সাহিত্যজীবন ব্যাপারটা নিয়ে নানা সময়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সাহিত্য জীবন কি সাহিত্যিকের ব্যাক্তিজীবন ? না সাহিত্যিকের ব্যাক্তিজীবন তাঁর সাহিত্যিকে কতটা প্রভাবিত করেছে তার বিচার।
অনেকেই এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারেননি। সাধুসঙ্গের আশায় যেমন পূর্ণ্যার্থী ঘোরেন, প্রকৃত পাঠকও তেমনই সাহিত্যিককে খুঁজে খুঁজে ফেরেন, নানা চাকায় ফেলে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেন। কতটা তাঁর পড়া পাঠের ওপর ভিত্তি করে মনের মধ্যে গড়ে ওঠা লেখকের সাহিত্য জীবনের বিনির্মাণ হল বা না হল মিলিয়ে দেখেন – এটা পাঠকের স্বাভাবিক ধর্ম। লেখকের ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় মৃত্যুর পরও পাঠকের বিনির্মাণের শিকার হতে হয় লেখককে। দেশে দেশে যুগে যুগে এটা হয়েছে, এবং হবেও।
বিখ্যাত লেখকের সমস্যা আরও বেশি। তাঁরা কোন চরিত্রের বার্তাবাহক হয়ে পড়লে তো কথাই নেই। পাঠক নিজের মনেই তাঁকে নিজের মতন করে নির্মাণ করে ফেলেছেন। আর কোন যুক্তিই তিনি মানতে রাজি নন। অথচ দেখা যাচ্ছে লেখক তার সৃষ্ট জনপ্রিয় চরিত্রটির সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে থেকে দিনের পর দিন জীবনকে অতিবাহিত করে গিয়েছেন। কিন্তু জনসমাজ তাকে হয়ত এই চরিত্রের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। অর্থাৎ পাঠকের মনে একটা অন্য জগত তৈরি হয়ে গিয়েছে লেখককে নিয়ে। ঠিক যেমনটা ঘটেছে সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ এর স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর ক্ষেত্রে। ওঁনার আসল এবং সম্পূর্ণ নাম কিন্তু শরদিন্দুভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আজকের সমাজে শরদিন্দু মানেই ব্যোমকেশ। অথবা ব্যোমকেশ মানেই শরদিন্দু। আমাদের সাহিত্য জগতের দুর্ভাগ্য এই যে আমরা সাহিত্যপ্রেমীরা এই অসামান্য প্রতিভাধর সাহিত্যিকের ছোটো গল্প গুলোকে সেভাবে ঘেঁটে দেখিনি। বিভূতিভূষণ, বনফুল, তারাশঙ্কর ও মানিকের প্রায় সমসাময়িক এই সাহিত্যিক সুদূর পশ্চিম ভারতে থেকেও কত নীরবে সাহিত্য-চর্চা করে গিয়েছেন। কলকাতার সাথে যোগাযোগ থাকলেও কলকাতার সাহিত্যিকদের প্রতিদিনের ওঠাবসার থেকে তিনি ছিলেন অনেক দূরে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তখনও বেঁচে। তার লেখা ‘চুয়াচন্দন’ বইটি পাঠিয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু কবি নাকি দেখে উঠতে পারেননি। শরদিন্দুর ডাইরি সে প্রমান দিচ্ছে।
৩০/০৯/১৯৪৮–এ শরদিন্দু লিখছেন –
