১৯৯২ সালের শেষের দিকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যকলা বিভাগ বা ভিস্যুয়াল আর্টস ফ্যাকাল্টিতে ছাত্র হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। তখন আমাদের ক্যাম্পাস এবং স্টুডিও ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মূল ভবনের ভিতরেই। ফলে ছবি আঁকার সাথে সাথেই চিনে ফেলছিলাম ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের প্রতিটি অলিগলি পাকস্থলি। গগনেন্দ্রনাথের ছবিতে যে আশ্চর্য আলোছায়ার খেলা, তা আমরা নিত্যদিন দেখতে শুরু করলাম সকাল থেকে সন্ধ্যে। দিনের বিভিন্ন সময় একই সিঁড়ি বা চাতালের আলোছায়ার বিস্তার কিভাবে পাল্টে যেতে থাকে সে ছিল আমাদের প্রতিদিনের লক্ষ্য করবার বিষয়। ছবি আঁকার ফাঁকে ফাঁকে ঠাকুরবাড়ির এ গলি, সে গলি এক্সপ্লোর করাটা বেশ একটা নেশার মত পেয়ে বসেছিল।
ঠাকুরবাড়ির সামনের মূল অংশটিতে ছিল আর্ট গ্যালারি। সুরেন্দ্রনাথ করের সিল্কের ওপর আঁকা প্রকাণ্ড সাঁওতাল যুগলের ছবিটি খুব টানতো আমাকে। আর ছিল রামকিঙ্করের ছোট্ট সেই জলরঙের ল্যান্ডস্কেপ। সুভো ঠাকুরের আঁকা কিউবিস্ট ধরণের রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিটিও বেশ লাগতো। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেসব ছবি দেখতাম। কেউ বিরক্ত করতো না, কারণ এইসব ছবি দেখবার দর্শক প্রায় ছিল না বললেই চলে।
এইরকমই একদিন একা একা ছবি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে টানা দালানে বসে আছি, এমন সময় চোখ গেল পাশের একটা বিরাট বন্ধ দরজার দিকে। এই দরজাটা যে আমি আগে দেখিনি তা নয়, কিন্তু এইরকম কৌতূহল বোধ করিনি। কি মনে হল উঠে গিয়ে ঠেলা দিলাম দরজাটায়। সেটা খুলে গেল অনায়াসেই, আর আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের ভেতরের দেওয়ালে পর পর ঝোলানো রয়েছে রবীন্দ্রনাথের আঁকা অনেকগুলো মূল ছবি। আলিবাবার আশ্চর্য গুহার মত সেই ঘরের দরজা তখন আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে, আর স্বল্প আলোকিত সেই হিমশীতল ঘরের মধ্যে আমি একা আর রবীন্দ্রনাথের ছবিরা। এই ছিল আমার রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির সঙ্গে প্রথম একান্ত পরিচয় এবং আলাপচারিতা। সেই স্বল্পালোকিত ঘরে অন্ধকার পরিপ্রেক্ষিতের ভিতর থেকে জেগে ওঠা নারীদের মুখাবয়ব গভীরতর রহস্যময়তা নিয়ে ঘিরে ধরছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি তুলির আঁচড় একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠে জানান দিচ্ছিল কি প্রচণ্ড আবেগ ও সৃষ্টির তাগিদ তিনি অনুভব করেছিলেন এইসব ছবির জন্ম মুহূর্তে। ঠিক এই একই অভিজ্ঞতা আমার আবার হয়েছিল দশ বছর পরে লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে ভিনসেন্ট ভ্যানগঘের আঁকা মূল ছবির সামনে দাঁড়িয়ে। মনে হয়েছিল ছবি আঁকার কাজ যেন তখনো চলছে আর প্রতি মুহূর্তে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে নতুন নতুন রেখা ও তুলির আঁচড়। ভ্যানগঘ এবং রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কোন শিল্পীর আঁকা ছবি দেখে আমার এইরকম উপলব্ধি হয় নি।
ফিরে আসি আবার প্রথম রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি দেখার গল্পে। নিকোলাই গোগোলের লেখা একটা ছোট গল্প পড়েছিলাম অনেকদিন আগে। সে গল্পের নাম ‘The Portrait’. গল্পের মূল বিষয় একটি প্রতিকৃতি, যার চোখদুটি এত জীবন্ত ভাবে আঁকা যে সত্যিই তাকাচ্ছে বলে মনে হয়, এবং দর্শকের মনে অস্বস্তির উদ্রেক করে। একটি বিরাট ঘরে রবীন্দ্রনাথের আঁকা এতগুলি মূল ছবির সামনে দাঁড়িয়েও আমার এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই তীব্র আবেগ তাড়িত ছবির চরিত্ররা মিলে যে সম্মিলিত ঘূর্ণির সৃষ্টি করেছে আমি তার মধ্যে সম্পূর্ণ ডুবে যাচ্ছি। এই মানসিক অবস্থার মধ্যেই একটি ছবির দিকে তাকিয়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ছবির তীব্র অন্ধকারের মধ্যেই একঝলক অপ্রত্যাশিত কঠিন আলোকরেখা। রবীন্দ্রনাথের চিত্রচর্চার সঙ্গে যা নিতান্তই বেমানান। এগিয়ে গেলাম সেই ছবির দিকে। ছবির কাঁচের সঙ্গে একেবারে চোখ লাগিয়ে লক্ষ করতেই যা দেখলাম তাতে এক মুহূর্তেই আমার আবেগ একেবারে বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়লো। রবীন্দ্রনাথের আঁকা মহামুল্য ছবির রঙের আস্তরণ খসে পড়ছে সারফেস থেকে। চরম অবহেলায় ফ্রেমের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে পিছনের দেওয়াল। আর সেই ফাঁক দিয়েই খসে পড়া রঙের আস্তরণ মেঝেতে ছড়িয়ে আছে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে। নিচু হয়ে আঙ্গুলের ডগায় তুলে নিলাম সেই রঙের গুঁড়ো। পেলিক্যান কোম্পানির রঙিন কালি ব্যবহার করতেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছবি আঁকার কাজে। এই কালির চরিত্র ছিল কতকটা আজকের দিনের অ্যাক্রিলিক রঙের মত। ফলে শুকিয়ে যাওয়ার পর যে কোন রঙের ওপর অন্য রঙ লাগাতে বাধা ছিল না। কিন্তু এইসব অমুল্য ছবিকে সংরক্ষণ করবার জন্য যে দক্ষতার প্রয়োজন আমরা সেসব থেকে বহু দূরে। লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে দেখেছি কি অসীম যত্ন নিয়ে এদুয়ার মানের আঁকা ক্ষতিগ্রস্থ একটি ছবিকে মেরামত করে রাখা হয়েছে, অথচ আমাদের এই দুর্ভাগা দেশে চরম অযত্নে অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের অমুল্য ছবি। মনে রাখতে হবে আমি বলছি আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগের দেখা অভিজ্ঞতার কথা। আজ সে ছবির কি দশা হয়েছে তা আমি জানি না।
Tags: Debraj Goswami, Paintings of Rabindranath, গল্প এবং সত্যি, দেবরাজ গোস্বামী, রবীন্দ্রনাথের ছবি
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।