রোববারের আলসে সকাল ! হালকা শীতের মিঠে রোদটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে ! বাঙ্গালীর রোববারের আড্ডা শুরু করার জন্য একেবারে সঠিক সময় ! মুখুজ্যেদের রোয়াকে বসে সবে ল্যেস-এর প্যাকেটটা খুলেছি, আমেরিকান সল্টেড চিপসটা খেতে শুরু করবো, এমন সময় পাশের গলি থেকে একটা লোক বেরিয়ে এলো ! দেখলে বছর পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ মনে হয়, রগের পাশে দু-একটা চুলে একটু রং ধরেছে, পাকানো চেহারা, গন্ডারের মতো খাড়া নাক, ভালো করে তাকিয়েই মনে হলো কোথায় যেন দেখেছি এই চেহারা ! এইটুকু ভাবতে ভাবতেই লোকটা আমার একেবারে কাছে চলে এসে একটু খান্ডার খান্ডার গলায় বললো, ‘এখানে একটু বসি ভাই !’ একটু সরে গিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, বসুন না !’ নাহ, গলার আওয়াজটা যেমনই হোক, কথার ভঙ্গিটা তো ঠিকই আছে ! লোকটা থ্যাঙ্কু বলে পাশে বসেই বললো, ‘আসলে অনেক বছরের অব্যেস তো এখানে বসার, তাই ছাড়তে পারি না !’ বলেই আমার দিকে চেয়ে দাঁত বার করে হাসলো ! সেই দাঁত দেখেই আবার আমার একটা খটকা লাগলো, এই দাঁতের ধরন যেন চেনা চেনা…..আরে, কোথায় যেন কে বলেছিলো ওই দাঁত দেখলেই মনে হবে এক্ষুনি কামড়ে দেবে !
দাঁতের কথাটা কেউ বলেছিলো, না কোথায় পড়েছিলাম এইরকম সব ভাবছি এমন সময় লোকটা আবার বললো, ‘এই ল্যেস-এর ব্যাপার-স্যাপার গুলো বেশ ভালো, কি বলো ! আমাদের কালে এগুলো আবার কলকাতায় পাওয়া যেত না, ওই আলু-কাবলি আর ডালমুট-ই সার !’ বলেই কেমন যেন জুলজুল করে তাকিয়ে রইলো আমার হাতের চিপস-এর প্যাকেট-টার দিকে ! ভদ্রতার খাতিরে বলতেই হলো, ‘হ্যাঁ এদের এই আমেরিকান সল্টেড-এর স্বাদটা খুব ভালো লাগে আমার, একটু টেস্ট করে দেখবেন নাকি ?’ এইটুকু বলতেই ‘তুমি যখন এতো করে বলছো’ বলেই প্রায় ছোঁ মেরেই প্যাকেটটা আমার হাত থেকে নিয়ে লোকটা একেবারে চার-পাঁচটা চিপস মুখের মধ্যে চালান করে দিলো ! হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠে বললাম, ‘আপনি বললেন এই রোয়াকে বসা আপনার অনেক দিনের অব্যেস, আপনি কি এখানেই থাকেন ? মানে, আগে তো আপনাকে পাড়ায় কখনো দেখিনি !’ প্রায় চোখ বুঁজে চিপস চিবোতে চিবোতে লোকটা বললো, বিলক্ষণ থাকি, ওই তো গলির মধ্যে হলদে বাড়ির দোতলায়, ২০ নম্বর পটলডাঙ্গা স্ট্রিট !’ আমি একটু থতিয়ে গিয়ে বললাম, ‘ কুড়ি নম্বর ! কিন্তু ২০ নম্বরের দোতলায় তো ছোড়দাদুর বন্ধু….’ ! আমার মুখের থেকে কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে লোকটা বললো ‘আমার নাম ভজহরি মুখুজ্জ্যে, ওটা পোশাকী নাম, এই বাংলাদেশে ওই নামে আমাকে খুব কম লোকেই চিনতে পারে, তুমিও বোধহয় পারবে না ! আমার ডাক নামটা হচ্ছে টেনি….তোমার বয়সী ছেলেমেয়েরা সেকালে আমাকে এই নামেই চিনতো !’