“সে সময় আমি নিতান্ত অপরিচিত লেখক নই। প্রবাসীতে নিয়মিত লিখতাম। চার, পাঁচ খানা বইও বাহির হইয়াছিল। কিন্তু তা বলিয়া রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করার যোগ্যতা আমার হইয়াছে তা ভাবাও ধৃষ্টতা। আমি শান্তিনিকেতনের ছাত্রও নই। কোন ছাড়পত্র লইয়া তাহার কাছে যাইব ? …… কালীকিঙ্কর বাবু বোলপুর হইতে ফিরিয়া আমার সহিত দেখা করিতে আসিলেন। তিনি বলিলেন তিনি কবিকে বলিয়াছেন ‘শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা তিনি পড়িয়াছেন কিনা, কবি বলিয়াছেন তিনি পড়েন নাই। কালীকিঙ্করবাবু জানিতে চান বই পাঠাইলে তিনি পড়িবেন কিনা। কবি সম্মতি জানান…… তাঁহার সনির্বন্ধ অনুরোধে ‘চুয়াচন্দন’ পাঠাইলাম। কিন্তু কবি ‘চুয়াচন্দন’ গ্রহণ করিলেন না। অন্তত গ্রহণ করলেন কিনা সে সংবাদ আমি আজ পর্যন্ত পাই নাই।”
এই প্রসঙ্গে একটি তথ্য সংযোজন করা জরুরী। বাংলা ১৩৪০ সাল অর্থাৎ ইংরেজি ১৯৩৩ সালে তাঁর প্রথম গল্পের বই ‘জাতিস্মর’ প্রকাশিত হওয়ার পর উৎসাহ, উত্তেজনার ঝোঁকে উপহার পৃষ্ঠায় ‘বনবেতসের বাঁশিতে পড়ুক তব নয়নের পরসাদ’ লিখে শরদিন্দু বাবু রবীন্দ্রনাথকে এক কপি পাঠিয়েছিলেন।এ প্রসঙ্গে শরদিন্দু বাবু তাঁর নোটখাতায় লিখেছিলেন –
“তারপর তিন মাস কবিগুরুর নিকট হইতে কোনও খবর পাইলাম না। বুক দমিয়া গেল। অবশেষে ভয়ে ভয়ে একখানি চিঠি লিখলাম। বইখানি পৌঁছিয়াছে কি ? কবির নেত্র প্রসাদ তাহার উপর পড়িয়াছে কি ? কিছুদিন পরে উত্তর পাইলাম। কবি দার্জিলিং হইতে ক্লান্ত পোষ্টকার্ড লিখিয়াছেন। তাহার মর্ম – ‘আমার অসুস্থ শরীরের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া আমার সেক্রেটারিরা সম্ববত আপনার বই আমাকে দেন নাই’।”
সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি জ্যোতিষ চর্চা ছিল শরদিন্দু বাবুর নেশা। এই চর্চাকে তিনি শুধু নিজের পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারেননি। সে যুগের বহু খ্যাতিমান সাহিত্যিক তাকে দিয়ে তার কোষ্টি ছক করিয়ে নিয়েছিলেন। নাম শুনতে খুব ইচ্ছে করছে? শুনলে চমকে যাবেন। ভাষাচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। তথ্যসূত্র এবং প্রমাণ রয়ে গিয়েছে শরদিন্দুর নিজের ডায়রিতে। ১৫/০৮/১৯৫১ তারিখের ডাইরিতে শরদিন্দু লিখছেন-
