পৌষ ও মাঘ এই দুইমাস শীতকাল। শীতকাল উৎসবের ঋতু। আমাদের শহর জুড়িয়া মেলা বসিয়া যায়। চর্মশিল্প মেলা, হস্তশিল্প মেলা, সুখাদ্য মেলা, পুস্তক মেলা প্রভৃতির সমারোহে সকলে মাতিয়া ওঠে। ময়দানে সার্কাস আসে। শিশুরা সার্কাস দেখিতে বড় ভালোবাসে। শীত পিকনিকের ঋতুও বটে। বাস ট্রাক ম্যাটাডোর লইয়া পিকনিক পার্টির লোকেরা হৈ হৈ করিয়া দূরদূরান্তে রওনা দেয়। তাহাদের কলধ্বনি ও মাইকের আওয়াজে শীতের বাতাসে উৎসবের ছোঁয়া লাগে। প্রচুর শাকসসব্জি আর নলেনগুড় পাওয়া যায় এই ঋতুতে। নলেনগুড়ের পিঠেপুলি খুবই উপাদেয় আহার্য। আর পাওয়া যায় কমলালেবু। দার্জিলিং-এর কমলালেবু স্বাদে অতুলনীয়। এই সময়ে জিনিয়া ডালিয়া চন্দ্রমল্লিকায় যেমন বাগান আলো হইয়া থাকে তেমনি রং বেরং-এর পশমের পোষাকে আবালবৃদ্ধবনিতা পথঘাট দোকান বাজার রঙ্গীন করিয়া রাখে। আমার প্রিয় ঋতু শীতকাল।
– একটা ভাল পয়েন্ট বাদ দিলি রন্তু?
রন্তু বাবার দিকে তাকায়।
– শীতের দুপুরে ক্রিকেট ভুলে গেলি। শীতে ক্রিকেট তো একটা বড় ফ্যাক্টার।
– ক্রিকেট তো এখন সারা বছরই হয়।
– তা হোক। শীতের ইডেনে ক্রিকেট একটা আলাদা ব্যাপার। সে তোরা বুঝবি না। ইডেনে টেস্ট ম্যাচ হচ্ছে আর কমল ভট্টাচার্য অজয় বসুদের বাংলায় ধারা বিবরণী – চার্মই আলাদা। তোদের পরীক্ষক তো নিশ্চয়ই আমাদের প্রজন্মের মানুষ। দেখবি খুব খুশী হবে।
রন্তু শেষ বাক্যটি কেটে ঢুকিয়ে দিল, শীতের দুপুরে ক্রিকেটের আসর আমাদের তেরো পার্বণের অন্যতম। আমার প্রিয় ঋতু শীতকাল।
কিন্তু এখন তেমন শীত পড়ল না বলে চিন্তিত হয়ে পড়লেন বাসুদেববাবু। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। অন্যবার এ সময়ে জাঁকিয়ে শীত পড়ে। সব শীত কি সাইবেরিয়ায় জমছে! বাসুদেববাবুর চোখের সামনে সাইবেরিয়ার অদেখা পাহাড় নদী গাছ গাছালি বরফের পুরু আস্তরণে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। পুতুলের মতো দুই মানবশিশু সেই বরফ নিয়ে লোফালুফি করছে।হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা চামড়ার জুতো সমেত তাদের পা মাখনের মতো নরম বরফের কাদায় ডুবে যাচ্ছে। সূর্যের ভেজা রশ্মি কানমাথা ঢাকা পশমের টুপির উজ্জ্বল রঙ চুঁইয়ে নিভিয়া লাঞ্ছিত নিটোল মুখের চামড়ায়, ক্লোজ আপ দাঁতের অনিন্দিত শুভ্রতায় আলতো নেমে এসে ঘাসের উপর প্রভাতকালীন শিশিরকণার মতো ঝকঝক করছে। শীত নিয়ে বাসুদেববাবুর চিরদিনই বড় দুর্বলতা। ছোটবেলায় ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে হি হি কাঁপতে কাঁপতে খেজুরগাছের ডগায় বাঁধা রসের ভাঁড় নামানো। সেই রস জ্বাল দিয়ে নলেনগুড়। উঠোনের প্রকাণ্ড উনুনের পাশে সব ভাইবোনে হৈ হৈ। সেইসব দিন কোথায় রেখে এসেছেন বাসুদেববাবু! শুধু শীতের সুখস্মৃতি উত্তুরে হাওয়ার নাচন লেগে সাদা হালকা মেঘের মতো ভেসে আসে।
কিন্তু এবারে তেমন শীত পড়ল না। অফিস যাওয়ার পথে দুশো বারো ডাউন বর্ধমান লোকাল জুড়ে শীতের আলোচনা এবং দুশ্চিন্তা। পরমাণু বোমা, অমর্ত্য সেন, জ্যোতির্ময়ী শিকদার শেষ হয়ে এখন শুধু শীত আর শীত।
– হবে না! একটা বোমায় কত তাপ বেরোয় জানেন? পাঁচ পাঁচটা বোমা। ইকোলজি চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে।
– পাঁচটা কি বলছেন দাদা! এদিকে পাঁচ, ওদিকে ছয়-ইজুগল্টু এগারো।
– দূর মশায়! বোমা ফাটার সঙ্গে শীতের সম্পর্ক কী?