লোকটার কথা শুনে চমকে উঠলাম, আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে কান প্রায় কানপুরে চলে যাবার জোগাড় , এসব কি হচ্ছে, আজ রোববারের সকালে স্বয়ং টেনিদা……চারমূর্তি-র টেনিদা…. আমার সামনে উপস্থিত ! তাই-ই ভদ্রলোককে আমার কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিলো, ছোড়দাদুর লেখা সব গল্পগুলো-ই বারবার পড়ে মনের মধ্যে টেনিদার চেহারাটার ছবি তো একেবারে গেঁথে রয়েছে ! আমি একটু উত্তেজিত গলায় বললাম, আ-আপনি টেনিদা ! মানে তাহলে তো আপনি আমার ছোড়দাদুকে চিনতেই পারবেন….আপনার একনিষ্ঠ চেলা….আপনাদের চারমূর্তির একজন…. আমার ছোড়দাদুর নাম কমলেশ ব্যানার্জি !’ টেনিদা খাড়া নাকটা একটু আকাশের দিকে তুলে বললেন, ‘কমলেশ ব্যানার্জি …..কমলেশ…..কম….ওঃ কমলেশ মানে তো প্যালা….তাই বলো……তো তাহলে তুমি আমাদের প্যালারামের নাতি ! তা তুমিও কি দাদুর মতো পটোল দিয়ে শিঙি মাছের ঝোল খেয়ে পালাজ্বর আর পিলে ম্যানেজ করছো ?’ বলেই টেনিদা বাজখাঁই গলায় খ্যা খ্যা করে একটু হেসে আরও দুটো চিপস মুখে পুরে দিলেন ! আমি এখন যারপরনাই উত্তেজিত, ঠাট্টাটা একেবারে গায়ে না মেখে বললাম,’আমার দিন আজ কিভাবে শুরু হলো কি যে বলবো আপনাকে ! আপনি টেনিদা, থুড়ি টেনিদাদু, স্বয়ং আমার পাশে বসে আমার সঙ্গে কথা বলছেন ! এতদিন এ পাড়াতে আছি কিন্তু একদিনও আপনাকে চোখের দেখাও দেখতে পাইনি !’ টেনিদা ল্যেস-এর প্যাকেটের শেষ চিপস-এর গুঁড়োগুলো মুখের মধ্যে চালান করে দিয়ে প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘সে তুমি আমাকে টেনিদা-ই বোলো, ছেলেবুড়ো আমাকে সে নামেই ডাকে। ও ডাকটাই আমার পছন্দ ! তুমি যে আমাকে এতদিন দেখতে পাওনি সে কথাটা ঠিক ! আমাকে তো সবাই দেখতে পায়না……মানে আমি-ই দেখা দিই না ! আমার তো মহাপুরুষের স্টেটাস…তাই যারা আমার ভক্ত তারাই কেবল আমার দেখা পায় ! আজ আমার জন্য তুমি হচ্ছো সেরকম একজন !’ টেনিদা রোয়াকের ওপর পা মুড়ে বেশ জম্পেশ করে বাবু হয়ে বসলেন !
