ধরণী কাকুর বয়স কত হবে এ ব্যাপারে আমাদের কোন আন্দাজ নেই । তবে সুদেব বলেছিল ওর দাদুর সাথে নাকি ধরণী কাকু এক সময় ফুটবল খেলত ! হতে পারে । তবে আজো ধরণী কাকুর যা চেহারার বাঁধন আর এক মাথা কালো ঝাঁকড়া চুল তা দেখলে তার বয়সের তল পাওয়া মুশকিল ! সে এক’শ বা দু’শ যাই হোক না কেন তবে তার সাহসের প্রশংসা না করে পারা যায় না । ছানা বলে , “ ধরণী কাকু হল সাহসের পাহাড় ! বরং ভূত বা অপদেবতারাই তাকে দেখে ভয় পায় !”
প্রতি শনি ও রবিবারে আমাদের নির্ধারিত গল্পের আসর বসে গ্রামের মাঝখানে একটা বহু পুরনো অশ্বত্থ গাছের নীচে বাঁধান বেদির উপর । একে আমরা রাস তলা বলে থাকি । কিন্তু এই শনিবারে ওখানে গ্রামের বড়দের একটা সভা হওয়ার কথা । তাই ,ওখানে গল্পের আসর হবে না । আমাদের মন খারাপের কথা শুনে মা বললেন ,” তোরা মন খারাপ করিস না । ধরণীকে গিয়ে বল আজ আমাদের বাড়িতে বরং গল্পের আসর বসবে ।“
এ কথা শুনে আমি তাড়াতাড়ি বলি ,” মা ,ধরণী কাকু কিন্তু চায়ের সাথে খাস্তা বিস্কুট খায় । ওটা মনে রেখ । আর দুবার চা দিতে হয় ।“
মা মাথা নাড়তেই আমি ছুটলাম ধরণী কাকু আর বাকিদের খবর দিতে । তখন যেন ডানায় ভর করে ছুটছি ! মুহূর্তের মধ্যে সবার কানে খবর পৌছে গেল ।
মাসের শেষ শনিবারটা আবার অমাবস্যা । আমাদের বাড়ির কাছে নন্দ আর রামের বাড়ি । কিন্তু সুদেব, ছানা আর জনার বাড়ি অন্য পাড়ায় । তাইওরাও সন্ধ্যা লাগতে না লাগতেই আমাদের বাড়ি চলে এসেছে । তবে জনা এসেই বলল , “আজ কিন্তু আমাকে এগিয়ে দিতে হবে । অন্তত গাব গাছটা পার করে না দিলে আমি বাড়ি চলে যাব ।”
আমরা এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি । মা কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল । জনার কথা শুনেছে । মা আমাকে বলল , “কিরে অলোক তুই,রাম আর নন্দ জনাকে বাড়ি পৌছে দিতে পারবি না ? “ মা আমার সাহসের ব্যাপারটা জানে বলেই এ কথা বলল । কাক ভোরের আগে আমি যে তাল বাগান থেকে তাল কুড়িয়ে আনি তা মা অবশ্যই জানে । যদিও গ্রামের সবাই বলে এই তাল বাগানেই নাকি অনেকে বিভিন্ন ধরনের ভূত দেখেছে । এটা ভূতদের একটা আড্ডাস্থল ! রাতে সবাই একবার এখানে আসবেই । অবশ্য আমি কখনও তাদের দেখিনি । আমরা জনাকে পৌছে দেব বলায় জনার চোখে মুখে একটা স্বস্তি ফিরে এল ।
আমাদের বাড়ির আঙিনাটা রোজ গোবর দিয়ে নিকিয়ে দেওয়া হয় বলেই সব সময় ঝাঁ-চকচক করে । সেই আঙিনায় একটা খেজুর পাতার চাটাই পেতে আমরা সবাই ধরণী কাকুর জন্য অপেক্ষা করছি । আজ শ্রোতার সংখ্যা একটু বেশি । আমার ভাই-বোনেরা তো রয়েছেই । তাছাড়াও রাম আর নন্দের ভাইয়েরাও এসেছে । আমরা নিজেদের মধ্যে গল্প করছি এমন সময় হেলতে দুলতে ধরণী কাকু আমাদের বাড়িতে এসেই হাঁক দিল ,” বৌদি , আমি এসে গেছি । অর্থাৎ চা তৈরি কর ।”
ধরণী কাকু এসেই যারা লন্ঠন নিয়ে এসেছিল সব নিভিয়ে দিতে বলল । একে ঘোর অমাবস্যা । তারপর আবার সব আলো নিভিয়ে দেওয়ায় অন্ধকারটা যেন আমাদের আরো চেপে ধরল ! শুধু মাত্র রান্না ঘর থেকে সামান্য কুপির আলোর সরু এক ফালি রশ্মি ছাড়া আর আলোর কোন চিহ্ন রইল না । আমরা একে অপরকে ছুঁয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকলাম !
ধরণী কাকু বসতে বসতে বলল ,”এত অন্ধকারেও আজ সংখ্যায় যে তোরা একটু বেশি তা দিব্যি বুঝতে পারছি ।“ এর মধ্যে মা চা দিয়ে গেল । ধরণী কাকু তার পুরনো অভ্যাস মতোই সুরুৎ করে একটা টান দিয়ে কোন ভনিতা না করেই বলল ,” আমি তখন কলকাতায় চাকরি করি। আমার অফিস ছিল গিলেন্ডারহউসে। এটির বয়স প্রায় এক’শ বছর ! আর প্রত্যেক ঘরের উচ্চতা হল ধর কুড়ি ফুট থেকে পঁচিশ ফুট। ইয়া মোটা দেয়াল। তখন আমরা ছিলাম প্রায় এক’শ পঞ্চাশ জন কর্মচারী। আমাদের মতো কয়েক জন কম বয়সী ছেলে ছাড়া বাকি সব বয়স্ক সহকর্মীরা ধুতি পরে অফিসে আসতেন। এরমধ্যে প্রায় আশি শতাংশ কর্মচারীই আসতেন শহরতলী থেকে ট্রেনে করে। তারা যেমন তাড়াতাড়ি আসতেন তেমনি চলেও যেতেন ছুটির প্রায় ঘন্টাখানেক আগে। আমি যেহেতু শিয়ালদার একটি মেসে থাকতাম তাই ছুটির পরেও কিছুটা সময় অফিসে কাটিয়ে যেতাম। আসলে মেসে গিয়ে অন্যদের তাস খেলা দেখা ছাড়া আমার কোন কাজ ছিলনা । ওরা সবাই পয়সা দিয়ে তাস খেলত।আমার ওসব ভাল লাগত না।একদিন ম্যানেজার বাবু আমাকে ডেকে বললেন ,” ধরণী , তুমিতো এমনিতেই দেরি করে মেসে ফের। আজ কপিলের মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় ও বাড়ি চলে গেছে। এদিকে আবার আজ একটা বড় প্রিমিয়াম দেওয়ার কথা।ওটা নিয়ে আমার ফিরতে ফিরতে প্রায় আটটা বেজে যাবে। আমি সুদীপ্তকে বলেছি কিছুটা সময় থাকার জন্য। কিন্তু ও একা থাকতে ভয় পাচ্ছে। তাই বলছিলাম তুমি কি আমি না আসা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করে যাবে।”
ম্যানেজারবাবু এমনভাবে বললেন যে আমি আর তাকে না বলতে পারলাম না । তাই আমিও রয়ে গেলাম। আগেই বলেছি আমাদের অফিসটা ছিল বিশাল লম্বা। আমার বসার জায়গা ছিল অফিসে ঢুকতেই । আর সুদীপ্ত বসত একেবারে শেষপ্রান্তে । আমি না দাঁড়ালে সুদীপ্তকে দেখতে পাবনা। ওরও একই অবস্থা। অতবড় বিশাল অফিসে মাত্র আমরা দুজন। বাথরুম যাওয়ার সময় দেখে গেলাম সুদীপ্ত কাজ করছে। আমি নিজের টেবিলে এসে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম। একা একা বসে থাকতে ভাল লাগছিলনা। এদিকে সুদীপ্ত কাজ করছে বলে ওর কাজের ব্যাঘাত ঘটাতে মন চাইছিল না । হঠাৎ মনে পড়ল আমার চারটা পেন্ডিং ক্লেম ফাইল আছে। বরং ওগুলো দেখলে কাজটাও হবে আর সময়ও কেটে যাবে। তাই আলমারি থেকে ফাইলগুলো এনে টেবিলে রাখলাম। আমি যে দপ্তরে কাজ করতাম সেটা ছিল একটা ক্লেম দপ্তর। দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে যদি তার বীমা করা থাকে তাহলে তার ওয়ারিশ সেই টাকাটা পাবে। পলিসির নিয়ম