ। এই ক্ষুদ্র পরিসরে সেই বিচিত্র ভাষা-শরীরের ছড়ানো-ছেটানো ভাষা নিয়ে আমাদের এই আলোচনা।
সম্ভবত পঞ্চাশের দশক থেকেই উৎসর্গের ভাষা, এক নতুন অভিনবত্বে-নতুন আবহাওয়ার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। এর আগে রবীন্দ্রনাথ থেকে কল্লোল পর্যন্ত এ ভাষা ছিল মূলত সম্বোধনসূচক সৌজন্যমূলক। রবীন্দ্রনাথ প্রধানত “শ্রীচরণেষু” “কল্যাণীয়েষু”, “করকমলে” ইত্যাদি সম্বোধনে আত্মীয়-স্বজন, পূজনীয়-পূজনীয়া, অগ্রজ-অনুজদের তাঁর মূল্যবান গ্রন্থ সকল উৎসর্গ করে গেছেন। মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কর এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উৎসর্গের ভাষাও ছিল মোটামুটি রাবিন্দ্রিক। মানিকের উত্তরসুরী দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মর্মান্তিক মৃত্যূর সাক্ষী ছিলেন, তিনি তাঁর “অশ্বমেধের ঘোড়া” গল্পগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুকে”। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর “শ্রেষ্ঠ কবিতা” উৎসর্গ করেন স্ত্রী “স্বাতীকে”। পক্ষান্তরে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁর “অস্তিত্ব, অতিথি তুমি” উৎসর্গ করেন ‘পরিচারিকা আশাকে”। পঞ্চাশ দশকের এই প্রথাবিরোধী গ্রন্থকার, তাঁর মুষ্টিমেয় গ্রন্থগুলি বহু বিচিত্রভাবে, বহু বিচিত্র ভাষায় উৎসর্গ করেছেন। বাংলা ভাষায় মিনিবুক স্রষ্টা এই লেখক তাঁর প্রথম মিনিবুক উৎসর্গ করেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী অগ্রজ গদ্যকার কমল কুমার মজুমদারকে “বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিংশ শতাব্দী তাঁকে দিয়ে শুরু” রূপে। তাঁর দ্বিতীয় গদ্যগ্রন্থ “সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য” উৎসর্গিত হয় চার বছরের মেয়ে তৃণার প্রতি। “তৃণা (৪) বইটি ছিঁড়ে কুটি-কুটি করে ফ্যালে”। এই সন্দীপন চট্টপাধ্যায়ের উৎসর্গের ভাষা থেকে আমরা জেনে যাই, “উৎপলকুমার বসু, মাত্র ৩০ বছর যে এগিয়ে আছে বাংলা কবিতা থেকে অর্থাৎ একুশ শতাব্দীতে” কিংবা “শঙ্খ ঘোষ, আমাদের কবি” “দেবেশ রায়, আমাদের লেখক” অথবা “অশোক দাশগুপ্ত, আমাদের সম্পাদক”। তবে সবচেয়ে মর্মান্তিক ভাষায় উৎসর্গ করেন তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস “এখন আমার কোনও অসুখ নেই”কে। উৎসর্গের পাতায় জ্বল জ্বল করে লেখা থাকে “তাঁদের, যারা সাহায্য করেননি বা উৎসাহ দেননি”। অশ্রুপাতক্ষম এ ভাষার সম্মুখে আমরা, তার পাঠকেরা নীরবে দণ্ডায়মান হই। ষাটের দশকের লেখক-কবিদের উৎসর্গের ভাষা আরো পরিবর্তিত হয়ে আস্তিত্বিক-আত্মজৈবনিক তথা আত্মমন্থনের ভাষা হয়ে দেখা দেয়। ষাটের প্রবীন আন্দোলন, হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টাদের উৎসর্গের ভাষা হয়ে ওঠে এক উদ্বাস্তু চেতনার সুতীব্র হাহাকার। এই দশকের হাংরি গদ্যকার সুভাষ ঘোষ তাঁর “এ্যামবুশ” উৎসর্গ করেন “যাঁরা আজীবন মানুষের স্বপক্ষে এ্যামবুশ বা গেরিলা প্রকৃতির ঐ আক্রমণ চালিয়ে যায় তাদের উদ্দেশ্যে”। “গোপালের নয়ন তারা” উৎসর্গিত হয়, ‘সভ্যতার শুরু থেকে আজ অব্দি সমস্ত উদ্বাস্তু ও দ্বাদশ ব্যক্তিদের’। ধর্ষণের বিরুদ্ধে গেরিলা অভ্যুত্থানের গদ্য সেই “সাবিত্রীবালা”কে সুভাষ উৎসর্গ করেন, “ধর্ষণ শোষণ, নির্যাতনের বলি তাবৎ উৎখাত, উদ্বাস্তু মানুষের উদ্দেশ্যে’ই। এমন কি সদ্য প্রকাশিত ‘সেভেনথ কার্ড” সুভাষ উৎসর্গ করেন সেইসব মানুষদের “যাদের নাই কথিত বণ্ড, বন্ধন, সূত্র-স্থানাঙ্ক, মিলনাঙ্ক নাই-অরবিটের বাইরে যারা – নেই যাদের গিফটেড নাম-নেম কার্ড…” তাদের।