19 Mar

অলকানন্দা রায়ের সাক্ষাৎকার

লিখেছেন:প্রতিভা দাস


[ অনেক কিছুকেই প্রথাগত ভাবনা বা সিস্টেমের বাইরে গিয়ে ভেবেছেন তিনি। প্রতিনিয়তই অনুভব করেন নতুন কিছু করার তাগিদ । আর এই রকম ভাবেই একদিন পান পশ্চিমবঙ্গের সংশোধনাগারের বন্দিদের নাচ শেখানোর দায়িত্ব – যা তাঁর নিজের কথায়, তাঁর জীবনে ঘটিয়ে দেয় এক আশ্চর্য উত্তরণ। তিনি ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যচর্চায় নিজস্ব নৃত্যশৈলী গড়ে তোলা শিল্পী অলকানন্দা রায়। ভরতনাট্যম থেকে ওডিশি ও রাশিয়ান ব্যালে থেকে রবীন্দ্রনৃত্য অবগাহন করেছেন সব নৃত্যধারাতেই । তিনি বিশ্বাস করেন সার্টিফিকেট – ডিগ্রি দিয়ে নৃত্যশিক্ষা হয় না। এজন্য চাই নাচের প্রতি ভালোবাসা । তাঁর নৃত্যের কোরিওগ্রাফি, পোশাক পরিকল্পনা, সামাজিক ভাবনা থেকে রবীন্দ্রনাথ সবকিছুই এক বিস্তারিত সাক্ষাৎকারে শোনালেন ‘গল্পের সময়’কে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নৃত্যশিল্পী প্রতিভা দাস।]   

 

 প্রতিভা দাসঃ    জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে নানা কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখলেও আপনি মূলত একজন নৃত্যশিল্পী। জীবনে এই নৃত্যশিক্ষার পাঠ বা নাচ শিখব এমন ভাবনা শুরু হয়েছিল কীভাবে?

অলকানন্দা রায়ঃ আসলে আমি তো যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে তখন থেকেই নাচছি। ভাবনা করে আমি নাচ শুরু করিনি। ছোটবেলায় ভালো নাচতাম, তাই মা আমাকে নাচ শিখিয়েছেন। বাবা সেটা সাপোর্ট করেছেন। আসলে নাচ আমার প্যাশন, এটা আমার একটা লাইফলাইন। তখনতো অত বুদ্ধি হয়নি বা এসব এত বোধও হত না। এটা এই বয়সে এসে বুঝতে পারি। নাচি নি – এমন কোনও সময় আমি মনে করতে পারি না। নাচকে আমি কখনো ‘নাচ’ হিসেবে নিই নি। এটা আমার ভালো লাগার জায়গা। ভালোবাসার জায়গা। নাচ নিয়ে আমার কোনোদিন কোনো অ্যাম্বিশন ছিল না। আমার যা কিছু হয়েছে, তা আমার কপাল জোরে। এটা আমি সব্বাইকে বলি। তবে নাচকে ভালবাসলেও আমি কোনোদিন ডান্সার হতে চাইনি। আমি পারফর্ম করতে কোনোদিন ভালবাসি না। ছোট্টবেলা থেকে না। যার জন্য আমি প্রোগ্রাম ভীষণ কম করতাম। আমি কিন্তু আজ এখানে, কাল ওখানে পরশু সেখানে – প্রোগ্রাম করিনি। যখন মনে হয়েছে তখনই করেছি। কারণ আমার এভাবে পারফর্ম করতে ভাল লাগে না। যখন আলাদা করে কোনও একটা ভাবনা বা কনসেপ্ট ভাল লাগছে তখনই পারফর্ম করি। পারফর্মার হব সেটা আমি কোনোদিন চাইও না। যেটুকু হয়েছে, যা পেয়েছি তাতে সত্যি বলতে আমার ক্রেডিট খুবই কম। আই নেভার পুসড মাইসেলফ – এখনও তাই।

প্রতিভা দাসঃ    নৃত্যশিক্ষার শুরুর দিকের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা যদি শোনান। ছোটবেলার কিছু ঘটনা।

অলকানন্দা রায়ঃ আমি আমি একদম ছোটবেলায় তো সি এল টিতে ছিলাম। আমি এখন বুঝতে পারি যে সি এল টিতে যাওয়ার জন্য আমি নাচটাকে বোধহয় এতটা ভালবাসতে শিখেছিলাম। কেননা ওখানে আমরা খেলার ছলে নাচটা শিখতাম। ছোটবেলা থেকে নাচে আমি কখনো পরীক্ষা দিই নি। নাচে পরীক্ষা জিনিষটা কী বা কেন তা এখনও আমার বোধগম্য নয়। আমার নাচের স্কুলে কোনো পরীক্ষা নেই। তাই আমি কমপিটিশনে বিশ্বাস করি না। নাচটা আসলে ভাললাগার জায়গা। পড়াশুনোতেও মার্কস, নাচেও মার্কস! আর ছোটবেলার স্মৃতি যদি বলতে হয় তাহলে তা এত আছে যে কী বলব! আমরা ট্রেনে করে ট্যুরে যেতাম। খুব মজা হত। একবার পুজোর সময় আমরা পাঁচটা জায়গায় গেলাম।  আমি যখন ছোট ছিলাম। তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিধান চন্দ্র রায়। আর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জওহরলাল নেহরু। দুজনেই বাচ্চাদের ভালবাসতেন। আমাদের সিএলটির একটা অন্য জায়গা ছিল। আমরা যেখানে যেখানে যেতাম অধিকাংশ জায়গাতেই আমরা স্টেট গেস্ট হয়ে থাকতাম। একবার এই রকম লক্ষ্ণৌ, জয়পুর, দিল্লি, বোম্বে (মুম্বই), আমেদাবাদ আমাদের যেতে হল। আমাদের আলাদা কোচ থাকত – যা ট্রেনের সঙ্গে অ্যাটাচ করা থাকত। এত সম্মান আর মজা নিয়েই আমরা যেতাম। একবার লক্ষ্ণৌতে সাংঘাতিক বন্যা হল। গাড়ি তো ঢুকতেই পারল না। সাইডিং-এই দাঁড়িয়ে রইল। দুদিন ট্রেনেই রইলাম। খুব, খুব আনন্দ করলাম। আমরা সেবার প্লাটফর্মে  পারফর্ম করলাম। আর কুলি, জি আর পি, রেলের লোকজন, আটকে পড়া মানুষই হল আমাদের অডিয়েন্স। তবে সেবার আমরা যে যা রোল করি তা করলাম না, প্রত্যেকে একে অন্যেরটা করলাম। আসলে আমাদের প্রত্যেকেরই প্রত্যেকের নাচ জানা থাকত।

প্রতিভা দাসঃ   তখন আপনাদের শেখাচ্ছেন বা চালনা করছেন কারা?