– আলবৎ আছে। সায়েন্স পড়লে এরকম আনপড় লোকের মতো বলতেন না।
এদিকে সায়েন্স ওদিকে অর্থনীতি।
– বাজার এখনো নামল না দেখেছেন! আপনার ইয়ের মতো একজোড়া ফুলকপির দাম বলল চৌদ্দ টাকা। শীত না পড়লে দেখবেন সব্জীর দাম কোথায় ঠেকে!
– কিসের মধ্যে কী। দাম তো চড়েছে অর্থনীতির কারণে। মে থেকে ব্লকেড। তার উপরে চাহিদা আর যোগানের মধ্যে –
পিছন থেকে আওয়াজ। দাদা কি অমর্ত্য সেনের খুড়তুতো ভাই? শেষ পর্যন্ত দুশো বারোয় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করছেন রামো রামো!
জানলার ধারে দুই ডেলি প্যাসেঞ্জার মহিলা মুখোমুখি বসে। মেমারির ওদিক থেকে আসেন। তাই দুশো বারোর মতো ভিড়ে ঠাসা গাড়িতেও ভাল জায়গা পেয়ে যান। একজনের কোলের উপর উলের বল নেচে যাচ্ছে আর একজনের মুখ চলেছে চড়বড় করে।
-পুজোর আগে এল টি সি তে সিমলা গেলাম তো। দুটো খুব সুন্দর কাজ করা শাল কিনেছি আর দুটো কার্ডিগান। একটাও পরতে পেলাম না দেখলি তো! এমন বিতিকিচ্ছিরি দেশ। মনে হচ্ছে এখনই অন্য কোথাও চলে যাই।
-সারা বছরই তো ঘামে ভিজতে ভিজতে যাতায়াত করতে হয়। দুই মাস একটু সুখ করব সেটুকুও ওপরওলার সহ্য হচ্ছে না।
-সামনে এক বয়স্ক ব্যক্তি। খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে মোটা লেন্সের ভেতর দিয়ে তাকালেন।
-ইউরোপের লোকেরা এত কর্মঠ হয় হয় কেন জানেন ম্যাডাম? ঠান্ডা। ঠান্ডা। ঠান্ডায় মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য কখনো পড়ে না। বড় বেশী পাপ করেছিলেন বলে এই দেশে জন্মেছেন।
অতঃপর ফুলকপি, নলেনগুড়, শীতের কার্ডিগান,ইডেনের ক্রিকেট,ডায়মন্ডহারবারে পিকনিক,সোয়েটারের ডিজাইন,বড়দিনের দীঘা, নিউইয়ার পার্টি, পার্কস্ট্রিট রেস্তোরা, কিঞ্চিৎ তরল এবং ইত্যাদি ইত্যাদি জাগলারের হাতের বলের মতো চকিতে ঘুরে বেড়াল নিজেদের মধ্যে কাটাকুটি করে। দুশো বারোর ভিড়ে ডিসেম্বরের অবাঞ্ছিত উষ্ণতায় যখন একটু একটু ঘামতে শুরু করেছেন তখন বেয়াক্কেলের মতো গান এল বাসুদেববাবুর মনে – শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন লাগল নাচন আমলকির ওই ডালে ডালে। গানের রেশ যৎসামান্য থাকতে থাকতেই ভাবতে বসে গেলেন রন্তুর প্যারাগ্রাফে আরও দু একটা ইমপর্টেন্ট পয়েন্টস ঢোকানো যায় কিনা। এবং ভাবতে ভাবতেই দুশো বারো কারশেডে না থেমে ঝমঝম করে সটান হাওড়া স্টেশনের সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দাড়িয়ে গেল।
লঞ্চঘাটের দিকে ভির দেখে দাঁড়ালেন বাসুদেববাবু। ভির ঠেলে গলা বড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলেন।
কী হয়েছে দাদা?
একজন তদন্ত সেরে বেড়িয়ে আসছিল। একরাশ বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিল, আরে দূর দূর। কিসসু না। একটা পাগল মরেচে। পাগল যেন কোনোকালে দেখেনি এরা।
আরেকজন কনুই দিয়ে গুঁতোতে গুঁতোতে তদন্তে ঢুকছিল। গবেষকের মতো জানান দিল, কতরকমের পাগল ছাগলই যে কোলকাতা শহরে রয়েছে!
