লেখক শিক্ষক বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি নেই বললেই চলে । লেখকদের শিক্ষকের কথা বলছি না, বলছি এমন শিক্ষক মশাইদের কথা যাঁরা লিখতে এসেছেন আর জগতজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন এমন সংখ্যা কম হওয়ার মূল কারণ শিক্ষক সত্তার সঙ্গে লেখক সত্তার সহজাত বিরোধ। এটি যদিও বহু চর্চিত একটি বিষয় তবুও বর্তমান প্রবন্ধের আলোচিত সাহিত্যিকের জীবন শিক্ষক সত্তায় বাঁধা থাকলেও চোরাপথে লেখক সত্তার স্রোত যেন বর্হিমুখী টানে সৃষ্টি সুখের উল্লাসকে খুঁজে ফিরেছে । চিরন্তন বিরোধী ও বিপরীতমুখী দুই সত্তার সহজাত সহাবস্থান সার্থক হলে যে অনন্য সৃজন হয় তা স্বাভাবিকতার পরিপন্থী।
লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-এর ক্ষেত্রে উপরোক্ত ভাবনা একদম ঠিক। একাধারে ডাকসাইটে লেখক এবং অন্য দিকে সবচেয়ে জনপ্রিয় অধ্যাপক। নিজের অধ্যাপক সত্তাকে লেখক সত্তার সাথে এত সুন্দর জারিত করতে পেরেছিলেন যা উত্তরসূরীদের কাছে ঈর্ষণীয়। নারায়ণবাবু ছাত্র বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক সুধীর চক্রবর্তীকে একান্তভাবে বলেছিলেন- সচ্ছল ভাবে বাঁচব, পরব শৌখিন পোশাক, কিনব পছন্দসই বই, খাব গোল্ডফ্লেক সিগারেট, সে তো আর একটা কলেজে পড়ালে হবে না,তাই আর ও দু জায়গায় পার্টটাইম। এরপর সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ করতেই হয়। আর সর্বোপরি লেখালিখির চাপ তো রয়েছেই। খারাপ লাগে না। তবে পড়ার সময়টা নিয়ে টানাটানি পড়ে যায় । তবে জেনে রেখো দুটো কাজ কোনওদিন করিনি, এক পরীক্ষার জন্য নোটবই লিখিনি আর দুই টিউশনি করিনি।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে যারা দেখেছেন তারা সবাই তাঁর ধোপদুরস্ত পোশাকেই দেখেছেন। রোজই প্রায় পাঠভাঙা পোশাকে দেখেছেন। আর একটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন সুধীর চক্রবর্তী মহাশয়। বাসে বা ট্রামে কদাচিৎ চাপতেন নারায়ণবাবু। না হলে ট্যাক্সি আর কাছাকাছি হলে পদব্রজে। আর পটলডাঙ্গা টু ইউনিভার্সিটি একটা মানুষে টানা রিকশায়। ছাত্রবন্ধু নারায়ণবাবুর সাথে এসব নিয়ে গল্পগাছা হত সুধীরবাবুর। ধোপদুরস্ত হওয়ার রহস্য উন্মোচন করে নিজেই বলেছিলেন ব্যাপারটার পেছনে একটা ছক আছে। দোকান থেকে একসঙ্গে বারোটা ফিনেলের ধুতি কিনি, বারোটা আদ্দির পাঞ্জাবি অর্ডার দিয়ে বানাই, বারোটা শঙ্খমার্কা সামারকুল গেঞ্জি,বারোটা আন্ডারওয়ার আর বারোটা রুমাল। এবার সকালে উঠে এক সেট পরলাম। রাতে এসে ছেড়ে দিলাম। রোজ একটা করে ধুতি পাঞ্জাবি পরলে টেঁকে বেশি। একসঙ্গে কিনলে কিছুটা সস্তাও হয়। পরিধেয় নিয়ে বাজে সময় নষ্ট করে লাভ কী? জান, জীবন যত পোড় খায় ততই এক একটা প্যাটার্ন তৈরি হয়ে যায়। যেমন আমি কোনদিনই রঙিন বা খদ্দরের পাঞ্জাবি পরব না। প্যান্টশার্ট পরব না। নিউকাট জুতো পরব না। গোল্ডফ্লেক ছাড়া অন্য সিগারেট খাব না। সিদ্ধান্তের এই বলিষ্ঠতা বজায় ছিল সিনেমার অভিনয়ের ক্ষেত্রেও। সুধীরবাবু প্রশ্ন করেছিলেন – স্যার এত চিত্রনাট্য লিখলেন কেউ বলেননি নায়ক