(১)
ফোনটা পেয়ে একটু থমকে রইলেন অবিনাশবাবু। কি লিখবেন? ভেবে পেলেন না। সাধারন দু একটা ভাবনা যা মাথায় এল সব মামুলি পর্যায়ের। অথচ এতবড় পত্রিকার এত নামজাদা সম্পাদকের রিকোয়েস্ট। তার ওপর পত্রিকাটিও বেশ বড়। আজকাল পুরো পত্রিকা খুটিয়ে না পড়লেও কেনার অভ্যেস অনেকের আছে। ফলত না কিনে অনেকেই থাকতে পারেনা। তার ওপর স্ট্যাটাসের একটা ব্যাপার আছে আজকালকার মানুষের। ফলে কিছু পত্রিকার নামের জোরে বিক্রি বাড়ে গোছের ব্যাপার। সেইরকম পত্রিকাই হল ‘খোঁজখবর’। তাছাড়া পত্রিকার নামেরও একটা ব্যাপার আছে। অবিনাশবাবু নিজের নামের ব্যাপারও জড়িত। অনেকগুলো দিন কাটালেন ভাবনার রসে জ্বাল দিয়ে।
আসলে তিনি গড়পড়তা বাঙালি। খবরের কাগজে সাব-এডিটরের পোস্টে চাকরি করতে করতে পাতা ভরানোর জন্য এটা-ওটা নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে লিখতে মাঝে কিছু গল্পও লিখে ফেলেছিলেন কয়েকখানা। আর তা থেকেই এখন একজন ‘রেগুলার লেখক’। তবে সমাজতত্ত্ব রাজনীতি নিয়ে তিনি বেশি লেখালিখি করে থাকেন। গত কয়েকটা পুজো সংখ্যাতে দুই একটা প্রেমের গল্প জমে যাওয়ায় লেখক অবিনাশ দত্ত এখন একজন পারফেক্ট পাঠক প্রেমিক রাইটার। নিয়মিত ফোন ও আসে বেশ কিছু। দুটি বই প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে নামজাদা প্রকাশন সংস্থা থেকে। এমতাবস্থায় ‘খোঁজখবর’ কাগজের বিখ্যাত সম্পাদক দীপ্তোষ বাবু ফোনে আগামী ভৌতিক সংখ্যার লেখাটার জন্য তাগাদা দিয়ে চলেছেন।
কিন্তু তার পক্ষে কী এধরনের গল্প লেখা সম্ভব? সত্যি বলতে কি ভূত তিনি দেখেননি। তিনি নিজে ভূতের গল্পের ব্যাপারে যতটা বিশ্বাসী ভূতের অস্তিত্বের ব্যাপারে ততটাই অবিশ্বাসী মানুষ। গড়পড়তা মানুষ যেমন হয় আর কি। রাতে ভৌতিক গল্প শোনার জন্য জমিয়ে বসেন আর পরদিন সকাল হলেই দূর সব ফালতু বলে লেগে পড়েন অন্য কাজে। এককালে বিজ্ঞান ক্লাব করেছেন চুটিয়ে, আর ভূত বিরোধী বক্তৃতাও দিয়েছেন গলা ফাটিয়ে। আর আই অবিনাশ বাবুই বিয়ের পর বউয়ের সাথে বর্ষার দিনে রোববার রাতে সানডে সাসপেন্স শুনেছেন শিরদাঁড়া সোজা করে। কিন্তু কখনই ও ব্যাপারটিকে লেখার সাবজেক্ট করবেন এমনটা ভাবেননি। এবার সরাসরি ঘাড়ে এসে পড়ায় ধরতেও পারছেন না। দুই একদিন কাটল এমন। দুএকটা ভৌতিক গল্পের বইও উল্টেপাল্টে দেখলেন, প্লট নেই মাথায়। ফাঁকা মাথা। একবার ভাবলেন ফোন করে না করে দেবেন এই বলে যে ওসব ফালতু বিষয় নিয়ে লেখার সময় আমার নেই। কিন্তু পড়ে নিজের সুনামের কথা ভেবে পিছিয়ে গিয়ে নিজের চিন্তার জগতে ডুব দিলেন।
