তিনি তখন খুবই ছোট। একদিন সকালবেলায় এক বন্ধুর সঙ্গে খড়গপুরের প্ল্যাটফর্ম ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখেন, কু ঝিক ঝিক করে একটা রেল গাড়ি প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল। লোকজন খুবই কম। ফাঁকা ফাঁকা। তাঁর আচমকা চোখ পড়ল রেল গাড়ির একটা জানালায়। সেখানে হলুদ রঙের একটা পাঞ্জাবির হাতা। তার থেকে বেরিয়ে এসেছে কবজি থেকে হাতের একটা পাঞ্জা। এমন হাত একজনেরই হতে পারে।
তিনি সোজা উঠে পড়লেন সেই কামরায়। গিয়ে দেখলেন, হ্যাঁ, উনি যা ভেবেছিলেন, তাইই। জানালার ধারে বসে আছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আসার সময় রাস্তার ধার থেকে অন্যান্য দিনের মতোই একটা গাছের ফুল সমেত ডাল ভেঙে নিয়েছিলেন তিনি। সেই ডালটা উনি তাঁর দিকে এগিয়ে দিলেন। তখন পর্যন্ত সেই ফুলের কোনও নাম ছিল না। রবীন্দ্রনাথ সেটা হাতে নিয়ে বললেন, এই ফুলটার নাম জানো ?
ছোট্ট ছেলেটি বলেছিলেন, না।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, এর নাম মুচকুন্দ ফুল।
এই ছোট ছেলেটাই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন লেখকদের লেখক, সম্পাদকদের সম্পাদক রমাপদ চৌধুরী। লিখেছিলেন – লালবাঈ। এই উপন্যাস বেরোনোর পরে পণ্ডিতরা গবেষণা করে ওই অঞ্চলের ইতিহাস রচনা করেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘বন পলাশীর পদাবলী’। বারবার বাধা পড়া সত্ত্বেও মহানায়ক উত্তমকুমার যখন বুঝতে পেরেছিলেন বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। তখন তাঁর সদ্য সদ্য মাতৃবিয়োগ ঘটেছে। তবু সেই অবস্থাতেই বাড়ি বয়ে এসে তিনি অনুমতি নিয়ে গিয়েছিলেন ‘বন পলাশীর পদাবলী’র চলচ্চিত্রায়ন করার। উত্তমকুমার করেছিলেন। উপন্যাসের গুণে সেটা শুধু সফল বায়োস্কোপই হয়নি, বাংলা ছায়াছবির জগতে হয়ে উঠেছে একটি ইতিহাস। একটি মাইল স্টোন।
প্রেসিডেন্সি কলেজের এই ইংরেজি ছাত্রের দু’ক্লাস উঁচুতে পড়তেন পশ্চিমবঙ্গের এক সময়ের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এবং বরেণ্য চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়।
এই সত্যজিৎ রায়ই পরবর্তীকালে যখন রমাপদবাবুর ‘খারিজ’ উপন্যাসটি নিয়ে সিনেমা করার জন্য কথা বলতে আসেন, সেদিনই সক্কালবেলায় ওই উপন্যাসটির সিনেমা-সত্ত্ব কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন আর এক স্বনামধন্য চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন। এই নিয়ে তাঁকে বারবার আফসোস করতে দেখেছি শেষ বয়সেও।
‘সানন্দা’য় প্রকাশিত আমার একটি গল্প নিয়ে যখন রাজনৈতিক মহল তোলপাড়, আমি আক্রান্ত হই রাজনৈতিক মদতপুষ্ট একদল লুম্পেনের হাতে, ডাকসাইটে এক দাপুটে রাজনৈতিক নেতা অধ্যাপক আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন পাঁচ কোটি টাকার। তখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সেই সময়ের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ আরও অনেক তাবড় তাবড় বিদগ্ধজনেরা। সেই সময়ও আমার হয়ে কথা বলেছিলেন এই রমাপদ চৌধুরী। জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি কী করেন ? আমি বলেছিলাম, পড়াশোনা করি।
– কীসে ?
আমি বলেছিলাম, ক্লাস টুয়েলভে।
উনি বলেছিলেন, চাকরি বরবেন ?
আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ।
উনি বলেছিলেন, তা হলে কাল থেকে চলে আসুন।
শুধু আমাকে নয়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন মৌলালির কাছে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চাকরি করেন। সে সময় সুনীলদা একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন রমাপদবাবুকে। চিঠিটা পড়েই তিনি বুঝেছিলেন, যিনি এ রকম ঝরঝরে গদ্য লিখতে পারেন, তিনি যদি গল্প-উপন্যাস লেখা শুরু করেন, অনেক রথী-মহারথীকে কাত করে দেবেন। সঙ্গে সঙ্গে উনি সাগরময় ঘোষকে বলেছিলেন, এই ছেলেটিকে দিয়ে দেশ-এ উপন্যাস লেখান। এর হবে।
সুনীলদার যে সত্যি সত্যিই সাহিত্যে খ্যাতি হয়েছিল, সেটা এখন সর্বজনবিদিত। শুধু সুনীলদাই নন, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় থেকে সুচিত্রা ভট্টাচার্য – সবাই উঠে এসেছেন রমাপদবাবুর হাত ধরে। নৃসিংহ ভাদুড়ী তো সর্বসমক্ষেই স্বীকার করেন, রমাপদবাবু আমার গুরু।
রমাপদবাবু সাধারণত বছরে একটির বেশি উপন্যাস লিখতেন না। কিন্তু যেটা লিখতেন সেটাই মার মার কাট কাট। উনিই শুরু করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের একটি নতুন ঘরানা – ‘গল্পসমগ্র’। আগে উপন্যাস ছাড়া তেমন কোনও বই সেভাবে বিক্রি হত না। গল্পের বইও যে বিক্রি হতে পারে, সেটা উনিই দেখিয়েছিলেন।
শুধু ‘রমাপদ চৌধুরী’ নামে নয়, উনি যে কত ছদ্মনামে লিখেছেন তার কোনও ইয়ত্তা নেই। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে তাঁর দুটি ছদ্মনাম – অর্জুন রায় এবং লোকেশ্বর বসু।
তাঁর বই এতটাই সাড়া ফেলেছিল যে, তখনকার বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা ডি এম লাইব্রেরি দু’জনকে দুটো গাড়ি উপহার দিয়েছিল। একজনের নাম – কাজী নজরুল ইসলাম আর দ্বিতীয়জনের নাম – রমাপদ চৌধুরী। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, রমাপদবাবু খুব ভাল গাড়ি চালাতেন। আর একটা ব্যাপারে উনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সেটা হল – শেয়ার মার্কেট। উনি এটা এতটাই ভাল বুঝতেন যে, শেয়ার মার্কেটের রাঘব-বোয়ালরা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতে আসতেন।
জ্যোতিষ শাস্ত্র নিয়েও প্রচুর পড়াশোনা ছিল তাঁর। তিনিই বহু বছর আগে আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে লিখেছিলেন, ‘জ্যোতিষ সম্পর্কে কয়েকটি অপ্রিয় প্রশ্ন’। ভাগ্যিস তিনি সেটা ছদ্মনামে লিখেছিলেন। না হলে সে সময় বিভিন্ন রাজ্যের জ্যোতিষিরা যেভাবে এককাট্টা হয়ে পথে নেমেছিলেন, লেখককে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, ধরা পড়লে নির্ঘাৎ প্রাণ সংশয় পর্যন্ত হতে পারত।
উনি বুঝতে পারতেন কোন লেখাটা ভাল আর কোনটা পাতে দেওয়ার মতো নয়। তাই সকলেই একবাক্যে মেনে নিয়েছিলেন, উনি শুধু লেখকদের লেখক নন, সম্পাদকদেরও সম্পাদক। কিন্তু উনি নিজে কখনও কোনও বই সেভাবে সম্পাদনা করেননি। যৌথভাবে কারও সঙ্গে তো নয়ই। একমাত্র আমিই সেই সৌভাগ্যের অধিকারী। আমি আর রমাপদবাবু মিলে বেশ কয়েকটি বই যৌথভাবে সম্পাদনা করেছি। উনি আমাকে এতটাই ভরসা করতেন যে, ওঁর ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড পর্যন্ত আমার কাছে রেখে দিতেন। আমার লেখালিখি নিয়ে সুচিন্তিত মতামত লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। ওঁর শেষতম বই ‘হারানো খাতা’র ভূমিকাতেও তুলে এনেছেন আমার প্রসঙ্গ। এ আমার পরম প্রাপ্তি।
ওঁকে যখন এই জুলাই মাসের(২০১৮) কুড়ি তারিখে বেলভিউ ক্লিনিকে ভর্তি করি, ভাবতেই পারিনি ওঁকে আর ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারব না। তবে হ্যাঁ, শরীর সায় না দিলেও মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তাঁর মাথা ছিল একেবারে পরিস্কার। জ্ঞান ছিল সতেজ। গেলেই বলতেন, আর কত দিন থাকব ? আমাকে বাড়ি নিয়ে চলুন। আমি বাড়ি যাব।
জানি না, উনি কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিলেন কিনা। যে বাড়িতে একদিন প্রত্যেকটা মানুষকেই যেতে হয়, যেতেই হয়; উনি কি সেই বাড়ির কথা বলতে চেয়েছিলেন ! কে জানে !
Tags: রমাপদ চৌধুরী, সিদ্ধার্থ সিংহ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।