অলকানন্দা রায়ঃ ওরে বাবা, সে সব বিখ্যাত মানুষজন। আমাদের তখন আলো করতেন তাপস দা, তাপস সেন। নাচ এবং কস্টিউম দেখতেন সুরেশ দত্ত, মিউজিক কম্পোজিশন করতেন প্রিয়লাল চৌধুরি। প্রিয়লাল চৌধুরি ছিলেন খুব নামকরা একজন কমপোজার। আবার পরবর্তী কালে যে এতটা মঞ্চের আলোর ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছি তা তাপস সেনের জন্যই। এই প্রসঙ্গে সেই লক্ষ্ণৌয়ের কথায় ফিরি। তো বন্যার জল নেমে যাওয়ার পর ঠিক হল যে আমাদের একটা প্রোগ্রাম হবে। সেই সময় তাপসদা মঞ্চের মধ্যে সূর্যোদয়, মেঘ আলোর খেলা করে দেখাতেন। আমি সেই লেট ফিফটিজ-এর কথা বলছি। লক্ষ্ণৌতেও তাপসদার আলোর কাজ দেখে তো দর্শকরা মোহিত। বারবার তারা আবার দেখানোর জন্য আবেদন করতে লাগলো। তখন ভাবতাম নাচের অনুষ্ঠান  এইরকমই হয়। এখন বুঝি আমরা কী পেয়েছিলাম।

প্রতিভা দাসঃ    আপনি ‘ভরতনাট্যম’, ‘ওডিশি’র মত ভারতীয় নৃত্যকলায় পারদর্শিতা অর্জন করেছেন। নৃত্যশিক্ষার প্রশিক্ষণ কেমন ছিল? কাদের কাছে আপনি শিখেছেন?

অলকানন্দা রায়ঃ ভরতনাট্যম প্রথম শিখেছিলাম মঞ্জুলিকা দাসের কাছে। মঞ্জুলিকাদির কাছে শুধু ভরতনাট্যম নয়, সমস্ত ফোক ডান্স শিখেছিলাম। আমার এখনও ভাল লাগে ফোক ডান্স। আই জাস্ট এনজয় ইট। ফোক ডান্সের মত স্বতস্ফুর্ততা তো ক্লাসিক্যাল ডান্সে নেই। আমি সবাইকে বলি তোমরা এসব জুম্বা-টুম্বা কেন করো। কেন ইন্ডিয়ান ফোক ডান্স করো না। তো একবার একটা প্রোগ্রাম হল, তখনও রবীন্দ্র সদন হয় নি। অনুষ্ঠানটা হয়েছিল রবীন্দ্র সরোবরের ভেতরে একটা অডিটোরিয়ামে। আমি নাচব, মঞ্জুলিকাদি আমায় নিয়ে গেছেন। আইটেমের নাম ‘জ্যোতিস্মরণ’। শুধু তবলায় নাচ। সেদিন অডিয়েন্সে ছিলেন রবিশঙ্করজী, আলি আকবর খাঁ, ধানুষ খান (তখন তিনি ইয়াং)। ছিলেন  মারুথাপ্পা পিল্লাই। আমি নাচ করে গ্রিন রুমে চলে গেছি। হঠাৎ এক ভদ্রলোক (পরে জেনেছি তিনি বিমানদা) রবিশঙ্করজীকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। বললেন, রবিশঙ্করজী তোমার সঙ্গে কথা বলবেন। আমার তখন ১২-১৩ বছর বয়স। রবিশঙ্করজী আমার নাচের প্রশংসা করে বললেন, একদিন তুমি খুব বড় ডান্সার হবে – আর আমি তোমার সঙ্গে বাজাবো। বাচ্চাদের বড় মানুষরা যেমনটা বলেন আর কী! কিন্তু আমি তো তখন দারুণ উত্তেজিত। ঘটনাটা আমার স্মৃতিকোঠায় এখনও জ্বলজ্বল করছে। এরপর আমার মায়ের পরিচয়ের সূত্রে গুরু মারুথাপ্পা পিল্লাই-এর কাছে ভরতনাট্যম শেখা। তারপর গুরুজী মারা গেলেন। আমি ছিলাম অনেকটা ডোবারম্যানের মত – ওয়ান মাস্টার ডগ। গুরুজী মারা যাওয়ার পর কারোর মাছে নাচ শিখতেই গেলাম না। শুধু মৃদঙ্গমে প্র্যাকটিসটা করি। এরপর একদিন সংযুক্তা পানিগ্রাহীর নাচ দেখতে গেলাম। অবিভূত হয়ে গেলাম। তবে তখনও ভরতনাট্যম আবারও কারো কাছে শিখব এমন ভাবনাতেই আসে নি। আর কলকাতায় তেমন শেখানোর মত কেউ ছিলও না। এই সময়ই একবার ওডিশা বেড়াতে যাচ্ছি, তখন বিমানদা প্রায় জোর করেই সংযুক্তা পানিগ্রাহীকে একটা চিঠি লিখে দিলেন। দিদি ইতিমধ্যেই আমার একটা অনুষ্ঠান দেখেছেন। আমি প্রণাম করলাম। তিনি বললেন – ‘আই রিমেমবার ইয়োর ডান্স। আই রিয়েলি লাভড ইট। আই উইল টিচ ইউ।’ সেই আমি দিদির কাছে ওডিশি শিখতে শুরু করলাম। তখন আমি দিদির প্রথম এবং একমাত্র স্টুডেন্ট। কারণ দিদির কাছে অনেকে ওয়ার্কশপ করতে গেছে, কিন্তু তারা নিয়মিত ছিল না। তারপরতো আমি তাদের বাড়ির লোক হয়ে গেলাম। দিদির দাদা-বৌদির সঙ্গে দারুণ সখ্যতা তৈরি হল। আমার হাজব্যান্ড চন্দন এবং আমাদের দুষ্টু ছেলেকে (ও তখন খুব ছোট) সাংঘাতিক ভালবাসতেন দিদি। সম্পর্কটা পারিবারিক হয়ে গেল। ফলে আমার নাচ শেখাটা শুধু একটা শেখার ব্যাপার ছিল না। এটা ছিল একটা জীবনকে চেনার মত ব্যাপার।