হতে? আসলে স্যারের রূপ সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করানোই ছিল লক্ষ্য। উত্তরে জিভ কেটে বলেছিলেন – ছিঃ লেখক কখনও অভিনেতা হতে পারে? আমি তো সংলাপ লিখি। সংলাপ আওড়াব কী করে? চিত্রনাট্য লিখতে লিখতে আমার লেখালিখিটাই পালিশ করি। আমরা অনেকেই জানি না বোধহয় ‘ঢুলি’ ছবির গান লিখে দিয়েছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। জীবনে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার এমন দৃঢ়তা মাষ্টারমশায় বলেই সামলাতে পরেছেন শেষ অবধি। টেনিদার মতন চরিত্র যে লোক লিখেছেন তার সিদ্ধান্তে অটল থাকার দৈনন্দিন মহড়াটি দেখলেন। একই দৃঢ়তা দেখেছিলাম সাহিত্যিক অমিয়ভূষণ মজুমদার এর সাহিত্য নিয়ে সিনেমা না হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করায়। কিছুতেই যেন পছন্দ করেন নি নিজের উপন্যাস আর গল্প নিয়ে সিনেমা করার বিষয়টি। আসলে একজন স্রষ্টা ব্যক্তিগত জীবনে কিছু দৃঢ়তা বোধহয় জরুরী এবং একান্তভাবেই জরুরী।
এই দৃঢ়চেতা সাহিত্যিক এর শিক্ষক সত্তার এক অনন্য উদারতার গল্প শুনিয়েছেন তাঁর একসময়ের পড়শি চিত্তরঞ্জন ঘোষ। এতে দাপুটে অধ্যাপকের ছাত্রদরদী মনের টাটকা প্রমাণ মিলে যায় – সেবার উনি( নারায়ণবাবু) হেড একজামিনার। আর আমি ওঁর অধীনস্ত পরীক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ প্রভাবশালী অধ্যাপক একটি রোল নম্বর পাঠালেন এই বলে যে এই রোল নম্বরের অধিকারীকে যেন পাশ করিয়ে দেওয়া হয়। নারায়ণবাবু ব্যাজার মুখে বললেন- খাতাখানা বার করুন তো? বার করলাম। খাতাটা একবার দেখুন তো। দেখলাম। বললেন পাশ করানো যায়? বললাম- পরীক্ষক এ খাতা খুবই ভালভাবে দেখেছেন, যথেষ্ট নম্বরও দিয়েছেন। আর দেওয়া যায় না। পঁচিশ দেওয়া হয়েছে। বললেন – মহা মুশকিল । কী যে করা যায়। নিজে খাতাটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন একটু। খানিক বাদে বললেন পঁচিশ পর্যন্ত যত খাতা আছে সব বার করুন। ওরাই বা কী দোষ করেছে। ওদের মুরুব্বি নেই। এই তো। আমিই ওদের মুরুব্বি। পঁচিশ পর্যন্ত সব পাশ করাব। এই বলে বালিশে বুক দিয়ে সব পঁচিশকে পাশ করাতে বসে গেলেন। অনেক রাত পর্যন্ত চলল সেই কাজ। বললেন পাশ যখন করাতেই হবে, অন্ততঃ কিছু প্রায়শ্চিত্ত করি। জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে, স্টুডেন্ট অ্যাট্রাকশনের শেষ কথা যে লেখক কাম অধ্যাপক তাঁর এহেন ছাত্রদরদী সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে মনোভাব যাই কাজ করুক জনসমক্ষে হিরো হওয়ার সুযোগ তো ছিল না। কারণ এ ঘটনা বাইরে রটবে না। তবু এমন সিদ্ধান্ত নিলেন স্রেফ ভালবাসা থেকে। লেখকসত্তার লেখক মানুষটি বোধহয় অধ্যাপকীয় খোলস ছেড়ে এখানেই বেরিয়ে এসে অনেকটা উচুঁতে নিজেকে উঠিয়েছিলেন।