নিজের শোনা কিংবা চেনা-অচেনা নানা মানুষের মুখে শোনা নানান ভৌতিক অভিজ্ঞতা ঘেঁটে জুৎসই ঘটনা খুঁজতে লাগলেন। কিছুতেই মনে মনে ভেবে পেলেন না, যে কখনও ভূত চোখেই দেখেনি বা নিদেন পক্ষে একটা প্ল্যানচেটের আসরে যায়নি সে কিভাবে ভূত নিয়ে লিখবে? ভাবতে ভাবতে শেষে যা থাকে কপালে ভেবে বন্ধু অনাদির কাছে শোনা পবিত্রবাবু নামে এক বই পাঠকের হারিয়ে যাওয়ার কাহিনীটা ভৌতিক রূপে দেবেন ভেবে আনাড়ি হাতে গল্প শুরু করলেন লিখতে। কম্পিউটারের স্ক্রিনে টপাটপ টাইপ ফুটে উঠতে লাগল।
(২)
ভূত আর ভয় এই দুটো এক না হলে ভূতের গল্প কখনও জমে না। অবিনাশবাবু জানতেন। তাই গল্পের প্রথমেই অনাদির লাভপুরের বাড়ির আধা ভৌতিক আবহাওয়া আর সুপ্রাচীন লাইব্রেরিটির ভিতরের অলৌকিক পরিবেশ নির্মানের জন্য রহস্যঘন অপর জগতের পরিস্থিতি বেশ কিছুটা ফুটিয়ে তোলার জন্য কিছু বাক্যব্যয় করলেন। নিজের কানে শোনা ঘটনাটি অপরের পছন্দের উপযোগী করতে করতে স্বাভাবিক নিয়মেই চোখ জড়িয়ে এল। একটু গড়িয়ে নিয়ে লিখবেন ভেবে পাশে গড়িয়ে দিলেন শরীরটা, দুটো চোখ এরপর শুধু এক হল না, হল একশো। ঘুমের মধ্যে তিনি যেন টাইপ করে চললেন দুহাতের দুরন্ত গতিতে। ঘুম ভাঙল ভোরের দিকে। রাতের ওষুধ খেতেও ভুলেছেন। ঘুম জড়ানো চোখেই কম্পিউটার বন্ধ করে ফের শরীরটাকে গড়িয়ে দিলেন বিছানায়।
(৩)
দ্বিতীয় বার ঘুম ভাঙল যখন, তখন বেলা বেশ গড়িয়েছে। দৈনন্দিন কাজকর্ম শেষে ভাবলেন গত রাতের লেখাটা নিয়ে বসি একবার। লেখা খুলে বেশ অবাক হলেন অবিনাশবাবু। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন স্ক্রিনের দিকে। শেষ অংশটা দেখে তার খটকা লাগল। এখানেই কি তিনি শেষ করেছিলেন, কি জানি গুলিয়ে যাচ্ছে তার মাথা। খটকাও বাড়ছে। এতটা তো তিনি লিখেছেন বলে মনে পড়ছেন না। তিনি মোটামুটি অনাদিবাবুর বাড়ির লাইব্রেরির সেই মজার পাঠক মানুষ পবিত্রবাবুর বই পড়িয়ে বেড়াবার বর্ণনা অবধি লিখেছেন। কিন্তু এখানে তো সেই বর্ণনার শেষের অংশ যোগ করা হয়েছে। সেই পাঠক নিজেই লিখেছেন। দিনটা ছিল আষাঢ়ের অমাবস্যা। আমরা ঠিক করে ছিলাম বই-এর পাঠকরা ভৌতিক গল্প পাঠের আসর করব। সবাই নিজের পড়া ভাল ভাল গল্প পাঠ করবে। লোডশেডিং হয়ে যাওয়ায় মোমবাতি জ্বালিয়ে গল্পপাঠ শুরু হল। – এতসব কাহিনী অবিনাশ মনে মনে ভেবেছিলাম। লেখেননি তো? কি জানি ঘুম চোখে লিখে ফেলেন নি তো? যাই হোক সমস্যা তো কিছু নেই। উনি লিখতেই তো চেয়েছিলেন। আজ বাকিটা নামাবেন বলে ওখানেই সেভ করলেন।
অবিনাশবাবু বিকালে লিখতে বসে চমকে গেলেন বললে ভুল হবে বেশ কিছুটা থতমত খেয়ে থমকে গেলেন। এই লেখার পরেও আবার আরেকটা লেখা রয়েছে গল্পের নায়ক – পাঠক পবিত্রবাবু বয়ানে। আজব ব্যাপার। তিনি ছাড়া তো আর কেউ কম্পিউটার খোলেন না। তবে কে লিখছে রোজ রোজ? প্রতিদিনই গল্পের বাকী অংশগুলো বাড়ছে। অথচ বাদ দেওয়ার মত কোনও অংশই থাকছে না।