অনুযায়ি সব ঠিক ঠাক থাকলে আমরা ওয়ারিশের নামে চেক পাঠিয়েদেব । এবার প্রথম ফাইলটি খুলে দেখলাম এটি একটি জলে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা। একটি বাচ্চা ছেলে বর্ষার ভরা নদীতে স্নান করতে গিয়ে ডুবে গিয়েছে। পোষ্টমর্টেম রিপোর্টেও দেখা যাচ্ছে যে ঐ বাচ্চার স্টমাকে জল ছাড়া আর কিছু নেই। আমার সমস্ত কাগজ দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সব ঠিক ঠাক থাকায় ক্লেমটা পেয়েবল করে দিলাম। মনে মনে ওর মাকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিলনা।এবার মনটা অনেকটা হাল্কা লাগল। এবার একটা বিড়ি ধরিয়ে মৌজ করে বার কয়েক টান দিয়ে দ্বিতীয় ফাইলটা টেনে নিলাম। এটা একটা মার্ডার কেস। পুলিশ রিপোর্ট বলছে যে দুই বন্ধু এক সাথে মদ খেয়ে কোন একটি ঘটনায় বাক বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে । আর তখন এক বন্ধু মদের বোতল ভেঙে অন্য বন্ধুর পেটে ঢুকিয়ে দেয়। এর পেছনে পুরোনো কোন ব্যবসা সংক্রান্ত রাগ কাজ করেছে। মৃতের পেটে পর্যাপ্ত পরিমাণে মদ পাওয়া গেছে। কাজেই একটা নোটসিট তৈরি করে ক্লেমটিকে নট পেয়েবল করে দিলাম। তৃতীয় ফাইলটি খুলে দেখলাম যে একজন লোক ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়ে ঘুমের চোখে বাড়ির পাতকুঁয়োয় পড়ে গিয়েছে। অথচ তার পায়ের চটিজোড়া কুঁয়োর সামনে দিব্বি গোছানো অবস্থায় রাখা ছিল। পুলিশ তার রিপোর্টে এটাকে কমিটেডসুইসাইড অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত মৃত্যু বলছে। কাজেই বলাই বাহুল্য যে এই ক্লেমটিও নট পেয়েবল হল। আমি সেই ভাবে নোটসিট তৈরি করে আগের ফাইলের উপর রাখতে গিয়ে দেখি দ্বিতীয় ফাইলটি টেবিলে নেই ! কিন্তু গেল কোথায় ! আমি যতটা পারা যায় নীচু হয়ে টেবিলের তলায় এবং চারদিকে খুঁজলাম। পেলাম না ! চোখের নিমেষে ফাইলটি গেলই বা কোথায় ! এমন নয় যে কেউ আমাকেএকটু ঘাবড়ে দেওয়ার জন্য ফাইলটি সরিয়ে রাখবে।এইমুহূর্তে লোক বলতে তো মাত্র দুজন ! তাছাড়া সুদীপ্ত অমন ছেলেও নয়।আমার মনটা ভীষণ খুঁতখুঁত করতে লাগল ! এবার তৃতীয় ফাইলটির উপরে একটা পেপার ওয়েট চাপিয়ে শেষ ফাইলটি পড়তে লাগলাম। ফাইলটি খুলেই দেখলাম এটি একটি দুর্গন্ধময় ফাইল। কে যেন একটি লোককে ইটভাটায় খুন করে তার মাথাটা কেটে নিয়ে গেছে ! আর সারা বুকে বহু আঘাতের চিহ্ন ! পুলিশের সন্দেহ যে ঐ মৃত ব্যক্তির উপর আততায়ীর এতটাই রাগ ছিল যে সারা বুকটা অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে তবে তার হয়তো শান্তি হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এক মহিলা নিজেকে ঐ মৃতের স্ত্রী বলে দাবি করেছে। সে নাকি মৃতের ঐ রকম বীভৎস বুক দেখেই চিনে ফেলেছে যে সে তারই স্বামী। অথচ শরীরে কোন পুরোনো দাগ বা জরুল কিছুই নেই যা দেখে ওকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা যায়। তাই বোধহয় পুলিশও তার ফাইনাল রিপোর্ট দিতে পারেনি। এদিকে কেসটি প্রায় তিন বছরের পুরোনো। আমরা অনেক চিঠি লিখেও ফাইনাল রিপোর্ট না পাওয়ায় ক্লেমটিকে নটপেয়েবল করে দিলাম। পরে যদি পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দিতে পারে তখন না হয় রিওপেন করা যাবে। কিন্তু যেইনা এই ফাইলটি টেবিলের উপরে সরিয়ে রাখতে যাব দেখি পুরোনো ফাইলগুলোর একটাও টেবিলে নেই ! অথচ পেপার ওয়েটটা রয়েছে ! আমি আবার এদিক ওদিক খুঁজলাম। পেলাম না ! অথচ বুঝতে পারছি কে যেন আমার হাতে ধরা শেষ ফাইলটিও টেনে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে ! আমি তখন যেদিক থেকে অদৃশ্য কেউ ফাইলটি টানছিল সেদিক বরাবর জোরে একটা ঘুসি চালালাম। ঘুসিটা গিয়ে একটা শক্ত জিনিসকে জোরে আঘাত করায় আমার হাতে খুব লাগল ! আর ঐ সুযোগে দেখলাম ফাইলটি শূন্যে ভাসতে ভাসতে ম্যানেজার বাবুর ঘরের বন্ধ দরজা দিয়ে ভিতরে চলে গেল ! আমি সুদীপ্ত বলে চীৎকার করে উঠলাম। সুদীপ্ত ছুটে এলে ওকে সব বললাম।ও সব শুনেই দেখলাম কাঁপতে শুরু করেছে ! ঠিক এমন সময় টেলিফোনটা বেজে ওঠায় আমি তুললাম। ওপার থেকে ম্যানেজারবাবু যা বললেন তার অর্থ হল তার ফিরতে প্রায় নয়টা বেজে যাবে। তাই আমরা যেন অফিস বন্ধ করে বাড়ি চলে যাই । আমরা তাই করলাম ।
ধরণীকাকু হাতের ইশারা করায় আমি তাড়াতাড়ি এক গেলাস জল এনে দিতেই ধরণীকাকু তা ঢকঢক করে খেয়ে নিল। এক নাগাড়ে এতটা কথা বলায় ওর গলাটা প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল। একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে গেলাসটা মাটিতে
রাখতেই জনা বলে উঠল, “তাহলে মোট কয়টা ভূত ছিল ধরণীকাকু ?”
“ আমি কি ছাই তা গুনেছি , না দেখতে পেয়েছি যে বলব।” ধরণীকাকু এবার একটা বিড়ি ধরাতে যাবে এমন সময় মা একথালা সাবুর পাঁপড় ভাজা এনে দিল। আর সাথে এক কাপ চা। থালাটা মাঝখানে থাকায় তা মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে গেল। ধরণীকাকু চা শেষ করে এবার একটা বিড়ি বার কয়েক ফুঁ দিয়ে তারপর ধরাল। একটা লম্বাটান দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে ধোঁয়া ছেড়ে কিছুটা সময় আকাশের দিকেতাকিয়ে থাকল। কি দেখল কে জানে !
ধরণী কাকু তার ফেলে আসা অতীতের মধ্যে এমন ভাবে ঢুকে গেছে যে আমরা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বলল , “জানিস সেদিন মেসে গিয়ে সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি । ঘুমের মধ্যেও বার বার ফাইল উড়ে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন দেখেছি ! তাই দশটা বাজার আগেই অফিসে চলে এসেছি । এসে দেখি ম্যানেজার বাবু চলে এসেছেন । আমি নিজের চেয়ারে বসার আগে ওনার চেম্বারে গিয়ে ঢুকলাম । উনি মাথা না তুলেই আমাকে বসতে বললেন । আমি গত রাতের সব ঘটনা পুংখানুপুংখ ভাবে বললাম । উনি হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না । শুধু মুচকি হাসলেন । অত বড় একটা ঘটনায় ওনার কোন অভিব্যক্তি না হওয়ায় আমি অবাক হলাম ! তারপর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চেম্বার থেকে বেড়িয়ে এলাম । শুধু আসার সময় বললাম –‘ স্যার , ফাইলগুলো ভাল করে না পড়ে শুধু আমার নোট দেখে সই করবেন না ।‘
এরমধ্যে একে একে অফিসে কর্মচারীরা আসতে শুরু করেছে । আমি কাজে মন বসাতে পারছি না । ম্যানেজার বাবুর অমন নির্লিপ্ততা আমাকে ভীষণভাবে অবাক করে দিয়েছে ! আমি কিছুতেই অস্বস্তি কাটাতে পারছি না । সুদীপ্তের সাথে একবার দেখা করা উচিত এই ভেবে ওর টেবিলের দিকে গেলাম । ওর প্রতিবেশী পদ্ম বলল আজ নাকি সুদীপ্ত অফিস আসবে না । ওর গতকাল রাতে জ্বর হয়েছিল । কবে অফিসে আসবে পদ্ম তা জানে না । আমি বুঝতে পারলাম ও গত রাতে ভীষণ ভয় পেয়েছিল আর তার থেকেই হয়তো ওর জ্বর এসেছে !
প্রায় চারটা নাগাদ ম্যানেজার বাবু আমাকে ডেকে পাঠালেন । আমি তার চেম্বারে যেতেই তিনি আমাকে বসতে বলে বললেন – ‘আচ্ছা ধরণী ,গত কাল তোমরা কখন অফিস বন্ধ করেছ ?’
“কেন স্যার , ঠিক আটটা নাগাদ ! “ আমি অবাক হয়ে বলি ।
“অথচ আর মাত্র পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা করতে পারলে না ! রাস্তায় জ্যামের জন্য মিনিট পাঁচেক হয়তো দেরি হয়ে গিয়েছিল । তাছাড়া আমি তো তোমাকে মেসে পৌছে দেব বলেছিলাম।” ম্যানেজার বাবুর গলায় সামান্য হলেও যে একটু উষ্মা রয়েছে তা আমি বুঝতে পারলাম ।
“আসলে আপনি যখন ফোন করে বললেন যে চেক পেতে আপনার প্রায় নয়টা বেজে যাবে আর তাই যেন আমরা চলে যাই । তারপরেই আমরাও চলে গিয়েছি । তাছাড়া কালকের ঘটনা তো আপনি সবই “–
আমি এটুকু বলতেই ম্যানেজার বাবু তার ভূরু যুগল কুঁচকে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন ,”আরে দাঁড়াও দাঁড়াও । কি বললে আমি কাল ফোন করে তোমাদের যেতে বলেছিলাম ! কাল তো আমি ফোন করিনি ! তাছাড়া যে অফিসে গিয়েছিলাম তাদের দু’ দিন ধরে ফোনটা খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে ! আচ্ছা বলতো কটা নাগাদ ফোন এসেছিল ? ”
আমি একটু ভেবে নিয়ে বললাম , “স্যার , আটটা নাগাদই হবে । তারপর আমরা অফিস ছাড়ি । তাছাড়া” –
উনি আবার আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন ,” আরে তখন তো আমি রাস্তায় ! বললাম না জ্যামে আটকে গিয়েছিলাম । আচ্ছা তুমি আমার গলা চিনতে পেরেছিলে ?”