ছাত্রদরদী লেখক শিক্ষক নারায়ণবাবুর আরও গল্প ছড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে কানাচে। এরকমই কিছু গল্প শুনেছিলাম অমিতাভদার মুখে (কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত)। পরে বোধহয় এ নিয়ে তিনি লিখেওছিলেন ‘কোরক’ পত্রিকায়। অমিতাভদার কথায় – ছাত্র ফেডারেশন করা আমাদের সময়ের ছাত্ররা মতাদর্শগত মিল থাকায় বামপন্থায় বিশ্বাসী মাষ্টারমশাই-এর পক্ষপাতিত্ব পেতাম প্রচুর। এছাড়া আমার মতন এই জাতীয় কেউ কেউ লেখালিখি করলে তিনি তাদের প্রায় বাগানের মালির মতন আগলে রাখতেন। একবার বি.এ. পরীক্ষার টেষ্ট এর পর ডিসকলেজিয়েট হওয়ায় অগতির গতি নারায়ণবাবুকে ধরতে হল। সব শুনে বললেন – যাও গোবিন্দর দোকান থেকে একশো বিশ বাবা জর্দা দিয়ে দুটি পান নিয়ে এসো। তারপর পানাসক্ত নারায়ন বাবু আমাকে হাত ধরে কলেজ অফিসে নিয়ে গিয়ে কলেজিয়েট বানিয়ে ছেড়েছিলেন। অমিতাভদার মুখেই শুনেছিলাম নাটকে একবার নাকি তাঁকে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল। সেই নাটক হল ‘ভাড়াটে চাই’, তবে সেই নাটকে হাসির ডায়ালগ বলার আগেই চোখ কাঁপিয়ে নিজেই হেসে ফেলতেন। অভিনয় অনেকটা ঠিক হলেও এটাই ছিল ত্রুটি।
তবে ‘স্টুডেন্ট সেভার নারায়ণবাবুর আরেকটি মজার গল্প শুনিয়েছিলেন অমিতাভদা। ১৯৫৭ সাল। বরানগর বিধানসভা নির্বাচনে জ্যোতি বসু দাড়িয়েছেন। তখন ওই অঞ্চলের অফিস সেক্রেটারি অমিতাভদা। লেখাপড়া শিকেয় উঠল। এম.এ না দিয়ে মাস্টারি নিয়ে চলে গেলেন হাওড়ার পানিত্রাসে। পরের বছর এসে দেখেন যা তা অবস্থা। ক্লাস থেকে নাম কাটাননি। বকেয়া মাইনে হিসেবে প্রচুর টাকা নিতে হবে। ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে গেলেন। ইউনিয়ন নেতা জানালেন যে মেরেকেটে সতেরো টাকা দিতে পারবেন। বিষয়টা জানতে পেরে নারায়ণবাবু আমাকে নিয়ে গেলেন রেজিস্ট্রার গোলাপ রায়চৌধুরীর কাছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বকেয়া মাইনে দুশো আটাত্তর টাকা নেমে এল আঠাশ টাকায়। ইউনিয়ন নয়। ওই ছোটো অঙ্কের টাকাটা মাস্টার মশাই পকেট থেকে দিয়েছিলেন। আজকের দিনের টিউশন প্রেমী জনপ্রিয় শিক্ষকরা এই পদ্ধতিকে কতটা আমল দেবেন জানা নেই।
এমন ছাত্রপ্রীতি যে শিক্ষকের তার পোষ্যপ্রীতিও ঈর্ষনীয়। পুত্র অরিজিৎ সহ পড়শিরা মেনেও নিয়েছেন সেই পোষ্যপ্রীতির কথা। কেষ্ট নামের একটি বেড়াল ছিল নারায়ণবাবুর খুব আদরের। তার নানা গুনের বর্ণনা নানা প্রতিবেশীর কাছে করেছেন। শোনা যায় কেষ্টও নাকি তার প্রভুর পরম ভক্তও ছিল। তবে পুত্রের কথা অনুযায়ী নারায়ণবাবুর এই বেড়াল প্রীতির পেছনে রাজশেখর বসুর প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল। নানা অঞ্চল থেকে কাদামাখা বেড়াল সংগ্রহ করে আনার শখ ছিল নারায়নবাবুর ছেলের। মায়ের কাছে বকাঝকা খাওয়ার ভয়ে পুত্রটি পিতার বুদ্ধিতেই ছাদের ঘরে ইঁট দিয়ে ঘর বানিয়ে তাদের আশ্রয় দিতেন সাময়িকভাবে । পরে নারায়ণবাবুর উপস্থিতিতে বিকালে তাদের পরিচর্যা ও আশ্রয়দানের কাজ শুরু হত। এভাবে নাকি এক বিশাল বেড়াল বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন নারায়ণবাবু যাদের মাঝেমাঝেই পংক্তিভোজন করাতেন স্ত্রীর আপত্তি উপেক্ষা করেই। তিনি যখন খেতে বসতেন তখন পায়ের কাছে নাকি বেড়ালেরা ভিড় করে থাকত। ভাবা যায়, টেনিদার বেড়াল প্রতিপালনের শখ ছিল?
