মাঠের মাঝখানে খানিকটা ঘাস জমি। জমিটায় একটা ডোবা কেটে ডাঙাটাকে উঁচু করা হয়েছে। একটা ছোট্ট মন্দির। জমিটায় ঝাউ,শিরীষ,পাকুড় আর তালগাছের ছায়া। জায়গাটা ঝাউতলা আশ্রম নামে পরিচিত। মন্দিরের মধ্যে দুটো কালো পাথর। একটি পাথর হল মা। অন্যটি বাবা। যে যার ভক্ত সে তার ইষ্ট অনুযায়ী পাথরে ফুল-জল দেয়।
মাঝে মাঝে গ্রামের লোকেরা ঢাক ঢোল বাজিয়ে পুজো দিতে আসে।
কাত্তিক-গনেশ-হেব-তুতে-বিশু এই পাঁচ অবতার সন্ধ্যা বেলায় আসে। তারপর গঞ্জিকা সেবন। কালকে থেকে দপদপ করে জ্বলে ওঠে আগুন। একদিন সন্ধ্যেবেলায় ওরা দেখল সাদা পোশাকের একজন সাধু শুয়ে আছে মাটিতে। ঘন চুল,দাঁড়ি,গোঁফ। তামাটে রঙ। মাটিতে ঘাসে এমন শুয়ে আছে যেন মাটি- গাছ- জল-ঘাসের মতই নীরব।
বিশু বললো, সাধুবাবা – ও সাধুবাবা?
চোখ খুললোসাধু। বললো, রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম,এই জায়গাটা দেখে ভাল লাগলো। চলে এলুম।
কাত্তিক বললো,জায়গাটা কিন্তু চোরাবালি –
স্মিত হাসি জেগে উঠলো সাধুর মুখে। বললো চোরাবালিতে না হয় বাঁশি বাজাতে বাজাতে ডুবে যাবো।
গণেশ বললো এখানে বড় বড় বিষধর মহারাজরা ঘুরে বেড়ায়।
সাধু বললো সে তো খুব ভাল কথা। আমি সাপ, বিছে, ভুত- প্রেত ভয় পাই না। ভয়টা আমার মধ্যে নেই।
ছিলিম তৈরি করতে করতে হেব বললো সাধুবাবা একটা গল্প বলো। সেই ছোটোবেলায় গল্প শুনেছি। তারপর আর গল্প শুনিনি।
কি গল্প শুনবে?
একটা সাধুর গল্প বলো।
সাধুর গল্প কেন?
আমরা খারাপ। সাধুরা সব ভালো – সেই জন্য।
গল্প শুরু হল। এক সাধুর আশ্রমে অনেক পাখি আসতো। একদিন সাধু দেখে তার আশ্রমে একটাও পাখি আসেনি। কি হল জানবার জন্য তিনি হাঁটতে থাকলো। কিছুদূর গিয়ে দেখে এক শিকারির জালে অনেক পাখি আটকে গেছে। ফাঁদে আটকে গিয়ে, অন্য পাখিদের বলছে এখানে পাখি শিকারি তোমাদের ছোলা দেবে। জাল পাতবে। তোমরা যেন ফাঁদে পা দিও না।
এরপর শিকারি এলো। পাখিগুলোকে একটা একটা ধরে যখন খাঁচায় রেখে দিচ্ছে,তখনও ধরা পড়া পাখিগুলো বলছে – এখানে পাখি শিকারিরা আসবে। ছোলা দেবে। জাল পাতবে। তোমরা যেন ফাঁদে পা দিও না। একই বুলি আওড়ে যাচ্ছে।
দুই
সাধুকে নিয়ে ভিক্ষায় বেরিয়েছিল কাত্তিক। একটা গ্রাম ঘুরে চাল-ডাল-আলু-বেগুন-পটল,এক চাঙারি বোঝাই। পাঁচ-দশ-কুড়ি-পঞ্চাশ টাকার নোটও কিছু। টাকাগুলো জামার পকেটে রেখেছিল কাত্তিক।
দুপুরে দুমানুষে খেয়ে জামাটা কে মন্দিরের পেরেকে ঝুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ জামাটা পড়ে যাওয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় কাত্তিকের। দেখে একটা ছোটো ছেলে ছুটে পালাচ্ছে।
ওমনি ঘুম চোখে ধর শালাকে, খিস্তি করতে করতে মার ছুট ছেলেটার পেছনে। মাঠের মধ্যে তখন বড়বড় পাট গাছ। অনেক তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাত্তা করতে পারল না কাত্তিক। পাট খেতের মধ্যে হারিয়ে গেল।
সন্ধ্যে বেলায় আবার পাঁচ অবতার। কাত্তিক বললো, শালাকে ধরতে পারলে ছাল-চামড়া গুটটে দিতুম।
গনেশ হাসতে হাসতে বললো তুই তো সাধুর ট্যাকাগুলো হাওয়া করেছিলি। তোর মাল যে হাওয়া করলো ভাব সে কেমন সেয়ানা?
তুতে বললো ওই ছেলেটা কে কাশি চেনে – ওর কাছে চল। ধরে ফেলবো।
কাশি তো অন্ধ। কি করে চিনবে?
চিনবে চিনবে। একটা ফচকে ছেলে তো?
হ্যাঁ
আরে সেদিন ইষ্টিশানে কাশি একটা ফচকের হাত চেপে ধরে বলেছে, সারাদিন গাড়িতে ভিক্ষে করে মাত্র পঞ্চাশ টাকা? তোর মা তো একটা, বাপ কটারে শালা? বল, কোন কোন বাপকে টাকা দিয়েছিস?
কাত্তিক বললো, চল তবে অন্ধ কাশির কাছে। ও আমাদের ছেলেটাকে চিনিয়ে দেবে। সবাই যখন উঠতে যাচ্ছে গণেশ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো, দেখ কাত্তিক তুইযে খালি খালি বলছিস ছেলেটাকে পেলে ছাল- চামড়া গুটটে নোব, কথাটা ঠিক নয়।
কেন নয়?
সেকথাই তো বলছি। শোন, ওকে আমরা সবাই মিলে দায়িত্ব নিয়ে নেকাপড়া শিককে বড়ো করব।
তারপর?
তারপর ওকে আমরা নেতা করব। তখন আমাদের কপাল খুলে যাবে।
তিন
দপদপ করে আগুন জ্বলছে ঝাউতলায়। মাথার উপর আলোকিত আকাশ। গাছেদের পাতা,ডোবার নীলজল। মাটির ওপর, ঘাসের ওপর সাদা কাপড়ের তামাটে রঙের সাধু ঘুমিয়ে আছে। পৃথিবীর বুকে নেমে আসেঝড়াপাতা। পাখিরপালক।
Tags: গাছতলা, পঙ্কজ চক্রবর্তী
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।