রাতে লিখতে বসে একটু ভয় পেতে লাগলেন অবিবাশবাবু। আর কি কেউ আছেন নাকি ঘরে। ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। ভূতের ভয়ও তাকে বহু বার এভাবে চেপে ধরেছে। গল্প শুনে ছোটবেলায় দিদি আর বড়বেলায় বৌকে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়েছেন ছোটো বাইরে সারতে। এটা অবিনাশবাবুর ক্ষেত্রে খুব কমন ব্যাপার। আর পরদিনই ধুস বাজে ব্যাপার বলে বিজ্ঞান ক্লাবের কাউকে ফোন করে আগামী কর্মসূচী গুলি আউড়ে নিয়ে নিজেকে ফ্রেস করেছেন। আজ কিন্তু ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে গেলেন। একবার ভাবলেন পিছনের হাঁ করা খোলা দরজাটা বন্ধ করে দেবেন। তারপর ভাবলেন না, তাহলে ঘরে তিনি একা হয়ে পড়বেন। সেটাতে আরো বিপদের সম্ভবনা তৈরি হতে পারে। একবার মনে হল তিনি একজন সাহসী লোক। এইসব ছুটকো ঘটনা আমল দেবেনই বা কেন? পরক্ষণে স্ক্রিনের দিকে তাকাতে চোখ ছানাবড়া। একি আরো দুই লাইন বেড়ে গেল। এ কি করে সম্ভব। একপ্রকার কাঁপতে কাঁপতে ইলেকট্রিক বোর্ডের মেইন সুইচ অফ করে বিছানায় গিয়ে টানটান হলেন। পাশে স্ত্রীর নাক ডাকার শব্দ। ফাঁকা ঘরের ভয়কে দ্বিগুন করল। এভাবে কখন ভয় পেতে পেতে চোখ ঘুমে জড়িয়ে গেল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। পরদিন ভোরে যখন ঘুম ভাঙল তিনি আরও কিছুটা সাহস আর আগ্রহ নিয়ে কম্পিউটার খুলে যা দেখল তাতে তার গলা শুকিয়ে গেল। আরও নতুন কয়েক পাতা টাইপ হয়ে গেছে। নতুন টাইপে গল্পটা যা দাড়িয়েছে তার সারমর্ম মোটামুটি এই – সেই গল্প বলার আসরে পবিত্র বাবু একটি দুষ্প্রাপ্য বই থেকে পাঠ করছিলেন – ‘পরাজগতের অপার বিস্ময়’। সেই পাঠের সময় তীব্র জোরে বাজ পড়ল লাইব্রেরির পাশের নারকেল গাছে। তারপর আর কিছু নেই। এই ঘটনাটি সম্পূর্ণ অজানা অবিনাশবাবুর কাছে। অনাদিবাবু পবিত্রবাবুর গল্প বলার সময় এইসব ঘটনা কিছু বলেননি। অনাদিবাবুর বয়ান অনুযায়ী পবিত্রবাবুকে পরবর্তীকালে পাওয়া যায়নি। লাইব্রেরিও বেশ কয়েকবছর স্বাভাবিক নিয়মে চলছে তারপর ফ্ল্যাট হয়ে যায়। গল্প আসরে এই খবর তো অনাদিবাবুর বয়ানে ছিল না।
অবিনাশবাবু যেন আস্তে আস্তে রহস্যের মধ্যে ঢুকে পড়ছেন। তার এই লেখা কে লিখছে। এর বিহিত করতেই হবে। তিনি ফোন লাগালেন অনাদিকে। সামান্য আলোচনার পরই অনাদিবাবুকে লাইব্রেরির কথা তোলায়, আর পবিত্রবাবুর বিষয় জানতে চাওয়ায় উনি বললেন, বলেছিলাম না ওটা তো ফ্ল্যাট হয়ে গেছে। বহু বছর আগের ঘটনা সবাই ভুলেও গেছে। তবে হ্যাঁ পবিত্রবাবুর কথা এখনও মাঝে মাঝে হয়, ভাবলে অবাক লাগে ভদ্রলোকের কথা। এরপরই প্রশ্ন করলেন হঠাৎ এতদিন পর তুই ওর খোঁজ করছিস কেন? অবিনাশবাবু বললেন, ভাবলাম ওকে নিয়ে একটু লিখি। এমন রসিক পাঠকও আর পাওয়া যায় না, যে কিনা ঘুরে