টেনিদার আতিথেয়তাও নাকি ছিল সীমাহীন । তাঁর পছন্দসই মানুষ যদি সাহিত্যিক হন তবে কথাই নেই। এ নিয়ে ভারি মজার একটি গল্প শুনিয়েছিলেন টেনিদা পুত্র অরিজিৎ – ছোটবেলায় প্রায়ই দেখতাম এক মলিন ধুতি পরা ভদ্রলোক আমাদের পটলডাঙার বাড়িতে আসতেন। সেই সহজ – সরল সাধাসিধে মানুষটিকে দেখলে বাবা ভীষণ খুশি হতেন। একদিনের ঘটনা মনে আছে। সকাল ১১টা – ১২টা নাগাদ তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছেন। বাবা বললেন দাদা হঠাৎ কি মনে করে ? ভদ্রলোক বললেন এই তো পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম একটু দেখা করে যাই। আধঘন্টা গল্প গুজব করব। পরের ট্রেনেই ফিরতে হবে। মা ভদ্রলোকের গলা শুনে এসে বললেন – এসেছেন যখন দুপুরে না খেয়ে কিন্তু যাবেন না। উনি স্মিত হেসে বললেন- ঠিক আছে, বলছেন যখন – ভাল করে রান্না করুন খেয়ে যাব। বাবা বাজারে গিয়ে ইলিশ মাছ কিনে আনলেন। দুপুরে খাওয়াদাওয়া সহ মজলিশি আড্ডা হল। উনি সম্মোহিতের মতন বন-জঙ্গল, জ্যোৎস্না রাতের পাহাড়, নির্জন টিলা, বিহারের প্রাকৃতিক শোভার নানা গল্প অদ্ভুত সুন্দর করে বর্ণনা করে চলেছেন। গল্পে গল্পে কখন যে বিকেল চারটে বেজে গেছে ভদ্রলোক খেয়াল করেননি, উনি হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন – সেকি এত বেলা হয়ে গেল – এবার যেতেই হবে – আধঘন্টা ভেবে এসেছিলাম – এতক্ষণ কেটেগেল। মা বললেন – দাদা চা বানিয়েছি খেয়ে যান। ভদ্রলোক চা না খেয়েই চলে গেলেন। বাবা মাকে জিজ্ঞাসা জেনেছিলাম ইনি লেখক বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভূতিবাবুকে বাবা নিজের বড় ভাইয়ের মতন শ্রদ্ধা করতেন। লেখক শিক্ষকদের আরেকটি সমস্যার মুখে প্রায়ই পড়তে হয়। পরবর্তীকালের অনুজ ছাত্র অথবা অনুজ লেখকের কঠিন প্রশ্ন অথবা প্রস্তাবের মুখোমুখি হওয়া। এমনই একটি ঘটনার সাক্ষী লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একবার একটি কবিতাপাঠ আসরে যাচ্ছিলেন তাঁর স্যার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে সঙ্গে করে। দীর্ঘ পঞ্চাশ মিনিটের যাত্রায় জাত ধূমপায়ী সুনীলবাবু গাড়ির সামনের সিটে বসে ছটফট করতে করতে অবশেষে উপায়ন্তর না দেখে বলেই ফেললেন- স্যার, আমি একটু সিগারেট খাবো? নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় হেসে বললেন নিশ্চয়ই। তোমার ষোল বছর বয়স হয়ে গেছে অনেকদিন। এখন আর ওসব কি ! ছেলেবালায় আমার একজন মাস্টারমশাই ছিলেন, তাঁর সামনেও আমি সিগারেট খেতাম। প্রথম প্রথম মাস্টারমশাইকে ঘরে বসিয়ে আমি বার বার উঠে বাইরে যেতাম। বাইরে দাঁড়িয়ে হুসহাস করে সিগারেট টেনে আসতাম। মাস্টারমশাই একদিন বললেন, তুই এত ঘনঘন বাইরে যাস কেন রে? তোর কাছে সিগারেট আছে? দে তো আমাকে একটা। আমার সেই গুরুকে আমি এখনও দারুন শ্রদ্ধা করি। অনুমতি দাতা ও লেখকের শ্রদ্ধা আদায়ের কায়দাও যে গুরু শিষ্য পরম্পরায় রপ্ত করতে হয় তা তো লেখকসত্তা নয় শিক্ষকসত্তায় নিহিত থাকে ।