গত তিন মাসের মধ্যে পর-পর দুইবার কলিকাতা যাইতে হইল। সেখানে জগদীশ, মনোজ বসু আরও অনেক সাহিত্য বন্ধুর সহিত দেখা হইল।বেঙ্গল পাবলিশার্সের অফিসে বসিয়া একদিন গল্প হইতেছিল। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় আসিলেন। মিষ্টভাষী মিশুকে লোক। কথাপ্রসঙ্গে জ্যোতিষের কথা উঠিল। সুনীতিবাবু তাঁহার জন্ম সময় আমাকে দিলেন। বম্বে ফিরিয়া কোষ্ঠি তৈরি করিলাম। অসাধারণ কোষ্ঠি। ফল নির্দেশ করিয়া তাঁহাকে পাঠাইয়া দিলাম। কয়েকদিন পরে তাঁহার চিঠি পাইলাম ; খুব আনন্দিত হইয়া চিঠি দিয়াছেন। আমি কয়েকটি প্রাচীন শব্দ সম্বন্ধে প্রশ্ন করিয়েছিলাম, তাহারও বিস্তারিত এবং পান্ডিত্যপূর্ণ উত্তর দিয়াছেন। সেকালে সমুদ্রগামী জাহাজকে ‘বহিত্ত’ বলিত, মাস্তুলকে ‘গুণবৃক্ষ’ বলিত। আমি জানিতাম না ; নাণক হইতে আনা শব্দের উদ্ভব তাহাও অজ্ঞাত ছিল। শব্দগুলি ‘মৌরী নদীর তীরে’ লিখিবার সময় কাজে লাগিবে।
ডায়েরির এই অংশের সমর্থনে সুনীতি কুমারের একটি চিঠির শেষ অংশ যোগ করা যায় –
চিঠিটি লেখা ১৬ই জুনে ১৯৫১ তারিখে। চিঠির ওপরে ছাপা আশুতোষ বিল্ডিং। ইউনির্ভাসিটি অব ক্যালকাটার প্যাডে। চিঠিটি নানা শব্দের অর্থগত ও তত্ত্বগত ব্যাখ্যা আলোচনায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু শেষের পুনশ্চ অংশের ৩টি প্রশ্ন মনে রাখার মতন। সুনীতিবাবু পুনশ্চ অংশে লিখছেন –
আমার রাশিচক্র ইইতে এই কয়েকটি বিষয়ও একটু দেখিবেন।
(১) চোখের অবস্থা কেমন থাকিবে ?
(২) ১৯৫১ – ৫২ তে কোন বড় বইয়ে হাত দিতে পারিব কিনা। সমাধান হইবে কিনা।
(৩) জীবনে আধ্যাত্মিক উপলব্ধির সম্ভাবনা আছে ?
ইতি
শ্রী সুনীতি
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, স্বয়ং ভাষাচার্যও ভবিষ্যৎ হিসাব নিকাশের দায়িত্বভার এই সাহিত্যিকের ওপরই চাপিয়েছিলেন। শরদিন্দু নিজে মজেও ছিলেন এই জ্যোতিষচর্চায়। তার প্রমাণ সাম্প্রতিক কালের অনুজ লেখক শঙ্কর দিয়েছেন তার একটি লেখায়। সেখানে শঙ্কর বলেওছিলেন শরদিন্দুর অভ্রান্ত ভবিষ্যৎবানীর কথা।
সুনীতি শরদিন্দুর এই মধুর সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তার কারণ সে যুগের আর এক খ্যাত নামা সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস। শনিবারের চিঠির সেই দপ্তরে যাতায়াত ও আলাপ পরিচয়ও ছিল শরদিন্দুর। কিন্তু এই সাহিত্যিকই শরদিন্দু ও সুনীতির সম্পর্কে জল ঢালেন। প্রমাণ রয়েছে শরদিন্দুর ডায়রির বেশ কিছু অংশে।
১৬-০৮-১৯৫১
দ্বিতীয়বার যখন কলিকাতা যাইবার প্রয়োজন হইল তখন স্থির করিলাম সুনীতিবাবুর সহিত দেখা করিয়া আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করিব। রওনা হইবার দুই দিন আগে তাঁহাকে চিঠি লিখিয়া দিলাম, কলিকাতায় আমার ঠিকানা ও ফোন নম্বর দিলাম।