প্রতিভা দাসঃ    আপনি ‘রাশিয়ান ব্যালে’ শিখেছেন। ব্যালে শেখার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

অলকানন্দা রায়ঃ প্রথম তো আমাদের স্কুলেই ব্যালে ক্লাস হত। আমি ব্যালে খুব ভাল করতাম। নাচ ব্যাপারটা আমার মধ্যে ছিল বলেই হয়তো এরকমটা হত। এরই পাশাপাশি আমি প্রথম থেকেই কোনো রিজিডিটির পক্ষপাতী ছিলাম না। ফলে সব কিছুকেই স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করারও চেষ্টা করতাম। তা আমার ব্যালে পারফরম্যান্স দেখে স্কুল থেকে আমায় ‘ক্যালকাটা স্কুল অফ মিউজিক’এ পাঠানো হল। আমি খুব ভালোবাসতাম  ব্যালে করতে। আমাদের ছোটবেলায় কলকাতায় অনেক বিদেশী ছিলেন। তারাই মূলত ব্যালে করতেন। আর ইন্ডিয়ান ছিলাম কেবলমাত্র আমি। পিয়ানোও শিখতাম। তবে শিখছিলাম, কিন্তু কিছু করার ছিল না। যিনি টিচার ছিলেন, ফেরত চলে গেলেন আমেরিকা। তারপর নানা কারণে আমার ব্যালে শেখাও বন্ধ হয়ে গেল।

প্রতিভা দাসঃ    নৃত্যশিল্পী হিসেবে আপনি নিজেকে তুলে ধরলেও গত এক দশকে মানুষ আপনাকে চিনেছে আর এক পরিচয়ে। তা হল সংশোধনাগারের বন্দিদের নিয়ে আপনার কাজ। এই কাজটা কীভাবে সম্ভব হল? শুরুর শুরুটা যদি আমাদের একটু শোনান।

অলকানন্দা রায়ঃ নৃত্যশিল্পী হব বলে কিন্তু আমি নিজেকে তৈরি করিনি। দর্শকের, মানুষের ভাল লেগেছে বলেই আমি একের পর এক নাচ করে গেছি। আজ বাষট্টি বছর ধরে নাচছি। আর সংশোধনাগারের বন্দিদের ব্যাপারটা বলতে গেলে বলব যে কোনো জিনিষটাই আমার কাছে কোনো পরিকল্পনার মাধ্যমে উঠে আসে নি। আমি কারা বিভাগের ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স ডে’র একটা অনুষ্ঠানে গেস্ট হয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েরা এসে আমাকে নাচ শেখানোর জন্য ধরল। সেখানে বিভাগীয় মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন আই জি ( কারা) বংশীধর শর্মা বা বি ডি শর্মা। ব্যাপারটা কিছুটা পূর্ণতা পেয়ে বি ডি শর্মা যখন আমাকে নাচ শেখানোর প্রস্তাব দিলেন তখন আমি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। আবার একটা নতুন কিছু করার আনন্দে মন মেতে উঠল। আমার পোশাক হোক, জীবন হোক, নাচ বা কাজ – সবেতেই আমি সামথিং ডিফারেন্টের পথে হেঁটেছি। আমার জানতে ইচ্ছে করছিল জেলের ভেতরে থাকা মেয়েদের জীবনটা কেমন। তাই আমি রাজি হয়ে গেলাম। আমি কিন্তু ওদের ভালবেসে কাজটা করতে যাইনি। তবে ওদের নাচ শেখাতে গিয়ে আমার কেমন যেন মায়া হল। কিন্তু বন্দি ছেলেদের দেখে আমার আরও কষ্ট হল। মেয়েদের নয়, বরং ছেলেদের আমার অন্যরকম লাগল। কীরকম যেন ক্যাজুয়ালি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের মায়েদের জন্য খুব কষ্ট হল। একটা শিশু যখন জন্মায় তখন কী কোনও মা তার ছেলে সম্পর্কে এমনটা ভাবে? আমি তখন শ্রী শর্মাকে বললাম যে আমি কী ছেলেদেরও শেখাতে পারি? উনি বললেন, আপনার সাহস আছে? সবাই কিন্তু ভয় পায়। আমি বললাম, আমার ভয়-টয় নেই। এরা তো আমার ছেলের বয়সী । তখন বি ডি শর্মা বললেন, ঠিক আছে। উনি আমাকে কোনো দিন কোনো কিছুতে না করেন নি। তাই হয়ত কাজটা এতদূর এগোতে পেরেছে। সেই থেকে কাজটা শুরু হল। তবে আমার যেটা বারবার মনে হয় ‘নাচ’ জিনিষটা কিন্তু এখনও – এ স্টেপ চাইল্ড অফ পারফর্মিং আর্ট। গান, নাটক, আঁকা যে মর্যাদাটা পায়, এখনও কিন্তু কোনোখানে নাচের সেই জায়গাটা তৈরি হয় নি। সেই সুযোগ-সুবিধেগুলো কম। এটা আমি জোর গলায় বলতে পারি। এটা মানুষের একটা অ্যাক্সেপ্টেন্সের ব্যাপার। এটা আমরা একা লড়াই করে কিছু করতে পারব না, যতদিন না মানুষ এটাকে এক পর্যায়ে রাখছে। হয়ত বলে, কিন্তু ব্যাক অফ মাইন্ড – তাতে কিন্তু নাচটা নেই। কটা নৃত্যোত্সব হয় বলো ? এনি ওয়ে। কোনোদিন হবে। সেটার আশাতেই থাকি। তো যে কথা বলছিলাম, যখন আমি জেলবন্দিদের নিয়ে কাজ শুরু করলাম, তখন কিন্তু কিছু কিছু জায়গা থেকে একটু রেজিস্ট্যান্স ছিলই। ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে নাচছে। তোমরা জেলের কোনও কোরিওগ্রাফি যদি দেখ, দেখবে ওরা একসঙ্গে রিহার্সালও করে না। মেয়েরা মেয়েদের জন্য, ছেলেরা ছেলেদের জন্য। শেষে গিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়। ওদের নাচে  মিলেমিশে কোনও কিছু নেই। এক্ষেত্রে আমাকে খুব চিন্তা করে কোরিওগ্রাফি করতে হয়। প্রথম যখন ডান্ডিয়া করেছিলাম তখনতো আমি জানতাম না। তারপর দেখলাম এটা বিরাট একটা ইস্যু হয়ে গেল। আর তখন তো প্রথম। এখন যেমন করলে কেউ কিছু বলবে না। এইভাবে ওদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে ওরা কতটা পাল্টেছে আমি জানি না, তবে এই জার্নিটা আমাকে পাল্টে দিয়েছে। আমি ভাল-মন্দ বিচার কখনও করি না, কী পেলাম-না পেলাম তার হিসেব কখনও করি না। মানুষকে মানুষ হিসেবেই ভাবি – এর থেকে বেশি কিছু না। আমার কাছে একজন ডান্সার যা, সিঙ্গারও তা, একজন সাধারণ মানুষও তাই। আমরা কী করছি না করছি সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান – এটা যেন কখনও ভুলি না।