টেনিদার এসব বড়ো বড়ো কথা এখন মাথায় আমার ঢুকছে না ! আমি বললাম, ‘ছোড়দাদুর লেখা আপনাদের চারমূর্তির সব গল্প-উপন্যাসগুলো আমার বারবার করে পড়া !’ টেনিদা মুখ ভেটকে বলে উঠলেন,’ ধুর ওই পেটরোগা প্যালা….. তোমার কি যেন হচ্ছে….হ্যাঁ ছোড়দাদু …সে লিখবে আমাদের গপ্পো ! সব নাম-ভাঁড়ানো কেস ! আমার কাছে শুনে রাখো, ওই স-অ-ব গপ্পোগুলো লিখেছে তোমাদের নারান গাঙ্গুলী ! ওই তো, কুড়ি নম্বর পটলডাঙ্গা স্ট্রিটের আমার বাড়ীটার দোতলায়-ই থাকতেন……আমার-ই তো ভাড়াটে ছিলেন ! আরে, নাম বদল করে দিতে ওনার জুড়ি নেই ! এই দ্যাখোনা এই যে ১৮ নম্বর বাড়ির মুখুজ্জ্যেদের রোয়াক, যেখানে আমরা এখন বসে আছি, আমাদের গল্পে সেটাকে চাটুজ্জ্যেদের রোয়াক করে ছেড়েছেন ! তারপর আমার নামটাও বদল করেছেন…..আমার আসল নামটা নাহয় নাই-ই বললাম !’ আমি বললাম, ‘নাম বদলে দিতেন !’ টেনিদা বললেন, ‘তবে আর বলছি কি ! যে মানুষ নিজের পিতৃদত্ত নাম বদল করে নিয়েছিলেন তাঁর কাছে এটা এমন কি ব্যাপার !’ আমি বললাম, ‘কেন…..নারায়ণ গাঙ্গুলী ওর আসল নাম নয় ?’ টেনিদা বললেন, ‘না-আ তো ! কলকাতা য়ুনিভার্সিটি-তে পড়াতেন তো…..সেখানকার খাতায় খোঁজ নিয়ে দেখো, দেখবে লেখা আছে টি এন জি….তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়…..ওটাই ওঁর আসল নাম ! আর ছোটবয়সে বাড়ীতে ডাকনাম কি ছিল জানো…..নাড়ু…..হা হা হা !’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এসব তো কিছুই জানতাম না ! কলকাতা ইউনিভার্সিটি-তে পড়াতেন…..কি পড়াতেন….বাংলা ?’ টেনিদা বললেন, ‘পড়াতেন মানে ! ডাকসাইটে মাস্টার ছিলেন বাংলাসাহিত্যের, ভালো বাংলায় যাকে বলে একেবারে পুঁদিচ্চেরি প্রফেসর ! প্রথমে পড়াতেন জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজে, তারপর কলকাতায় সিটি কলেজে আর সবশেষে কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে ! আরে ভাই, উনি যখন ক্লাসে পড়াতেন আশপাশের সব ক্লাস বন্ধ হয়ে যেত……ছাত্রছাত্রীরা খবর নিয়ে কাছাকাছির কলেজ থেকে আশুতোষ বিল্ডিং-এ চলে আসতো টি এন জির লেকচার শুনতে…বোঝো ব্যাপার !’
গালে হাত দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনিদার কথা শুনে যাচ্ছি ! বললাম,’তারপর…..অন্য কলেজের সব স্টুডেন্ট ভিড় করতো ওঁর লেকচার শুনতে…এতো এখন ভাবাই যায় না !’ টেনিদা বলে চললেন, ‘তবে আর বলছি কি ! একবার কি হয়েছে শোনো…..ওঁর ক্লাসের সময় ইউনিভার্সিটির লেকচার হলে ছাত্রছাত্রীদের এতো ভিড় হয়েছিল যে বহু স্টুডেন্ট বসবার জায়গা না পেয়ে একঘন্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নোট নিয়েছিল, খাতা এ ওর পিঠে রেখে …..সে প্রায় খবরের কাগজে বেরোবার মতো ব্যাপার ! আর ওঁর স্টুডেন্টরাও পরে তৈরী হলো সেরকম, তোমাদের সৌমিত্র চাটুজ্যে, সুনীল গাঙ্গুলী, সমরেশ মজুমদার, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, অমিতাভ দাশগুপ্ত, নির্মাল্য আচার্য্য, উজ্জ্বল মজুমদার, সুধীর চক্রবর্তী, গৌরমোহন বাঁড়ুজ্জে, কত নাম করবো !’ আমি বললাম, ‘পড়াশোনায় নিশ্চয়ই খুব ভালো ছিলেন !’ টেনিদা বললেন,’সে আর বলতে ! এ কি এই টেনি শর্মা…….ম্যাট্রিকে তিন তিনবার ফেল ! নারান গাঙ্গুলী ম্যাট্রিক পাশ করলেন ৮৪% নম্বর নিয়ে দিনাজপুরের জেলা স্কুল থেকে ১৯৩৩ সালে ! ঐ জেলার-ই বালিয়াডিঙ্গি গ্রামে জন্ম তো ! কিন্তু তারপরেই ঘটলো যত গন্ডগোল ! ব্রিটিশ পুলিশের দারোগা বাবা প্রমথনাথের ছেলে তারকনাথ ব্রিটিশ সরকারের চোখে রেভোলুশ্যনারি সাস্পেক্ট হয়ে ইন্টার্ন হয়ে গেলেন ! কলেজের পড়াশোনায় ছেদ পড়তে লাগল ! যা হোক করে নন-কলিজিয়েট স্টুডেন্ট হয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলেন বরিশালের বি এম কলেজ থেকে ! ওখানে ওঁর একজন মাস্টারমশাই কে ছিলেন শুনবে ? জীবনানন্দ দাশ ! তারপর ডিস্টিংশন নিয়ে গ্রাজুয়েট হলেন ওই কলেজ থেকেই ১৯৩৬-এ ! আবার পড়াশোনায় বাধা ! শেষমেশ কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৪১-এ বাংলায় এম এ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, রেকর্ড-ভাঙা মার্কস, ব্রহ্মময়ী সোনার মেডেল ! বাংলা ছোটগল্পের ওপর রিসার্চ করে ১৯৬০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি ফিল ! বড়ো লাজুক ছিলেন হে……নামের আগে ডক্টরেটটা কোনোদিন লিখতে পারেননি !’
আমি একমনে শুনে যাচ্ছি ! টেনিদা থামতেই বললাম, ‘টেনিদা, ওই যে আপনি রেভোলুশ্যনারি সাস্পেক্ট হয়ে ইন্টার্ন হওয়ার কথা বললেন…..সেটা হলো কি করে !’ টেনিদা বললেন, ‘মুক্তচিন্তার ফল হে ! দারোগা বাবার ছিল দারুন বই পড়ার নেশা, অজস্র নানারকম বই কিনে ডাকে আনাতেন, বাড়িতে একটা ছোটোখাটো লাইব্রেরী-ই গড়ে উঠেছিল ! আর সেইসব নানা বিষয়ের বই কিশোর বয়স থেকেই পড়তেন তারকনাথ……একটা সাহিত্যপ্রিয় মানসিকতা গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক স্বদেশী চেতনাও জাগছিল, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র আর নজরুলের লেখা পড়ে, আর বামপন্থী ভাবধারার প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিল তাঁর মন ! মনে হয় দাদা শেখরনাথও তাতে ইন্ধন জুগিয়ে ছিলেন কিছুটা ! এই সবই তাঁর কথায় কাজে কিছুটা প্রকাশ পাচ্ছিলো আর কি ! মানসিকভাবে আজীবন বামপন্থী ছিলেন, যদিও পথে বেরোনোর রাজনীতি কোনোদিন-ই করেননি !’ আমি বললাম, ‘তাই তো….আজকালকার অধ্যাপকদের সঙ্গে কত তফাৎ !’ টেনিদা বললেন, ‘ শোনো….কিরকম মাপের ছাত্রপ্রিয় মাস্টারমশাই ছিলেন টি এন জি, সেটা তো তুমি তাপস ভৌমিকের সম্পাদনায় ‘মাষ্টারমশাই’ বইটা, যেটা সম্প্রতি কোরক থেকে বেরিয়েছে, সেটা পড়লেই জানতে পারবে……বিভিন্ন তাবড় তাবড় ছাত্রের স্মৃতিচারণ থেকে ! জানতে পারবে নারান গাঙ্গুলীর কিংবদন্তী হয়ে যাওয়া স্মৃতিশক্তির কথা……এক কবি তাঁর প্রকাশিত কবিতার কপি হারিয়ে ফেলেছেন…..টি এন জি স্মৃতি থেকে সেই কবিতা বলে যাচ্ছেন আর কবি সেটা টুকে নিচ্ছেন……ভাবা যায় ! আরও শোনো ! তোমাকে যদি আমার…এই টেনি শর্মার জন্মদাতা মানুষটির যাবতীয় সাহিত্যিক কীর্তিকাহিনীর কথা শোনাই তাহলে তো একেবারে তাজ্জব হয়ে যাবে !’ আমি উদগ্রীব হয়ে বললাম, ‘ সেটা কিরকম, টেনিদা !’