“কি যে বলেন স্যার, আপনার গলা চিনবো না ! এখন যেমন বলছেন ঠিক তেমনি । তাছাড়া আজ সকালে এসে তো আপনাকে গত রাতের সব ঘটনার কথা বললাম । আপনি সব শুনলেন অথচ মুখে কিছুই বললেন না ! “
এবার ম্যানেজার বাবু দু’ হাত দিয়ে তার মাথাটা ধরে কনুইয়ে ভর দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন । তারপর আস্তে আস্তে বললেন ,” ধরণী , তোমার শরীর কি ঠিক আছে ? আমি গত রাতে একবার ঐ আটটা দশ নাগাদ এসে যখন দেখলাম যে অফিসে তালা দিয়ে তোমরা চলে গেছ তখন তো আমিও বাড়ি চলে গেলাম । আজ বাইরের কিছু কাজ মিটিয়ে এই তো সবে ঘন্টা খানেক আগে এসেছি । আর তুমি কিনা বলছ আমার সাথে সকালে কথা বলেছ ! হাউ স্ট্রেঞ্জ ধরণী ! “
ওনার কথায় আমিও বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম । গতকাল রাত থেকে এই পর্যন্ত কোন হিসেবই মেলাতে পারছি না । ভাবছি ইনি সত্যিই কি আমাদের ম্যানেজার বাবু ! নাকি এখানেও কোন গন্ডগোল আছে ! তাহলে আজ সকালে যার সাথে অত কথা বললাম তিনি কে ! তিনি তো এই রঙেরই জামা পরে এসেছিলেন ! নাকি অন্য রঙের ! সব কেমন যেন তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছে ! আমার দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকায় ম্যানেজার বাবু আবার গত রাতের ঘটনাটা জানতে চাইলেন । এবার আমি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব বললাম । উনি মন দিয়ে সব শুনলেন । তারপর হঠাৎ করে আমার যারা একান্ত বন্ধু তেমন কয়েকজন সহকর্মীকে ডাকলেন । তারা আজ সকাল থেকে আমার কথা বা ব্যবহারের মধ্যে কোন রকম অসঙ্গতি লক্ষ্য করেছে কিনা তা জানতে চাইলেন । তারা ‘না’ বলল বটে তবে এটাও বলল যে আজ ধরণী কম কথা বলেছে এবং সব সময় কি যেন ভেবে চলেছে ।
এবার ম্যানেজার বাবু বললেন ,” বাড়ির সব খবরা খবর ভাল আছে তো ? তুমি বরং এক কাজ কর ধরণী, দিন কতক বাড়ি ঘুরে এস । গ্রামের অমন মুক্ত আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে বুক ভরে বাতাস টেনে নিলে দেখবে মনটা একেবারে তরতাজা হয়ে গেছে । কলকাতার এমন বদ্ধ হাওয়ায় তোমার মনটা হয়তো বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ।একটা দরখাস্ত দিয়ে চলে যাও ।”
ম্যানেজার বাবু যে আমার কথা একেবারেই বিশ্বাস করলেন না তাতে আমি খুব দুঃখ পেলাম ।
এবার ছানা বলে উঠল , ” তুমি কি এরপর গ্রামে চলে এলে ? “
ধরণী কাকু বার কয়েক মাথা নাড়িয়ে বলল ,” হ্যাঁ, এসেছিলাম । কিছুদিন থেকে আবার চলেও গিয়েছিলাম ।”
আমরা সবাই উদগ্রীব হয়ে ধরণী কাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি । এরপর কি হল তা না জানা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না । একটা বিড়ি ধরিয়ে অন্ধকারে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ধরণী কাকু বলল, “ বুঝলি ধীরে ধীরে ব্যাপারটা মন থেকে মুছে গিয়েছিল । শুধু আলমারিটার কাছে গেলেই মাঝে মাঝে মনে পড়ত ! তবে তার পরের বছর ইন্টারন্যাল অডিটের সময় আবার সেই ফাইলগুলোর খোঁজ পড়ল ! আমি আবার তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম । কিন্তু পেলাম না । তারপর হঠাৎ একদিন দেখি আমার টেবিলের উপরেই ফাইলগুলো রয়েছে । আমি তাড়াতাড়ি ফাইলগুলো খুলে যা দেখলাম তাতে শুধু বিস্মিত হওয়াই নয় ,প্রায় মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলাম । আমার নোটসিটটা একেবার বদলে গিয়েছে । যেগুলো নট পেয়েবল লিখেছিলাম সব পেয়েবল হয়ে গেছে । আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হল যে , হাতের লেখাটা আমারই ! অস্বীকারের কোন উপায় নেই । আমার নোটের নীচে ম্যানেজার বাবু ‘এগ্রি’ বলে সই করেছেন ।”