প্রতিভা দাসঃ    ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ থেকে ‘মুক্তধারা’ সিনেমা – এই জার্নিটা কীভাবে বাস্তবে রূপ পেল?

অলকানন্দা রায়ঃ আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।

প্রতিভা দাসঃ    জেলের বন্দিরা আপনাকে ‘মা’ বলে ডাকেন। এই অনুভবটা কেমন? নাইজেল আকারাকে আপনি খুঁজে পেলেন কীভাবে?

অলকানন্দা রায়ঃ মা হওয়াটা সহজ ব্যাপার ছিল না। একদিনে হইনি। আমি ওদের ম্যাডাম ছিলাম। আস্তে আস্তে মা হয়েছি। যখন জেলের ভেতর কেউ যায় তখন ওরা ধরেই নেয় যে যারা এখানে আসছে, তারা কোনো একটা উদ্দেশ্য নিয়েই আসছে। হয় কোনও এন জি ও টাকা বানাবে ওদের দেখিয়ে, নয় কেউ তথ্য জানতে আসবে। আমি কিন্তু এখনও (আজকের দিন পর্যন্ত) কাউকে জিজ্ঞাসা করি নি যে তারা কেন কী কারণে জেলে বন্দি হয়ে আছে। কোনও কারণে যদি জেনে গেছি সেটা আলাদা কথা। আমি জানতে চাইনি, কারণ ওরা একে অপরের প্রতি অভিযোগ করলে আমার বায়াস হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। কারণ আমি তো মানুষ। এখন সবই জানি কিন্তু আর প্রভাবিত হই না। নাইজেলও ওদের মধ্যে একজন ছিল। ওর নাম ভিকি। ওকে সবাই ভিকি বলে জানে। আজকে ও একটা জায়গায় পৌঁছেছে, সেটা আমার হাত ধরেই হোক বা নিজে – সেটা ওর কপাল – আমি কিছু করিনি। ও ভাল থাকুক। অনেকে, অনেকেই বেরিয়ে গেছে। প্রত্যেকে নিজের একটা জায়গা করে নিয়েছে। লোকে তাদের কথা জানে না। তারা কেউ কিন্তু আর অন্ধকার জগতে ফিরে যায় নি। আমি যখন প্রথম জেল বন্দিদের নিয়ে কাজ করেছিলাম তাদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন এখন মুক্তি পেয়েছে। তাদের সবাই না হলেও ৯০ শতাংশ যোগাযোগ রাখে আমার সঙ্গে। ওঁদের বেশিরভাগই খুব গরীব। তারা তাদের মত করে জীবিকা বেছে নিয়েছে। কেউ ট্রাক ড্রাইভার, কেউ ইঁটখোলায় কাজ করে। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র প্রথম দৃশ্যে যে ছেলেটি গান গেয়েছে – অসাধারণ গান করে – ও লাইফার ছিল। তারপর হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পায়।ও ইঁটখোলায় কাজ করত। তারপর টাকা জমিয়ে টোটো কিনেছে। প্রথমদিনেই আমাকে ফোন করছে – মা আজ আমি টোটো চালাব। তোমার আশির্বাদ চাই। তো এইভাবেই প্রত্যেকেই যে যার মতো জীবিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে নাইজেল ভাল স্কুলে পড়েছে, ভাল ঘরের ছেলে। খুব ইন্টেলিজেন্ট, একটা লিডারশিপ কোয়ালিটি আছে। ও সবসময় আমার সঙ্গে থাকত। তাই ওকে অনেকে জেনেছে, চিনেছে। আজ গর্ব হয় এরা এত সুন্দর করে নিজেদের তৈরি করে নিয়েছে। এটাই আমার পাওয়া। আমি সবার ভেতরের মা।

প্রতিভা দাসঃ    বন্দিরা ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘মোক্ষগতি’, ধ্রুবজ্যোতি তুমি যীশু’র মতো প্রযোজনায় অংশ নিচ্ছে। বাংলার বাইরে দিল্লি-মুম্বই-পূণে-ভূবনেশ্বরে অনুষ্ঠান করছে – এতে তাদের মানবিক উত্তরণ কতটা ঘটেছে? যেখানে আপনি বারবার বলেছেন যে বন্দিদের পুনর্বাসনের জন্য সমাজকে সংবেদনশীল হতে হবে।