টেনিদা বলতে শুরু করলেন, ‘সাহিত্যচর্চা শুরু করেছেন তো একেবারে চোদ্দ পনেরো বছর বয়েস থেকেই ! প্রথমে ছোটদের জন্য কবিতা লিখে পুরস্কার ! তারপর বড়োদের জন্য আরও কবিতা আর গল্প লেখা শুরু, সেই কিশোর বয়সেই ! সতেরো আঠারো বছর বয়সেই লেখা ছাপা হতে লাগলো বিখ্যাত সব পত্রিকায়….দেশ, বিচিত্রা, শনিবারের চিঠি ! তারপর একদিন বিশু মুখুজ্যে…ওই যে যাঁর কথা সাগরময়বাবু ‘সম্পাদকের বৈঠকে’ বইতে সাতকাহন করে লিখেছেন……সেই বন্ধু বিশুবাবু এসে ধরলেন ওঁকে…..ছোটদের জন্যে লিখতে হবে ! সেই শুরু…… প্রথমে ‘মৌচাক’-এ…..তারপর ‘শিশুসাথী’-তে ধারাবাহিক ‘চারমূর্তি’-র কীর্তিকাহিনী ……ব্যাস, জন্ম হয়ে গেলো আমার…..ওঁর বন্ধু বাড়ীওয়ালা প্রভাত মুখুজ্জে নতুন রূপে অমর হয়ে গেলো বাংলা সাহিত্যে……সঙ্গে আরও তিনজন…..স-ব কিন্তু নিজের চোখে দেখা আর চেনাজানা ঘটনার সঙ্গে কল্পনার রং মিশিয়ে লিখেছেন……এমনকি ছোটবেলায় শোনা বরিশালের ভাষাটাও আমার চেলা হাবুল সেন…..মানে তোমাদের স্বর্ণেন্দু-র মুখে বসিয়ে দিয়েছেন…..’মেকুরে হুড়ুম খাইয়া হক্কইর করসে’…বোঝো একবার !’ টেনিদা দম নেওয়ার জন্যই বোধহয় থামলেন ! আমি তো নট নড়নচড়ন, একাগ্রভাবে শুনে যাচ্ছি টেনিদার কথা ! টেনিদা আবার শুরু করলেন, ‘ অধ্যাপনা আর সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি নারান গাঙ্গুলী সিনেমার জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন, কপালকুণ্ডলা,ইন্দিরা, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন……. লিখেছেন ঢুলী সিনেমার গান, অনেকগুলো মঞ্চসফল হাসির নাটক লিখেছেন…..আরে ওঁর লেখা ‘ভাড়াটে চাই’ নাটকটা তো একটা ইতিহাস হে ! আরও শোনো….বাংলা সাহিত্যে জার্নাল লেখার এক নতুন স্টাইল এনে দিয়েছিলেন দেশ পত্রিকায় মাসের পর মাস সুনন্দর জার্নাল লিখে…..যা পড়ার জন্য আপামর সাহিত্যপ্রিয় বাঙালী প্রতি সপ্তাহে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো ! ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন হে….নইলে সুনন্দর জার্নালের শেষ কিস্তিতে অসুস্থ মানুষটা কিভাবে লিখলেন যে পরের সপ্তাহে সুনন্দর জার্নালের পাতাটা যদি না থাকে তাহলে পাঠক যেন ধরে নেন আর একজন কমনম্যান বাঙালীর অবলুপ্তি ঘটলো ! শব্দদূষণের ভয়ানক পরিনাম নিয়ে লেখা এই শেষ কিস্তিটা লিখে পাঠাবার দুদিন বাদেই তোমাদের এই টেনিদার জন্মদাতা পিতা পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন !’ টেনিদার গলাটা ধরে এলো ! আমি তাকিয়ে দেখলাম টেনিদা মুখটা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন, চোখের কোণটা চিক চিক করছে !