অনেকেই জানেন না টেনিদার স্রষ্ঠার প্রথম সাহিত্যসৃষ্টি হল কবিতা। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁর স্বরচিত কবিতা তিনি গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ড করে যান। কবিতা আবৃত্তি করতে ভালবাসতেন। নাট্যাভিনয়ের প্রতি ঝোঁকও ছিল। একটি শ্রুতিনাটকও সাহিত্যিক বন্ধুদের সঙ্গে রেকর্ড করেছিলেন গ্রামাফোন কোম্পানিতে। নাটকটির নাম ছিল ‘মাইকেল মধুসূদন’, এই নাটকে নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথের ‘বৈকুন্ঠের খাতায়’ তিনকড়ির ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল নারায়ণবাবুকে।
ওনার বেশ কয়েকটি গ্রন্থ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিতও হয়েছিল। ‘উপনিবেশ’ উপন্যাসটি হিন্দিতে অনুদিত হয়েছিল, মালায়ালাম ভাষায় আর একটি উপন্যাসও অনুবাদ হয়েছিল বলে শোনা যায়। চেক ভাষায় অনুদিত হয়েছিল ‘মেঘের উপর প্রাসাদ’। স্রেফ বামপন্থী মনোভাবাপন্ন হওয়ার জন্য সাহিত্য একাডেমী পুরস্কারের তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ গিয়েছিল এমন অভিযোগ রয়েছে তাঁর পুত্রের।
এমন সুবিশাল যার সাহিত্যসৃষ্টির সম্ভার তাঁকেও নাম সমস্যায় ভুগতে হয়েছে প্রথম জীবনে। আসল নাম তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ছদ্মনামে নারায়ণ হয়ে ওঠায় কলেজ জীবনে অধ্যাপক হেরম্ব চক্রবর্তীর সন্দেহের তালিকায় পড়েন একটি কবিতাকে কেন্দ্র করে। সে কাহিনী দারুন মজার।
সালটা ১৯৩৭। কলেজ ম্যাগাজিনে লেখা নির্বাচনের ভার অধ্যাপক হেরম্ব চক্রবর্তীর ওপর। কলেজের সেই কমিটিতে ছিলেন স্বয়ং কবি জীবনান্দ দাশও। কিন্তু তাকে বেশি পাওয়া যেত না বলে হেরম্ববাবুই সব কিছুর দেখভাল করতেন। তিনি উদীয়মান প্রতিভাকে স্বাগত জানান সর্বাগ্রে। এটা তার স্বভাবও বটে। একটি কবিতা জমা দিয়েছেন কলেজের ছাত্র তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। কবিতার ছাঁচ এবং ধাঁচা বেশ চেনা চেনা ঠেকছিল। বাড়ি গিয়ে নানা পত্রপত্রিকা ঘেঁটে হেরম্ববাবু বের করলেন ‘দেশ’ পত্রিকা থেকে একই কবিতা। পরদিন কলেজে ডাক পড়ল তারকনাথের। টুকটাক কথা বার্তায় জানা গেল ফরিদপুর থেকে সেবছরই এই কলেজে ভর্তি হয়েছে তারকনাথ। ফলে আগে তার সাথে ওনার পরিচয় হয়নি। প্রিয় কবিদের নাম বলতে বললেন। নাম যা বলল তাতেও মুদ্রিত কবিতার কবির নাম এল না। এবার সরাসরি ‘দেশ’ পত্রিকার মুদ্রিত কবিতাটি মেলে ধরলেন হেরম্ববাবু। কঠিন গলায় বললেন- পড়ে দেখ। একই কবিতা টুকে জমা দিয়েছ। কবিতাটির দিকে তাকালেন তারকনাথ। চেনা কবিতা। কবির নাম রয়েছে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। ভীরু চোখ দুটি এবার অধ্যাপকের দিকে টেনে তারকনাথ বললেন- এই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এর কবিতা আপনি পড়েন, স্যার ? হেরম্ববাবু বললেন – খুব পড়ি। তরুণ হলেও বলিষ্ঠ ও সম্ভাবনাময়। খুশিতে নুয়ে পড়ল তারকনাথ। প্রণাম করে বললেন আশীর্বাদ করুন স্যার। আপনার আশা যেন সফল হয়। হেরম্ববাবু অবাক। এই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সুখ্যাতিতে এর খুশি হওয়ার কারণ কী? এবার ছেলেটি হেসে বলল তারক আমার কলেজের নাম স্যার। আমিই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। ওই নামেই কবিতা ‘দেশ’-এ পাঠানোয় ওরা ছাপিয়েছে। যদিও পরবর্তীকালে নারায়ণের আড়ালেই চলে যায় তারকনাথের যাবতীয় সাফল্য – খ্যাতি – সম্মান।