অলকানন্দা রায়ঃ আমরা সবাই দোষ করি। দোষ করিনি এমন বোধ হয় সমাজে কেউ নেই। আইনের চোখে ওরা দোষী তাই ওরা ভেতরে। আইন আইনের মত চলে। ওদের মানুষের মর্যাদাই হারিয়ে যায়। সেটা যদি ফিরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তার মর্যাদাও তারা দেয়। ওদের নিয়ে আমি ট্রেনে করে বেঙ্গালুরু, পুণে এত জায়গায় গেছি, বাসে করে শান্তিনিকেতন গেছি – সমস্যা হয়নি। পঞ্চাশ জনের দলে চল্লিশ জন ছেলে, দশজন মেয়ে, পাঁচ-ছ’জন গার্ড। ওরা কী পালাতে পারে না? ওরা সেলফ পুলিশিং করে। গার্ডদের বলে আপনারা ঘুমোন। এটা কিন্তু শেখার মত। আর প্রোগ্রামের ম্যানেজমেন্ট সেটাও তারিফযোগ্য। এত জিনিসপত্র যায়। সবকিছু নামাতে ওদের দশ মিনিট লাগে না। প্রোগ্রাম শেষ হলে সব জিনিস ট্রাঙ্কে ভরে প্যাক-আপ করতে লাগে পনেরো মিনিট। সবকিছুতে লেবেলিং করা। সব নির্দিষ্ট তালাচাবি দেওয়া। নানা রঙের ব্যবহার। নিজেরাই করে। আজ এতজন তো বেরিয়ে গেছে। প্রথম টিমের থেকে বোধহয় দশজন আছে। প্রোগ্রামের মান কিন্তু ওরা পড়তে দেয় না। ওরা কিন্তু কেউ ডান্সার নয়। প্রত্যেকে নিজেরা নিজেরা প্র্যাকটিস করে, ট্রেন্ড করে। আমি গিয়ে পারফেকশন করাই। আমার আর কোনও অ্যাসিস্ট্যান্ট লাগে না। কেউ বেরিয়ে গেলে নতুনদের তৈরি করাটা ওরাই করে। আমি ওই জায়গায় থাকলে হয়ত পারতাম না। তবে এমনও হয়, কোনও সময় কেউ যদি কোনও দোষ করে, ভুল করে আমি সঙ্গে সঙ্গে টিম থেকে বাদ দিয়ে দিই। একবার দশজনকে, একবার সাতজনকে একসঙ্গে বাদ দিয়েছি। পুরো প্রোগ্রামটাই দিন সাতেকের মধ্যে ম্যানেজ করে আমার ছেলেরা। ‘মা’ বলে আমি কিন্তু আহ্লাদ করি না। কখনও মারধোরও করি। কিন্তু ওরা কিছু মনে করে না। শুধরে নেয়। ওদের জন্য আমি তো বিদেশ যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আর যাই না। একবার বিদেশ থেকে ফিরে দেখলাম ওরা অভিমানে লিখে রেখেছে – তুমি ২৩ দিন এত ঘণ্টা, এত মিনিট পরে এসেছো। আমার মনে হয় বিদেশ অনেক গেছি। এখানে আমার কাজ অনেক বেশি। নিজে অনেক নেচেছি। ভালও লাগেনা আর এখন।

প্রতিভা দাসঃ    আপনি পণ্ডিচেরির অরবিন্দ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত। সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে কাজের অনুভবটা কেমন?

অলকানন্দা রায়ঃ অরবিন্দ আশ্রমটা একেবারে অন্যরকম। ওখানে সকলে যে যার নিজের মত কাজ করে, মায়ের নামে। এই যে আমি নাচি, নাচ শেখাই – আমি মনে করি আমি মায়েরই কাজ করছি। মায়ের কাজে যেন কোনও খুঁত না থাকে। এই আশ্রমের সঙ্গে আমার যোগ অন্য ধরনের। মায়ের ঘরে আমার বিয়ে হয়। আজ মা নেই। কিন্তু তাকে আমি সবসময় পাই। তিনিই আমাকে এত কাজ করার শক্তি দেন। এই কাজ করতে অসম্ভব ধৈর্য লাগে, সহ্যশক্তি লাগে। ওরা যেমন আমায় ভালবাসে, তেমনই রাগ অভিমানও করে। ক’দিন না গেলে আবার ফোন করে ভুল স্বীকার করে। সত্যি বলতে কী আমার জীবনটা একদম অন্যরকম হয়ে গেছে।

প্রতিভা দাসঃ    দীর্ঘ নৃত্যজীবনে দেশে-বিদেশে বহু অনুষ্ঠান করেছেন। বিদেশে ভারতীয় নৃত্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কেমন?

অলকানন্দা রায়ঃ আমি সেই আশির দশকের প্রথম থেকে বিদেশ যাচ্ছি। তখনকার সঙ্গে এখনকার কোনও তুলনা হয় না। তখন জানবার আগ্রহ যেন বেশি ছিল। কৃষ্ণের চরিত্র নিয়ে সে কী জিজ্ঞাসা। কেন তোমরা ভগবানের (গড) ভালবাসাকে শো করে দেখাচ্ছো। তখন অত কেউ ভারতীয় নৃত্যকলা নিয়ে বিদেশে যেত না। ওদেরও অনেক কৌতূহল ছিল। কিন্তু একটা সময় পর তা বোধহয় নষ্ট হয়ে গেছে। বলিউড ঢুকে পড়েছে। ওখানকার বাঙালিরাও বলিউড কালচার ফলো করছে। আমি কাউকে বা কোনও নাচকে ছোট করছি না, দে ডোন্ট লাইক বলিউড কালচার। কারণ ওখানকার ভারতীয় ছেলেমেয়েরাও তো বলিউড কালচারে গা ভাসাচ্ছে। সাজ-গোজ, এমনকি বিয়েগুলোও বলিউড স্টাইলে হচ্ছে। বাঙালিদেরও তাই। কিন্তু আমাদেরও তো নিজস্ব একটা কালচার আছে। আমাদেরও তো বিয়ের গান ছিল। আসলে সময়ের সঙ্গে সব পাল্টায়। তাকে প্রয়োজনে গ্রহণও করতে হয়। তবে থাকে সেটাই যা গভীর, যার একটা মূল আছে। যার রুট নেই – তা ঝড়ে পড়ে যাবে। নাচ তো ভেতরের ব্যাপার, সেটা শুধু হাত-পা দিয়ে হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার নাচে টেকনিকের উপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের নাচে ভাব-রস গুরুত্বপূর্ণ। ভাব-রস ছাড়া তুমি তো আত্মাকে স্পর্শই করতে পারবে না। আমরা তা দিয়েই তো স্পর্শ করি দেশ-বিদেশের দর্শকদের।