কলিকাতায় পৌঁছিয়া শুনিলাম তিনি ফোন করিয়াছিলেন। তিনি কবে কবে বাড়িতে থাকিবেন এবং কখন গেলে দেখা করিবার সুবিধা হইবে তাহা জানাইয়া দিয়াছেন। একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোকের সহিত ঘনিষ্ঠ আলাপ হইবে ভাবিয়া উৎফুল্ল হইলাম।
একদিন সকালবেলা দেখা করিতে গেলাম। গিয়া দেখিলাম, সম্পূর্ণ অন্য মূর্তি ; সে সুমিষ্ট মিশুক ভাব আর নাই। কেমন যেন ব্যাজার ভাব। অসময়ে বিরক্তিদায়ক উমেদার উপস্থিত হইলে বড়মানুষের যেমন মুখের ভাব হয় অনেকটা সেইরূপ। মনে হইল, আমি কোনও অনুচিত প্রস্তাব করিব এই আশঙ্কায় পূর্ব হইতেই তিনি বিরূপ হইয়া আছেন। লজ্জিত ও অপদস্ত হইয়া তাড়াতাড়ি ফিরিয়া আসিলাম।
১৭-০৮-১৯৫১
সুনীতিবাবুর সহিত দেখা করিতে যাইবের আগের দিন সন্ধ্যাবেলা জগদীশ ভট্টাচার্যের বাসায় গিয়াছিলাম। গিয়া দেখিলাম সেখানে সাহিত্যিকদের আসর বসিয়াছে, শ্রীমনোজ বসুকে সম্বর্ধনা করা হইল। সেখানে সজনী দাসের সহিত দেখা হইল।সজনীর বোলচাল হইতে মনে হইল সে আমাকে দেখিয়া বড়ই প্রীত হইয়াছে। বারবার শনিবারের চিঠিতে লিখিবার জন্য নির্বন্ধ করিল। শেষে বলিল, ‘চল, কাল সকালে আমার বাড়িতে যেতে হবে। আমি এসে গাড়িতে করে তোমাকে নিয়ে যাব।’ আমি বলিলাম, ‘কাল যেতে পারব না ভাই, কাল সকালে একবার সুনীতিবাবুর বাড়ি যেতে হবে।’
সজনী অত্যন্ত উৎসুক হইয়া বলিল, ‘কেন ? কেন ? সুনীতিবাবুর মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ের চেষ্টা করছ নাকি?’
আশ্চর্য হইয়া বোধহয় বলিলাম, ‘সে কি ! আমি যাচ্ছি তাঁর কাছে কিছু জ্ঞান আহরণ করতে।’ কিন্তু সজনী বোধহয় বিশ্বাস করিল না।
১৮-০৮-১৯৫১
সুনীতিবাবুর মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিবাহ দিবার সঙ্কল্প দূরের কথা, তাঁহার যে বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে তাহাই আমার জানা ছিল না। তাছাড়া ছেলের বিবাহের জন্য মেয়ের বাপের দ্বারস্থ হইবার মত মনোবৃত্তি আমার নয়। কিন্তু সুনীতিবাবু তাহা জানেন না; আমার সহিত তাঁহার পরিচয় নিতান্তই ভাসা–ভাসা।
আমি জানি, সজনী তাহার সাহিত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সুনীতিবাবুর মুখাপেক্ষী। সুনীতিবাবুকে পাকড়াইয়া, পুস্তক সম্পাদনা কার্যে সাক্রেদি করিয়া সে বেশ গুছাইয়া লইয়াছে। তাই আমি সুনীতিবাবুর সহিত দেখা করিতে যাইব শুনিয়া তাহার বোধহয় ভয় হইয়াছিল। সজনীর বিদ্যাবুদ্ধির দৌড় আমার অজানা নাই। আমি সুনীতিবাবুর কুটুম্ব হইয়া বসিলে সে আর কল্কে পাইবে না। তাই সে সুনীতিবাবুকে আমার সম্বন্ধে এমন কিছু বলিয়াছিলেন (দু’জনেরই টেলিফোন আছে) যাহার ফলে তাঁহার মন আমার প্রতি বিরূপ হইয়া উঠিয়াছিল। এছাড়া তাঁহার ব্যবহারের আর কোনও নির্ভরযোগ্য কৈফিয়ৎ নাই।’