এসব ক্ষেত্রে ফাইলটি দপ্তরে এলে একটি ভাউচার হবে এবং তাতে বড় বাবুর সই ও ম্যানেজার বাবুর সই থাকবে । তারপর ক্যাশ দপ্তর থেকে ওয়ারিশের নামে চেক তৈরি হবে । অথচ এসব কিছুই হয়নি ! তার আগেই অফিস একাউন্ট থেকে টাকা বেড়িয়ে গেছে ! সবটাই বড় রহস্যময় , বড় বিস্ময়ের ! এরপর আরো ছয় মাস চাকরি করেছিলাম । তারপর একটা তদন্ত কমিটি তৈরি হয়েছিল । তাদের রিপোর্টে ম্যানেজার বাবু আর আমি নাকি এক গভীর চত্রান্ত করে এই কাজটা করেছি তা উল্লেখ করা হয়েছে । তার ভিত্তিতে ম্যানেজার বাবুর বেতন এক ধাপ কমে গেল এবং আমার চাকরিটা চলে গেল !সমাধান করে উঠতে পারিনি ! আমার উপর ঐ সব মৃত লোকদের কিসের যে এত রাগ ছিল তা আজও বুঝতে পারিনি ! অথচ আমি তো কোন ওঝা নই যে ভূতদের উপর অত্যাচার করায় ওরা আমার উপর রেগে আছে ! তাহলে ওরা আমার সাথে এমনটা করল কেন ! আবার এটাও ভাবি যে এই পৃথিবীতে তো এমন অনেক জিনিস আছে যা আজও অনাবিষ্কৃত ! যা বৈজ্ঞানিকদের জ্ঞানের বাইরে ! এটাও হয়তো অমন কিছু একটা হবে ! যা চিরকাল রহস্যের জালে আবৃত থাকে । হাজার চেষ্টা করেও এর কোন উত্তর পাওয়া যাবে না । “
মায়ের রান্না শেষ হয়ে গেছে । তাই বাইরে এসে আমাদের অমন ঘোর অমাবস্যার মধ্যে আঙিনায় চুপচাপ বসে থাকতে দেখে মা অবাক হয়ে বলল ,” কিরে তোরা সবাই এখনও বসে আছিস কেন ! ধরণী বোধহয় আর আসবে না । এলে এতক্ষণে চলে আসত ।”
এ কথায় আমরা সবাই ভীষণ চমকে গেলাম ! পাশে বসা ধরণী কাকুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে নেই ! কিন্তু গেল কখন ! সে তো কোনদিন না বলে যায় না ! আমাদের না বললেও মাকে অন্তত বলে যাবেই !তাহলে এতক্ষণ ধরে কে আমাদের গল্প বলছিল ! সেটাও কি তাহলে রহস্য ! আমি বার কয়েক ঢোক গিলে বললাম ,”মা , তুমি তাহলে পর পর দুবার কাকে চা দিলে ! আর ঐ সাবুর পাঁপড় ! “
মা বিস্মিত হয়ে বলল ,” চা আবার দিতে দেখলি কখন ? তবে একবার তোদের সাবুর পাঁপড় ভেজে দিয়েছিলাম ।“
এমন সময় বাবা নিত্যদিনের মতো তাস খেলে বাড়ি ফিরল । আমাদের ঐভাবে একসাথে দলা পাকিয়ে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বলল ,” কিরে তোরা সবাই এখানে কি করছিস ? আজ তোদের কে গল্প শোনাল ? “
“ জানতো আজ ধরণীর আমাদের বাড়িতে এসে গল্প বলার কথা ছিল । অথচ এরা সেই সন্ধ্যা থেকে বসে আছে , কিন্তু ও এল না ! কাউকে দিয়ে একটু খবর পাঠালেই পারত । তাহলে ওরা এতক্ষণ বসে থাকত না । “ মা বলল ।
মায়ের কথা শেষ না হতেই বাবা অবাক হয়ে বলল ,”ধরণী খবর দেবে কেমন করে ! আজ তো ওর মা মারা গেছে । আসার সময় দেখে এলাম ওর বাড়িতে শ্মশান যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে । হয়তো এতক্ষণে চলেও গেছে ! “
আমরা তখন একে অপরের দিকে এক রাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়েছি ! অথচ ঘোর অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না ! শুধু অনুভব করছি আমাদের সারা শরীর তখন কেঁপে চলেছে !
Tags: অঞ্জন সেনগুপ্ত, ভাসমান রহস্য
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।