প্রতিভা দাসঃ    বিভিন্ন নৃত্য প্রযোজনার ক্ষেত্রে আপনি বারবার রবীন্দ্রনাথের স্মরণাশ্রিত হয়েছেন। একটা সময় ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে আপনার আর শান্তি বসুর জুটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল শুনেছি। এ বিষয়ে যদি কিছু শোনান আমাদের।

অলকানন্দা রায়ঃ রবীন্দ্রনাথ আমাকে এমনভাবে ঘিরে আছেন যে আমি অনেক সময় ঠাট্টা করে বলি যে আমি বোধহয় কবিগুরুর অদৃশ্য কোলে বড় হয়েছি। শুধু উপলব্ধি নয়, আমি যেন সবখানেই রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে পারি। তিনি কী বলতে চাইছেন তা অনুভব করতে পারি। যখন আমি প্রথম ‘শ্যামা’ করি তখন আমার মাত্র ১৫-১৬ বছর বয়েস। তখন আমায় যেমন শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল তেমনই করেছিলাম। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, জর্জ বিশ্বাস, চিন্ময়দা এমন সব দিকপালেরা ছিলেন সেই প্রোডাকশনে। চিন্ময়দা গেয়েছিলেন উত্তীয়র গান, কোটালের গান গেয়েছিলেন জর্জদা। তাতে অবশ্য শান্তিদা ছিলেন না। প্রথম ‘শ্যামা’ করেছিলাম নরেশদার সঙ্গে। তখন অবশ্য বুঝিনি আমি কাদের সঙ্গে কাজ করছি, এখন বুঝতে পারি। তবে এর পরে যখন আমি নিজে ‘শ্যামা’ করতে গেছি তখন আমি নিজের ভাবনায় করেছি। যেমন যখন উত্তীয় ওকে আংটি দিচ্ছে তখনও কাঁদবে কেন? ও তো ওকে ইউজ  করছে। যদি ভুলটা  ভাবত তাহলে আংটি দিত না। লোকে প্রশ্ন করত  – কেন আপনি এরকমটা আলাদা করলেন। আমি আমার বোধের জায়গাটা বলতাম। সেই সময় ক্রিটিকরাও ছিলেন এক একজন জ্ঞানের ভাণ্ডার। যেমন অমিতাভ চৌধুরি, সন্তোষ ঘোষ, মৈত্রেয়ী চ্যাটার্জি, বসু গুপ্ত প্রমুখ। আমি বলতাম এটা আমার ভাবনা, রবীন্দ্রনাথকে যে যেভাবে ভেবেছে, সেভাবে করেছে। তবে অর্থহীন হয়ে পড়বে এমন কাজ কখনই করতাম না। আর শান্তিদার সঙ্গে আমার নাচের একটা অদ্ভুত আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। আমরা যদি ভুলও করি তাও একসঙ্গে করতাম। এটা আমি জোর গলায় বলি যে শান্তিদার সঙ্গে নাচের কমফর্ট লেভেল ছিল তা আমি অন্য কারোর সঙ্গে নাচ করে পাইনি। শান্তিদার নাচের গ্র্যাভিটিই ছিল অন্যরকম। ওইরকম একটা পুরুষালী ভঙ্গী, সঠিক মুভমেন্ট, তার সঙ্গে ছিল পরিমিতি বোধ। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাবনা একজন পুরুষ কীভাবে তুলে ধরবে তা শান্তিদার কাছে শেখার। এটা সবাই পারে না। কেউ বেশি করে ফেলে, কেউ কম করে। আসলে শান্তিদা নাচ ছাড়বার পরে আমারও আর ‘শ্যামা’ কর হয় না। বুঝতে পারি না আমি কার সঙ্গে করব। আর সবাই এত ছোট – তাই আমার কোনও হিরো নেই। হিরো ছাড়াই নাচি (হাসি)।

তবে এখন তো কেউ নায়িকার রোল করতে বললে আমি কোনওমতেই করব না। কিন্তু ‘চণ্ডালিকা’ করব। চণ্ডালিকার সঙ্গে আমি নিজেকে রিলেট করতে পারি। সে নিয়ম ভেঙেছে। শেষবার যখন ‘শ্যামা’ করলাম, তখন শান্তিদা বেশ অসুস্থ। শান্তিদার শ্বাসকষ্ট হত। প্রেমের জোয়ারে- করছি। শান্তিদাকে বললাম ছোট ছোট মুভমেন্ট করুন। আমিও তাই করলাম। দর্শক কিন্তু ওভারঅল কোনও বিচ্যুতি অনুভব করতে পারল না। ব্যাপারটা এইরকম ছিল।

প্রতিভা দাসঃ    নৃত্য জগতের বহু বিখ্যাত মানুষজনের সঙ্গে আপনি কাজ করেছেন। কিছু অভিজ্ঞতা যদি শোনান।