কিন্তু সজনীকান্ত দাসের ওপর কোনো ব্যাক্তিগত ক্রোধ বা ক্ষোভ ছিলনা শরদিন্দু বাবুর। ক্ষেত্র বিশেষে প্রসংসাও করেছেন। ডায়রিতে মানুষও নিজের সাথে নিজেই কথা বলে। ডায়রিতে মিথ্যে লেখা খুব শক্ত অন্তত মনস্তাত্ত্বিকরা তাই বলে থাকেন। সজনী বাবুকে ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন তার প্রমাণও রয়েছে ডায়রির আরও কয়েকটি অংশে। সেটা পড়লেই বোঝা যাবে সজনী বাবু সম্পর্কে শরদিন্দু বাবুর মূল্যায়ণ।
০১-১১-১৯৫০
প্রসঙ্গত একজন সাহিত্য ব্যবসায়ীর কথা মনে পড়িল যাহার সহিত প্রমথ বাবুর একটু মিল আছে। সে ব্যাক্তি সজনীকান্ত দাস। দুইজনের মধ্যে সাদৃশ্য কিন্তু সম্পূর্ণ বাহ্য। দুইজনেই রঙ্গ-ব্যঙ্গে পটু, দুইজনেই শনিবারের চিঠির যৌবনকালে তাহার সহিত সংযুক্ত ছিলেন। কিন্তু চরিত্র ও সাহিত্যকৃতির পরিমাণে উভয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। সজনীকান্তকে অনেকে সাহিত্যের দিগ্দর্শক মনে করেন। সজনী কবিতা, গল্প উপন্যাসও লিখিয়াছে ; ব্রজেন বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের অনুবর্তী হইয়া অনেক বাংলা ক্লাসিক সম্পাদন করিয়াছে ; এমন কি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসও লিখিয়াছে। কিন্তু তবু তাহাকে সাহিত্যিক বলিতে পারি না। আসলে সে সাহিত্য ব্যবসায়ী। মন্দিরের পূজারী যেমন কালক্রমে মোহান্ত হইয়া ওঠে, সেইরূপ সজনীও অনেকটা সাহিত্য মোহান্ত। তাহার মধ্যে সামান্য যেটুকু সাহিত্য বুদ্ধি ছিল তাহা নিছক ব্যবসায়ী বুদ্ধিতে পরিণত হইয়াছে।
০২-১১-১৯৫০
খাঁটি বাংলা ভাষা লিখিবার সহজ শক্তি সজনীর আছে। অশ্লীল-ইঙ্গিত-ভরা ইয়ার্কি, যাহা একদিন শনিবারের চিঠির সংবাদ সাহিত্যের বিশেষত্ব ছিল, তাহা সজনীর সহজাত। কবিতায় কদাচিত রস-সৃষ্টি তাহার কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে পাওয়া যায়। তবু সে সাহিত্যিক নয়। ইহার কারণ, তাহার discrimination নাই, সত্য-অসত্য জ্ঞান নাই, ভাল-মন্দ বোধ নাই। যিনি প্রকৃত সাহিত্যিক তাঁহার মনে একটি সদা-সক্রিয় তুলাদন্ড কাজ করে, প্রতিটি বস্তু তৌল করে, তাহার মূল্য নির্ধারণ করে। Poets are the unacknowledged legislators of the world. এই বিচারবুদ্ধি বা বিবেক সজনীর নাই। তাই যখন সে কোনও বিষয়ে মতামত প্রকাশ করে তখন হয় তাহা অন্যের মতামত কিম্বা তাহা ভুল মতামত। কিন্তু একটি কথা স্বীকার করিতে হইবে – সে একজন অতি উচ্চ অঙ্গের reporter. এখানে বিচারবুদ্ধির প্রয়োজন নাই, তাই এক্ষেত্রে সে অদ্বিতীয়। এক কথায় সে journalist.