ঘুরে বই পড়াত। অনাদি বাবু বললেন হ্যাঁ, একথা ঠিক। পবিত্রবাবুর মন ছিল অন্য সত্বায় বাঁধা। অর্থ নয়,লেখাই ছিল আরাধ্য বিষয়। সারাদিনই নানা জায়গা ঘুরে বই জোগাড় করতেন। আর পছন্দসই মানুষদের পেলেই বই পড়াতেন। দুস্প্রাপ্য বই সব। নানারকম প্লট, নানা বিচিত্রকাহিনীর সংগ্রহে ছিলেন এক চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া। ভালো কিছু পড়লে নানা মানুষদের খুঁজে খুঁজে পড়িয়ে দিতেন। নানা লাইব্রেরি ঘেঁটে ঘেঁটে বই পড়তেন, ভালো লাগলে জেরক্স করতেন। ছোট বড় সব লাইব্রেরিতেই তার যাতায়াত ছিল। সেখানকার খাঁটি পাঠককেও তিনি নিখুঁত ভাবে চিনতেন। তারাও তার কথা মানত দেবতাজ্ঞানে। এতবড় পড়ুয়া মানুষটা যে এভাবে হটাৎ হারিয়ে যাবেন একদিন কেউ কখনও ভাবতে পারেনি। লেখালেখিতে ঝোঁক থাকলেও তিনি লিখতেন কম। হঠাৎ করে অনাদিবাবুর লাইব্রেরিতে আসা বন্ধ হল। পবিত্রবাবুদের তিনকুলে কেউ ছিলও না আর ব্যাচেলর এই মানুষটার থাকার কোন ঠিকানাও ছিল না। কলকাতার দিকে একটা মেসের কথা বললেও তিনি নানা মফস্বলের লাইব্রেরির নানা মানুষদের সাথে এমনভাবে মিশতেন যে তাদের বাড়িতেও থেকে যেতেন কখনও কখনও। ফলে সবাই ভেবেছিল কোথাও হয়ত গেছেন। চলে আসবেন কদিন বাদে। অথবা পারিবারিক জমানো পুঁজির ইন্টারেস্টের টাকায় লোকটা মাঝে মাঝেই চলে যেতেন পাহাড়ে বা জঙ্গলে। সেরকম কোথাও চলে গিয়েছেন হয়ত। কিন্তু দিন গড়ালো মাসে, মাস গড়ালো বছরে। লোকের মন থেকে পবিত্রবাবু ফিকে হলেন ধীরে ধীরে। সবাই ভাবল পবিত্রবাবু পৃথিবীর হিসাব চুকিয়েছেন কোনওভাবে। অনাদিবাবু একটু থেমে বললেন তবে আর একটা ঘটনা নিয়ে পবিত্রবাবু হারিয়ে যাওয়ার বিষয় আরও রহস্যাবৃত। একবার সন্ধ্যের দিকে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন লাইব্রেরিতে, পবিত্রবাবুর বন্ধু পরিচয় দিয়ে। দুখানা বইও ফেরত দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের। বই দুটির একটি আমাদের লাইব্রেরির। অন্যটি অন্য লাইব্রেরির। পবিত্রবাবু নাকি দিয়ে গিয়েছিলেন ওনাকে ফেরত দিতে। অন্তত উনি তাই বলেছিলেন। এই ঘটনাটা পবিত্রবাবু নিখোঁজ হওয়ার ছমাসের মধ্যে ঘটনা। সেদিনও সন্ধ্যেতে লোডশেডিং ছিল। বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি। মোমবাতি জ্বলছিল কাউন্টারে। মুখটা স্পষ্ট দেখা যায়নি। আমাদের লাইব্রেরির বাইরের অন্য বইটার নামটাও মনে আছে – ‘পরাজগতের অপার বিস্ময়’। আমরা পরে ফেরত করিয়েছিলাম। হাবড়া শ্রী চৈতন্য মঠের বই ছিল। উনি মিনিট পাঁচেক ছিলেন। শুধু পবিত্রবাবুর কথা বলায় ঘড়ঘড়ে গলায় বলেছিলেন মধ্যমগ্রামের দিকে কোনও লাইব্রেরি থেকে বেরোনোর সময় ঝড়বৃষ্টিতে রাস্তায় জমা জলে দাঁড়িয়েছিলেন। এমন সময় বাজ পড়ে