অলকানন্দা রায়ঃ ঘটনাচক্রে ছোটবেলা থেকেই আমি বড় বড় মানুষজনের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সুচিত্রা দি (মিত্র), মৌ মাসির (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) সঙ্গে একস্টেজে বসে আমি ‘মায়ার খেলা’ করেছি। তখন ভাবিনি এগুলো আসলে ইতিহাস হবে। তখন এত ভিডিওগ্রাফিও ছিল না। এমনকি কালার ছবিও তোলা হত না। সব সাদা-কালো। এতটাই পুরোনো আমি। সাগরদা (সেন), সুমিতা দি (সেন), দ্বিজেনদা (মুখোপাধ্যায়) – এঁদের সঙ্গে কত প্রোগ্রাম করেছি। আমি প্রথম ওডিশি পারফরমেন্স করেছি দিদির (সংযুক্তা পাণিগ্রাহী) ড্রেস পরে। ওডিশি ফেস্টিভ্যালে হঠাৎ নাচের সুযোগ। আমার তখন ড্রেস কস্টিউম কিছুই নেই। যামিনী কৃষ্ণমূর্তি যখন এখানে পারফর্ম করতে আসতেন তখন মঞ্চে অ্যানাউন্সমেন্টের দায়িত্ব তিনি আমায় দিতেন। কত বড় বড় মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি। আমাকে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমি বিমানদা (বিমান ঘোষ), সন্তোষ দা (সন্তোষ সেনগুপ্ত) এঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। সন্তোষদাই তো প্রথম আমাকে দিয়ে ‘শ্যামা’ করান। তারপর সবাই ডেকেছে। তারা ছিলেন আর্টিস্ট মেকার। সংযুক্তা পাণিগ্রাহীকে প্রথম কলকাতায় অনুষ্ঠান করার সুযোগ দেন বিমান ঘোষ। আমাদের সময়ে কাজের একটা গভীরতা ছিল। এখন কেমন যেন দেখি সব ক্ষণস্থায়ী। এই যে তুমি আমার জীবনের গল্প শুনতে এসেছো তা তো এই রুটটা আছে বলেই। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, আজ যদি শান্তিদার শরীর ঠিক থাকত তাহলে উনি এখনও নম্বর ওয়ান থাকতেন। আমি নরেশদা, শান্তিদা, সাধনদার সঙ্গে কাজ করেছি। পরের জেনারেশনে লালি( শুভাশীষ), কৌশিক – এদের সঙ্গেও কাজ করেছি। কেউ কেউ বলেছে তুমি কী এবার তোমার নাতির বয়সী ছেলেপুলেদের সঙ্গে নাচ করবে নাকি? আমি ভাবি হয়ত তাই। (হাসি) আমার বড় নাতি তো এখন ২৫ বছর।

প্রতিভা দাসঃ    আপনার প্রযোজনার ক্ষেত্রে আপনি বরাবরই নিজস্ব আঙ্গিক এবং পোশাকের উপর জোর দিয়েছেন। এই ভাবনাটা কেমন থাকে। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলান কীভাবে?

অলকানন্দা রায়ঃ আমি মনে করি যে কোনও একটা আর্ট ফর্ম যেন ডোবা হয়ে না থাকে। ইট হ্যাজ টু বি এ রিভার। ক্ল্যাসিকাল নাচটা একটা ভিত। ওটা ব্যাকরণটা শেখায়। আমি যখন একটা গান কম্পোজ করি, আমি ওডিশির উপর বেস করেই কম্পোজ করি – তাতে আঙ্গিকটা রাখি, কিন্তু কাঠিন্যটা রাখি না। ব্যাকরণ থেকে সরি না। আমার নাচে আমি, হাত, বডি, মুভমেন্ট, এক্সপ্রেশন – এসবগুলো ভেঙে দিই, কিন্তু ফুট-ওয়ার্কটা ভাঙি না। কারণ ফুটওয়ার্কের সঙ্গে ভাবের কোনও যোগ নেই। তালটা ধরে রাখি, বাকিটা ভেঙে দিই।

প্রতিভা দাসঃ    অনেক সম্মান পেয়েছেন। মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন। কিন্তু কিছু না পাওয়ার, না করার বেদনা কী অনুভব করেন। কোনও স্বপ্নের কাজ কী এখনও বাকী থেকে গেছে?

অলকানন্দা রায়ঃ আমি জানি না কতদিন বাঁচব। দু-একটা প্রোডাকশন মাথার মধ্যে রয়েছে। সেটাও জানিনা করতে পারব কী না। আসলে বড় কাজ করতে গেলে স্পনসর খুঁজতে হবে ভেবেই আর এগোনো হয় না। না হয় না হবে। তাতে খুব কোনও দুঃখ নেই। যেমন আমার খুব কুচিপুরি শেখার শখ ছিল। জামসেদপুরে থাকাকালে কিছুদিন শেখার চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু তারপর কলকাতায় ফিরে নানা টানাপোড়েনে তা আর হল না। কুচিপুরিতে অদ্ভুত একটা চপলতা আছে, অভিনয় আছে, ফ্লো আছে। ওরা গান করে করে নাচে। আমার খুব শখ ছিল ওইরকমভাবে নাচব। দেখি হয়ত এই বয়সে কোনোদিন ওইরকম মনের মত কোনো প্রোডাকশনে নেমেও পড়তে পারি। এই বয়সে সেই স্বাধীনতা নিশ্চয়ই পাব।

প্রতিভা দাসঃ    পোশাক নিয়ে আপনি বরাবরই অন্যরকম। ভাবনাগুলো কীভাবে আসত?