০৩-১১-১৯৫০
সজনীর প্রকৃত সাহিত্যিক স্বধর্ম কী তাহা আমিও অনেকদিন বুঝিতে পারি নাই। একবার কলিকাতায় গিয়াছি, শনিবারের চিঠির অফিসে আড্ডা বসিয়াছে ; সজনী ছাড়া আর কে কে উপস্থিত ছিল এখন মনে নাই। কথায় কথায় আনন্দবাজার পত্রিকা ও অমৃতবাজার পত্রিকার রেষারেষির কথা উঠিল, দুই পক্ষে তখন খিস্তিখেউড়ের যুদ্ধ চলিয়াছে। গল্প শুনিয়া আমার বড় বিরক্তি বোধ হইল। মনে আছে, বেশ একটু উত্তপ্ত ভাবে এইসব অসার প্রতিদ্বন্দিতা ও ব্যক্তিগত ঈর্ষাদ্বেষকে সংবাদপত্রের স্তম্ভে টানিয়া আনার নিন্দা করিয়াছিলাম। আমার নিন্দা প্রায় একটা লেকচার হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। দিন দশেক পরে শনিবারের চিঠি বাহির হইলে দেখিলাম, আমার ভাষণটি হুবহু ‘সাহিত্য প্রসঙ্গ’ শিরোনামায় ছাপা হইয়াছে ; কিন্তু মতগুলি যে আমার তাহার উল্লেখ কোথাও নাই। উহা সম্পাদকীয় মন্তব্য রূপেই প্রকাশিত হইয়াছে।
০৪-১১-১৯৫০
সজনীর গলদ কোথায় বুঝিতে পারিলাম। সাহিত্য তাহার ধর্ম নয়, সে শ্রুতিধর –reporter. তাহার আড্ডায় অনেক পন্ডিত ব্যক্তির যাতায়াত আছে ; সুনীতিবাবু, ব্রজেনবাবু, নীরদ চৌধুরী, প্রমথ বিশীকে আমি নিজেই তাহার আড্ডায় মজলিশ জমাইতে দেখিয়াছি ; তাছাড়া মোহিত মজুমদার সুশীল দে প্রভৃতিরও যাতায়াত আছে শুনিয়াছি। সজনী এই সকল পন্ডিতব্যক্তির মতামত সংগ্রহ করিয়া সাহিত্য ব্যবসায় চালাইতেছে।সে যে একজন উৎকৃষ্ট reporter তাহার পরিচয় আবার পাইলাম রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর। শ্মশান যাত্রার যে বর্ণনা সে শনিবারের চিঠিতে লিখিয়াছিল তাহার তুলনা নাই। বহু সহস্র বর্ণনার মধ্যে ঐ বর্ণনাটি মনের মধ্যে এখনও উজ্জ্বল হইয়া আছে। সে যে সাহিত্য বিচারক নয়, সম্প্রতি তাহার একটি নূতন প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। বনফুলের শ্রেষ্ঠগল্প নামক পুস্তকের প্রথম সংস্করণে সজনী ভূমিকা লিখিয়াছিল। সে ভূমিকা যাঁহারা পড়িয়াছেন তাহারাই সজনীর সাহিত্যবুদ্ধির পরিচয় পাইয়াছেন।‘’
অর্থাৎ ওপরের অংশটি পড়লে বোঝা যাচ্ছে যে তিনি সজনীকান্ত দাসকে একজন মানুষ হিসাবেই বিশ্লেষণ করেছেন আর তাকে সমালোচনার পাশাপাশি তার গুনেরও কদর করে গিয়েছেন। কিন্তু শরদিন্দু বাবুর দুর্ভাগ্য দশচক্রে ভগবানভূত এর মতন’ সম্পর্কটি নষ্ট হল সুনীতি বাবুর সাথে। সম্পর্ক টিকলে হয়ত বাংলা সাহিত্য আরও মূল্যবান কিছু পেতে পারত।
তবে শুধু সুনীতি বাবুর কোষ্ঠী বিচারই না তিনি কোষ্ঠী বিচার করেছিলেন সাহিত্যিক বন্ধু বিভূতিভূষণেরও । তার প্রমানও রয়েছে তার ডায়রির পাতায়।
২৫-১২-১৯৫০
অগ্রহায়ণের শনিবারের চিঠি বিভূতি সংখ্যা হইয়াছে। তাহাতে বিভূতি সম্বন্ধে অনেক লেখা পড়িলাম। তাহার জন্ম হইয়াছিল ১৩ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ ! অর্থাৎ মৃত্যুর সময় তাহার ৫৭ বছর বয়স পূর্ণ হইয়াছিল।