রাস্তার পাশের নারকেল গাছটায় আর তাতেই বোধ হয় পবিত্রবাবু …। এটা নাকি উনি লোকমুখে শুনেছেন বলে জানিয়ে বলেছিলেন – ঘটনার কদিন আগেই আমাকে বই দুটি দিয়ে বলে গেল শরীরটা খারাপ। একটু ফেরত দিও। এই কথা বলে বেরিয়ে গেল আগন্তুক। উনি বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় সাথে সাথেই লাইব্রেরিতে ঢুকেছিল দুই যুবক কর্মী সনাতন আর সদানন্দ। দুজনেই বৃষ্টি বাদল আর অন্ধকার দেখে লাইব্রেরির বাগানের উল্টোদিকে বাড়ির গ্যারেজের নীচে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। আগন্তুক এবং তার বিবরণ শুনে তারা হতবাক। কাউকে লাইব্রেরিতে ঢুকতে বা বেরোতে নাকি তারা দেখেননি। আগন্তুকের বর্ণনা শুনে তারা এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। সত্যি সত্যি ওরা নাকি কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেনি। হঠাৎ জোরে আলোর ঝলকানি দিয়ে প্রবল শব্দে বাজ পড়ায় ভয় পেয়ে লাইব্রেরির ঘরে তারা ঢোকে। তাহলে সেদিনের পবিত্রবাবুর বন্ধু পরিচয় দেওয়া আগন্তুকটি সত্যি সত্যি কে? তিনি ঐ বই দুটি ফেরৎ দিয়েছিলেন এটা তো সত্যি। তাহলে মিথ্যে কোনটা? সেটাই তো প্রশ্ন? – থামলেন অনাদিবাবু। বইয়ের নাম আর ঘটনার বিবরণ শুনতে শুনতে ভেতরে ভেতরে ঘামছিলেন লেখক অবিনাশ। শেষে কোনমতে বললেন– ভদ্রলোকের কোন সন্ধান পেলে বলিস তো?
‘ও কে’ – বলে ফোন কাটলেন অবিনাশবাবু।
(৪)
গল্প লেখকের রহস্য সন্ধানে আবার নিজেই নামলেন লেখক। তবে অবশ্যই দিনের বেলায়, অনাদিবাবুর বলা অনেক ঘটনাই এখন তার সম্পদ হয়ে আছে। প্রথমে কম্পিউটার খুলে সব কিছু চেক করলেন। কোন গোলমাল পেলেন না। ইন্টারনেট কানেকশন সব ঠিকঠাক রয়েছে। তিনি লেখেন ইউনিকোড বাংলায় তাতেই তো টাইপ হয়ে যাচ্ছে বার বার। এবার তার মনে হল তাহলে কি পবিত্রবাবুর আত্মা! ভাবতেই ভর দুপুরে অবিনাশবাবুর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। আর দাড়াঁতে পারলেন না কম্পিউটারের সামনে।
বিকালে ব্যাঙ্কের কাজ করে বাড়ি ফিরতেই স্ত্রী সুনেত্রা বলল – জানো এখন নাকি নানা ভয়ের অ্যাপ এসেছে। মেজদি ফোন করেছিল। দুএকটা ওকে দেখিয়েছে ওর মেয়ে মুন্নি। নানা অবাস্তব ঘটনা সরাসরি দেখাচ্ছে নাকি সেখানে। আমি তো লোভে পরে ডাউনলোড করে একটা দেখেই ভয়ে সেই থেকে উঠতে পারছি না। তুমি আসায় বাঁচলাম। এক ঘরে দেখা যায় না। কি মারাত্মক। রেল লাইন ধরে সাদা ধোঁয়ার মতন এসে সোজা গাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। ব্যস তারপরই গাড়িটার অ্যাক্সিডেন্ট। কি জানি কি ভাবে এরা তোলে কে জানে? তুমি তো বোধহয় এইসব নিয়েই লিখবে ভাবছো? একবার দেখোনা অ্যাপটা খুলে। আগের কোন ঘটনাই স্ত্রীকে বলেননি। কিন্তু জ্যান্ত ভূতের