পঞ্চাশ বছর আগের এই শহরটাকে যেন অচেনা লাগে অশীতিপর সত্যরঞ্জন চৌধুরীর। রিক্সা করে যেতে যেতে দুধারে যাই দেখেন তাই যেন অচেনা।তবু জীবনের প্রথম পঁচিশটা বছর তো কাটিয়ে ছিলেন এই শহরে। সেই স্মৃতি নিয়ে চলেছেন পুরোন এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে।গলির মুখে এসে একটু দোনামনা করে শেষে ঢুকে পড়লেন।রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাড়িটার দিকে তাকালেন। ভুল হবার তো কথা নয়। তবে গত অর্ধ শতাব্দীতে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ফলে মূল বাড়িটাকে আজ আর চেনবার উপায় নেই। বেশ বোঝা যায় পরিবার ও প্রয়োজন বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়িরও কলেবর বেড়েছে। তবু স্মৃতি তোলপাড় করে মূল বাড়িটার আভাস পাওয়া গেল। কলিং বেলএ হাত রেখে মনে হল মানুষটা আছে তো? বেল বাজাতেই দরজা খুলল এক তরুণী।
-এটা তো শিবদাস মুখোপাধ্যায়……।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, বসুন। আমি ডেকে দিচ্ছি। কী বলব আপনার পরিচয়?
– চোখে, মুখে একটা কৌতুকের হাসি রেখে বৃদ্ধ বললেন, ‘বল না একজন বুড়ো মানুষ এসেছেন। দেখি আমায় সে চেনে কিনা’।
বুদ্ধিমতী মেয়েটি বোধহয় বুঝে নিল। মিষ্টি হাসি ফিরিয়ে দিয়ে চলে গেল ভেতরে।– ‘দাদু……, তোমার বন্ধু এসেছেন………’।
ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করলেন আর এক অশীতিপর। আগন্তুক মিল খুঁজতে চেষ্টা করলেন । মিল পাওয়ার কথা নয় তবু মিল খুঁজে পেলেন কারণ তিনি জানেন কার কাছে এসেছেন। কৌতুক মেশান হাসি চোখে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘চেনা চেনা লাগছে কি একটু?’ এত দিনের ব্যবধানে ‘তুই’ সম্বোধন করতে দ্বিধা হল। চশমাটা একটু ঠেলে দিয়ে, চোখ বড় বড় করে, গলার স্বরে কিছুটা আন্দাজ করে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে শিবদাস জিজ্ঞেস করলেন- ‘সত্য?’
মুহুর্তে দুজনে ফিরে গেলেন পঞ্চাশ বছর আগের সেই তরুণ বয়সে। কত স্মৃতি, কত কৌতুক, কত অকারন পুলক। সত্য চৌধুরী তখন বর্ধমান মহারাজার এস্টেটে নবীন কর্মী।আর শিবদাস বর্ধমান টেকনিক্যাল স্কুল থেকে বাস্তুবাদের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে রাজবাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের ঠিকাদার। সেই থেকে বন্ধুত্ব। কিন্তু পরিস্থিতি দুজনকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মহারাজাধিরাজ বিজয়চাঁদ এর দেহান্ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সারা দেশে স্বাধীনতার লড়াই থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে নতুন যুগ আসছে। নতুন মহারাজা উদয়চাঁদের আমল থেকেই রাশ আলগা হতে শুরু করে । এস্টেটের