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক উৎসর্গ দেখা যায় বাসুদেব দাশগুপ্তর সেই কিংবদন্তী প্রতিম ‘রন্ধনশালা’ গল্পগ্রন্থে। “আগুন জ্বালা রিংয়ের ভিতর দিয়ে খাঁচার বাঘ লাফিয়ে পড়লো। আর আকাশফাটা করতালির শব্দ বাধা দিলো না। কাউন্টারে আর বিক্রি হল না। তিন আনা চার আনা টিকিট। খেলা শেষ হতে সামনের মাঠে ধান ছড়িয়ে সার্কাসের পাখিগুলোকে খাওয়ালেন ম্যানেজার মশাই, খাওয়া শেষ হলে সার্কাসের পাখিগুলো ছুটি চায় তিন মাসের। ওরা ঘুরবে দশ সমুদ্র আর সাত মহাদেশ, ওদের পায়ে রূপোর মল ঝুমঝুমিয়ে ওঠে আমারও ছুটি দরকার। আমারো মনে পড়লো – আমাকে মায়ের জন্য কিনতে হবে আলতা, সিঁদুর আর মনোহারী ফিতে। আজ বুধবার। দূরের গাঁয়ে হাট বসেছে। খেলা দেখাবার লাঠিখানির বদলে বাঘের কাছ থেকে আমি লাল কম্বলের জামাখানা ধার করলুম। নতুন জামায় রঙচঙ সেজে হাটে যাই। হাটের লোকেরা আমার জামা দেখে ভাবে আমিই নাকি বাঘ? সওদা নিয়ে তাই সকলে চলে যায়, দৌড়ে যায় পালিয়ে। আমার হয় না কেনা আলতা, সিঁদুর আর মনোহারী ফিতে। মাঠের ওপারে তালগাছের মাথায় অন্ধকার ঘন হয়ে নামে। ছুটির মেয়াদ ফুরোলে আমি ফিরে আসি। এসে দেখি বাঘ নিজেই এখন খেলা দেখাচ্ছে খুব। ও এখন নিজেই নিজের রিং মাস্টার। খেলা দেখাবার লাঠিখানা এখন ওর হাতে। রিংয়ে ঢুকবার পথের ওপর দাঁড়িয়ে আমি অবাক হয়ে ওর খেলা দেখি। ট্রাপিজের খেলা দেখাবার পোষাক পরে টগর এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। ঐ পোষাক ওর দেহের প্রতিটি রেখাকে আরও সুন্দর করেছে। আটোঁ করে বাঁধা বেণীতে দোলে মনোহারী ফিতে। আমি টগরের কাছে গিয়ে বলিঃ ‘টগর, তোর মনোহারী ফিতেটা আমায় দিবি?’ ও ধাক্কা মেরে আমায় সরিয়ে দেয়, ম্যানেজার মশাই এসে আমাকে বলেন, – ‘এখানে ভিড় করবেন না, বাইরে যান’। গ্যালারিতে বার বার করতালির শব্দ ফাটে? ঘন ঘন বিক্রি হয় চানাচুর, নকুলদানা, চিনে বাদাম। ফিরে আসতে আসতে তাকিয়ে দেখি অগণিত দর্শকের মাঝে আমার মা-ও বসে আছেন। তিনি একমনে বাঘের খেলা দেখছেন। ফ্লাড লাইটের উজ্জ্বল আলোয় চকচক করে তার নাকের নাকছাবি আরত চোখের কোণায় জল।”
বাংলা ভাষায় সম্ভবত এটিই সবচেয়ে সংবেদনশীল দীর্ঘ উৎসর্গ।
সত্তরের লেখক কবিদের উৎসর্গের ভাষা হয়ে ওঠে আরো সংকেতময়। ব্যর্থ হয়ে যাওয়া মুক্তির দশকের যন্ত্রণাময় ভাষায় এই দশকের কবি রণজিৎ দাশ তাঁর নির্বাচিত কবিতা উৎসর্গ করেন সেই সব মানুষদের “ভবিষ্যতে যারা শহরের প্রান্তে ফেলে রাখা অতিকায় ভাঙা টেলিভিশনের বাক্সের ভিতর বসে মাফিয়া মগজ ব্যাঙ্ক এবং রোবট পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কবিতা পড়বে – তাদের জন্যে”। নয়ের দশকের শুরু থেকেই ভোগ্য পণ্যের আবছা হাতছানি আমাদের পণ্য সভ্যতার কাছে নিয়ে যেতে শুরু করে দেয়। কম্পিউটার ও টেলিভিশন সমাজ জীবনে ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক পণ্য লেখালিখির বিরুদ্ধে সরব হন কয়েকজন। লেখক ও কবি। সুবিমল মিশ্রর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার তত্ত্ব ও তাঁর লেখালিখি আমাদের এক নতুন ভাষা – নতুন জগৎ – নতুন সাহিত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। তিনি, তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প উৎসর্গ করেন, “আগামী প্রজন্মের প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখকদের। তাঁরা আমার এই সব এই সমস্ত কিছু বাতিল করে দেবার স্পর্ধা রাখবেন।” তাঁদের।
আশি-নব্বইয়ের ভাষা হয়ে ওঠে পণ্য আক্রান্ত নিরুপায় দগ্ধ দীর্ণ যন্ত্রণার অনুরণন। উৎসর্গের ভাষা থেকে সন্ত্রাস ক্রমশ হারিয়ে যায়। পোস্ট মডার্নিজম তথা উত্তর আধুনিক মতবাদ ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। উৎসর্গের ভাষাতেও প্রবেশ করে সেই আবহ এবং সেই উচ্চারণ। ডি.টি.পি. ও অফসেট এসে ছাপাখানার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয়। ফলে অজস্র গ্রন্থ প্রকাশিত হতে শুরু করে। এই সব কবি-লেখকরা তাঁদের গ্রন্থগুলি কখনও “ভবিষ্যতের কবি লেখকদের”, “কবিতা পাগলদের” অথবা “শূন্যতা বুকে নিয়েও যারা হেঁটে চলেন পূর্ণতার দিকে” তাঁদেরকে উৎসর্গ করতে থাকেন। পঞ্চাশের কবি ও গদ্যকার সমীর রায়চৌধুরী নয়ের দশকে দাঁড়িয়ে উত্তর আধুনিকতায় আক্রান্ত হন। তাঁর “পোস্ট মর্ডান কবিতা বিচার” উৎসর্গীত হয়, “একুশ শতকের অমৃত-বাষ্প-বহ্নি-বেদ-অণ্ড-গর্ভ ও সাম এর কবিদের” উদ্দেশে। পঞ্চাশের আর এক গদ্যকার শিল্পী পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় এই দশকে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘অসুখের প্রেম” উৎসর্গ করেন, তাঁর নিজস্ব “গোপন অশ্রুরাশির উদ্দেশ্যে”। আবার অশোক অধিকারী তাঁর “গুহার দেওয়ালে বাইসন” উৎসর্গ করেন সেই মানবকে, “যে মানব প্রথম গুহার দেওয়ালে তাদের আকাঙ্খা রেখাচিত্র করে, আর তারা ঐ চিত্র প্রথম আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়,” তাঁদেরকে। এই দশকে প্রকাশিত আরো একটি উৎসর্গপত্র থেকে আমরা জেনে যাই, তিন জন জ্ঞানী মানুষের কথা, “যারা বিশ্বাস করেন সমস্ত জ্ঞান ও জিজ্ঞাসার গন্তব্য রহস্যভেদে, শিল্প তার ব্যতিক্রম নয়। শিল্প রহস্য ভেদের সামগ্রিক যুক্তি নির্দেশ” মাত্র।
এছাড়াও উৎসর্গের ভাষায় আমরা পেয়ে থাকি, “মাননীয়েষু”, “সুহৃদ প্রতিমেষু”, “বরাবরেষু”, “প্রিয় দর্শনেষু” ইত্যাদি বিচিত্র সম্বোধন। একজন গদ্য লেখক উইপোকাদেরও গ্রন্থ উৎসর্গ করে সাড়া ফেলে দেন। এইভাবে, বাংলা সাহিত্যে উৎসর্গের ভাষা সেই রবীন্দ্রনাথ থেকে আজ পর্যন্ত, কত নীরব-নিথর, কত মৌন-মুখর, কত হাসি-কান্নায় আমাদের সংক্রামিত করে চলেছে…।
……………………
প্রবীর চক্রবর্তী – লেখক নিবিড় পাঠক। সমকালীন সাহিত্য গবেষক।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘লোকায়ত’ অষ্টম (১৯৯৯) সংকলনে। সম্পাদকমণ্ডলীর অনুমতিতে এখানে পুনরায় প্রকাশিত হল।
Tags: প্রবীর চক্রবর্তী, বাংলা সাহিত্যে উৎসর্গ ভাবনার বিচিত্রা কথা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।