অলকানন্দা রায়ঃ সত্যি বলতে কী ছোটবেলা থাকেই পোষাক নিয়ে আমি অন্যরকম ভাবে ভাবতে চাইতাম। আমার একটা জামা ছিল (৬০ সালের কথা বলছি)। ওটা পরে গেলেই সুচিত্রা দি (মিত্র) বলতেন – এ মা মুন্নি একটা ছেঁড়া জামা প্রে এসেছে। কিন্তু ওটাই ছিল আমার ডিজাইন, নিজস্বতা। এটা বড় বয়সেও ছাড়তে পারিনি। এক সময় অসুস্থতার কারণে আমি শাড়ির সঙ্গে স্নিকার্স পরতাম। লোকে আমার পায়ের দিকেই আগে তাকাত।  আমার কমফর্ট জোনের কথা ভেবেই এটা করেছিলাম। কে কী ভাববে তা গ্রাহ্য করিনি। এখন পাগড়ি পরি। এটারও একটা ঘটনা আছে। আমি তখন চিত্রাঙ্গদা করি, একা। নিজেই সুরূপা, নিজেই কুরূপা। কোনো অর্জুন নেই, কোনো মদন নেই। দুটো কাপড়কে ঝুলিয়ে রেখে তাদের সাথে কথা বলি আর অভিনয় করি। সেখানে বীর চিত্রঙ্গদা একটা পাগড়ি পরেছিল। স্টেজে বসেই সাজবদল হত। তা এই পাগড়ি পরে বেশ দেখতে লাগছিল নিজেকে। এটা অনুভব করেই পাগড়িটাকে সঙ্গী করে নিলাম। এখন তো আমার কিছু স্টিচ করা পাগড়ি আছে আর কিছু এমনি। পরে নিতে হয়। আসলে আমার একঘেয়েমি ভাল লাগে না। কেন ওডিশি মানেই মাথায় চুড়ো পরতে হবে। কেন সম্বলপুরী শাড়ি পরতেই হবে? আমি নাচের সুবিধের জন্য পোশাক বদল করে নিয়েছি। একবার কী হল বলি, বিদেশে অনুষ্ঠান, টিম নিয়ে গেছি। বিদেশে গিয়ে দেখলাম রেডি করে রাখা ব্লাউজগুলো আনতে ভুলে গেছি। কী করা যায়? তখন মাথা খাটিয়ে সকলের জন্য ওইরকম রঙের ফুলস্লিভস টি-শার্ট কিনলাম। আর টি-শার্টের উপর কাঁচুলি করে কাপড় নিয়ে নাচ করলাম। সেই স্টাইল চেঞ্জ। এখন কিন্তু সবাই সেটা করে। আমি যত বিয়ের বেনারসি পেয়েছি সব কেটে কেটে কস্টিউম বানিয়ে ফেলেছি। একবার ওইরকম একটা বানানো কস্টিউম পরে চিত্রাঙ্গদা করেছি। শো দেখে বসু গুপ্ত জিজ্ঞাসা করলেন মণিপুর রাজকন্যা হয়ে তুমি ওডিশি কস্টিউম কেন পরলে? আমি বললাম এটা তো ওডিশি কস্টিউম নয়। এটা বেনারসী কেটে বানানো। আর মণিপুরের রাজকন্যা কী কেবল মেখলা পরে ঘুরে বেড়াবেন? অন্য জামাকাপড় পরবেন না? কুরূপা চিত্রাঙ্গদা রিয়েল, কিন্তু সুরূপা হল ফ্যান্টাসি। সে কল্পনায় যা খুশি পরতে পারে। ঘাঘরা চোলিও পরতে পারে। বসু গুপ্ত আমার ব্যাখ্যায় দারুণ খুশি হয়েছিলেন। তবে আমার নর্ম ভাঙায় একটা ভাবনা থাকে, কারণ থাকে। এমন কিছু করিনা যাতে শালীনতা নষ্ট হয়।

প্রতিভা দাসঃ    কী কলকাতা, কী মফস্বল – সর্বত্রই এখন চলছে চটুল গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নৃত্য শিক্ষার আসর। এর লক্ষ্য হয় এলাকার মঞ্চে নাচ করা, না হয় রিয়েলিটি শোতে অংশ নেওয়া। এতে কী মূল ধারার নৃত্যশিক্ষার প্রতি মানুষ আগ্রহ হারাচ্ছে ?

অলকানন্দা রায়ঃ রিয়েলিটি শোয়ের নামে যা হচ্ছে তাকে আমরা নৃত্য বলতেই পারি না। এগুলো জিমন্যাসটিকস। হাত-পা ছোঁড়া, ডিগাবাজি খাওয়া নাচ নয়। ওয়েস্টার্ন ডান্স আলাদা। ভারতীয় নাচে এসব নেই। একবার আমায় একটা রিয়েলিটি শোতে ডেকেছিল। তাতে উদ্যোক্তারা ক্লাসিক্যাল, সেমি-ক্ল্যাসিক্যাল, ফোক, বাংলা গান থাকার শর্ত মানায় আমি অংশ নিয়েছিলাম।

প্রতিভা দাসঃ    নৃত্য জগতের আজকের প্রজন্মকে কোনও বার্তা দেওয়ার আছে আপনার?

অলকানন্দা রায়ঃ আমার বার্তা শুনবে কে? কেন শুনবে? আমার কাছে অনেকে নাচ শিখতে আসে। জিজ্ঞাসা করে টেলিভিশন শো, পোগ্রামের কথা। আমি বলি ওসব কিচ্ছু হয় না এখানে। আমার এখানে পরীক্ষারও ব্যবস্থা নেই। কারণ আমার গানে ডিপ্লোমা আছে, পিয়ানোয় ডিপ্লোমা আছে, কিন্তু কোনওটাই করি না। আমার নাচে একটা সার্টিফিকেটও নেই – অথচ নাচটাই করি। এটা ভালবাসার ব্যাপার। শেখার ব্যাপার। আগে ক্লাসিক্যাল শেখো। রিয়েলিটি শো কোনও পথ নয়। তাৎক্ষণিক কিছু পাওয়ার জন্য করলে কিন্তু নাচটা হবে না।

প্রতিভা দাসঃ গল্পের সময়ের পক্ষ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

অলকানন্দা রায়ঃ তোমাকেও ধন্যবাদ।

………………………………

কৃতজ্ঞতা স্বীকার ঃ শ্রী শান্তি বসু, শুভাশীষ দত্ত  ও শাশ্বতী ভট্টাচার্য 

প্রতিভা দাস – কথক ও সৃজনশীল নৃত্যশিল্পী। শান্তি বসু ও ড. মালবিকা মিত্রর সুযোগ্য ছাত্রী।

Tags: ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