গল্প শুনে তিনি প্রায় গুটিয়েই বসে রইলেন। স্ত্রীর উদ্যোগেই আবার সবল হয়ে বাথরুম থেকে ফিরে কম্পিউটার খুললেন। হঠাৎ মনে হল নেটটা চালিয়ে একবার দেখলেই হয়। ফেসবুকটা আপডেট করা হয়নি। এই সব ফালতু চক্করে ফেসবুক দেখেও ওঠা হয় নি অনেকদিন। এটা ওটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে তার একটি সাইটের লিংক-এ চোখ আটকে গেল- ‘বন্ধুভূত কম’। ভূত পিছন ছাড়ছে না, সামনে এগোলেও পিছন টানছে যেন। অবিনাশবাবু ক্লিক করলেন সেই সাইটে, খুলে গেল সাইট। নানা মজাদার ভৌতিক রহস্য উদ্ঘাটনের ভিডিও যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে দেশ বিদেশের নানা ভৌতিক – আধা ভৌতিক ও অতি ভৌতিক তথ্য। স্ক্রল করতে করতে একটা লিঙ্ক দেখতে শিউরে উঠলেন তিনি। সাইটির নাম ‘ আউট সাইট ওয়ার্ল্ডস স্পিরিট ডট কম’। অবিনাশ বাবু ঢুকে পড়লেন সেই সাইটে। বিচিত্র সব দৃশ্য – চলমান ধোঁয়ার স্রোতের মধ্যে ছুটে চলেছে নানা অবাস্তব অবিশ্বাসী জন্তুর দল, পাখির মত ডানা তাদের। তারা মিলিয়ে যাচ্ছে ধোঁয়ার স্রোতে। আবার বেড়িয়েও আসছে। তাদের চিনতে পারলেন না অবিনাশবাবু। নেশা তাকে পেয়ে বসেছে। শেষ দেখে উঠবেন। হঠাৎ এদের মধ্যেই যেন উড়ন্ত এক মানব শিশুর মতন চেহারাওয়ালা প্রানী নজরে এল। ক্লোজ করতেই মুখ যা ভেসে এল তা মানুষের আর পাখির মিলিত রূপ বলাই ভাল। সে স্ক্রীনেই প্রশ্ন করল – এই জগতে কেন? এখানে তো কেবল মৃতেরা আসতে পারে, তুমি কি করে? পরিষ্কার বাংলা, তবে যান্ত্রিক কন্ঠস্বরের আওয়াজ। অবিনাশ বাবু বললেন, আমি হঠাৎ কানেক্ট করে ফেলেছি। সে বলল – বাহ। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা নয়। জীবিত পৃথিবীর সাথে এখানে তো কোন কানেকশন নেই। তোমার কম্পিউটারের মাধ্যমে যে আছে সেই সেট করেছে। সে আবার কি? – ঘাবড়ে গেলেন অবিনাশ বাবু। হ্যাঁ – সেই ফোকলা দাঁতে হাসল সেই উড়ন্ত পাখি মানুষ। তারপর সে বলল, তোমার আসলে লিঙ্কিং হয়ে গেছে অন্য এক জগতে লিঙ্কের মধ্যে। হঠাৎ অবিনাশবাবুর মনে হল, পুরো কথা গুলো প্রোগ্রামিং করা আছে। রেকর্ড বাজছে। লোকটি বলল- না না রেকর্ড নয়, তোমার কম্পিউটার থেকে তোমার ফেসবুক হয়ে তোমার লিঙ্ক এই সাইটে ঢুকেছে। তুমি লেখক জানি। এখানকার সাইটে অর্থাৎ আমাদের এই জগৎে নানা স্পিরিট ঘুরছে। তোমার কম্পিউটারে সেসব দেখতে পাবেনা। তুমি এখন পৃথিবীর বাইরের আউট সাইট স্পিরিট ডট কমের সাথে আছ। তোমার পুরোটা আমি দেখতে পাচ্ছি। তোমার ভূত ভবিষ্যৎ সব আমাদের কাছে স্পষ্ট। বল কি জানতে চাও? আমাদের সাধ্যের মধ্যে থাকলে উত্তর দেব। অবিনাশবাবু নির্দ্বিধায় বললেন কম্পিউটারে আমার লেখা কে লিখে দিচ্ছে ? লোকটাও স্পষ্ট উত্তর দিল – “যে তোমাকে আমাদের সাথে লিঙ্ক করালো”।
‘সে কে?’