তরুণ কর্মীরা বুঝতে পারেন যে নতুন পথ খুঁজতে হবে, যে যার মত ছড়িয়ে পড়তে হবে ভাগ্যান্বেষণে। সত্য চলে যায় মধ্যপ্রদেশে লোহার খনিতে কাজ নিয়ে। আর শিবদাস রাজবাড়ির ঠিকাদারী ছেড়ে সরকারী পি ডব্লিউ ডির ঠিকাদার হয়ে যান। জীবন এগিয়ে চলে নিজের নিজের ছন্দে। প্রথম দিকে মাঝে মাঝে আসা যাওয়া ছিল, ধীরে ধীরে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে পৈত্রিক বিষয় আশয়ের বিলি ব্যবস্থা করতে বর্ধমানে আসা। সত্য জানেন এটাই শেষ আসা। তাই মনে হল পুরোন বন্ধুর কথা।
সারা দিন কেটে গেল গল্প গুজব করতে করতে। সেই রাজবাড়ির গল্প। সদ্য গ্রাম থেকে আসা দরিদ্র যুবকদের চোখে রাজবাড়ির মানুষদের গল্প, তাঁদের ঐশ্বর্যের কথা। গল্পের ঝুলি শিবদাসের ভরা থাকত সব সময়ে। রক্ষণাবেক্ষণের কাজে তাঁর যাতায়াত ছিল অন্দরমহল পর্যন্ত, অনেকটা সাহেব-বিবি-গোলামের ভূতনাথের মতো। তাছাড়া তাঁর গল্প বলার ভঙ্গীটা ছিল ভারী সুন্দর। শ্রোতারা যেন চোখের সামনে সব দেখতে পেত।
– দাদু সেই ভূতের গল্পটা আরেকবার বলবে? সেই যে তোমার নাক মুখ চেপে ধরেছিল, তুমি আরেকটু হলে মারা যাচ্ছিলে?বল দাদু অনেকদিন শুনিনি।
-বলুননা বাবা।
-বল না ,সবাই যখন শুনতে চাইছে।
-ঐ দাদুর সামনে বল, তুমি বানিয়ে বলছ কিনা আজ ঠিক ধরা পড়ে যাবে।
এতসব দাবি মেনেই শুরু হল গল্প। বর্ধমানের মহারাজারা ছিলেন গভীর ভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসী। কয়েক পুরুষ ধরে তাঁরা অনেক দেবদেবীর মন্দির নির্মান করেন নিজেদের রাজ্যে। তবে তাঁরা বোধহয় শিব ঠাকুরের বিশেষ ভক্ত ছিলেন। বর্ধমান জেলার কালনার একশ আট শিব মন্দির তার সাক্ষ্য দেয়। তারকেশ্বরের বাবা তারকনাথের মন্দিরও ছিল তাঁদের এলাকা ভুক্ত। তাই শিবরাত্রির দিন বাবা তারকনাথের চরণে বর্ধমান রাজ পরিবারের পুজো দিয়েই পুজো শুরু হতো।
শিবরাত্রির কয়েকদিন আগে থেকে যোগাড় যন্ত্র শুরু হয়েছে। রাজপুরোহিত মহন্ত মহারাজের নেতৃত্বে মহারাজার তরফে পুজোসামগ্রী নিয়ে শিবরাত্রির সকালে একটা দল রওয়ানা হবে। দলে আছেন প্রবীণ কর্মী ভট্টাচার্য মশাই, গোমস্তা বাবু অনিল শিকদার, খাজাঞ্চি বাবু শরৎ সরকার এবং সত্য। শিবদাস একটু থেমে বন্ধুর দিকে তাকালেন।
-না না, আমার নাম প্রথমে ছিল না । আমি ভট্টাচার্য্য মশাইকে ধরে বসলাম আমিও যাব। আমি তখন সদ্য রাজ এস্টেটে কাজে যোগ দিয়েছি। উনি কি ভেবে বলে দিলেন- চল। দলে একজন কম বয়সী ছেলে দরকার। কথায় বলে না খেতে পেলে শুতে চায়। আমি ভাবলাম বুড়ো মানুষদের সঙ্গে যাব, আমারও একজন সঙ্গী থাকলে ভাল হয়। তোমার দাদু তখন রাজবাড়ির ঠিকাদার। আমার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। বললাম, চল যাবি? চল শিবরাত্রিতে তারকেশ্বরে পুজো দিয়ে আসি। রাজার পুজো নিয়ে যাব, ভাল ব্যবস্থা থাকবে। ও এক কথায় রাজী। শিবদাস কে সকলেই পছন্দ করে তার আমুদে, হৈচৈ করা স্বভাবের জন্যে। সকলেই রাজী হয়ে গেল।