বিভূতির কোষ্ঠীর ছক তৈয়ার করিয়াছি ; কিন্তু জন্ম সময়ের অভাবে লগ্ন স্থির করিতে পারিতেছি না। তাহার চেহারা ইত্যাদি হইতে মনে হয় সিংহ লগ্ন। সিংহ লগ্নের বুধ মারক। বুধ দশার আরম্ভেই মৃত্যু হইয়াছে।
কোষ্ঠী ভাল, কিন্তু লেখকযোগ খুব প্রবল নয়। ভ্রমণের বহু যোগ আছে। কর্মস্থানে গুরু শিক্ষকের কর্ম করাইয়াছে। অষ্টমস্থ রাহু ২১ বছর বয়স পর্যন্ত বহু ক্লেশ দিয়াছে। শনির দশায় প্রবাসে ভাগ্যোদয় হইয়াছে।
আমি জানিতাম বিভূতি কৃপণ ও গৃধ্নু ছিল। যাহা পড়িলাম তাহাতেও ঐ কথাই আছে ; তবে কেহ কেহ whitewash করিয়াছেন। কোষ্ঠীতে কিন্তু কার্পণ্য দোষ দেখিলাম না। (২য় কে)। চন্দ্রের ৪র্থে পাপগ্রহ রাহু থাকিলে পেটুক হয় – এটাও মিলিয়াছে। হয়তো কার্পণ্য দোষ তাহার সহজাত ছিল না ; অবস্থার উন্নতির সহিত মন তাল রাখিতে পারে নাই, তাই তাহাকে কৃপণ মনে হইত।
সত্যিই পড়লে মনে হয় যেন জ্যোতিষের অমোঘ স্বীকারোক্তি বিভূতিবাবুর মৃত্যুর পূর্বে এই কোষ্ঠী বিচার করাইলে বাংলা সাহিত্যের ভাগ্য যে সমৃদ্ধ হইত একথা আমার মত নিরক্ষরও বুঝতে পারছেন।তবে শরদিন্দু বাবু জ্যোতিষ সংক্রান্ত বেশ কিছু বইও পড়তেন। তার নানা নমুনা তার ডায়রির অংশে ছড়িয়ে আছে।
১৮-০৮-১৯৪৮
একটি অতি চমৎকার বই পড়িলাম – শ্রীযোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয়ের ‘আমাদের জ্যোতিষ ও জ্যোতিষি’। আশ্চর্য এই যে বইখানি ৪৫ বৎসর আগে বাহির হইয়াছিল কিন্তু কেহ ইহার নাম জানে না। ইহাতে প্রমাণ হয় বিদ্যার প্রতি আমাদের অনুরাগ নাই, সত্যের প্রতি নিষ্ঠা নাই। জাতি হিসাবে আমরা অতি অভাজন।
এই পুস্তকে বিদ্যানিধি মহাশয় অকাট্য যুক্তি দ্বারা প্রমান করিয়াছেন যে খ্রীঃপূঃ ২৫০০ অব্দে পাঞ্জাবের উত্তরাঞ্চলে বেদ রচিত হইয়াছিল, তখনই জ্যোতিষের সূত্রপাত। খ্রীঃপূঃ ১২০০ অব্দে বেদাঙ্গ জ্যোতিষে এই জ্যোতির্বিদ্যা দানা বাঁধে। বিদেশী পন্ডিতেরা এ বিষয় লইয়া ঘাঁটাঘাঁটি করেন নাই, কারণ বিদ্যানিধি মহাশয়ের প্রমাণ খন্ডন করিবার শক্তি তাঁহাদের নাই। অথচ তাহা স্বীকার করিয়া লইলে ভারতে আর্যোদয় সম্বন্ধে তাঁহাদের সব theory –ই ভন্ডুল হইয়া যায়। তাঁহাদের মতে খ্রীঃপূঃ ১২০০ অব্দ নাগাদ আর্যরা ভারতবর্ষে আসিয়াছিল। তাই বিদেশী পন্ডিতেরা যেন বিধ্যানিধি মহাশয়ের বইখানা দেখিতেই পান নাই এমনি ভাবে চুপ করিয়া আছেন। আমাদের স্বভাব বিদেশী হৈ চৈ না করিলে আমরাও চুপ করিয়া থাকি। তাই ৪৫ বৎসর বিদ্যানিধি মহাশয়ের অমূল্য গবেষণা কেহ লক্ষ্যই করিল না।
অকপট স্বীকারোক্তি। জ্যোতিষ, ফলিত জ্যোতিষ নানা বিষয়ে এই রকম বলিষ্ঠ যুক্তি ছড়িয়ে আছে ডায়রির নানা পাতায় পাতায়। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ কি এই ডায়রির সন্ধান পেয়েছিলেন? কোনো খোঁজাখুঁজিই করেনি বোধহয়। মাঝে মাঝে মনে হয় ব্যোমকেশ না হয় সত্যান্বেষী, যুক্তিই তার মূলধন হলে এমন তথ্য অনুসন্ধানে আগ্রহ নাও থাকতে পারে। তাহলে রহস্যাকৃত বরদা। বরদাকেও তো জ্যোতিষ চর্চায় দেখা গেল না।