‘সে তোমার বন্ধু’
‘কোথায় সে?’
‘তাকে তো দেখতে পাবেনা, কিন্তু সে নিয়মিত লিখতে চাইছে।সে তোমার বন্ধু’
সে কি কোন অ্যাপ সাইট?
‘না সে তোমার বন্ধু। অনেক অনেক দূরের পৃথিবী থেকে সে তোমাকে সাহায্য করছে। তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ না। তবে জানতে পারছ।’
অবিনাশবাবু বললেন, সে কি এভাবেই আমার লেখা লিখে যাবে?’
‘না সে তার কিছু কথা বলেই চলে যাবে।
‘আমরাও চলে যাব, অন্য গ্যালাক্সিতে।’
‘তোমারা কারা?’
আমরাই আউট সাইট ওয়ার্ল্ড স্পিরিট। এ পৃথিবী চেনা জগতের বাইরের সত্তা।
মাথা গুলিয়ে গেল অবিনাশবাবুর। তিনি যেন ঝিমিয়ে পড়েছেন। মাথার মধ্যে কষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ স্ত্রীর ধাক্কায় চোখ মেলে দেখেন কম্পিউটার কিবোর্ডে মাথা রেখে পড়ে আছেন। স্ত্রী বলল কী হল? ঘুমিয়ে পড়লে? দেখ কম্পিউটার খোলা। কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে এক সেকেন্ডে ঘুম ছুটে গেল। ফেসবুকের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অংশ খোলা। সবথেকে উপরের জ্বলজ্বল করছে একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। প্রেরক পবিত্র বিশ্বাস। ছবি নেই। প্রোফাইলে ক্লিক করলেন। সন্দেই সত্যি হল। নানা অংশের ছবি-ছাবার পর একটি পোস্ট ‘সরি হি ইজ নো মোর’। কে চালাচ্ছে তার প্রোফাইল। মিউচুয়াল ফ্রেন্ডস দেখলেন। ঠিক, দুটি সাইট ‘বন্ধুভূত ডটকম’ আর ‘আউট সাইট ওয়ার্ল্ড স্পিরিট ডট কম’। ঘামে জামা ভিজে গেল। একই সাথে ফোনটা বেজে উঠল। সম্পাদক দীপ্তোষ বাবুর ভারী কন্ঠ ভেসে এল – স্যার এই মাত্র আপনার লেখাটা পেলাম। পড়েও ফেললাম। অসাধারন হয়েছে স্যার। এমন আষাঢ়ে গল্পই তো চেয়েছিলাম। অবিনাশবাবু সমস্ত দেহটা চেয়ারে হেলিয়ে দিলেন। সত্যি তিনি তো কোন লেখা পোস্ট করেননি। ওপাশ তখন বলে যাচ্ছে – বাজ পড়ার ইনসিডেন্টটা দারুন দিয়েছেন স্যার। পবিত্রবাবুর নিখোঁজ হওয়ার সাথে লাইব্রেরিতে বাজপড়ার ঘটনা যেভাবে মিলিয়ে ধোঁয়াশা করে দিয়েছেন ভাবা যায়না স্যার। মুখ দিয়ে কথা সরছে না অবিনাশবাবুর। তোতলাতে শুরু করলেন অবিনাশবাবু। ত ত করে শুধু মুখ দিয়ে বেরোল – শেষটা? সম্পাদক উত্তর দিলেন অসাধারন স্যার। শেষের শব্দ বন্ধনীতে কী অভিঘাত। শেষ হল কত আশারে। ওফ্ ভাবা যায় না। অবিনাশবাবু শুধু বললেন – এরাই তাহলে কখনও কখনও বন্ধুভূত হয়, তাই না?
ওপারের ভারী কন্ঠ এলিয়ে উত্তর দিল – কি জানি?
Tags: অদূরে, দেবাশিস মজুমদার
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।