একটু পরে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে টেনিদা আমার দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি সিগারেট খাও ? লজ্জা পেও না…বলো !’ সরাসরি প্রশ্নটায় একটু হকচকিয়ে গিয়েও বললাম, ‘হ্যাঁ..মানে বেশী কিছু নয়, মাঝে মাঝে !’ টেনিদা-র দৃষ্টি আবার দূরে আকাশের দিকে চলে গেলো, ‘পারলে ওটা ছেড়ে দিও ! আমার পিতৃদেব তো পারেননি…..সারাদিনে কত গোল্ডফ্লেক যে পুড়ে যেত….৭২ বনমালী নস্কর লেনের শিশিরের মতো ২০ পটলডাঙ্গা স্ট্রিট-এ তো কেউ ছিল না যে ধার-নেওয়া সিগারেটের হিসেব রেখে সতর্ক করবে…..এদিকে ফুসফুস আর হার্ট তো ওই অনিয়ম আর সহ্য করেনি……সেই পঞ্চাশ বছর আগে কোথায় বিধিবদ্ধ সতর্কবাণী, আর কোথায় কি ! সাহিত্যের মাঠে হেসেখেলে যার তিন সেঞ্চুরি করার কথা সেই মানুষটা বাহান্ন-তে রান আউট হয়ে গেলো ভাই !’ টেনিদার গলাটা আবার ধরে এলো ! পরিবেশটা স্বাভাবিক করার জন্য আমি বললাম,’টেনিদা, একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, করি ?’ টেনিদা মুখটা নামিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন ! আমি বললাম, ‘ছোড়দাদুর তো সব চুল একেবারে সাদা, বয়সের ছাপ এসে গেছে সারা শরীরে, এখন হায়দরাবাদ-এ মেয়ের কাছে গেছেন, কিন্তু আপনি তো একেবারে যুবক রয়েছেন….. সেই খাড়া নাক, কালো চুল আর গোরা-পেটানো সুস্থ সবল চেহারা…এটা কি করে সম্ভব হলো !’ টেনিদা এবার সেই স্বাভাবিক বাজখাঁই গলায় হেসে উঠলেন, আসনপিঁড়ি বসা অবস্থা থেকে উঠে পড়ে আমার পিঠটা একটু চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘ভায়া…টেনিদা-দের বয়স কখনো বাড়ে না……টেনিদা, ঘনাদা, ফেলুদা, ব্রজদা, ব্যোমকেশ….. এদের কখনো বয়স বাড়ে না…..বাড়তে নেই….এদের বয়স যদি বেড়ে যায় তাহলে সেই পুরোনো কালের মানুষগুলো, যারা এদের ওপর ভর করে সর্বক্ষণ তাদের কিশোর আর তরুণ বয়সে ফিরতে চায় তাদের কি হবে বলতো !’
এই পর্যন্ত বলেই টেনিদা আমার দিকে হাতটা আলতো করে নেড়ে দিয়ে পেছন ফিরে চলতে শুরু করলেন। আমি তাড়াতাড়ি রোয়াক উঠে পড়ে ওঁর সঙ্গে চলতে গেলাম ! সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে একটা শব্দ হতেই আমার ঘুম ভেঙে চোখটা খুলে গেলো ! দেখলাম বুকের ওপর খুলে রাখা ‘টেনিদা সমগ্র’ বইটা খাটের ওপর থেকে নিচে পড়ে গেছে………জানলার ফাঁক দিয়ে সকালের এক ঝলক রোদ এসে পড়েছে বইয়ের প্রচ্ছদের ওপর….মলাটের জ্যাকেটে ছাপা টেনিদার মুখটা সেই উজ্জ্বল আলোয় ঝকঝক করছে !
Tags: পিতৃতর্পন, সিদ্ধার্থ সান্যাল
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।