এ প্রসঙ্গে একটা বিষয়ের কথা পাঠকদের জানিয়ে রাখি – জ্যোতিষ চর্চার মতন প্ল্যানচ্যাট-এ শরদিন্দু বাবুর গভীর বিশ্বাস ছিল। বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক শোভন বসুর একটি লেখা থেকে জানা যায় – তিনি (শরদিন্দু বাবু) নিজে বহুবার প্ল্যানচেট টেবিলে অশরীরী আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পরে তাঁর স্নেহভাজন কয়েকজন এক প্ল্যানচেট আসরে শরদিন্দু বাবুকে স্মরণ করেন। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে অম্নিবাস সম্পর্কে এমন কয়েকটি কথা বলেন যা ঐ আসরে হাজির বিশেষ একজন ছাড়া অন্য কারুর জানার কথা নয়। শুধু তাই নয়, অল্পদিনের মধ্যে কোন একটি সমস্যার কিভাবে সমাধান হবে তারও ইঙ্গিত তিনি করেন। এমন কি, অম্নিবাস বিক্রির পরিমাণ দেখেও আনন্দ প্রকাশ করেন, অবশ্য সেই সঙ্গে পরিহাস করে বলেন – ‘তাতে আমার এখন আর কি লাভ !’
এর কিছুকাল পরে প্ল্যানচেটের আসরে আবার তিনি এসেছিলেন। স্বভাবতই অম্নিবাসের কথা ওঠে। তিনি বলেন, না, এখন আর এসবে তাঁর কোন আগ্রহ নেই। মর্ত্যভূমির টান বোধ করি তখন শিথিল হয়ে এসেছে।
ওনার টান শিথিল হয়ে আসলেও আমাদের টান কিন্তু বেড়েই চলেছে। লেখকের এই নানা বিচিত্র শখ নিয়ে নানা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। সত্যিতো শরদিন্দুর কোনো চরিত্রই স্রষ্টার এই গুনটিকে উত্তরাধিকারীর মতো বহন করেননি। কেন করেননি ? সঠিক উত্তর পাওয়া খুব মুশকিল। হয়ত বা স্রষ্টার খেয়াল। স্রষ্টার এই খেয়াল, এই শখ আমাদের হাত ধরে নিয়ে যায় অচেনা এক জগতে। সেখানেইতো শুরু হয় শরদিন্দুর না বলা গল্পের অজানা উপাখ্যান, যা কল্পনায় লেখা হয়ে ওখানেই হারিয়ে যায়। তাই নয় কি ?
email:galpersamay@gmail.com
ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায় on October 17, 2018
প’ড়ে অনাবিল আনন্দ পেলাম। বিষয়টাও চমৎকার। লেখকের সৃষ্ট কোনও চরিত্রে লেখককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাবলীল গদ্য।
অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায় on October 23, 2018
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক লেখায় তাঁর জ্যোতিষ বিশ্বাসের কথা আছে । তিনি ব্যোমকেশকে গাড়ি দেননি, কারণ “আমি ব্যোমকেশের কোষ্ঠি বিচার করিয়াছি । উহার ভা্গ্যে গাড়ি নাই “। ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ এবং আরও দু একটি ঐতিহাসিক লেখায় জ্যোতিষের বেশ বড় ভূমিকা আছে । লেখাটি পড়ে অনেক কিছু জানলাম । ধন্যবাদ ।
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।