-আমরা শিবরাত্রির দিন সকালবেলা সকলে তৈরি হয়ে বর্ধমান থেকে ট্রেনে কামারকুন্ডু, সেখান থেকে তারকেশ্বরে গিয়ে পৌঁছলাম। সঙ্গে ফল মূল মিষ্টি কাপড় ও অন্যান্য পুজোর উপকরণ নিয়ে চার জন কর্মী। দেশ তখন পরাধীন। তারকেশ্বর একটি গ্রাম, হাতে গোনা পাকা বাড়ি। গ্রামের লোকজন কৃষিজীবী। রাজার অর্থানুকুল্যে মন্দিরে অতিথি নিবাস এবং কয়েকজন স্থায়ী কর্মীও আছে। আমাদের সেখানেই জায়গা হল। দোতলায় একটা বড় হল ঘরে মেঝেতে ফরাস পাতা।তাতে চাদর বিছানো এবং ছজনের জন্যে ছটা বালিশ।দরজার পাশে একটা জালায় জল ও ঘটি।
ফাল্গুন মাসে শিবরাত্রির সময়ে রাতে একটু শীত শীত ভাব থাকলেও দুপুরে রোদ্দুরের ভালোই জোর থাকে। দুপুরে ক্লান্ত শরীরে পৌঁছে ঘরে গিয়ে আমাদের বেশ আরাম হল। আজ উপবাস, শিবরাত্রির দিন তারকেশ্বরে পুজো দেওয়া সচরাচর সুযোগ হয়ে ওঠে না। একটু বিশ্রামের পর বিকেল হতেই হাত মুখ ধুয়ে ,কাচা পোশাক পরে আমরা মন্দির চত্বরে উপস্থিত হলাম। একটু ঘোরা ঘুরি করতেই প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এল। বাবা তারকনাথের চরণে প্রথম নিবেদিত হবে রাজার পাঠানো পুজো। সকলেই সমীহ করে পথ ছেড়ে দিল। মহন্ত মহারাজ প্রথম মন্দিরে প্রবেশ করলেন সঙ্গীদের মাথায় বড় বড় বারকোষে ফলমূল ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে। তারপর একে একে ভট্টাচার্য্য মশাই ও আমরা নিজেদের পুজো সেরে নিলাম দেবাদিদেবের কাছে নিজেদের মনষ্কামনা জানিয়ে।অতিথিদের জন্যে প্রসাদ ও রাতের খাবারের ব্যবস্থা ছিল। সারা দিন অভুক্ত থাকার পর সকলে প্রসাদ গ্রহণ করে প্রাণ জুড়োলাম। শিবরাত্রির রাতে চার প্রহরে শিবলিঙ্গকে দুধ, গঙ্গাজল, মধু দিয়ে স্নান করিয়ে বেলপাতা আকন্দ, ধুতুরা, অপরাজিতা ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। মন্দিরের পুরোহিত আমাদের চার প্রহরের পুজো দেখতে অনুরোধ করে বললেন আজকের রাত জেগে থাকতে হয়। কিন্তু সারা দিনের ক্লান্তিতে আমাদের আর সে সামর্থ ছিলনা। কিছুক্ষণ মন্দিরে কাটিয়ে আমরা ঘরে চলে যাওয়াই মনস্থ করলাম।
মন্দিরের একজন কর্মী এসে একটা গ্যাসবাতি জ্বেলে ঘরে রেখে গেল। সকলেই পরিশ্রান্ত হয়ে বিশ্রামের তোড়জোড় করতে লাগলাম। মন্দিরের কর্মী চলে যেতে যেতে ফিরে এসে বলল, বাবুরা আপনাদের একটা কথা বলি।এটা তো বাবার থান।আজ তো শিবরাত্রির রাত, রাতে ঘুমুতে নেই। আজ রাতটা জেগেই থাকবেন বাবুরা।আর দরকার হলে আমকে ডাকবেন।