একই মজার গল্প আছে তার শেষ কীর্তি সুনন্দর জার্নাল নিয়ে। দুটি গল্পেরই উৎস কিশলয় ঠাকুরের স্মৃতিচারণা। কিশলয়বাবু ‘দেশ’ সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কাছে শুনেছিলেন ‘সুনন্দ’ কাহিনীর গল্প। ‘সুনন্দ’ ছদ্মনাম গোপন রাখবার জন্য উভয়ের মধ্যে (সাগরময় ঘোষ ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে) গোপন একটি চুক্তি হয়। পাছে অফিস থেকে প্রকাশ হয়ে পড়ে তাই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় অন্যকে দিয়ে কপি করিয়ে পাঠাতেন। নিজে কখনও কপি দিতেও আসতেন না। সাগরময় অবাঙালি পিওন পাঠিয়ে আনিয়ে নিতেন লেখা। অবশ্য শেষের দিকে একটি অসতর্ক রচনায় ধরা পড়ে যান তিনি। সেবার বৈঠকখানা রোডের এক হাঙ্গামায় বই বাঁধাই পাড়ায় বহু লেখকের বই নষ্ট হয়ে যায়। লেখক প্রকাশকদের প্রচুর ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্থ হলেন তিনিও। বৈঠকখানার লাগোয়া তাঁর ঠিকানা। ঘটনাটা সম্পর্কে পরের ‘দেশ’ পত্রিকায় সুন্দর জার্নাল এ এমন অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেন যে অভিজ্ঞ পাঠক এবং যারা তাঁর ঠিকানা জানতেন, তারা ধরে ফেললেন। ছিন্ন হল নারায়ণের সুনন্দ ছদ্মবেশ।
মৃত্যুর আগে কি দেহের ছদ্মবেশ ছাড়ার বার্তা আসে ? নাকি অসুস্থ শরীরে মৃত্যুর আগমন তিনি টের পেয়েছিলেন? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণা সেই ইঙ্গিতই দেয়। শেষ কিস্তি সুনন্দর জার্নাল পড়ে চমকে গিয়েছিলেন স্বয়ং সুনীল। রচনাটি আগাগোড়া হাহাকারের মতন। নিজের মৃত্যুচিন্তাও ছিল খুব। এক জায়গায় লিখেছিলেন আপাতত এই মুহূর্তে বুক ভাঙা আর্তনাদে আমার গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে- আমি জনমের শেষ ডাকি গো মা তোরে ইত্যাদি। আবার এক জায়গায় লিখেছেন – পরের সংখ্যা ‘দেশ’-এ যদি সুনন্দর জার্নাল এর পাতা অদৃশ্য হয় আশা করি তাহলে আপনারা কেউ বিস্মিত হবেন না।
আসলে নারায়ণ গাঙ্গুলীর শেষ দিনের সাক্ষী স্বয়ং সুনীল গাঙ্গুলী। যেদিন রাতে সেরিব্রাল অ্যাটাক হয় ঐদিন সকালে মনীন্দ্র রায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সন্তোষ সেনগুপ্তদের সঙ্গে একই গাড়িতে একটি অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠে যান সুনীল ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। বহুদিন বাদে স্যারকে দেখতে পেয়ে ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞাসা করেন সুনীল। উত্তরে জানান – ‘হ্যাঁ। এখন ভালো আছি। রাণীক্ষেত ও নৈনিতাল-এর দিকে পুজোর সময় ঘুরতে গিয়ে নানা অসুবিধার কথা সেদিনের পঞ্চাশ মিনিটের আলাপচারিতায় জানিয়ে বলেছিলেন একটু ফ্লু-র মতন হয়েছিল। কিন্তু এখন ভালো আছি। এই ‘ভালো আছি’ কথাটার ওপর জোর দিয়েছিলেন এটা স্পষ্ট মনে ছিল সুনীলবাবুর। সেই জোর যে সেদিন রাত্রেই নষ্ট হয়ে যাবে তা বুঝতে কয়েকঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল সুনীলকে। তাই সুনীল লিখেছিলেন মৃত্যুকে অনুভব করেছিলেন অবচেতনভাবে। কিন্তু তিনি হার মানতে চাননি। মৃত্যুকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আর জোর দিয়ে বলেছিলেন ‘ভালো আছি’।