আর একটু ভিড় ঠেলে এগোতেই বাসুদেববাবুর নজরে এল এক বৃদ্ধ মরে পড়ে আছে। একমাথা উস্কো চুল – অপরিচ্ছন্ন দাড়ি। ছেঁড়া খোঁড়া শতচ্ছিন্ন পোষাক। গভীর রাতে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে অনেক খড়কুটো জোগাড় করেছিল পরিশ্রম করে। তিনটে দেশলাই কাঠি পড়ে আছে। পাশে দেশলাই বাস্ক। একটাও জ্বালাতে পারেনি।
বাসুদেববাবু অফিসে তাড়া আছে। বড়বাবুর সঙ্গে এমনিতেই খটামটি চলছে। তবু চলার গতি শ্লথ হয়ে গেল। পাগলটার কথা বারবার মনে পড়ছে কেন বুঝতে পারলেন না। কাঠিগুলো একটাও জ্বালাতে পারেনি কেন বোঝার চেষ্টা করলেন। হয়তো বারুদ ঠিকমতো শুকিয়ে রাখতে পারেনি পাগলটা। বারুদ শুকোনোর ব্যাপারটা খুব জরুরী বলে মনে হল বাসুদেববাবুর। শর্টকার্টে কার্জন পার্কের ভেতর দিয়ে যেতে গিয়ে দেখলেন, আট দশ বছরের দুই শিশু ঘাসের উপর শুয়ে আছে। সূর্যালোকে ঝলমল করছে গোটা পার্ক।
– রাতে খুব শীত করে রে দিদি। ফুট থেকে ঠাণ্ডা উঠে কাঁপুনি দেয়।
– এখন ভালো করে রোদ্দুর মেখে রাখ। আমার মতো জামা খুলে শরীর দিয়ে চোঁ চোঁ করে রোদ্দুর টেনে নে। দেখবি রাতে কম শীত লাগবে।
দিদির দেখাদেখি ভাইও জামা খুলে ফেলল। এমনকি প্যান্টও। বাসুদেববাবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন দুই শিশুর চোখ, নাক, গাল, বুক, উরু দিয়ে সুর্যালোক চোঁ চোঁ করে ঢুকে যাচ্ছে শরীরের ভিতর। তারপর রক্তবাহী শিরার মধ্যে দিয়ে চারিয়ে যাচ্ছে প্রতিটা কোষের নিকষ গভীরে। ইতিমধ্যে চট করে ভেবে নিলেন আজ রাতের গভীরে যখন রন্তুর সুন্দর বাংলায় লেখা প্যারাগ্রাফ দেওয়াল আলমারির উষ্ণতায় কেতরে থাকবে তখন চারিদিকে খোলা কোলকাতার হাঁটাপথে কত কী সব আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে যাবে। মার বুকের আশ্রয়ও নিচের থেকে উঠে আসা হিমের মতো শীতল দেখে শিশুরা অবাক হয়ে সব কান্না ভুলে যাবে। পাগল ছাগল মানুষ প্রাণপণে বারুদে অগ্নিসংযোগ করার ব্যর্থ চেষ্টার পর একবুক অভিমান নিয়ে শান্ত হবে সব ক্লান্তি সঁপে দিয়ে। কার্জন পার্কের আশেপাশে কোথাও এক দিদি ছোট ভাইকে জড়িয়ে সূর্যালোকের প্রত্যয় নিয়ে পার হয়ে যাবে কালো নিথর রাত্রি। হঠাৎ কেমন শীত শীত করতে লাগল বাসুদেববাবুর। ভাবলেন সকালের প্যারাগ্রাফটা রন্তুকে আবার নতুন করে লিখতে বলবেন।
অফিস যেতেই বড়বাবু নিজে কিছু না বলে মুচকি হাসলেন, যান এ ও সাহেব তলব করেছেন। পায়ের ধুলো দিয়ে আসুন। ভয়ে ভয়ে সাহেবের চেম্বারে ঢুকতেই ভালখবর পেলেন। লিভ ট্রাভেল কনসেশন অ্যাপ্রুভড হয়ে গেছে – ছুটি এবং টাকা। সাহেবের ঘর থেকে বেড়িয়ে আসতে আসতে বাসুদেববাবুর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রন্তুর মা কী খুশিই হবে! সারাদিন নিজের চেয়ারে বসে আঁকিবুঁকি কাটলেন,অবান্তর কিছু যোগ বিয়োগ করলেন আর বুকের ভিতর ঝমাঝম শব্দ শুনলেন দীর্ঘক্ষণ ধরে।
আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরুলেন অফিস থেকে। বাইরে বেরিয়েই টের পেলেন বেশ শীত পড়েছে। এক ছোকরা হকার সান্ধ্য কাগজ নিয়ে চিৎকার করতে করতে চলেছে – অবশেষে শীত এল কলকাতায়। বাসুদেববাবুর মন এখন ভীষণ ভাল। স্ট্যান্ড রোডের ফুটপাতে বসা সব্জিওলার কাছ থেকে বাইশ টাকায় একজোড়া ফুলকপি কিনে হাতে দোলাতে দোলাতে হাওড়ার দিকে হাঁটা দিলেন। সকালে লঞ্চঘাটের যেখানে ভিড় দেখেছিলেন সেখানে এখনও খুব ভিড়। এক হকার সেখানে উলের রঙীন টুপি নিয়ে বসে পড়েছে। বিশ বিশ রূপয়া। বিশ বিশ রূপয়া। বাসুদেববাবু ঠেলে ভিতরে ঢুকবার চেষ্টা করলেন।
Tags: বিষ্ণু বিশ্বাস, যে বছর শীত কম পড়ায় আমরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।