লোকটি চলে গেলে সকলে একটু মুখ চাওয়া চায়ি করলেন। কেউ কিছু বললেন না কারণ শিবরাত্রির উপোস করে রাত জাগতে হয় এই প্রচলিত বিশ্বাসটি সকলেরই জানা। সকলে চুপচাপ থাকলেও রাতটা যে নিদ্রাহীন কাটাতে হবে সেটা সকলেই মেনে নিল।সত্য বলল, আমি জানি তো, তাই তাস নিয়ে এসেছি। মহন্ত মহারাজ ও ভট্টাচার্য্য মশাই মৃদু হেসে সম্মতি জানালেন কিন্তু তাস খেলার বাইরেই থাকলেন। শিকদার বাবু, সরকার বাবু, সত্য চৌধুরী আর আমি মহা উৎসাহে তাস খেলা শুরু করলাম। এমন একটা ভাব যে একটা রাত তাস খেলে জেগে কাটানো কোনও ব্যাপারই নয়। এদিকে মহন্ত মহারাজ আর ভট্টাচার্য্য বাবু এটা ওটা আলোচনা করে সময় কাটাচ্ছেন।
রাত বারোটা বাজার পর ধীরে ধীরে শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে।প্রথমে সোজা হয়ে বসে থাকতে থাকতে বালিশটা কনুইটা রেখে একটু পাটা ছড়িয়ে দেওয়া, তারপর ঘন ঘন হাই তুলতে তুলতে, ঢুলতে ঢুলতে তাস খেলায় ভুল করা- এই সব হতে লাগল। ইতিমধ্যে ঢাক ঢোলের আওয়াজে বোঝা গেল যে তৃতীয় প্রহরের পুজো সমাপ্ত । কেউ একজন বলল তাস খেলা থাক, ঘুমোন বারণ কিন্তু শোয়া তো আর বারণ নয়।সবাইকার কথাটা মনে ধরল। সকলেই একে একে শরীর টা এলিয়ে দিতে লাগলেন। মোহন্ত মহারাজ এক ধারে তারপর ভট্টাচার্য্য মশাই ,একদম শেষে আমি। শিবরাত্রির রাতে ঠান্ডা ভালোই ছিল, সব জানলা বন্ধ, অজানা জায়গা তাই দরজাটা বন্ধ করাই স্থির হল। বদ্ধ ঘরে গ্যাস বাতিটা রাখা উচিৎ নয় তাই ওটা বাইরে রেখে দরজা বন্ধ করা হল।
নিজেদের মধ্যে মৃদু গল্প গুজব চলছে। মাঝে মাঝে আবার চুপচাপও হয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। সত্য জড়ানো গলায় বলে উঠলো, শিবু, ঘুমোসনি তো?
-না না ঘুমোইনি।
আবার কিছুক্ষণ কথা বার্তা চলতে লাগল। ধীরে ধীরে সকলেরই গলার স্বর নিস্তেজ হয়ে আসতে লাগল। মনে হতে লাগল ঘুমোন বারণ কিন্তু চোখ বুজে শোওয়া তো বারণ নয়। হঠাৎ একটা নাক ডাকার আওয়াজ। সেই আওয়াজে সবাই আবার সচেতন হয়ে উঠল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই আবার নিস্তেজ। আমাদের মনে হতে লাগলো ঘুমোন না হয় বারণ কিন্তু চোখ বুঁজে শুতে আপত্তি কোথায়। সকলেরই মাথায় আছে শিবরাত্রির রাতে বাবার থানে ঘুমোলে পুজো দেওয়া নিস্ফল। আমরা তাই একটা আধো ঘুম আধো জাগরণ- একটা তন্দ্রা তন্দ্রা ভাবের মধ্যে রয়েছি।
হঠাৎ কানে এল মোহন্ত মহারাজের গলা।–আঃ কি হচ্ছে। সকলেই আমরা শুনলাম।মনে হল হয়ত ভট্টাচার্য্য মশাইয়ের পা লেগেছে গায়ে।
তারপর ভট্টাচার্য্য মশাইয়ের গলা –উঃ বাবারে। সঙ্গে ঠক করে একটা আওয়াজ। সঙ্গে কি যেন একটা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল। এর পর শিকদার বাবু। -ওরে শীত করছে। চাদরটা নিয়ে নিচ্ছিস কেন? সরকার বাবু বললেন , এই কাতুকুতু লাগছে। এখন কি এসবের সময়?
-নাতি নাতনিরা যখনই এই গল্পটা শুনেছে তখনই যে প্রশ্নটা করে সেটাই করল। দাদু তোমরা একটু চোখ খুলে তাকালে না কেন?