বিদগ্ধ পন্ডিতবর্গ আমার বক্তব্য পড়ে নাক কোঁচকাবেন কিন্তু বারবারই মনে হয় – টেনিদার নির্মল আনন্দ সৃষ্টি আড়ালে নিজের গভীর যন্ত্রণার একটা প্রেরণা সবসময় কাজ করেছে। মেনে নিতে পারেন নি অনেক কিছুই। যেমন সম্পর্কচ্যুতি মেনে নিতে পারেননি তার প্রথমা পত্নী রেণু দেবী। ৯ই নভেম্বর ১৯৭০ তার স্মৃতিচারণার একটু পড়লে পরিষ্কার হবে অনেকটা-
বেলা ২টো নাগাদ ছোটমামাকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম কেওড়াতলা। দেখলাম অগণিত নরনারী, ছাত্র-ছাত্রীর ভিড়, সবাই ব্যস্ত, ট্রাক কখন আসবে। একপাশে আমিও দাঁড়িয়ে আছি। শূণ্য বুকে। …… এই তো শেষ দেখা, শেষবারের মতন স্বামীকে দেখব…
একটা প্রাণহীন দেহের প্রতীক্ষায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি। সমস্ত দেহমন যেন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। এমন সময় বেলা ৪টে নাগাদ পুস্পসজ্জিত একটি ট্রাক এসে ঢুকলো শ্মশানের মধ্যে। কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না। গৌরবাবুর (ঘোষ) স্ত্রী ইলাদি আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন এবং শবদেহের পায়ের কাছে আমাকে বসিয়ে দিলেন। একবারের মতন চেয়ে দেখলাম সেই মানুষ, যে মানুষ একদিন সম্পূর্ণ আমার ছিল। সেই মানুষ কতদূরে সরে গেছে। এবারে আরও দূরে। সামান্য সময় মাত্র চেয়ে দেখলাম। …… আর তাকাতে পারলাম না। পায়ের কাছে মাথা রেখে এই প্রার্থনাই জানিয়ে এলাম যদি পরজন্মে মানুষ হই, তবে যেন তোমাকেই স্বামী হিসেবে পাই। তুমি যতই দুঃখ দাও সব সহ্য করে যাব। … আর কোন অভিমান নেই আমার। আজ আমার সব শেষ হয়ে গেল।
ভেতরে ভেতরে ভালো বোধহয় ছিলেন না নারায়ণবাবু। ক্ষয়ের একটা স্রোত বোধহয় নিজেই গড়ে তুলেছিলেন আশা দেবীকে বিবাহের পর থেকে। আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় নারায়ণ বাবুর বাইরের হাসিখুশি উজ্জ্বল আস্তরণের অন্তরালে এক বিষন্ন, প্রায় পরাহত একটি মানুষ লুকিয়ে আছেন।
জনপ্রিয়তার শিখরে থাকা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ভেতরে ভেতরে বোধ হয় নিঃসঙ্গ হয়েছিলেন খুব। অন্ততঃ তার ছাত্র অলোক রায় বা সরোজ দত্তদের সাথে আমি একমত। ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। আমার মনে হয় পরবর্তীকালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা সলিল চৌধুরীও এই অভ্যন্তরীণ নিঃসঙ্গতার শিকার হয়েছিলেন। একদিকে খ্যাতির দাপট অন্যদিকে নিঃসঙ্গ নিকেতন যেন একলা করছিল ক্রমশঃ। নির্জন শিখর উপন্যাসের দেবনাথ ভট্টাচার্যের মধ্যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে সন্ধান করলে হয়ত খুব অন্যায় হবে না। কিংবা হয়ত লেখক মানুষরা এমনই হন। কি জানি ?
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।