সত্য চৌধুরী জবাব দিলেন, আমরা আসলে এমন একটা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলাম যে মনে হচ্ছিল বহুদূর থেকে শব্দ গুলো ভেসে আসছে। মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্ন দেখছি। তার পরেই আমি। হঠাৎ কে যেন আমার মাথায় একটা রাম গাঁট্টা মারল। আমি ধরে নিলাম এ নিশ্চয়ই শিবুর কাজ। আর কারুর সঙ্গে তো আমার ইয়ার্কির সম্পর্ক নয়।
-আমি শুনলাম সত্যর গলা। আঃ শিবু।এই রকম ইয়ার্কি কেউ করে! আমি ভাবলাম ঘুমের ঘোরে বলছে হয়তো । উঠে বসে দেখার শক্তি নেই। এর পরই আমি। একটা কাগজ নিয়ে আমার নাক মুখ একসঙ্গে কেউ চেপে ধলল। ধীরে ধীরে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি প্রাণপণে চিৎকার করছি-সত্য ছেড়ে দে আমি মারা যাব। চেষ্টা করছি কিন্ত গলা দিয়ে আওয়াজ বেরচ্ছে না। বোধ হয় আর এক মুহুর্ত দেরি হলে আমি মারা যেতাম এমন সময় ছেড়ে দিল। আমি ধরমর করে উঠে বসলাম।
– আর উঠে বসেই আমার ওপর চোট পাট। অথচ আমার তখনও গাঁট্টায় মাথা জ্বলছে। হাসতে হাসতে সত্য চৌধুরী বললেন।
সবাই তখন উঠে বসে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করলেন। দরজা খুলে গ্যাসবাতিটা ঘরে আনা হল। মোহন্ত মহারাজ বললেন কেউ তাঁর কান মলে দিয়েছে। এ কাজ কার? সকলেই মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। ভট্টাচার্য্য মশাই বললেন কেউ হঠাৎ মাথার বালিশটা টেনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আমার মাথাটা ঠক করে মাটিতে পড়েছে। দেখা গেল বালিশটা ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে পড়ে আছে। সকলে সেই ঠক করে মাটিতে মাথা ঠোকার শব্দটা মনে করতে পারলেন। শিকদার বাবুর চাদর পায়ের দিকের দেওয়াল ঘেঁষে পড়ে আছে। সরকার বাবু কাতুকুতু দেওয়ার কথা বললেন।সকলে এ বিষয়ে একমত এই কাজ মোহন্ত মহারাজ বা ভট্টাচার্য্য মশাই কখনই করেননি। শিকদারর বাবু বা সরকার বাবুও মোহন্ত মহারাজের কান মলে দিয়ে মজা করার সাহস দেখাবেন না। সকলের সন্দেহ গিয়ে পড়ল সত্য এবং আমার ওপর। আমদের দুজনের বয়স কম, এই অসভ্যতা আমাদের পক্ষেই করা সম্ভব। সত্য তখন ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। শিবু এ নির্ঘাত তোর কাজ। এই দুষ্টু বুদ্ধি আর কারও হবে না। আমি তখন চক্রব্যুহে একা অভিমন্যু। আমি মরিয়া হয়ে চিৎকার করে উঠি ,আমি তো আরেকটু হলে মারা যাচ্ছিলাম। আমি খবরের কাগজে মুড়ে একটা চাদর এনেছিলাম। চাদর গায়ে দেবার সময়ে কাগজটা পাশে ফেলা ছিল। ঐ দেখুন দোমড়ান কাগজটা পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঐটা দিয়ে আমার নাক মুখ চেপে ধরা হয়েছিল। এ নিশ্চয়ই তোর কাজ সত্য। সত্যি কথা বল।
সত্য চৌধুরী হাসতে হাসতে বলেন, আমি তখনও গাঁট্টা খেয়ে মাথায় হাত বোলাচ্ছি।
সকলেই এবার মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। তাহলে এ কার কাজ? কারোর মুখেই মিথ্যে কথা বলার চিহ্ন নেই। মোহন্ত মহারাজ তখন গম্ভীর মুখে বললেন সকলেই বলছেন তিনি করেননি। কিন্তু কেউ তো করেছেন। সকলকে বাবা তারকনাথের নামে শপথ করে বলতে হবে যে সে নিজে নির্দোষ। মোহন্ত মহারাজের বিশ্বাস শিবরাত্রির পুজো দিয়ে বাবার থানে বসে কেউ মিথ্যে কথা বলতে পারবে না। সুতরাং ধরা পড়বেই একজন। প্রস্তাবে সকলেই রাজী হয়ে গেলেন। মোহন্ত মহারাজ নিজেই শুরু করলেন, আমি বাবা তারকনাথের নামে শপথ নিয়ে বলছি যে আজ রাতে এখানে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে আমি কোনওভাবেই যুক্ত নই এবং আমি কাঊকে শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করিনি। এবার ভট্টাচার্য্য মশাই বলুন। ভট্টাচার্য্য মশাই বললেন। তারপর একে একে সকলেই বললেন। সত্য এবং আমার বলার পর মোহন্ত মহারাজের ভুরু কুঁচকে উঠল। সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ, তাহলে এ কাজ কে করল?
সকলেই যখন সকলের মুখের দিকে তাকাচ্ছে তখন হঠাৎই আমাদের মনে পড়ল মন্দিরের ঐ কর্মচারীর কথা। মনে পড়ল শিবরাত্রির রাতে ঘুমোতে নেই, বাবার থানে তো নয়ই। তবে কি ………???
আমি আর সত্য ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলাম মন্দির চুত্বরে আলো এবং অনেক মানুষ। একটা যাত্রা পালা চলছে। মানুষজন সেখানে বসে রাতজাগাটা সেরে নিচ্ছে। একটু ডাকাডাকি করতেই অতিথিনিবাসের সেই কর্মীটি এল। আমরা উত্তেজনায় গড়গড় করে যার যা হয়েছিল বললাম, দরজা জানলা সব ভেতর থেকে বন্ধ ছিল তাও বললাম। সব শুনে লোকটি একটুও অবাক হলনা। বলল, বাবুরা আপনাদের বলেছিলাম না শিবরাত্রির রাতে বাবা তারকনাথের থানে ঘুমোতে নেই। আপনারা শুনলেন না। আজ বাবার চ্যালা-চামুণ্ডারা বেরোয় তো।
আমরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, চেলা চামুন্ডা মানে?
-মানে ভূত,প্রেত, নন্দী, ভৃঙ্গী। তারাই তো বাবার সঙ্গী সাথী। তবে আজ পর্যন্ত ক্ষতি কারও করেনি। আপনারা বাকি রাতটা আর ঘুমোবেন না। আমরা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।শুধু সে রাত কেন, তারপর অনেক রাত আমরা ঠিকঠাক ঘুমোইনি।
-দাদু একটা কথা বলত, মহাদেবের সঙ্গী সাথিরা ভূত প্রেত কেন?
-এতো বড় কঠিন প্রশ্ন। এ সমস্ত তোমাদের কলেজে পড়ার কথা।তবু যেটুকু জানি বলি। তবে বেশি প্রশ্ন করলে জবাব দিতে পারবনা আগে থেকে বলে দিচ্ছি।
-ঠিক আছে,ঠিক আছে তাই বল।
শিবের বাহ্যরূপ বিচার করলে অনার্য ভাবেরই পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা দক্ষযজ্ঞের কাহিনী থেকে জানি বৈদিক দেবতাদের কাছে শিব ছিলেন ব্রাত্য। কিন্তু আর্য-অনার্য সংস্কৃতি মিলনের ফলে শিব ধীরে ধীরে সংস্কৃত হয়েছেন। আর্যদের যাগযজ্ঞ, ও বৈদিক দেবদেবী দেশের সাধারণ মানুষ গ্রহণ করলেন না। ধীরে ধীরে পৌরাণিক দেবদেবীরা পূজিত হতে লাগলেন।শিব ছিলেন গণদেবতা। তিনি বাঘছাল, গলায় সাপ, ষাঁড় তার বাহন, ভূতপ্রেত নিয়ে শ্মশানে-মশানে চিতাভস্ম মেখে সিদ্ধি খেয়ে ঘোরাফেরা করেন। সেই শিব আর্য ছোঁয়ায় শিব ধীরে ধীরে সত্যম-শিবম-সুন্দরম হয়ে উঠেছেন। তাঁরা দেখেছিলেন যে এঁর পুজোয় নারী-পুরুষ, ব্রাহ্মণ-চন্ডাল, পন্ডিত মূর্খ সকলেরই সমান অধিকার।ভক্তি ছাড়া এঁর পুজোয় আর কোনও উপাচারই লাগেনা। একটা বেলপাতা আর জল দিলেই আশুতোষ সন্তুষ্ট।এই গণদেবতাকে আর্য ঋষিরা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলেন। নানারকম দার্শনিক, রুপক ব্যাখ্যা দিয়ে শিবকে মহিমাণ্বিত করে তুললেন যে শিব সকলের কাছে গ্রহণীয় বরণীয় হয়ে উঠল।
কিন্তু শিবের এই সংস্কার বাংলায় ততটা হয়নি। কারণ আর্যদের বিজয় রথ পূর্বভারতে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল।আদিগুরু শঙ্করাচার্য হিন্দুধর্মকে একটা বাঁধনে আনবার জন্যে যে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ স্থাপন করেন তার একটিও বাংলায় নয়। এই সব কারণে সম্ভবত শিব এদেশে শ্মশানবাসীর ইমেজ সম্পূর্ন ত্যাগ করতে পারেননি। এখানে বহু অন্ত্যজ মানুষ একমাস সন্যাস পালন করে গাজন উৎসব পালন করেন। এই গাজনের শিব ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এর মহেশ্বর থেকে অনেক আলাদা। তাই বাংলায় গাজনের শিবের সঙ্গীসাথী নন্দীভৃঙ্গী রাও থেকে গেছেন। তাঁরা বিশেষ বিশেষ দিনে সক্রিয় হয়ে ওঠে বলে ভক্তদের বিশ্বাস।
এবার সভা ভাঙার পালা। সবাই উঠে গেল। একটা চমৎকার দিন কাটিয়ে সত্য চৌধুরী এবার উঠবেন। জ্ঞাতি দের মধ্যে নিজের অংশ বিলি ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। কাল ফিরে যাবেন বিলাসপুর, আর কোনদিনই এই শহরে আসা হবেনা। চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে সত্য চৌধুরী বললেন, আচ্ছা শিবু, সেদিনতো আমরা অবিশ্বাস করার মত কিছু পাইনি। কিন্তু আজ এই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, নতুন শতাব্দীতে পৌঁছে তোর কি বিশ্বাস হয় ভূত প্রেত নন্দী ভৃঙ্গী এসব আছে?
শিবদাস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, আমার নাম শিবদাস। আমি তো শিবভক্ত।আমার মামার বাড়ি কাটোয়ার কাছে শিঙ্গিতে। সেখানকার বূড়োশিবের ভক্ত ছিল আমার মা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মা বুড়োশিবের পুজো পাঠাত। রাজ এস্টেটে কাজে যোগ দিয়ে আমি বর্ধমানের একশ আট শিবমন্দির মেরামত করে কর্ম জীবন শুরু করেছিলাম। শিবঠাকুরে আমার ভক্তি আছে। তাই আমি প্রশ্ন করিনা। মনে প্রশ্ন এলে তাকে চাপা দিয়ে আমি ভাবি আশ্চর্য্য সেই রাতে আমরা বাবার মনে স্থান পেয়েছিলাম। আমাদের বেচাল দেখে স্বয়ং বাবা মহাদেব তাঁর সঙ্গীদের পাঠিয়েছিলেন আমাদের শিক্ষা দিতে। এর চেয়ে বড় পাওনা আর কী হতে পারে জীবনে? প্রশ্ন করলে, অবিশ্বাস করলে, আমার এই পরম প্রাপ্তিটাই হারিয়ে যায় তাই আমি কোন প্রশ্ন করিনা।
দুই বৃদ্ধ কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকেন। এক সময়ে ঝিলমিল এসে বলে দাদু রিক্সা এসে গেছে। সত্য চৌধুরী সকলের কাছে বিদায় নিয়ে ধীরে ধীরে গিয়ে রিক্সায় ওঠেন।
Tags: ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই রাত
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।